Published : 01 Sep 2019, 05:04 PM
পরিবারতন্ত্র উপমহাদেশের রাজনৈতিক ইতিহাসে অমোচনীয় দাগ। দলীয় পৈতার মর্যাদা পাওয়া এই বৈশিষ্ট্যচিহ্ন এখনও সমানভাবে দৃশ্যমান। অবশ্য বিশ্বব্যাপীই রাজনৈতিক উত্তরাধিকারের প্রশ্নে পারিবারিক পরম্পরা কমবেশি লক্ষণীয়। তবে বাংলাদেশ, ভারত বা পাকিস্তানের মতো দেশগুলোতে 'পীরের ছেলে পীর' ফর্মুলায় দলীয় নেতৃত্বের পরিবর্তন রাজনীতির চেহারা ও চরিত্র— দুটিতেই যোগ করেছে ভিন্নতা। রাজনীতির এই 'উপমহাদেশীয় সংস্করণ' কখনও কখনও তৈরি করে অনাকাঙ্ক্ষিত সংকট। কুক্ষিগত ক্ষমতাজাত এমন সংকটে পড়া এই মুহূর্তের লাগসই দলের উদাহরণ হতে পারে বিএনপি।
জন্ম পঙ্কে হলেই যে তা সৌরভ ছড়ায় না, এমন কথা প্রকৃতিবিরুদ্ধ। রাজনীতির গতিপ্রকৃতিতেও এ কথা ততটাই সত্যি। তাই বিএনপির আত্মপ্রকাশের পটভূমির তূল্যবিচারে দলটির আজকের কর্মকাণ্ড বিবেচ্য হওয়া উচিত নয়। তবে জন্মদাগ মোছার নয়। আর খাসলতগুণে তা খুঁচিয়ে খুঁচিয়ে দগদগে রাখা হলে তো কথাই নেই।
নামকাওয়াস্তে বিরোধী অবস্থানে হলেও বিএনপিই এখন সরকারের একমাত্র সমালোচক। তবে নিজেদের 'অতীত' নিয়ে দলটিকেও কম কথা শুনতে হয় না। ২১ অগাস্ট গ্রেনেড হামলার ১৫তম বার্ষিকী ঘিরে বিএনপি আরেক দফা সমালোচনার তপ্ত কড়াইয়ে। ভয়াবহতম এ হামলার ভুক্তভোগী দল আওয়ামী লীগের তীব্র ক্ষোভ ও বিষোদগারের মুখে তারা বরাবরের মতো অসহায়। এই অসহায়ত্ব দলটি 'অর্জন' করেছে। সুতরাং এটি ভোগ করা তাদের নিয়তি। আর বিএনপির জন্মের আগে সংঘটিত দেশের ইতিহাসের নারকীয়তম ১৫ অগাস্ট হত্যাকাণ্ডের দায় থেকেও দলটির 'ক্লিন চিট' পাওয়া কঠিন। কারণ, আর কিছু না হোক, বিএনপির প্রতিষ্ঠাতা জিয়াউর রহমান যে তখন দৃশ্যমানভাবে হাতপা গুটিয়ে বসে ছিলেন, ইতিহাস তার সাক্ষ্য দেয়।
