Published : 03 Sep 2019, 06:58 PM
যতদিন যাচ্ছে বাংলাদেশে শাড়ির মতো জনপ্রিয় হচ্ছে কুইজ। এখন পরীক্ষারপ্রশ্নপত্রে কুইজ, ইন্টারভিউতে কুইজ, টেলিভিশনে কুইজের প্রতিযোগিতা প্রায়ই চোখে পরে। সুতরাং কুইজ দিয়েই শুরু ওশেষ হতে পারে লেখাটা-
প্রশ্ন: মেয়েরা শাড়ি পরে,পুরুষরা পরে না কেন?
উত্তর: পুরুষের ধৈর্য কম। তারা 'ধর মুরগি কর জবাই' টাইপ। মেয়েদের ধৈর্য ও সহ্যশক্তি বেশি, তাদের বুক ফাটেতো মুখ ফোটে না। তাই তারা শাড়ি পরে। শাড়ি পরার নাকি ৮০টি কৌশল আছে এবং মেয়েরা নাকি নিত্য নতুন কৌশলে শাড়ি পরতে ভালোবাসে!তবে মেয়েদের অভিমান বেশি।পছন্দের শাড়ি বা পোশাক কিনে না দিলে তারা আত্মহত্যার মতো ঘটনাও ঘটিয়ে ফেলতে পারে!
প্রশ্ন: মেয়েরা বিয়ের সময় 'লাল শাড়ি' আর ছেলেরা পাগড়ি পরে কেন? বিয়ের শেষে একজনের হাতের সাথেঅন্যের হাত মিলিয়ে দেয়া হয় কেন?
উত্তরঃ সংসার যে দোজখ আর সেখানে যে দশ নম্বর মহাবিপদ সংকেত সবসময় থাকে সেটা জানিয়ে দিতেই মেয়েরা লাল শাড়ি পরে। বিয়ের সময় সব পুরুষ হয়ে যায় চরিত্রবান। তাদের অতীত ঢেকে রাখার জন্যই নাকি তারা পাগড়ি পরে। আর হাত মিলিয়ে দেয়ার রেওয়াজ এসেছে বক্সিং থেকে। কারণ বক্সাররা মারামারির আগে কিন্তু হাতটাই মিলিয়ে নেয়! তবে 'লাল শাড়ি' পরার বিপদও আছে। 'কালার বিলাইন্ড' ষাড় (সুনীল গাঙ্গুলীর বিখ্যাত কবিতার লাইন-বরুনার জন্য আমি হাতের মুঠোয় প্রাণ নিয়েছি/দুরন্ত ষাড়ের চোখে বেঁধেছি লাল কাপড়!) গুতো দিতে দৌড়ে আসতে পারে। পাড়ার শয়তান ছেলেটা গেয়ে উঠতে পরে-ওহহ লাল শাড়িরে/নিশিরাইতে যায় ফুল বনে লাল শাড়িরে!
প্রশ্ন: ভারতের নারীদের কাছে হিমাংশু বর্মা এত জনপ্রিয় কেন?
উত্তর: কারণ সে সবসময়ে শাড়ি পরে এবং সে উপাধি পেয়েছে 'শাড়িম্যান' হিসেবে! হিমাংশু সব সময় হাতজোড়করে বলেন 'জয় শাড়ি'!তিনি এক গবেষণায়দেখিয়েছেন-'ভারতবর্ষে আদি থেকে মধ্যযুগ পর্যন্ত পুরুষ নারী নির্বিশেষে শাড়িকেই অঙ্গেজড়িয়েছেন।শাড়ি সবসময়েই ক্রিয়েটিভ'!
প্রশ্ন: হিমাংশু বর্মার সাথে সাহিত্যিক (অধ্যাপক। বিশ্ব সাহিত্য কেন্দ্রের প্রতিষ্ঠাতা। ৩০ অগাস্ট ২০১৯ এ একটি দৈনিকে উনি শাড়ি বিষয়ে একটা লেখা দেন। এরপর ওনাকে এবং শাড়ি নিয়ে যোগাযোগ মাধ্যমে ভূমিকম্প শুরু হয়ে যায়) আবদুল্লাহ আবু সায়ীদ এর মিল কোথায়?
