Published : 11 Sep 2019, 08:10 PM
২০১৬ সালের ঘটনা। আমরা কয়েকজন একটি অফিসিয়াল কাজে সড়ক পথে বরিশাল যাচ্ছিলাম। আমাদের সঙ্গে ছিল অফিসের গাড়ি। আমাদের গাড়িসহ মাওয়া ফেরিঘাটে গিয়ে ফেরিতে উঠে অপেক্ষা করতে থাকি। যানবাহনে ভরে গেলেও ফেরি ছাড়ার নাম নেই। আমরা এক পর্যায়ে ফেরির এক কর্মচারীর সঙ্গে কথা বলে জানতে পারি, একজন ভিআইপির জন্য ফেরি অপেক্ষা করছে। প্রায় অর্ধশত গাড়ি এবং এসব গাড়ির অসংখ্য যাত্রীদের প্রায় পৌণে দুঘণ্টা দাঁড় করিয়ে রাখার পর অবশেষে সেই কাঙ্ক্ষিত ভিআইপি একটা দামি কারে চেপে ফেরিতে উঠলেন। আমরা উন্মুখ হয়ে সেই ভিআইপিকে এক নজর দেখতে গেলাম। দেখলাম সেই ভিআইপিকে, তিনি হলেন ছাত্রলীগের তৎকালীন কেন্দ্রীয় সভাপতি সাইফুর রহমান সোহাগ!
ছোটকালে দেখেছি সামরিক শাসক জিয়া এবং এরশাদ হেলিকপ্টারে চেপে বিভিন্ন জেলা ও থানা সদর সফরে যেতেন। হেলিকপ্টার অবতরণ করা মাত্র প্রচণ্ড হুড়োহুড়ি শুরু হয়ে যেত। হেলিকপ্টার এবং এর আরোহীদের দেখতে মানুষের মধ্যে সে কি উন্মাদনা! কার আগে কে যাবে তার জন্য রীতিমতো যুদ্ধ। এই ভিড় ঠেকানোর জন্য পুলিশ-মিলিটারিদের গলদঘর্ম হতে হতো। এখন প্রায় একই ধরনের দৃশ্য দেখা যায় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের মধুর ক্যান্টিনে। ছাত্রলীগের সভাপতি কিংবা সাধারণ সম্পাদক যখন কোনো দামি গাড়িতে করে মধুর ক্যান্টিনে আসেন, তখন শত শত কর্মী পঙ্গপালের মতো চারদিক থেকে এসে নেতাকে ঘিরে ফেলার চেষ্টা করেন। মনে হয়, যেন কোনো বিখ্যাত সেলিব্রিটির আগমন ঘটেছে। নেতাকে ঘিরে চারদিকে হুড়োহুড়ি শুরু হয়ে যায়। নেতার সঙ্গে একটু হাত মেলানোর জন্য, নেতার দৃষ্টিসীমায় আসার জন্য ছাত্রলীগ কর্মীদের মধ্যে এই উত্তেজনা গোটা বিশ্বেই বিরল। দুনিয়ায় কোনো সেলিব্রিটির জন্যও এমন ঘটনা ঘটে বলে মনে হয় না।
ছাত্রলীগের নেতারা কীভাবে এমন ভিআইপি হয়ে উঠল? কী তাদের মহত্ব? তারা কী এমন কাজ করেন বা কী এমন মধুর বাণী শোনান যে তাদের নিয়ে এমন কর্মীরা এমন মাতোয়ারা হন? না, আমার দেখা মতে, ছাত্রলীগ গত তিন দশকে কখনই তেমন কোনো মহৎ কর্ম করেনি। ছাত্রলীগের নেতারাও এমন কোনো মহান ব্যক্তি হয়ে উঠেননি। তবে তারা যা করতে পেরেছেন, তা হলো, নিজেদের ভিআইপির আসনে প্রতিষ্ঠিত করেছেন। তাদের কথায় যদি প্রশাসন না চলে, তদ্বির যদি না মানা হয়, দাবি অনুযায়ী যদি চাঁদা না দেওয়া হয়, ফেরি যদি অপেক্ষা না করে, কর্মীরা যদি তাদের 'গার্ড অব অনার' না দেয়, তাহলে সংশ্লিষ্টদের 'কপাল পোড়ানোর' যোগ্যতা তারা অর্জন করেছেন।
কিন্তু এই নব্য 'ভিআইপি'দের নিয়ে ক্ষমতাসীনরাও স্বস্তিতে নেই। সম্প্রতি ছাত্রলীগের সভাপতি-সাধারণ সম্পাদকের বিভিন্ন বিতর্কিত কর্মকাণ্ডের কারণে এই কমিটি ভেঙে দিতে প্রধানমন্ত্রী নির্দেশ দিয়েছেন বলে বিভিন্ন সংবাদমাধ্যমে খবর আসে । গত কয়েকদিনে মিডিয়াতে ছাত্রলীগের কমিটি ভাঙা-বিষয়ক বিভিন্ন খবরে অনেকের মধ্যে কৌতূহল তৈরি হয়েছে। দলপ্রধান খোঁজ-খবর নিয়ে, গোয়েন্দা প্রতিবেদনের ভিত্তিতে নিজ হাতে যাদের সভাপতি-সাধারণ সম্পাদক বানিয়েছেন, মাত্র এক বছরেই তাদের কর্মকাণ্ড তিতা হয়ে গেল কেন? কেন কমিটি ভেঙ্গে দেওয়ার দাবি উঠছে?