রাজনীতিতে শেষকথা বলে কিছু না থাকলেও কিছু কথা সবসময়ই থাকে; শুরুতেও থাকে, শেষেও থাকে। এই কিছু কথাহলো জনগণের কথা, দেশ ও দশের কথা। গণমানুষকে বাদ দিয়ে রাজনীতি হয় না, জনগণের দাবিদাওয়াবাদ দিয়ে রাজনৈতিক কর্মসূচি হয় না। সুতরাং বিপদ ঘটে তখন, যখন জনগণ ও জনাকাঙ্ক্ষা উপেক্ষাকরে জন্মসূত্রে দলীয় হর্তাকর্তা বনে যাওয়া ব্যক্তির চাওয়া-পাওয়া দলের ভেতর মুখ্য হয়েওঠে। দলীয় গঠনতন্ত্র মানলে ১০ জনের সবাই না হোক, অন্ততপক্ষে ন্যূনতম সংখ্যাগরিষ্ঠের(ছয়জন) মতের ভিত্তিতে সিদ্ধান্ত গৃহীত হওয়ার কথা। কিন্তু পরিবারতন্ত্রের দাপটে ঘটেএর উল্টোটা। অবশ্য ঢালাওভাবে সমালোচনাও প্রাপ্য নয় পরিবারতন্ত্রের। ভারতে রাহুল গান্ধীরসাম্প্রতিক সিদ্ধান্ত কংগ্রেসের চেনা চেহারায় ভিন্নতা আনার প্রচেষ্টা হিসেবে দেখা যেতেপারে। যদিও পুনরায় সোনিয়া গান্ধীর হাতে ব্যাটন তুলে দেওয়ার বিষয়টিকে যে লাউ সেই কদুরবাইরে কিছু ভাবাও কঠিন।
কথা হলো, যারহাতে কলকাঠি নাড়ার ক্ষমতা থাকবে, তার বুকে জনগণের হৃদস্পন্দন কিছুটা হলেও স্পন্দিতহওয়া চাই। নইলে গোল বাধে। কোনও রাজনৈতিক দলই একজন বা দুজন ব্যক্তিমানুষের সিদ্ধান্তেচলতে পারে না। তাহলে বেটার আপনি কলকারখানা খুলে বসুন।
২১ অগাস্ট গ্রেনেড হামলার ব্যাপকতার বিপরীতে তৎকালীন বিএনপি সরকারের সমান নিষ্ক্রিয়তাই এর লক্ষ্য, উদ্দেশ্য ও পৃষ্ঠপোষকতা আন্দাজ করার পক্ষে যথেষ্ট। এই আন্দাজকে এক কদম এগিয়ে কেউ কেউ হয়তো 'সারকামস্ট্যানশিয়াল এভিডেন্স'ও বলতে পারেন। পাশাপাশি জজ মিয়া নাটকসহ অন্যান্য ক্ষেত্রে বিএনপির আচরণ সরকারের আসীন একটি রাজনৈতিক দলের ন্যূনতম যোগ্যতা প্রমাণেও ব্যর্থ। দলীয় পরিচয়ে চিহ্নিত করা হলেও সরকার তো আসলে দেশের সব মানুষেরই। অবশ্য সর্বজনীন মনোভাবের এই অগ্নিপরীক্ষায় বাকি দলগুলোও যে খুব ভালোভাবে উত্তীর্ণ হবে, এ কথা জোর দিয়ে বলা অসম্ভব। তবু ২১ অগাস্ট গ্রেনেড হামলায় আহতদের গণহারে হাসপাতালগুলো থেকে ফিরিয়ে দেওয়ার ব্যবস্থা বলবৎ করার মতো বিএনপি সরকারের গরিবী মানসিকতা কে ভুলতে পারবে? নাকি ভোলা যায়?