উত্তর: দুজনেই শাড়ির পূজারি। দুজনের মতেই শাড়ি ক্রিয়েটিভ যদিও আআসা (আবদুল্লাহ আবু সায়ীদ) মনে করেন শাড়ি রহস্যময়! দুজনেরই দুঃখ ইদানিংকার প্রজন্মোর সাথে শাড়ির দূরত্ব বাড়ছে।তবে এই দুজনের পার্থক্য হচ্ছে হিমাংশু সবসময় এখন শাড়ি পরেন, কিন্তু আআসা কখনই শাড়ি পরেন নি! খুব ছোটকালে তাঁর মা তাঁকে ছোট্ট শাড়ি পরিয়ে সাজিয়ে দিয়েছিলেন কিনা, বহুবছর গেলেও তাঁর কাছ থেকে আমরা সেটা জানতে পারিনি! তবে উনি কোন একদিন একটা শাড়ি পরে ছবি তুললে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে সেটাও সুপার ডুপার হিট হবে।
প্রশ্ন: ধরুন আপনি একটা কবিতা লিখলেন এমন-নারীদের চাই শুধু কামুক পুরুষ, ইন্দ্রজিৎ ধনবান কোন স্বামী/তাদেরমানায় ভালো দুরংয়ের এমন শাড়ি/পুরুষেরাচিরকাল চায় বিপন্না নারী!-কবিতাটাপড়ার পর নারীবাদীরা কী ক্ষেপে যাবেন?
উত্তর: যিনি লিখেছেন তিনি একটা স্ট্যাটাস দিয়ে দেখতেপারেন বাকিটা যোগাযোগ মাধ্যমই করে দেখাবে।
প্রশ্ন: শাড়ি নির্মাতা কোম্পানি ও আবদুল্লাহ আবু সায়ীদের পরবর্তী করণীয় কী?
উত্তর: আবদুল্লাহ আবু সায়ীদ সাহেব ইতোমধ্যে শাড়ি নিয়ে লিখে ফেলেছেন এখন তিনি লুঙ্গি নিয়ে লিখতে পারেন। কম্বিনেশানটা চমৎকার হবে। (যদিও অনেক আগে একটা জনপ্রিয় সাপ্তাহিক পত্রিকা শাড়ি ও লুঙ্গি সংখ্যা বের করেছিল যা পাঠকপ্রিয় হয়েছিল) বাংলাদেশের প্রসিদ্ধ শাড়ি নির্মাতা কোম্পানিগুলো আআসা -কে উপদেষ্টা হিসেবে নিয়োগ দিতে পারে। কারণ এই প্রজন্মের মাঝে তিনি শাড়িকে আলোচনার শীর্ষে তুলে দিতে পেরেছেন!
প্রশ্ন: বাংলা বা হিন্দি ছবিতে শাড়ির ব্যবহার কতোটা চোখে পড়ে?
উত্তর: শাড়ি ছাড়া বাংলা বা হিন্দি ছবি বানানোই সম্ভব না। বিয়ে বা বাসর মানে সেখানে থাকবে লাল শাড়ি। পরদিন সকালে পুকুর, ঝরনা বা ওয়াশরুমে নায়িকার স্নানের পরিচিত দৃশ্য দেখা যাবে, নায়িকার মাথায় আবার টাওয়াল পেচানো থাকবে! বৃষ্টিতে গান মানে হচ্ছে ফিনফিনে স্বচ্ছ সাদা শাড়ির ব্যবহার যেন নায়িকার শরীরটা ফুটে ওঠে চরম মাত্রায়। আর ধর্ষণ? সেদিকে না হয় না যাই! তবে আর্ট ফিল্ম বলে ছবির একটা প্রজাতি আছে যেখানে গরীব নায়িকার গায়ে ব্লাউজ থাকে না! (এদেশের কিছু মানুষ এরকম যে ছবিটা বেশি দেখেছে তার নাম পদ্মা নদীর মাঝি)
প্রশ্ন: কবি সাহিত্যিকদের কাছে শাড়ি এত আকর্ষণীয় কেন?
উত্তর: এটা উপ-মহাদেশীয় ঐতিহ্যের অংশ। সংস্কৃত 'শাটি' শব্দ থেকে এসেছে শাড়ি যার মানে পরিধেয় বস্ত্র। প্রাচীন পালি সাহিত্যে শাড়ির উল্লেখ আছে।খ্রিস্টের জন্মের (যিশুর পোশাকও লক্ষণীয়। একখণ্ড সাদা কাপড়ই বেশি পরতেন) পাঁচ হাজার বছর আগেই তুলা এবং পরবর্তীকালে রেশম চাষের কথা ও কাপড় বোনার বিবরণ পাওয়া যায়। গুপ্তযুগে (৩০০ থেকে ৫০০ সাল) কবি কালিদাসের 'কুমার সম্ভব' বইতে শাড়ির উল্লেখ আছে। সে সময় একখণ্ড কাপড় পরতো পুরুষ যেটা ধুতি হিসেবে পরিচিত। মেয়েরা পরতো দুইখণ্ড কাপড়। উপরে থাকতো 'আধখানা' কাপড়। মোগল আমলে শাড়িতে বহুমাত্রিক নকশা ও ব্লাউজের প্রচলন হয়। ইলোরা, অজন্তা বা ময়নামতির গুহাচিত্র বা মাটির ফলকে নারীদের শাড়ি পরার নিদর্শন আছে।প্রায় চার হাজার বছর ধরে এই উপমহাদেশে নারীর পোশাকই ছিল শাড়ি। ইতিহাসবিদ রমেশ মজুমদার এর বর্ণনায় ৮ম শতাব্দীতেও ভারতীয় উপ মহাদেশের নারীর পোশাক ছিল শাড়ি। কালিদাসের কারণে কিনা জানি না কম বেশি সব লেখক সাহিত্যিকদের নারীর বর্ণনায় শাড়ি এসেছে ভিন্ন ভিন্ন ভাবে।
প্রশ্ন: শাড়ি বিষয়ক সর্বশেষ যাকে নিয়ে বিতর্ক সেইআবদুল্লাহ আবু সায়ীদের বর্ণনায় শাড়ি কীভাবে এসেছে?
