Published : 09 Sep 2019, 02:37 PM
(বিস্মৃতিপ্রবণজাতিকে শেকড়ের ইঙ্গিত)
নাটের গুরু !!
অ-তে অজগর, আ-তে আম, ই-তে ইঁদুর, ঈ-তে ঈগল…..
বৃটিশ রাজত্বের রাজধানী কলকাতায় ধুমসে চলছে বাংলা ক্লাস। ১৯১৫ সালে দিল্লীতে নিয়ে যাবার আগে পর্যন্ত কলকাতাই ছিল রাজধানী। প্রচুর পরিশ্রম করছেন বৃটিশ মিলিটারি সেক্রেটারি। জনমানস চিনতে ভাষা জানা দরকার। তাছাড়া বেঙ্গল প্রদেশটা তাঁর মাথাব্যথার কারণও বটে। সুজলা সুফলা হলেও এরকম অগ্নিগর্ভ প্রদেশ ভারতে আর নেই। ভবিষ্যতের সূর্যসেন, আলীমুদ্দীন, ক্ষুদিরামদের পায়ের আওয়াজ পাচ্ছেন তিনি। তাই এ চেষ্টা। কপালগুণে মাস্টারও পেয়েছেন চমৎকার। এই বাঙালি মাস্টারটা প্রচণ্ড বিপ্লবী-বিদ্বেষী। সব উচ্চপদের সাহেবরা তাই তাঁর ঘনিষ্ঠ বন্ধু। বিপ্লবী-দমনের গোপন শলাপরামর্শ তাঁর সাথেই করেন সমর সচিব।
ধড়াম!
কেঁপে গেল দুনিয়া ২৩ ডিসেম্বর ১৯১২ সালে। লুটি তো ভাণ্ডার, মারি তো গণ্ডার– কলকাতায় বোমা পড়েছে খোদ বড়লাট লর্ড হার্ডিঞ্জ-এর ওপরে, কপালগুণে বেঁচে গেছেন তিনি। ক্ষিপ্ত উন্মাদের মতো ইন্টেলিজেন্স বিভাগের ঘাড়ে ঝাঁপিয়ে পড়লেন সমর সচিব। বোমা মেরেছে কোনো পালোয়ান নয়, মেরেছে কিশোরী মেয়ে লীলাবতী। কিভাবে পালালো মেয়েটা? এত বড় একটা ঘটনা, কেন কেউ আগে থেকে জানতে পারল না? ইন্টেলিজেন্স কি ঘোড়ার ঘাস কাটছে বসে বসে?
প্রাণপাত করল ইন্টেলিজেন্স। দু'বছর পর তদন্ত রিপোর্ট হাতে নিয়ে হন্তদন্ত হয়ে বড়লাটের কাছে উর্দ্ধশ্বাসে ছুটলেন স্বরাষ্ট্র সচিব। রিপোর্ট পড়ে চোখ কপালে উঠে গেল হার্ডিঞ্জ সাহেবের। লীলাবতী আদতে মেয়েই নয়! শাড়ি পরে এসেছিল বসন্ত বিশ্বাস, বাংলারই দামাল কিশোর। আর, এ নাটকের নেপথ্য নায়ক আর কেউ নয়, প্রবল 'বিপ্লবী-বিদ্বেষী' স্বয়ং সেই বাংলার মাস্টার! লোকটা আবার বোমা-ঘটনার পর দেরাদুনের জনসভায় বিপ্লবীর ফাঁসি দাবি করে ডুকরে কেঁদে উঠে রুমাল ভিজিয়ে ফেলেছিল! "বোমা নিক্ষেপের ব্যাপারে ওই লোকটাই ছিল নাটের গুরু" (মাই ইন্ডিয়ান ইয়ার্স ১৯১০-১৯১৬, লর্ড হার্ডিঞ্জ– বইটা এখন ইন্টারনেটে কিনতে পাওয়া যায়)। ধর, ধর ব্যাটাকে। পুলিশ, মিলিটারি সব একসাথে ছুটল তাঁর আস্তানায়।
