Published : 03 Oct 2019, 06:30 PM
একটা গল্প দিয়ে শুরু করি। ১৯৩০ এর দশকে সুইডেনে সমাজবাদী কল্যাণরাষ্ট্রের যাত্রা শুরু হলে সমাজ ও রাষ্ট্রের প্রায় সকল স্তরে মানবকল্যাণের স্বার্থে নানা সংস্কার সাধিত হয়। যার ফলে অন্যান্য সৃজনশীল কর্মকাণ্ডের পাশাপাশি লেখালেখিতেও একদল শ্রমজীবী এবং স্বশিক্ষিত লেখক লেখিকার আবির্ভাব হয়। উল্লেখযোগ্য স্বশিক্ষিত লেখকদের মধ্যে সুইডিশ একডেমির সদস্য এবং নোবেলজয়ী কবি হ্যারি মার্টিনসন যেমন ছিলেন তেমনি এই সময়ের পাঠক নন্দিত কবি লেখিকা এলসি ইউহানসনও অন্যতম। ইউহানসনের জন্ম স্টকহোমের উত্তরের প্রদেশ উপল্যান্ডে ১৯৩১ সালে। তিনি কর্মজীবনে ছিলেন এক ধরনের শ্রমিক। বেশিরভাগ সময় কাজ করেছেন ডাক বিভাগে। তিনি তাঁর প্রথম কাব্যগ্রন্থ প্রকাশ করেছেন ৪৭ বছর বয়সে। তাঁর প্রথম উপন্যাস প্রকাশ করেছেন ৫৪ বছর বয়সে।
তিনিপ্রথম বই প্রকাশ করতেএত দীর্ঘ সময় নিলেন কেন? তিনি কি দেরিতেই লেখালেখিশুরু করেছিলেন?
তাঁর জবাব ছিল এরকম: আমি দেরিতে প্রথম বই প্রকাশ করেছি তারমানে এই নয় আমি দেরিতে লেখালেখি শুরু করেছি। আমার শৈশবে আমাদের বাড়িতে কোন বই ছিল না। আমি বই পড়ার সুযোগ পাইনি। আমাদের বাড়িতে কোন চিত্রকর্মও ছিল না। আমি প্রাচুর্যের মুখ দেখিনি। আমার মনকে প্রকাশ করার জন্যে লেখালেখিই ছিল সহজ এবং একমাত্র সম্ভাব্য উপায় যদিও তারও কোন সুযোগ ছিল না। আর্থিক টানাপোড়েন, বিয়ের পরে সাংসারিক চাপ ও লেখালেখির প্রতি অস্বীকৃতিমূলক মনোভাব আমার বই প্রকাশে বড় বাধা ছিল। সন্তানের পোষণ ও যত্মআত্মি, সংসারের দৈনন্দিন কাজ, পাশাপাশি ডাক বিভাগের মুজুরিগিরির কারণে আমি লিখতে বসতে পারিনি বা লিখে উঠতে পারিনি। যখন আমার সন্তান বড় হয়ে উঠল– আমি ফুরসত পেলাম, লেখালেখিতে বসতে পারলাম। বই প্রকাশ পেল। কিন্তু প্রকৃত সত্য হলো কৈশর থেকে শুরু করে সাতচল্লিশ বছর বয়স পর্যন্ত প্রতিদিন আমার মাথায় লেখালেখি চলত। সেইঅর্থে আমি সারাজীবন ধরে প্রতিদিন প্রতিক্ষণ লিখেছি।
আজএলসি ইউহানসনের বয়স ৮৮। তিনি এই বয়সে লিখেচলেছেন। তাঁর বই প্রকাশিত হয়সুইডেনের শীর্ষস্থানীয় প্রকাশনা সংস্থা থেকে।
ব্যক্তিগতভাবে আমার শুভাকাঙ্খী, আন্তরিক বন্ধু এলসি আজও চলনে বলনে কাজে কর্মে উদ্দীপনায় ভরপুর। তিনি যোগ দিয়েছিলেন সুইডেনের উপসালা শহরের কেন্দ্রীয় গ্রন্থাগারে উপসালা সাহিত্যকেন্দ্র আয়োজিত বাংলাদেশ আর সুইডেনের নারীদের লেখালেখি শীর্ষক সাহিত্যসন্ধায়। একই বিষয়বস্তুর উপর বাংলাদেশের উপর আলোকপাত করে অনুষ্ঠান সাজানো হয়েছে গোথেনবার্গ বইমেলায়, স্টকহোমে সুইডিশ লেখকদের সঙ্গে আর ভিকস সৃজনশীল প্রতিষ্ঠানে (ভিকস ফলকহগস্কোলা)। এসব অনুষ্ঠানে আমি ছাড়াও মতবিনিময়ে যোগ দিয়েছেন দৈনিক জনকণ্ঠের সাহিত্য সম্পাদক কবি মিলু শামস এবং স্ট্যামফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক ও কবি সাকিরা পারভিন।
সবকটি অনুষ্ঠানেই ঘুরেফিরে নিন্মোক্ত প্রশ্নগুলো এসেছে
১. মেয়েদের লেখালেখির পথে অন্তরায়গুলো কী কী?