উত্তর: 'শাড়ি পৃথিবীর সবচেয়ে যৌনাবেদনপূর্ণ অথচ শালীন পোশাক। শুধু শালীন নয়, রুচিসম্পন্ন, সুস্মিত ও কারুকার্যময় পোশাক। নারী শরীরকে যতটুকু অনাবৃতরাখলে তা সবচেয়ে রহস্যচকিত হয়ে ওঠে, পোশাক হিসেবে শাড়ি তারই উপমা… আধুনিক শাড়ি পরায় নারীর উচু-নিচু ঢেউগুলো এমন অনবদ্য ফুটেওঠে,যা নারীকে করে তোলে রমনীয় ও অপরূপ।শাড়ি তার রূপের শরীরে বইয়ে দেয় একঅলৌকিক বিদ্যুৎ হিল্লোল।…নারী দেহকে কতোটা প্রদর্শন করলে আর কতটা অপ্রকাশিতরাখলে তা শারীরিক মোহ বজায় রেখেও দর্শকের চোখে অনিন্দ্য হয়ে উঠবে তা পোশাকটি যেন সহজাতভাবেই জানে।…শরীর নিয়ে এমন শিল্পিত খেলা আর কে খেলতে পারে?…বাকি পৃথিবীর অধিকাংশ দেশেই পোশাক হয়শরীরটাকে রমনীয় গুদামঘর বানিয়ে রাখে, নয়তো বিবসনা করে রগরগে যৌনতারমৌতাত উদযাপন করে। শাড়ির মধ্যে আছে এই দুইয়ের মিলিত যাদু…বাঙালির শরীর অধিকাংশসময় সুগঠিত নয়। এই ত্রুটিকেও শাড়ির রুচি স্নিগ্ধশৈল্পিক আব্রুর মধ্যে এনে যেন বাঙালি মেয়েকে প্রাণে বাঁচিয়ে দেয়। তাদের শরীরের অসমঅংশগুলোকে লুকিয়ে ও সুষম অংশগুলোকে বিবৃত করে শাড়ি এই দুর্লভ কাজটি করে।'
প্রশ্ন: শাড়ির এই বর্ণণা পড়ে আপনি কী শিখলেন?
উত্তর: শাড়িতে নারী শরীরের উচু নীচু অংশ যেভাবে ফুটে ওঠে অন্য পোশাকে তা ওঠে না। শিল্পী সুলতানের ছবিতে বাংলার নরনারীর শরীর সুগঠিত ও হৃষ্টপুষ্ট হলেও আআসা এর বর্ণনায় বাঙালি নারীর উচ্চতার ত্রুটি আছে এবং তা সুগঠিত না হলেও শাড়ি নাকি এই ত্রুটি ঢেকে দেয়! বাকি পৃথিবীর বেশিরভাগ দেশের পোশাক নাকি নারীর শরীরকে 'রমনীয় গুদামঘর' বানায়। এখানে অবশ্য সৌদি আরব বা আফগানিস্তানি নারীদের পোশাকের কথা উল্লেখ করা হয় নি।উল্লেখ করা হয়নি সাগর তীরেস্নান করতে গেলে যে পোশাক ব্যবহার করা হয় সেটা সম্পর্কে! স্নানের পোশাকে যৌনতার মৌতাত উদযাপন হয় কিনা সেটাও স্পষ্ট করে বলা হয় নি।বলা হয়েছে নারী শরীরের'অসম অংশগুলো লুকিয়ে ও সুষম অংশগুলো বিবৃত করে (এখানে অসম ও সুষম অংশের নাম এবং বিস্তারিত বর্ণনা আসেনি!) শাড়ি দুর্লভ কাজ করে এবং শাড়ির মত শরীর নিয়ে দুর্লভ খেলা আর কিছু খেলতে পারে না! সুলতানের আঁকা ছবির সাথে আআসা–র বর্ণনা না মিললেও কারো কারো মনে পড়ে যেতে পারে সৈয়দ শামসুল হকের সেই উপন্যাসটার কথা। নাম 'খেলারাম খেলে যা'! উপন্যাসের এক জায়গায় ছেলের মন্তব্য এমন-দেখেছ বাইরে কী সুন্দর জোসনা ? ফুলের ঘ্রাণ আসছে? মেয়ের উত্তর-বুঝছি আপনি আমারে….চান!