গুরু হাওয়া হয়ে গেলেন চোখের পলকে, শুরু হলো লুকোচুরির গিনেস রেকর্ড। আজ বাংলা তো কাল পাঞ্জাব, আজ মাদ্রাজ তো কাল আসাম। অসম্ভব ক্ষিপ্রতায় ভানুমতির খেল খেলে চলেছেন গুরু আর পেছনে ছুটছে ঘর্মাক্ত সেপাই-শান্ত্রীদল। নাম, পোশাক, রূপ ও ঠিকানা বদলের ইয়ত্তা নেই। টিকি বাঁধা উড়ে বাবুর্চি, বিষ্ঠার টিন মাথায় "হঠ যাও হঠ যাও" মেথর, বিয়ে পড়ানো পণ্ডিতজী, শব-মিছিলে আরামে শায়িত মৃতদেহ, রাগ-রাগিণীর আত্মহারা বেহালা বাদক বহুরূপী গুরু। বছরের পর বছর কেটে গেল, কানামাছি ভোঁ ভোঁ চলছেই। অস্থির হয়ে উঠল বৃটিশ সরকার।
কিন্তু এই বিপজ্জনক লুকোচুরির মধ্যেই পাল্টা আঘাত হানলেন সেই আশ্চর্য কর্ম-দানব। ১৯১৫ সালে প্রথম বিশ্বযুদ্ধ শুরু হয়ে গেছে, শত্রুকে আঘাত হানার এই তো সময়! কাবুলে গড়ে উঠেছে রাজা মহেন্দ্র প্রতাপ, অজিত সিং, অম্বাপ্রসাদ আর বরকত উল্লার নেতৃত্বে প্রথম 'স্বাধীন ভারত প্রবাসী সরকার' (জার্মানি, তুরস্ক তাকে স্বীকৃতিও দিয়েছিল)। কাবুল থেকে থাইল্যান্ড পর্যন্ত লক্ষ বর্গমাইল জুড়ে আবার সিপাহী বিদ্রোহের মেঘ ঘনীভূত হচ্ছে। পুরো আয়োজনে আছে বিপ্লবী কিছু নেতাদের সাথে পাঞ্জাবি কর্তার সিং, মারাঠি পিংলে, আর বাংলার এই গুরু। ব্যস্ত, ব্যস্ত, ব্যস্ত !!
হলো না। কতিপয় মীর জাফর এখানো আছে, তখনো ছিল। নবাব খান আর কৃপাল সিং-এর গোপন খবরে অতর্কিতে ঝাঁপিয়ে পড়ল মরণাস্ত্রে সজ্জিত সামরিক দানব, ব্যর্থ হয়ে গেল হাজার হাজার মুক্তিসেনার বুকের রক্ত। গুরু তখন রাজবেশ পরে সোজা গিয়ে হাজির জাপানি দূতাবাসে। ভিসা চাই। আমি রাজা পি.এন. ঠাকুর, কবিগুরুর আত্মীয়। জাপান সম্রাটের আমন্ত্রণে কবিগুরু জাপান যাচ্ছেন তো, তাই আমাকে কবিগুরুর আগে ওখানে যেতে হচ্ছে কবির পছন্দের খাবার, শয্যা ও অন্যান্য আয়োজন তদারক করতে। হয়ে গেল ভিসা, ২২ জুন হারুকি-মারু জাহাজের বারান্দা থেকে শেষবারের মতো দেখে নিলেন জন্মভূমির মাটি। অস্ফুটস্বরে বললেন, "ওয়েট, মাই ডিয়ার বৃটিশ! ওয়ান ফাইট মোর, দ্য লাস্ট অ্যান্ড দ্য বেস্ট"।
সুবিশাল ভারতবর্ষ তখনো টলমল করছে হাজার হাজার সূর্যসেন, ক্ষুদিরাম, হরিপদ দত্ত, প্রীতিলতা, দীপ্তিমেধা চৌধুরী, আলীমুদ্দিন, মনিরুজ্জামান ইসলামাবাদীর মত বিদ্রোহীদের পদভারে। এদিকে গুরুর জাপানে পৌঁছানোর খবরটা চড় হয়ে চটাশ করে পড়ল বৃটিশের গালে। সাথে সাথে শুরু হলো আহত সিংহের গর্জন, কচ্ছপের কামড় দিয়ে চেপে ধরল জাপান সরকারকে। আমাদের বিদ্রোহী ফিরিয়ে দাও, এক্ষুণি, এই মুহূর্তে। ওদিকে সরকারবিরোধী পার্টি জনগণকে বোঝাচ্ছে, দেশপ্রেমিক লোকটাকে খুন হবার জন্য বৃটিশের হাতে তুলে দেবে ভাই !
