Published : 26 Aug 2019, 07:37 PM
ব্লু ইকোনমি, বাংলায় যাকে আমরা বলছি সমুদ্র অর্থনীতি। ২০১০ সালে অধ্যাপক গুন্টার পাউলি ভবিষ্যতের অর্থনীতির রূপরেখা প্রণয়নের জন্য জাতিসংঘ কর্তৃক আমন্ত্রিত হন। সেখানেই একটি টেকসই ও পরিবেশবান্ধব মডেল হিসেবে ব্লু ইকোনমির ধারণা দেন। জেনে রাখা ভাল, বিশ্বের কাছে গুন্টার পাউলি টেকসই উন্নয়নের 'স্টিভ জবস' হিসেবে পরিচিত। সমুদ্রের সুনীল জলরাশির অন্তরালে থাকা বিপুল অর্থনৈতিক সম্ভাবনা যার প্রধান বিষয়। তার ধারণা অনুযায়ী সমুদ্র অর্থনীতিতে, অর্থনৈতিক সম্ভাবনার সাথে সাথে অন্তর্ভুক্ত থাকতে হবে সাধারণ জনগণের সুযোগ-সুবিধা, ভাবতে হবে পরিবেশের কথা, থাকতে হবে উদ্ভাবনী এবং গতিশীল ব্যবসায়িক চিন্তা-ভাবনা।
২০১২ সালের রিও ডি জেনিরোতে টেকসই উন্নয়ন শীর্ষক জাতিসংঘ সম্মেলনে প্রথম উত্থাপিত হয় 'ব্লু-ইকোনমি'। যেখানে নানান ধারণা দিয়ে বোঝানো হয়, আগামীদিনের জন্য একটি সমুদ্রভিত্তিক অর্থনীতি গড়ে তোলার কথা। যার উদ্দেশ্য হবে মানুষের জীবনমান উন্নয়ন এবং সামাজিক সাম্য প্রতিষ্ঠা। পাশাপাশি পরিবেশে ক্ষতির ঝুঁকিও কমিয়ে আনা। সেই সমুদ্র অর্থনীতির সাথে টেকসই উন্নয়নের প্রসঙ্গটিও ওতোপ্রতোভাবে জড়িত। সর্বজনস্বীকৃত একটি আন্তর্জাতিক সংজ্ঞা অনুসারে, টেকসই উন্নয়ন হচ্ছে আশেপাশে থাকা সম্পদের সঠিক ব্যবহারের মাধ্যমে বর্তমান সময়ের চাহিদা মেটানো, কিন্তু তার ফলে ভবিষ্যৎ প্রজন্ম কখনো ঝুঁকির মুখে পড়বে না।
সমুদ্র অর্থনীতিতে বাংলাদেশে সম্ভাবনা কতটুকু, তা আলোচনার আগে বাংলাদেশের সমুদ্র বিজয় নিয়ে সংক্ষেপে জেনে নেয়া যাক। বঙ্গোপসাগরের সীমানা নিয়ে মিয়ানমার ও ভারতের সঙ্গে বাংলাদেশের বিরোধ চলে আসছিল দীর্ঘদিন। এ বিষয়ক আন্তর্জাতিক আদালতের রায়ে ২০১২ সালে মিয়ানমারের সাথে ও ২০১৪ সালে ভারতের সাথে সমুদ্রসীমা বিরোধ নিষ্পত্তি হয়। এরফলে ১ লাখ ১৮ হাজার ৮১৩ বর্গকিলোমিটার সমপরিমাণ টেরিটোরিয়াল সমুদ্র এলাকায় বাংলাদেশের নিরঙ্কুশ কর্তৃত্ব, অধিকার ও সার্বভৌমত্ব প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। যার আয়তন প্রায় আরেকটি বাংলাদেশের সমান। আরও আছে ২০০ নটিক্যাল মাইল একচ্ছত্র অর্থনৈতিক অঞ্চল। আর চট্টগ্রাম উপকূল থেকে ৩৫৪ নটিক্যাল মাইল পর্যন্ত মহীসোপানের তলদেশে সব ধরনের সম্পদের ওপর পূর্ণ অধিকার। এই সুবিশাল জলরাশির ভেতরেই লুকিয়ে আছে বাংলাদেশের সমুদ্র বা নীল অর্থনীতির এক অপার সম্ভাবনা। কারণ সমুদ্র উপকূল পরিবেষ্টিত পৃথিবীর অন্যান্য দেশগুলো সমুদ্র সম্পদকে কাজে লাগিয়ে পাল্টে দিয়েছে দেশের অর্থনীতি।