স্বাভাবিকভাবেইপ্রশ্ন ওঠে, বিএনপি সরকারের সেসময়ের এমন অবস্থান নেওয়ার পেছনে কারণ কী ছিল? অন্যকেঘায়েল করে নিজের কমজোরি ঢাকা যাবে, এর চেয়ে আত্মঘাতী ভাবনা আর হয় না। ধারণা করা চলে,হাওয়া ভবনকে তখন 'ম্যানেজ' করার ক্ষমতা কারোর ছিল না। এখনও দলটির সুতো বাঁধা সেই লন্ডনে।
'রেফারেন্স' হিসেবে সেভাবে আমলে নিতে অনেকেই হয়তো নিমরাজি হবেন, তবু কৃষক শ্রমিক জনতা লীগের সভাপতি কাদের সিদ্দিকীর মন্তব্য টানা যেতে পারে। ২৬ অগাস্ট এক অনুষ্ঠানে তিনি বলেন, একাদশ জাতীয় নির্বাচনের আগে ঐক্যফ্রন্টের নেতৃত্ব ড. কামালের কাছ থেকে তারেক রহমানের হাতে চলে গিয়েছিল। শেখ হাসিনাকে হটিয়ে পলাতক আসামিকে ক্ষমতায় বসাতে তিনি রাজনীতি করেন না। এ কারণে ঐক্যফ্রন্ট থেকে নিজেকে প্রত্যাহার করে নিয়েছেন তিনি। এই পরিসরে বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য গয়েশ্বয় রায়ের 'তারেক-কথন'ও স্মর্তব্য।
'২১ অগাস্টের হামলা দেশের ইতিহাসে সবচেয়ে নিন্দনীয় ঘটনা'— বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুলের এই মন্তব্য কি দলটির আত্মোপলব্ধির আভাস দেয়? কিন্তু একই সঙ্গে তিনি এ-ও বলেছেন, এ ব্যাপারে বর্তমান সরকারপ্রধানের বক্তব্য রাজনৈতিক উদ্দেশ্যপ্রণোদিত। বিএনপি মহাসচিবের এই কথা শুনে ঝটতি মনে প্রশ্ন জাগে, ভয়াবহ এই হামলা কি রাজনৈতিক উদ্দেশ্যবিবর্জিত ছিল? উত্তরটা তিনি দিলেই ভালো হয়।
হাতে কলমে প্রমাণের অভাবেও সত্য মরে না; এটাই সত্যের জোর। হামলার ধরন, ব্যবহৃত উপকরণ, ব্যাপকতা সর্বোপরি স্থান ও কাল বিবেচনায় ২১ অগাস্ট হামলার বিষয়টি দেশবাসীর কাছে পরিষ্কার। উপরন্তু হামলা-পরবর্তী পুলিশি তৎপরতা, প্রশাসনিক ব্যবস্থা ও আইনি প্রতিকারের বিষয়টিও তৎকালীন সরকার তথা ক্ষমতাসীন দলটির জাত চিনিয়ে দেয়। দলটির সেই জাত-পরিচয় এখনও অটুট বলেই প্রতীয়মান হয়।
কারচুপির নির্বাচনের 'অবৈধ' সংসদে বিএনপি দলীয় নির্বাচিতদের যোগদান কৌশল হিসেবে বিবেচ্য হতে পারে বৈকি। যদিও এক যাত্রায় দলীয় মহাসচিবের পৃথক ফল ধন্দে ফেলে দেয়। এরপরও গণতন্ত্রের স্বার্থে এটা মেনে নিলেও দলটির সংরক্ষিত আসনের রুমিন ফারহানার সরকারি প্লটের জন্য আবেদনের পক্ষে যুক্তি দাঁড় করানো যায় না; কৌশল হিসেবেও পায় না পাস মার্কস। বিএনপি মহাসচিব এর পক্ষে সাফাই গাওয়া সত্ত্বেও বিষয়টিকে 'আনইথিক্যাল' বলেও দাগিয়ে দেন। এ অবস্থায় রুমিনের তড়িঘড়ি আবেদন প্রত্যাহার কী বার্তা দেয়? এ ঘটনা যতটা না ভুল শোধরানোর চেষ্টা হিসেবে প্রতীয়মান, তার চেয়ে বেশি দলীয় দৈন্যদশার প্রতিফলন। দলীয় রাজনীতির নামে দেশে যা চলছে, তা আসলে ক্ষমতা দখলের লড়াই ছাড়া আর কিছু নয়। এ কথা মনে রেখেও মোটাদাগে ন্যূনতম যে নীতি-আদর্শের চর্চার মধ্য দিয়ে রাজনৈতিক দল অক্সিজেন পায়, আত্মপ্রকাশের চার দশক পরও বিএনপিতে সেই প্রাণবায়ুর ঘাটতি প্রকট। খালেদা জিয়ার মুক্তি আন্দোলনের 'ইনহেলার' দিয়ে তা পূরণ করা কঠিন।