না! প্রতিবাদের ঝড় তুলে ফেলল জনতা আর সংবাদপত্রগুলো। ও আমাদের অতিথি, জাপানি আতিথেয়তার ঐতিহ্যে কলঙ্ক লাগতে দেব না। এদিকে প্রথম বিশ্বযুদ্ধে সদ্য বিজয়ী বৃটিশ চাপ দিয়ে চলেছে লীগ অব নেশনস (জাতিসংঘের পূর্বসুরী)-এর মাধ্যমে। দিনে দিনে ভেঙে পড়ল জাপান সরকারের মেরুদণ্ড, বিদ্রোহীকে ফিরিয়ে দেবার প্রস্তাব পাশ হয়ে গেল সংসদে। পাশবিক উল্লাসে ফাঁসির দড়ি পাকাতে শুরু করল বৃটিশ, পলকের জন্য থমকে গেল বহমান ইতিহাস– "বিশ্ব রহিল নিঃশ্বাস রুধি, নিভায়ে সূর্যতারা"।
"হল না"। বাসায় ফিরে দীর্ঘশ্বাসে স্ত্রীর দিকে তাকালেন বিরোধী দলের নেতা মি. তোয়ামা। "লোকটাকে আর বাঁচানো গেল না হায়েনার হাত থেকে"।
"একটা উপায় আছে"।স্ত্রী তাকালেন কন্যা তোশিকোর দিকে, "মাত্র একটাই উপায় আছে মা"।
নতস্বরে বললেন কন্যা– "আমি জানি। আমি ….. আমি রাজি আছি।"
ব্যস, দূর-দ্বীপবাসিনীর মধুর সম্মতিতে নির্ধারিত হয়ে গেল নিয়তি। ভবিষ্যতে নেতাজীর আজাদ হিন্দ ফৌজের গর্বিত পদধ্বনির জন্য তৈরি হয়ে গেল ইষ্ফল-বার্মা, মণিপুর, কোহিমা, সিঙ্গাপুর, থাইল্যান্ড। মহাকালের ডাক এসেছে ঐ, মাভৈঃ! এদিকে বিয়ের উৎসবে উল্লাসে ফেটে পড়ল সমস্ত জাপান। এ এখন জাপানি নাগরিক, আমাদের জামাই! দেখি, কোন শালা গায়ে হাত দেয়!
আইনের সামনে লেজ গুটিয়ে নিল জাপান সরকার। উদ্যত কালফণা গুটিয়ে নিল বৃটিশ, ক্রোধে ক্ষোভে হাত কামড়াতে লাগল। খোদ বড়লাটের গায়ে হাত তোলা "ক্রিমিনাল", এভাবে পার পেয়ে যাবে?
ধনী দেশ, বড়লোক শ্বশুর, পারিবারিক মাধুর্যের হাতছানি। তবু মনের মধ্যে "কোন্ রাতের পাখি গায় একাকী সঙ্গীবিহীন অন্ধকারে"! অগণিত বিদ্রোহীদের সারি সারি মুখ, বেশিরভাগই খুন হয়ে গেছে বৃটিশের হাতে। সেই মৃতদেহগুলো কি শুধু ইতিহাসের ডেসক্রিপশন হয়েই থাকবে? মহামুক্তির প্রেসক্রিপশন হবে না কখনো ? শুরু করেছিলেন কত বছর আগে বাংলার সেই দামাল কিশোর। আজ পেরিয়ে গেছে মাঝ বয়স, তবু উঠে দাঁড়ালেন। আকাশে বাতাসে ছড়িয়ে দিলেন আহ্বান– এসো ভাই, আরেকবার চেষ্টা করে দেখি।
ফিরে তাকাল ফিলিপাইন,মালয়েশিয়া, কোরিয়া, হংকং, সিঙ্গাপুরের লক্ষ লক্ষ ভারতীয়। কে? কে কথা বলছে? আকাশে-বাতাসেছড়িয়ে পড়ছে কার উদাত্ত আহ্বান, এসো ভাই, আরেকবার চেষ্টা করি। প্রথম বিপ্লব ব্যর্থ হয়েছে,ব্যর্থ হয়েছে দু'দুটো সিপাহী বিপ্লবও। কিন্তু সাফল্যের ভিত্তি গড়ে গেছে তারা নিজেদেরহাড়ে গড়া ব্রহ্মাস্ত্র দিয়ে। এসো, আরেকবার চেষ্টা করি।