মজার ব্যাপার হলো, ছাত্রলীগের কমিটি ছাত্রলীগের নেতাকর্মীরা করে না বা করতে পারে না। এটা করেন খোদ আওয়ামী লীগের সভাপতি। ২০১৮ সালের ১২ ও ১৩ মে সম্মেলনে কমিটি করতে ব্যর্থ হয় ছাত্রলীগ। পরে একইবছরের ৩১ জুলাই সম্মেলনের দুই মাস পর কেন্দ্রীয় ছাত্রলীগ ও ঢাকা বিশ্বদ্যালয়ের সভাপতি-সাধারণ সম্পাদকের নাম আওয়ামী লীগ সভাপতি চূড়ান্ত করার পর তার ঘোষণা দেন দলটির সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের। চলতি বছরের ১৩ মে সম্মেলনের এক বছরের মাথায় ৩০১ সদস্যের পূর্ণাঙ্গ কমিটি ঘোষণা করা হয়। এর পর থেকেই শুরু হয় অভ্যন্তরীণ কোন্দল ও বিরোধ।
কমিটি ঘোষণার দিন সন্ধ্যায় কমিটিতে পদবঞ্চিতরা মধুর ক্যান্টিনে সংবাদ সম্মেলন করতে গেলে ছাত্রলীগের সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদকের অনুসারীরা তাঁদের ওপর হামলা চালান। এতে কয়েকজন নারী নেত্রীসহ ১০ থেকে ১২ জন আহত হন। পরদিন ছাত্রলীগের সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদককে গণভবনে ডেকে ছাত্রলীগের কমিটি থেকে বিতর্কিত নেতাদের বাদ দেওয়ার নির্দেশ দেন আওয়ামী লীগের সভাপতি ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। সেদিন সংবাদ সম্মেলন করে অভিযুক্ত ব্যক্তিদের বহিষ্কার করা হবে বলে জানান এবং ১৬ জনের নাম প্রকাশ করেন। অন্যদিকে পদবঞ্চিতরা 'বিতর্কিত' ও 'অযোগ্য' ১০৭ জনের একটি তালিকা প্রকাশ করেন।
তাদের অভিযোগ অনুযায়ী, কমিটিতে যে ১০৭ জন 'বিতর্কিত' স্থান পেয়েছেন, তাঁদের মধ্যে ২৫ জন বিবাহিত (ছাত্রলীগের গঠনতন্ত্রে বিবাহিতদের নেতা হওয়ার সুযোগ নেই), ১৯ জনের পরিবার সরাসরি বিএনপি কিংবা জামায়াতের রাজনীতির সঙ্গে যুক্ত, ১১ জন মাদকাসক্ত ও মাদক ব্যবসার সঙ্গে জড়িত, ৮ জন বিভিন্ন মামলার আসামি, ৬ জন ব্যবসায়ী, ৩ জন বিভিন্ন অভিযোগে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান থেকে বহিষ্কৃত, ২ জন ছাত্রলীগ থেকে আগে বহিষ্কৃত, ৬ জন ছাত্রদল ও ছাত্রশিবিরের সাবেক নেতা, ৬ জন চাকরিজীবী বা সরকারি চাকরির জন্য সুপারিশপ্রাপ্ত। এ ছাড়া ১৪ জন রয়েছেন, যাঁরা প্রথমবারের মতো সংগঠনে পদ পেয়েছেন। ৭ জন দীর্ঘদিন ধরে রাজনীতিতে নিষ্ক্রিয় থাকার পরও পদবি পেয়েছেন।