প্রশ্ন: প্রশ্নের পালা এখানেই শেষ হোক। শেষ প্রশ্ন হোক-শাড়িতে নারীর সৌন্দর্যের যে একটা বাহ্যিক দিক আছে সেটার বিবরণ, নারীর প্রশংসা কিংবা সম্পর্কের সর্বজনীন বিবরণ কেমন হতে পারে?
উত্তর: হুমায়ুন আজাদের বর্ণনায় কোন কোননারী শাড়িতে জীবন্ত। তারা সেটা নিয়ে জীবনের দিকে হাঁটে।হুমায়ুন আজাদের বর্ণনায় শাড়ি কখনও ঘুমন্ত। শাড়ি পরে সেক্লান্তিতে ঘুমোয়। সুনীলের বর্ণনায় নারী প্রিয়দর্শিনী। ব্যঙ্গ করেহলেও তিনি শাড়ির সবচেয়ে জীবন্ত মডেল ইন্ধিরা গান্ধীর উদ্দেশ্যে লিখতে পারেন-প্রিয় ইন্দিরা তুমি বিমানের জানালায় বসেগুজরাটের বন্যা দেখতে যেওনা। শাড়ির বিবরণ আছে হুমায়ূন আহমেদের অনেক বইতে। যেমন-শাড়ি পরলে রূপাকে খুব মায়াবতী মনে হয়।হিমু সেটা জানে। তাই হিমু যখন হলুদ পাঞ্জাবি পরে তার বাসার সামনে দিয়ে হেঁটে যায় তখন রূপা নীল শাড়ি পরে ছাদে যেয়ে দাঁড়ায়। সারা ভারত আরেক মহিয়সীরশাড়িতে মুগ্ধ ছিল। নাম তার মাদার তেরেসা। খুব সাধারণ শাড়িপরেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। সম্ভবত এসব শাড়ি অনুপ্রেরণার কিংবা শাড়ির এমনভিন্ন দিকও আছে!
শারীরিক সম্পর্কের গানও হতে পারে শিল্প মানে উত্তীর্ণ, সব সময়ের জন্য উদাহরণের। যেমন-তোমার ভাঁজ খোল আনন্দ দেখাও করি প্রেমের তরজমা/যে বাক্য অন্তরে ধরি নাই দাঁড়ি তার নাই কমা! অথবা 'সীমানা পেরিয়ে' ছবির সেই অসাধারণ গান-বিমূর্ত এই রাত্রি আমার মৌনতারই সূতোয় বোনা একটি রঙিন চাদর। সেই চাদরের ভাঁজে ভাঁজে….
বাংলার শাড়ি রং বদলায়। শোকে সেকালো হয়। হলুদের সময় সে জীবন্ত। জনপ্রিয় গান-'হলুদ বাটো মেন্দিবাটো' র হলুদের মতোই উজ্জ্বল। বিয়ের শাড়ি সবচেয়ে আনন্দের, নিজের আরাধ্য মানুষকে বিয়ে করতে পারা মানে সফল বিপ্লব আর বিপ্লবের রং লাল।বিয়ের শাড়ি তাই কৃষ্ণচূড়ার লাল। আনন্দে লাল যে নারী, প্রিয়তমকে হারিয়ে সে কান্নাকাতর, তখন তার শাড়ির রং সাদা! দুঃখিনী বর্ণমালার জন্য যেশাড়ি সেটা সাদা কালো, অক্ষর গাঁথা।
আর আমার বাংলা মা'র যে শাড়ি তার রং লাল সবুজ।
বিশেষ দ্রষ্টব্য: স্টার গিল্ড নামের এক লাইভ অনুষ্ঠানে বলিউড তারকাসালমান খানের কাছে শাড়ি চেয়েছিলেন সানি লিওনি। লাইভঅনুষ্ঠানে সানি লিওনির পোশাকের ওপর তাকে একটা দামি শাড়ি পরিয়ে দিয়েছিলেন সালমান খান।এই শাড়ির কোনও রং আছে কিনা আমার জানা নাই!