২. মেয়েদের কী আলাদা প্রতিযোগিতা বা প্রতিদ্বন্দ্বিতার মুখোমুখি হতে হয়?
৩. মেয়েদের লেখালেখির ভবিষ্যত কী?
৪. মেয়েদের বই প্রকাশের পথে দৃশ্যত আর অদৃশ্যত বাঁধাগুলো কী কী ?
৫. মেয়েরা কেন লেখেন?
৬. মেয়েদের লেখালেখির বিষয় কী?
৭. মেয়ে লেখকদের বিষয়বস্তুর সঙ্গে ছেলে লেখকদের বিষয়বস্তুর কোনো পার্থক্য আছে কি?
৮. ১৯৭১ সালে বাংলাদেশের স্বাধীনতার পরে মেয়েদের লেখালেখির জগৎ অগ্রসরমান না কি পশ্চাৎপদ?
কার্যত একজন প্রতিশ্রুতিশীল নারী লেখককে নারী হিসেবে আলাদা কোনো বাধার মুখোমুখি হতে হয় বলে আমি মনে করি না। তবে বাধা বলতে সামগ্রিক অর্থে সামাজিক দৃষ্টিভঙ্গি আর পুরুষতন্ত্রের খোলনলচে। সমাজের এই খোলনলচে বদলে ফেলা গেলে এক ঢিলে অনেক পাখি মারা পড়বে। লেখালেখির ক্ষেত্রে নারী বা পুরুষ এই বিভাজনকে বিবেচনায় নেবার দরকার আছে কি? তাতে নারীদের বিশেষ সুবিধা হয় বলেও আমার মনে হয় না। এতে করে তাদের প্রান্তিক অবস্থানেই ঠেলে দেয়া হয়। বছর কয়েক পূর্বে মাধ্যমিক আর উচ্চমাধ্যমিকে মেধাতালিকা নির্ধারণের ব্যাপার ছিল। ঐ সময় প্রায় বছরই দেখা যেত মেয়েরা সম্মিলিত মেধাতালিকায় ছেলেদের চেয়ে এগিয়ে।
তাই মেয়ে বা ছেলে যিনিই লেখালেখিতে আসবেন তিনি নিজের সঙ্গে প্রতিনিয়ত প্রতিদ্বন্দীতা করে টিকে থাকবেন। একজন লেখকের জন্যে পুরো জীবনটাই একটা পাঠশালা। সেখানে জেলখানাও একটা সুযোগ। হাসপাতালও একটা বিশ্ববিদ্যালয়। লেখালেখি করতে এসে সংক্ষিপ্ত পথ খোঁজার অর্থই হচ্ছে ধান্দাবাজি। এই সংক্ষিপ্ত পথে যিনি হাঁটবেন তিনি আখেরে হারিয়েই যাবেন। কেউ তাকে রক্ষা করতে পারবে না। এখানে উত্তরাধিকার বা অনুকম্পা নিয়ে উৎসব, মেলা, সেমিনারে আমন্ত্রণ, গণমাধ্যমে ছবি ও নাম ছাপানো এমনকি কর্পোরেট আর প্রতিষ্ঠানিক ক্ষমতার জোরে পারিবারিক মালিকানায় বা পৃষ্টপোষকতায় জাতীয় আন্তর্জাতিক সাহিত্য উৎসবের নিয়ন্ত্রক হওয়া যায়। কিন্তু আখেরে লেখালেখিতে টিকে থাকা যায় না।
লেখকের আখেরি আশ্রয় হচ্ছে পাঠকের মন। সেটা লেখকের জীবদ্দশাতেও হতে পারে, মৃত্যুর পরেও হতে পারে। এক্ষেত্রেও মেয়ে বা ছেলে বলে কিছু নাই। একজন জাত লেখক বা লেখিকা যখন লেখেন তিনি ছেলে বা মেয়ে হিসাবে লেখেন না। যদিও তার যাপিত জীবনের অভিজ্ঞতার ছাপ থাকতে পারে। কিন্তু সেটা লেখকের 'দেখানো' (to show) অর্থে নয়। বরং 'দেখা' (to see) অর্থে। তেমনিভাবে একজন পাঠক যখন পড়বেন সেটা কে লিখেছেন 'নারী' না 'পুরুষ' কালো না সাদা লেখক ধনী না গরীব লেখক হিন্দু না মুসলিম সেটা মাথায় কাজ করবে না। লেখালেখি যেমন ধর্মীয় বাণী নয় তেমনি রাজনৈতিক ইশতেহারও নয়।