আন্তর্জাতিক সমুদ্র সম্পদ গবেষকরা বহুকাল আগে থেকেই বঙ্গোপসাগরকে বিভিন্ন ধরনের সম্পদের খনি হিসেবে চিহ্নিত করেছেন। বঙ্গোপসাগরের তলদেশে যে খনিজ সম্পদ রয়েছে তা পৃথিবীর আর কোনও সাগর, উপসাগরে নেই বলেও ধারণা অনেকের। আরো বহু বছর আগে মণি, মুক্তা, সোনা, রূপা, তামা, প্রবালসহ বিভিন্ন ধরনের মহামূল্যবান ধনরত্ন এখানে রয়েছে ধারণা করে, ভারতবর্ষের পৌরাণিকে বঙ্গোপসাগরের নাম দেওয়া হয়েছিল 'রত্নাকাগার'।
বর্তমানে বঙ্গোপসাগরের সমুদ্র সম্পদকে দুইভাগে ভাগ করা যেতে পারে। অপ্রাণিজ সমুদ্র সম্পদ ও প্রাণিজ সমুদ্র সম্পদ। অপ্রাণিজ সমুদ্র সম্পদ বলতে মূলত খনিজ ও খনিজ জাতীয় সম্পদকে বোঝায়। যার মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো তেল, গ্যাস, চুনাপাথর ইত্যাদি। খনিজ সম্পদের মধ্যে রয়েছে প্রায় ১৭ ধরনের খনিজ বালি। এর মধ্যে বেশি পরিমাণে পাওয়া যায় জিরকন, রুটাইল, সিলিমানাইট, ইলমেনাইট, ম্যাগনেটাইট, গ্যানেট, কায়ানাইট, মোনাজাইট, লিকোক্সিন ইত্যাদি। যার প্রত্যেকটি পদার্থই মূল্যবান, তবে মোনাজাইট অতিমূল্যবান পদার্থ। এই তেজস্ক্রিয় পদার্থ পারমাণবিক বোমা তৈরিতে ও পারমাণবিক চুল্লিতে শক্তি উৎপাদক হিসেবে ব্যবহৃত হয়। বাংলাদেশ আণবিক শক্তি কমিশনের তথ্যমতে, দেশের সমুদ্র সৈকতের বালিতে মোট খনিজের মজুদ ৪৪ লাখ টন এবং প্রকৃত সমৃদ্ধ খনিজের পরিমাণ প্রায় ১৭ লাখ ৫০ হাজার টন, যা বঙ্গোপসাগরের ১৩টি স্থানে পাওয়া গেছে। তাদের হিসেবে বাংলাদেশের সমুদ্রসীমা থেকে প্রায় ১০ লাখ টন খনিজ বালু উত্তোলন করা যেতে পারে। এছাড়াও বঙ্গোপসাগরের তলদেশে রয়েছে ম্যাঙ্গানিজ নডিউল, ফসফরাস ডেপোজিট, পলিমেটালিক সালফাইড, অ্যাডাপোরাইট, ক্লেসার ডেপোজিট নামক আকরিক। এইসব আকরিক পরিশোধনের মাধ্যমে পাওয়া যাবে মলিবডেনাম, কোবাল্ট, কপার, জিঙ্ক, লেডসহ ইত্যাদি দুর্লভ ধাতু। এসব ধাতু জাহাজ নির্মাণ ও রাসায়নিক কারখানায় ব্যবহার করা যাবে। বাংলাদেশ জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ বিভাগের প্রতিবেদন অনুযায়ী অগভীর সমুদ্রের তলদেশে ভ্যানাডিয়াম, প্লাটিনাম, কোবাল্ট, মলিবডেনাম, ম্যাঙ্গানিজ ক্রাস্ট, তামা, সিসা, জিঙ্ক এবং কিছু পরিমাণ সোনা ও রূপা দিয়ে গঠিত সালফাইডের অস্তিত্ব রয়েছে। ১ হাজার ৪০০ থেকে ৩ হাজার ৭০০ মিটার গভীরে এসব মূল্যবান সম্পদ রয়েছে। বঙ্গোপসাগরের প্রায় ৩০ থেকে ৮০ মিটার গভীরে সিমেন্ট শিল্পের কাঁচামাল 'ক্লে'র সন্ধান পাওয়া গেছে।
