Published : 27 Aug 2019, 06:38 PM
ভারতের পররাষ্ট্রমন্ত্রী জয়শঙ্করের সফরের সময় চারটি বিষয় নিয়ে অনেকেরই কম বেশি উদ্বেগ ছিলো। যার ভেতর প্রথমে এসেছিল কাশ্মীরের সাম্প্রতিক সময়ের পরিবর্তন। ভারতের সংবিধান পরিবর্তন করে কাশ্মীরের বিশেষ স্ট্যাটাস মুছে ফেলা ও লাদাখকে পৃথক করার পরে আঞ্চলিক রাজনীতিতে এর যতটা প্রভাব পড়বে বলে অনেকে ধারণা করেছিলেন সেটা ঘটেনি। কারণ, চীনের বক্তব্য অনেক সংযত ছিল। অন্যদিকে পাকিস্তান ছাড়া অন্য প্রতিবেশী এবং আর্ন্তজাতিক মহল থেকে কোন প্রতিক্রিয়া দেখানো হয়নি।
বরং পাকিস্তান বাস্তবে ওভার রিঅ্যাক্ট করে। কারণ, রাজনীতি ও কূটনীতিতে একটি সমস্যা হলে সবগুলো দুয়ার বন্ধ করে দিতে নেই। ইমরান খান রাজনীতি ও কূটনীতিকে অনেকটা ওয়ানডে ক্রিকেট মনে করে অলআউট খেলতে গেছেন। তিনি যোগাযোগ থেকে বাণিজ্য অবধি বন্ধ করে দিয়েছেন ভারতের সঙ্গে। বাণিজ্য বন্ধ অনেকখানি নামমাত্র। কারণ, পাকিস্তানের সঙ্গে ভারতের বাণিজ্য হয় তিন পথে। পথগুলো হলো আফগানিস্তান দিয়ে, অবৈধভাবে আর বৈধভাবে। তাই ওই বাণিজ্য বন্ধের প্রভাব খুবই কম। আফগানিস্তানের বৈধ আর অবৈধ পথ খোলাই থাকবে। তাতেই ৭০ ভাগ বাণিজ্য চলবে।
যাহোক, কাশ্মীর নিয়ে ভারতের ভেতরও নানা প্রতিক্রিয়া আছে। পক্ষে ও বিপক্ষে অনেক মত। আর এগুলো সবই যখন চলমান ওই সময়ে জয়শঙ্কর বাংলাদেশ সফরে আসেন। স্বাভাবিকভাবে অনেকে মনে করেছিলেন, ভারত মনে হয় কাশ্মীর ইস্যুতে বাংলাদেশকে পাশে পাবার জন্যে জয়শঙ্করকে এত তাড়াতাড়ি বাংলাদেশে পাঠালেন। যদিও সফরটি আগেই নির্ধারিত ছিল। নির্ধারিত সফর হলেও অনেকে এমনও মনে করেছিলেন, সার্কের ভেতর পাকিস্তানের পরেই মুসলিম অধ্যুষিত দেশ বাংলাদেশ। তাই ভারত তাড়াতাড়ি বাংলাদেশকে পাশে চাচ্ছে কাশ্মীর ইস্যুতে। কিন্তু শেষ পর্যন্ত জয়শঙ্কর তাদের সকলের দুশ্চিন্তা ও উদ্বেগের আগুনটিতে পানি ঢেলে দিলেন। তিনি সাফ জানিয়ে দিলেন কাশ্মীর ভারতের অভ্যন্তরীণ ইস্যু। এ নিয়ে অন্য কারো সঙ্গে কোন কথা নয়।
কাশ্মীর ইস্যুর পরে দ্বিতীয় ইস্যু ছিলো আসামের প্রায় চল্লিশ লাখ ভারতীয় মুসলিমের নাগিরকত্ব এখনো না দেয়া। বাংলাদেশ ঘরপোড়া গরু। ১১ লাখ রোহিঙ্গা নিয়ে ধুঁকছে। তাই যখনই আরেক প্রতিবেশী দেশে চল্লিশ লাখকে নাগরিকত্বহীন করা হয়েছে , আর তারা ধর্মে মুসলিম- তখনই তাদের ভেতর নাগরিকত্বহীন রোহিঙ্গাদের ছবি দেখতে পেয়েছে। তাছাড়া বিজেপির কিছু কিছু দায়িত্বহীন নেতা বিভিন্ন সময়ে বলেছেন, তারা বাংলাদেশী। তাদেরকে বাংলাদেশে ফেরত পাঠানো হবে। এসব মিলে আসামের এই নাগরিকদের দিয়ে একটা শঙ্কায় ছিলেন বাংলাদেশের অনেকে। তবে যারা একটু খোঁজ খবর রাখেন তারা জানেন, এই শঙ্কা আগেই কেটে গেছে। স্বরাষ্ট্র মন্ত্রী পর্যায়ের মিটিংয়ে যখন আমাদের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী দিল্লী গিয়েছিলেন তখনই তাকে জানানো হয়েছিল, আসামের এই নাগরিকদের নিয়ে বাংলাদেশের উদ্বেগের কোন কারণ নেই। কারণ, এটা ভারতের অভ্যন্তরীণ বিষয়। তারপরেও জয়শঙ্কর এলে তাকে আমাদের কয়েক সাংবাদিক এ বিষয়ে প্রশ্ন করেছিলেন। তিনি এ বিষয়েও জানিয়ে দেন আসামের নাগরিক সমস্যা তাদের অভ্যন্তরীণ বিষয়।