লেখালেখি হচ্ছে সত্যকে প্রকাশ। এই সত্যের প্রকাশ হচ্ছে জীবন ও সুন্দরের পক্ষে, ক্ষমতা ও অসুন্দরের বিপরীতে। দুর্বলের বিপরীতে অবস্থান নেয়া, অসুন্দরের পক্ষে জয়ধ্বনি করা, জীবনের মুর্দাবাদ ধ্বনি আর ক্ষমতার জিন্দাবাদে সাময়িক ব্যক্তিগত স্বার্থ হাসিল হলেও আখেরি আশ্রয়ে ঐ লেখককে খুঁজে পাওয়া যাবে না। কথাটা ছেলে বা মেয়ে লেখক সকলের জন্যেই সমানভাবে প্রযোজ্য।
গণমাধ্যম কখনো কখনো অন্ধের ভূমিকা পালন করে। এজন্য অনেক বড় মাপের লেখক কখনও নিগ্রহের স্বীকার হতে পারে। এক্ষেত্রে চট্টগ্রামের বীরাঙ্গনা লেখিকা রমা চৌধুরী যেমন ছিলেন এমনকি আহমদ ছফাও ছিলেন। ক্ষেত্র বিশেষে নারী লেখকরাও যথেষ্ট অগ্রাধিকার ভোগ করে থাকেন। উদাহরণ দিয়ে বিষয়টা খোলাসা করে দেই। হাল আমলে সেলিনা হোসেন, নাসরীন জাহান আর শাহীন আখতার যে অগ্রাধিকার ভোগ করেন জীবনানন্দ দাশ তার এককানিও ভোগ করেননি।
কোনো কোনো উঠতি লেখক প্রতিষ্ঠিত কোনো সম্পাদক বা লেখক কিংবা অধ্যাপক অথবা প্রতিষ্ঠানকে সিঁড়ি হিসেবে ব্যবহার করেন। এক্ষেত্রে ছেলেরা যেমন আছেন, মেয়েরাও পিছিয়ে নাই। একটু পরিস্কার করে বলি। তসলিমা নাসরিন তার লেখালেখির উঠতি সময়ে কমপক্ষে তিনজন জাঁদরেল সম্পাদক বা লেখকের সঙ্গে সম্পর্কে আবদ্ধ হয়েছেন, তাদেরকে সিঁড়ি হিসেবে ব্যবহার করেছেন। এসব তো গোপন কিছু না। তিনিও নারী, নারীবাদী। কথা আর না বাড়াই। মেয়েদের লেখালেখির অন্তরায় বলতে সামাজিক দৃষ্টিভঙ্গি বা পারিবারিক অসমর্থন বড় একটা বিষয়। তাছাড়া আলাদা কোন অন্তরায় বর্তমান প্রেক্ষাপটে আছে বলে আমি মনে করি না।
একবিংশ শতকের বাংলাদেশ হবে মেয়েদের বাংলাদেশ। যে মেয়ে প্রতিশ্রুতি নিয়ে যোগ্যতা নিয়ে প্রস্তুতি নিয়ে যাত্রা শুরু করবেন শুধু লেখালেখি নয় জীবনের যে কোনো ক্ষেত্রে ভাল করবেনই। বাধা আসলেও বাধা ডিঙাবেই। এই শতকে মেয়েরা বালিশের ওয়ারের দৈর্ঘ্য প্রস্থ নিয়েই বসে থাকবে না । তারা বাংলাদেশের ভূখণ্ড থেকে মহাকাশ বা চাঁদের দূরত্বও মাপবে। তাই লেখালেখিতে কোন বাধা থাকলেও সেটা তোয়াক্কা করার দরকার নাই।
মেয়েদের লেখালেখির ভবিষৎ নিঃসন্দেহে উজ্জ্বল। সাহিত্য অঙ্গনে আমাদের নতুন নীতি, সংস্কার আর প্রাতিষ্ঠানিক অবকাঠামো বাড়ানোর নিমিত্তে মেয়েদের অবস্থান সংহত হবে। আমরা আশা করব দৈনিকের সাহিত্য পাতার দায়িত্বে যেমন মেয়েরাও থাকবেন তেমনি বাংলা একাডেমি, শিল্পকলা একাডেমি, জাতীয় গ্রন্থকেন্দ্রের শীর্ষ নির্বাহী পদে তরুণ উদ্যমী মহিলা আমলা, শিক্ষাবিদ বা লেখিকারা দায়িত্ব নেয়ার সুযোগ পাবেন।