কমিটি নিয়ে দ্বন্দ্বের কোনো সুরাহা হয়নি। বরং দলাদলি বেড়েছে। আর এর দায়ভার চাপছে সভাপতি-সাধারণ সম্পাদকের উপর। তাদের বিরুদ্ধে অনেক অভিযোগ। বিশেষ করে পূর্ণাঙ্গ কমিটিতে টাকার বিনিময়ে বিতর্কিত ও নিজস্ব লোকদের অন্তর্ভুক্তি, দুপুরের আগে ঘুম থেকে না ওঠা, মধুর ক্যান্টিনে অনুপস্থিত থাকা, জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের সম্মেলনে গিয়ে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামালের সকাল ১১টা থেকে বিকাল তিনটা পর্যন্ত অপেক্ষা করা, শিক্ষামন্ত্রী ডা. দীপু মনিকেও ছাত্রলীগের এক অনুষ্ঠানে গিয়ে সভাপতি-সাধারণ সম্পাদকের জন্য অপেক্ষা করা, জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয় ও ইডেন কলেজের সম্মেলনের দুই মাস পেরিয়ে যাওয়ার পরও কমিটি করতে না পারা, কুষ্টিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের কমিটি করার বিষয়ে অনৈতিক অর্থনৈতিক লেনদেন, অনৈতিক সম্পর্কের জড়িয়ে পড়াসহ এন্তার অভিযোগ।
বছর দুই আগে ডেইলি স্টার পত্রিকায় বাংলাদেশ ছাত্রলীগকে নিয়ে একটি প্রতিবেদন প্রকাশ করা হয়। প্রতিবেদনটা শুরু করা হয় এভাবে: বাংলাদেশ ছাত্রলীগ লিখে গুগলে খোঁজ করলে আওয়ামী লীগ সমর্থক ছাত্র সংগঠনটির কর্মকাণ্ডের ভয়াবহ চিত্র পাওয়া যায়। বিভিন্ন ওয়েবসাইট ও নিউজ পোর্টালে ছাত্রলীগ নিয়ে যেসব ছবি প্রকাশিত হয় সেগুলোকেই গুগল একত্র করে দেখায়।
গণমাধ্যমে প্রকাশিত খবরের হিসাব থেকে দেখা যাচ্ছে, গত আট বছরে ছাত্রলীগের বিভিন্ন সংঘর্ষের ঘটনায় ১২৫ জনের বেশি নিহত হয়েছেন। গত আট বছরে ছাত্রলীগ সংশ্লিষ্ট মারামারিতে যারা নিহত হয়েছেন তাদের মধ্যে ৭১ জনই সংগঠনটির নিজেদের কর্মী। এদের মধ্যে আবার ৬০ জন নিহত হয়েছেন নিজেদের বিভিন্ন উপদলের কোন্দলে। প্রতিদ্বন্দ্বী সংগঠনের সঙ্গে সংঘর্ষে মারা গেছেন ছাত্রলীগের ১১ নেতাকর্মী। নিহত বাকি ৫৪ জন শিশু, সাধারণ মানুষ ও অন্য ছাত্র সংগঠনের নেতাকর্মী।
২০০৯ সালে আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় আসার পর পরই বেপরোয়া হয়ে ওঠে ছাত্রলীগ। নিজেদের কর্মকাণ্ডের কারণে সমালোচনার কেন্দ্রবিন্দুতে পরিণত হয় একসময়ের ঐতিহ্যবাহী ছাত্র সংগঠনটি। সে বছর এপ্রিল মাসে বিরক্ত হয়ে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ছাত্রলীগের সাংগঠনিক প্রধানের পদ থেকে সরে যান।
কিন্তু তাতেও বেআইনি কর্মকাণ্ড থেকে সংগঠনটির নেতাকর্মীরা নিবৃত্ত না হওয়ায় পরের বছর প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয় থেকে টেন্ডারবাজি ও অন্য যেকোনো অপকর্মের সঙ্গে যুক্ত ছাত্র সংগঠনটির বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়কে নির্দেশ পাঠানো হয়। ছাত্র সংগঠনটি ক্ষমতাসীন দলের সঙ্গে যুক্ত হলেও কোনোরকম ছাড় না দিতেও বলা হয় সেই নির্দেশে।