বাস্তবে কাশ্মীর ও আসামে যাই ঘটুক না কেন, ভারত তাদের এ নিজস্ব সমস্যাও নিজেরাই মেটাতে চাচ্ছে এটা অনেক ভালো লক্ষণ এবং এবারের জয়শঙ্করের সফরে স্পষ্টভাবে দুটো সমস্যাকে অভ্যন্তরীণ সমস্যা হিসেবে উল্লেখ করে ও তার ব্যাখ্যা দিয়ে জয়শঙ্কর বড় কূটনীতিকের দায়িত্বই পালন করেছেন। কারণ, এ দুটো বিষয়ে যে বাংলাদেশকে জড়ানো হবে না এ বিষয়টি পরিষ্কার করা অনেক বেশি দরকার ছিল। আসামের নাগরিকত্ব নিয়ে ভারত যা করে করুক সেটা তাদের দেশের বিষয়। এর কোনো প্রভাব বা এর কোনো বোঝা কোনো মতেই বাংলাদেশের ওপর পড়বে না এ নিশ্চয়তা একটি বন্ধু ও সৎ প্রতিবেশীর কাছে বাংলাদেশের ন্যায্য চাওয়া। অন্যদিকে কাশ্মীর একটি বিষফোঁড়া। একটি এলাকা তিন ভাগে ভাগ হয়ে তিন দেশের অধীনে। চীন, ভারত ও পাকিস্তান তিনটি দেশই কাশ্মীরের ভূখণ্ড আয়ত্বে নিয়েছে।
চীনের কাছে মূলত পাকিস্তান কাশ্মীরের ভূমি বিক্রি করেছে। তাছাড়া ৭০ বছরের বেশী সময়ের এই সমস্যার কারণে এই উপমহাদেশে যেমন শান্তি এলো না তেমনি সার্কও দাঁড়াতে পারলো না। অথচ সার্কের ভবিষ্যত ছিল। সড়ক ও নৌপথ আর নৌ বন্দরের সম্ভারে সমৃদ্ধ এ সার্ক অনেক কিছু করতে পারতো। নতুন একটা অর্থনীতি ও নিজস্ব বাজার হবার সব সুবিধা রয়েছে সার্কে। শুধু ভারত ও পাকিস্তানের এই কাশ্মীর সমস্যার জন্যে সার্ক কার্যকর হলো না। তবে তারপরেও ভবিষ্যতে সার্ককে কার্যকর করা ও এই উপমহাদেশে শান্তি প্রতিষ্ঠার জন্যে এখন একটি মাত্র দেশ আছে, সেটা বাংলাদেশ। বাংলাদেশই কেবল এই শান্তি প্রতিষ্ঠার নেতৃত্ব দিতে পারে। আর সে নেতৃত্ব দেবার মত নেতা শেখ হাসিনাই। তাই এমতাবস্থায় ভারত যদি বাংলাদেশকে কাশ্মীর সমস্যার সঙ্গে জড়ানোর চেষ্টা করতো (যদিও শেখ হাসিনা বাংলাদেশকে জড়াতে দিতেন না) তাহলে এ ভবিষ্যতও নষ্ট হয়ে যেতো। এক্ষেত্রে ভারত খুবই ম্যাচিউরিটির পরিচয় দিয়েছে। কারণ ভারতের অনেক থিঙ্কট্যাঙ্ক চায় শেখ হাসিনার নেতৃত্বে একদিন সার্ক আবার কার্যকর হয়ে উঠে নতুন একটি অর্থনীতি হোক।