বই প্রকাশের পথে ছেলেদের আর মেয়েদের বাধা আলাদা করার কিছু নাই। এখানে উভয়কেই সমান বাধা ডিঙাতে হয়। নগরে ঝড় উঠলে সেখানে দেবালয় বা মসজিদকে আলাদা করার সুযোগ নাই।
মেয়েরা কেন লেখেন? একজন ছেলে যে তাড়নায় লেখেন একজন মেয়েও মনের সেই তাড়না থেকেই লিখবেন।
মেয়ে লেখক আর ছেলে লেখকদের বিষয়বস্তুর তারতম্য ক্ষেত্রবিশেষে থাকতে পারে। কেননা প্রকৃতিগতভাবে দুইজন বিপরীত লিঙ্গের হবার কারণে যাপিত জীবনের অভিজ্ঞতা ভিন্ন হতে পারে ক্ষেত্র বিশেষে। এক্ষেত্রে সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের একটা স্বীকারোক্তি স্মরণ করতে চাই। তাঁর জীবনের আফসোস ছিল তিনি একটা মেয়ের বাবা হতে পারেননি কেননা ছেলে হিসেবে তিনি জানেন একটা ছেলের বেড়ে ওঠার অভিজ্ঞতা। তাই মেয়ের বাবা হলে তিনি তার মেয়ের বেড়ে ওঠা প্রত্যক্ষ করতে পারতেন। এই সত্যটা অন্যদের ক্ষেত্রেও প্রযোজ্য।
গোথেনবার্গ বইমেলায় দর্শকদের মাঝ থেকে বেশকটি প্রশ্নের একটি ছিল– ঔপনিবেশিক ব্রিটিশ আমল, পাকিস্তানি আমল পেরিয়ে বাংলাদেশে মেয়েদের লেখালেখি কী অগ্রগতির দিকে নাকি পশ্চাৎপদতার দিকে?
জবাবটা এরকম : ১৯৭২ সালে ছোট কলেবরে ঢাকায় একটা বইমেলা হয়েছিল, সেখানে সাকুল্যে নতুন বই ছিল ৩২টি। আর ২০১৮, ২০১৯ সালে একুশে গ্রন্থমেলায় প্রকাশিত বইয়ের সংখ্যা পাঁচ হাজারের মতো। তার মধ্যে শতকরা পঁচিশ ভাগ বই মেয়েদের লেখা। তাতে প্রমাণ হয় মেয়েদের লেখালেখিও যথেষ্ট এগিয়েছে। আরও এগোবে।
বাংলাদেশে বসে যারা আরবিতে, উর্দুতে বা ইংরেজিতে লেখালেখি করেন আমার আলোচনায় তাদের হিসেবের মধ্যে রাখিনি। বহুভাষাভাষী লেখালেখির প্রসঙ্গে তাদের কথা ভাবা যাবে। রবীন্দ্রনাথের লেখালেখির শতকরা চল্লিশ ভাগ ছিল ইংরেজিতে। তিনি নিজেকে ইংরেজ সাহেব ভাবেননি। এখনকার বাংলাদেশে ইংরেজির ছেলে লেখক বা মেয়ে লেখকরা সময় থাকতে বাংলাটা শিখে নিতে পারেন।
বাংলাদেশে অন্যান্য সূচকের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে একবিংশ শতকের বাংলাদেশে লেখালেখিতেও মেয়েরা অগ্রভাগে আসুক। যেমনটা নারী প্রধানমন্ত্রী, নারী স্পিকার, নারী বিরোধীদলের নেতা; তেমনটাই লেখালেখির জগতে দেশের জমিন ডিঙিয়ে বিদেশের মাটিতেও আমাদের মেয়েরা বাজিমাত করুক।