এক থেকে দুই, দুই থেকে চার। অবাক বিস্ময়ে সারা পৃথিবী দেখল, লক্ষ লক্ষ বুকে ধীরে ধীরে প্রাগৈতিহাসিক দানবের মতো জেগে উঠছে শতাব্দীর ক্ষুধিত দেশপ্রেম। বন্যার মতো এগিয়ে এল মানুষ, জাপান থেকে বার্মা পর্যন্ত লক্ষ লক্ষ প্রবাসী ভারতীয়রা, গঠিত হয়ে গেল মুক্তিবাহিনী "ইন্ডিপেন্ডেন্স লীগ", কেন্দ্র তার টোকিও, গুরু তার কর্ণধার। বিরাট সেনাবাহিনীকে আগেপরে গুছিয়ে তুলেছেন মোহন সিং, মেজর শাহনেওয়াজ, মেজর ধীলন, লেফটেন্যান্ট কর্নেল আজিজ আহমেদ, ক্যাপ্টেন ড. লক্ষ্মী স্বামীনাথন, মেজর জেনারেল এম.ভি. পিল্লাই, লেফটেন্যান্ট কর্নেল এ সি চ্যাটার্জী, করিম গনি, ডি এম খান প্রভৃতি। ওদিকে সুদূর বার্লিন থেকে ভেসে আসছে মহাকালের বরাভয়– "আমি সুভাষ বলছি। মনে রেখো, পরাধীনতার চেয়ে বড় অভিশাপ আর নেই…।" দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের উত্তাল তরঙ্গের দুই প্রান্তে দুই বাঙালি কর্ণধার মনপবনের নাওটাকে কিনারায় ভেড়াবার জন্য ব্যাকুল যেন পৃথিবীর দু'ধারে দুটো মত্ত আবেগ পরস্পরকে আলিঙ্গন করার তাগিদে ফুলে ফুলে উঠছে। গল্প নয়। তোমার আমার ইতিহাস, বিদেশের মাটিতে।
বার্লিনে নেতাজীর চোখে তখন অনেক স্বপ্ন। সুদূর ইউরোপের চেয়ে জাপানের দিক থেকে আক্রমণটাই বেশি সুবিধেজনক। তাছাড়া সমগ্র এশিয়ার একমাত্র স্বাধীন দেশ জাপানের প্রেসিডেন্ট জেনারেল তোজো প্রথম থেকেই বলছেন, "এশিয়া ফর এশিয়ানস, গো হোম হোয়াইটস"। তার কাছে গুরুর দাবি গেল "আমার বয়স হয়েছে। সুভাষকে এনে দাও"। ওদিকে বার্লিনেও তাই। "আমাকে জাপান পাঠাও। তাঁর অধীনে সেপাই হলে গর্ববোধ করব আমি সুভাষচন্দ্র বোস।" (হায়! আমাদের আজকের নেতারা!) ততদিনে হিটলারের প্রথম দিকের তুমুল বিজয় স্তিমিত হয়ে এসেছে, তার ভবিষ্যৎ টালমাটাল। কিন্তু তবু, হিজ এক্সেলেন্সি চন্দ্র বোসের অনুরোধের একটা দাম আছে। জোগাড় হলো সাবমেরিন। মেজর আবিদ হাসানকে সাথে নিয়ে যুদ্ধসংকুল মৃত্যুগহ্ববরের মধ্যে দিয়ে তিনমাসের সাবমেরিনে জাপান।
শতাব্দীর সাথে শতাব্দীর দেখা হল ২ জুলাই, ১৯৪৩। স্বাধীনতার দুই অতন্দ্র বাঙালি প্রহরী, একজন নবীন একজন প্রবীণ। ৪ জুলাই ১৯৪৩, নবীনের হাতে সমস্ত দায়িত্ব তুলে দিয়ে তৃপ্তির ছুটি নিলেন অর্ধশতাব্দীর মহাবিদ্রোহী নাটের গুরু। তারপর নিশ্চিন্তে চোখ বুঁজলেন। শ্রদ্ধাবনত জাপান সম্রাট রাজশকট পাঠিয়ে দিলেন সে মরদেহ বইবার জন্য। জাপানের ইতিহাসে রাজপরিবারের বাইরে ওই একবারই ব্যবহার হলো সেটা। নেতাজী ইউরোপে গঠিত "আজাদ হিন্দ ফৌজ" ডিজলভ করেছেন আগেই। গুরুর গড়া "ইন্ডিপেন্ডেন্স লীগ" আর্মি সেই "আজাদ হিন্দ ফৌজ" নাম নিয়ে পা বাড়াল স্বাধীনতার দিকে। ২১ অক্টোবর ১৯৪৩ সিঙ্গাপুরে নেতাজীর নেতৃত্বে গড়ে উঠল স্বাধীন ভারতবর্ষের দ্বিতীয় প্রবাসী সরকার, মোট দশটি দেশ তাকে রাজনৈতিক স্বীকৃতি দিয়েছিল।
মুক্তির মন্দির সোপানতলে, কতো প্রাণ হলো বলিদান, লেখা আছে অশ্রুজলে….. তাঁর নাম স্বাধীনতা। তাঁর নাম দেশপ্রেম। জাতি-ধর্ম বিভেদের বহু ঊর্দ্ধে মহামুক্ত মহানন্দ সুবিশাল মহাপুরুষ তাঁর নাম রাসবিহারী বসু॥