আবার এর পাশাপাশি রোহিঙ্গা সমস্যা সমাধানে জয়শঙ্কর শতভাগ সমর্থন দিয়ে গেছেন। বাস্তবে রোহিঙ্গারা যখন দুই বছরেও নিজ দেশে যেতে পারলো না, পশ্চিমা বিশ্ব ও জাতিসংঘেরও এ বিষয়ে যেখানে খুব বেশি তাড়া নেই- সেখানে ভারতকেই এ বিষয়ে উদ্যোগী হতে হবে। কারণ, রোহিঙ্গারা ইতোমধ্যে বাংলাদেশের সমুদ্র রুটের ধারে বসে কী করছে সেটা কম বেশি সকলে উপলব্ধি করছে। রোহিঙ্গারা ইতোমধ্যে যেমন আর্ন্তজাতিক চোরাচালানির সঙ্গে জড়িত হয়ে পড়েছে তেমনি তারা এখন অনেক বড় হুমকি বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ নিরাপত্তার জন্যে। কক্সবাজার এলাকার সাধারণ মানুষ ইতোমধ্যে ভীত হয়ে পড়েছেন। আমাদের প্রধানমন্ত্রীও বলেছেন, তারা আমাদের অনেক সমস্যার কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। তাছাড়া রোহিঙ্গাদের কেন্দ্র করে যেসব এনজিও এখানে কাজ করছে তারাও সকলে নিরাপদ এনজিও নয়। রোহিঙ্গারা যেমন বাংলাদেশের সীমান্তবর্তী স্থানে অবস্থান নিয়েছে তেমনি তারা ভারতেরও সীমান্তবর্তী অবস্থানে। শুধু এই নয়, কোনো গোষ্ঠী যদি বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ নিরাপত্তার জন্য হুমকি হয়ে দাঁড়ায় তারা যে খুব শিগগিরই ভারতেরও অভ্যন্তরীণ নিরাপত্তার জন্যে হুমকি হয়ে দাঁড়াবে তাতে কোনো সন্দেহ থাকে না। তাই স্বাভাবিকই ভারতের এখন বাংলাদেশের সমানই দায় পড়েছে রোহিঙ্গা সমস্যার একটি সমাধান করা তাদের অভ্যন্তরীণ নিরাপত্তার জন্যে। ভারতের অনেক ব্যবসা আছে মিয়ানমারের সঙ্গে। এটা যেমন সত্য, তেমনি এটাও সত্য ওইসব ব্যবসার থেকে কোনো অংশে কম গুরুত্বপূর্ণ নয় তাদের নিজস্ব অভ্যন্তরীণ নিরাপত্তা। আর সে জন্যে রোহিঙ্গা সমস্যায় তাদের বাংলাদেশের পাশে থাকতে হবে, বাংলাদেশ ও ভারতকে ভবিষ্যত অভ্যন্তরীণ নিরাপত্তা ঝুঁকি মুক্ত রাখার জন্যে। এখন দেখা যেতে পারে ভারত ও বাংলাদেশের মিলিত চেষ্টা রোহিঙ্গা সমস্যা সমাধানে কতটা কার্যকর ভূমিকা রাখতে পারে।
সর্বশেষ ৫৪টি নদীর পানি সমস্যা সমাধান। উভয় দেশ এ বিষয়ে কারিগরি কাজ করছে। তবে এখানে একটা বিষয় মনে রাখা দরকার সেই আশির দশকের প্রথম থেকেই এই কাজ বার বার করা হচ্ছে বা করার উদ্যোগ নেয়া হচ্ছে। তাই মাঝে মাঝেই জেআরসি বা যৌথ নদী কমিশনের মিটিং এর খবর প্রকাশ হয়েছে। এখান থেকে বের হয়ে আসতে হবে। জয়শঙ্কর বলেছেন, তার সরকার প্রতিশ্রুতিবদ্ধ। মূলত মোদি সরকার রাজনৈতিকভাবে এ বিষয়ে প্রতিশ্রুতিবদ্ধ। বাস্তবে এসব সমস্যা আগে রাজনৈতিক পথে সমাধান করে নিতে হয় তারপরে কারিগরি দিক দেখতে হয়। চুক্তিতে তেমনটি থাকাই ভালো। মোটা ফ্রেমের কাজটি রাজনৈতিক পথেই সমাধান করতে হবে। ভারতের সংবিধান অনুযায়ী বাংলাদেশ ও ভারতের পানি সমস্যার সমাধানে পশ্চিমবঙ্গ একটা বড় ফ্যাক্টর। বিজেপি পশ্চিমবঙ্গে প্রতিদিনই ক্ষমতাবান হচ্ছে। এর থেকে কি কোন আশার সঞ্চার করা ভুল হবে? পাশাপাশি জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব দুই দেশের সব নদীতে পড়েছে। সেখান থেকে বের হয়ে আসার জন্যেও কাজ করতে হবে। আর সেজন্য নদ-নদীর পানি বণ্টনের ট্রাডিশনাল ধারণা থেকেও দুই দেশের বের হয়ে আসা উচিত।