সংঘর্ষের অনেকগুলো ঘটনা বিশ্লেষণ করে দেখা যায়, অর্থ উপার্জন এবং শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ও এলাকায় আধিপত্য বিস্তার প্রায় সবগুলো সংঘর্ষেরই মূল কারণ। সংগঠনটির নেতাকর্মীদের বিভিন্ন অপকর্মে যুক্ত হওয়া থেকে দূরে রাখতে আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের তাদেরকে প্রয়োজনে চাকরি এমনকি টাকা দেওয়ারও প্রস্তাব করেছিলেন। কিন্তু তাতেও কাজ হয়নি (ডেইলি স্টার, জুলাই ১৯, ২০১৭)।
না, ছাত্ররাজনীতির নামে দুর্বৃত্তপনার এই ধারা থেকে ছাত্রলীগ এক বিন্দুও সরে আসেনি। নেতৃত্ব পরিবর্তন করেও কোনো লাভ হচ্ছে না। বরং দিন দিন যেন অধঃপতন আরও বাড়ছেই। গত ১২ মে নকলে বাধা দেওয়ায় পাবনার শহীদ বুলবুল কলেজের এক প্রভাষককে মারধর করেন ছাত্রলীগের নেতা-কর্মীরা। ছাত্রলীগ আয়োজিত কনসার্টে পৃষ্ঠপোষক প্রতিষ্ঠানের দেওয়া অর্থের ভাগ-বাঁটোয়ারা নিয়ে গত ১২ এপ্রিল রাতে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের মল চত্বরে কনসার্ট স্থলে অগ্নিসংযোগ ও ভাঙচুরের ঘটনা ঘটে। তার আগে ২৩ ফেব্রুয়ারি নরসিংদী সরকারি কলেজের অধ্যক্ষের কার্যালয়ে ঢুকে তাঁর ওপর ময়লা দিয়ে হামলা করেন ছাত্রলীগের নেতা-কর্মীরা। ১৩ ফেব্রুয়ারি জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে তৃতীয় ও চতুর্থ শ্রেণির কর্মচারী নিয়োগকে কেন্দ্র করে ৬০ লাখ টাকার ভাগ-বাঁটোয়ারা নিয়ে ছাত্রলীগের দুই পক্ষ সংঘর্ষে জড়ায়। সংগঠনটির নেতা-কর্মীদের এ ধরনের অপকর্মের খবর প্রায়ই সংবাদ-শিরোনাম হচ্ছে।
১৯৪৮ সালে প্রতিষ্ঠিত ঐতিহ্যবাহী সংগঠন ছাত্রলীগের একটি গৌরবোজ্জ্বল অতীত রয়েছে। জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান বলেছিলেন, 'ছাত্রলীগের ইতিহাসই বাঙালির ইতিহাস।' প্রতিষ্ঠার পর '৫২-এর ভাষা আন্দোলন, '৬২-এর শিক্ষা আন্দোলন, '৬৬-এর ছয় দফা ও ১১ দফা আন্দোলন, '৬৯-এর গণঅভ্যুত্থান, '৭১-এর মুক্তিযুদ্ধ, '৯০-এর স্বৈরাচারবিরোধী আন্দোলনসহ সব প্রগতিশীল গণতান্ত্রিক আন্দোলন-সংগ্রামে এ সংগঠনের নেতাকর্মীরা ঐতিহাসিক ভূমিকা রেখেছেন। সেই সংগঠনের ইতিহাস ধূসর থেকে ধূসরতর হচ্ছে, খসে পড়ছে গৌরবের পালক। পরিণত হচ্ছে বিষবৃক্ষে।
প্রশ্ন হলো ক্ষমতাসীনরা এই বিষবৃক্ষকে আর কতকাল পৃষ্ঠপোষকতা করবেন? কেন করবেন?