এছাড়া সম্প্রতি বঙ্গোপসাগরের অগভীর ও গভীর তলদেশে মহামূল্যবান ধাতু ইউরেনিয়াম ও থোরিয়ামের অস্তিত্ব পাওয়া গেছে। আর বাংলাদেশের পাশেই প্রতিবেশী ভারত কৃষ্ণা গোধাবেরি বেসিনে ১০০ টিসিএফ গ্যাস আবিষ্কারের কথা জানিয়েছে দেশটির রাষ্ট্রীয় সংস্থা ওএনজিসি। এছাড়া বাংলাদেশের কাছাকাছি মিয়ানমারের সাগর ভাগেও পাওয়া গেছে বড় গ্যাসক্ষেত্র। এ কারণে ভূতত্ত্ববিদদের অনেকে মনে করেন, বাংলাদেশের সমুদ্র সীমায়ও বড় ধরনের গ্যাসের মজুদ থাকতে পারে। এখন পর্যন্ত বাংলাদেশ ২০১৩ সালে ভারতের রাষ্ট্রীয় কোম্পানি ওএনজিসির সাথে দুটি অগভীর ব্লকে তেল গ্যাস অনুসন্ধানে চুক্তি করেছে। তবে গতি ততটা আশাব্যঞ্জক নয়। আর অস্ট্রেলিয়ার কোম্পানি সান্তোসের সাথে গভীর ব্লক ১১ ও দক্ষিণ কোরিয়ার পোস্কো-দাইয়ুর সাথে গভীর ব্লক ১২ এর জন্য চুক্তি স্বাক্ষর হয়েছে। তবে তাদেরও দ্বি-মাত্রিক সিসমিক জরিপ ছাড়া তেমন কোন অগ্রগতি নেই।
এবার বলা যাক, প্রাণিজ সম্পদের কথা। মৎস্য সম্পদ, সামুদ্রিক প্রাণী, সামুদ্রিক আগাছা, লতা, গুল্মতেও ভরপুর বঙ্গোপসাগর। বঙ্গোপসাগরে বাংলাদেশের সমুদ্রসীমায় রয়েছে ৪টি মৎস্যক্ষেত্র। যেখানে প্রায় ৪৪০ প্রজাতির সামুদ্রিক মাছ রয়েছে বলে ধারণা করা হয়। তাছাড়া আরও আছে ৩৩৬ প্রজাতির শামুক-ঝিনুক, ৭ প্রজাতির কচ্ছপ, ৫ প্রজাতির লবস্টার, ৩৬ প্রজাতির চিংড়ি, ৩ প্রজাতির তিমি, ১০ প্রজাতির ডলফিন, প্রায় ২০০ প্রজাতির সি উইড (এক ধরনের সামুদ্রিক ঘাস) রয়েছে বলেও মনে করেন অনেক গবেষক। কিন্তু বর্তমানে মাছ ধরতে বাংলাদেশের জেলেরা দেশী নৌযান নিয়ে মাত্র ২০ থেকে ৫০ কিলোমিটার পর্যন্ত যেতে পারে। অর্থাৎ বাংলাদেশের জেলেদের কাছে সমুদ্রসীমার বড় একটা অংশই অজানা। ৫০ কিলোমিটারের বেশি দূরে যাবার মতো মাছ ধরার কোনও নৌযানই নেই বাংলাদেশের। এই সমস্যার সমাধান করা নিশ্চয়ই কঠিন কিছু নয়।
বঙ্গোপসাগরে আছে বিপুল পরিমাণ সামুদ্রিক আগাছা। এসব আগাছা প্রক্রিয়াজাতকরণ করে বিভিন্ন রোগের ওষুধ তৈরি করা যায়। এসব আগাছার মধ্যে ইসপিরুলিনা সবচেয়ে মূল্যবান। চীন, জাপান, ইউরোপের বিভিন্ন দেশে মানুষ এগুলোকে খাদ্য হিসেবে খেয়ে থাকে। তবে সমুদ্র সম্পদ আহরণ কিন্তু সহজ কোনও বিষয় নয়। সমুদ্রে খনিজ সম্পদ অনুসন্ধান, খনন, আহরণ সবই প্রযুক্তিগত বিষয়। তাই আজ চাইলে কালই যে সমুদ্রসম্পদ আহরণ শুরু করা যাবে তা নয়। এজন্য প্রয়োজন দক্ষ পরিকল্পনা। সরকারের পক্ষ থেকে এখন পর্যন্ত সে বিষয়ে যে যথেষ্ঠ ঘাটতি রয়েছে তা বলাই যায়। সমুদ্র বিজয়ের পরপরই ২০১৪ সালে সরকারের পক্ষ থেকে ব্লু ইকোনমি সেল গঠন করা হয়। কিন্তু এখন পর্যন্ত তাদের বলার মতো কোনও কাজ বা অগ্রগিত নেই। আবার বাংলাদেশ ব-দ্বীপ পরিকল্পনা বা ডেল্টা প্ল্যান-২১০০ মহাপরিকল্পনায় সমুদ্র অর্থনীতিকে অগ্রাধিকার দেওয়া হয়েছে। এই পরিকল্পনায় নীল অর্থনীতির সম্ভাবনা কাজে লাগাতে পাঁচ ধরনের কৌশল ঠিক করা হয়েছে, যার মধ্যে অন্যতম হলো সামুদ্রিক সম্পদের বহুমাত্রিক জরিপ দ্রুত সম্পন্ন করা। কারণ সমুদ্রের যতটা জানা, তার চেয়ে বেশী অজানা বাংলাদেশের কাছে।কোন জরিপ নেই, তাই কোন তথ্যও নেই। কিন্তু সেই জরিপ কাযর্ক্রম এখনো শুরুই করা যায়নি। ২০১৪ না হোক ২০১৫ সালে বা ২০১৬ সালেও জরিপ কার্যক্রম শুরু করা গেলেও এখন তা শেষের দিকে থাকতো। আর তা নাহলেও কিছু তথ্য তো জানা যেতই। তাহলে এখন করণীয় কি? করণীয় হচ্ছে যত দ্রুত সম্ভব স্বল্প, মধ্যম ও দীর্ঘমেয়াদী পরিকল্পনা প্রণয়ন করা। প্রয়োজনে পরে আবার বদালানো যেতে পারে। কিন্তু একটি পরিকল্পনা খুবই প্রয়োজন। সাথে আর যা প্রয়োজন তা হলো
১. একটি জরিপ কার্যক্রম দ্রুত শুরু করা, যেখান থেকে তথ্য মিলবে। জরিপের প্রয়োজনে বিদেশী দক্ষ সংস্থার পরামর্শ নেয়া যেতে পারে। এ কাজে অভিজ্ঞতা আছে এমন বিদেশী প্রতিষ্ঠানকেও স্বচ্ছতার সাথে সেই দায়িত্ব দেয়া যেতে পারে। একই সময়ে চেষ্টা করতে হবে নিজেদের সক্ষমতা বৃদ্ধিরও। এজন্য বিভিন্ন দেশের সাথে প্রয়োজনীয় জ্ঞান ও অভিজ্ঞতা বিনিময়ও খুবই গুরুত্বপূর্ণ।
২. সমুদ্র অর্থনীতিকে যারা সফলভাবে কাজে লাগাতে পারছে তেমন দেশ, যেমন ইন্দোনেশিয়া বা অস্ট্রেলিয়ার এ সংক্রান্ত গৃহীত পদক্ষেপগুলো পর্যালোচনা করে একটি সমুদ্র নীতিমালা প্রণয়ণ করা যেতে পারে। কারণ আজ হোক কাল হোক এই বিষয়ে নীতিমালা করতেই হবে।
৩. দেশের বাইরে যে বাংলাদেশিরা এইখাতে গবেষণায় ও কাজে দক্ষতার পরিচয় দিয়েছেন তাদের পরামর্শ নেয়া, প্রয়োজনে দেশে ফিরিয়ে আনার ব্যবস্থা নিতে হবে।
৪. সমুদ্র নির্ভর শিল্পের উন্নয়ন ও প্রসারে পর্যাপ্ত বাজেটও বরাদ্দ করা জরুরী।
৫. সমুদ্র বিজ্ঞানের বিকাশে দেশের বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে এ সংক্রান্ত বিভাগ খোলা ও আলাদা গবেষণাকেন্দ্র স্থাপন করার ব্যবস্থা নেয়া।
৬. বিদেশি বিনিয়োগকারিদের আহ্বান জানানোর পাশাপাশি দেশীয় শিল্পোদ্যোক্তাদের ব্লু ইকোনোমি ঘিরে শিল্প প্রতিষ্ঠায় আকৃষ্ট ও আগ্রহী করা।
৭. চীন ও জাপান এরইমধ্যে ব্লু ইকোনমিতে বাংলাদেশকে সহায়তার আগ্রহ দেখিয়েছে। তাদের পরিকল্পনার কথাও ভেবে দেখা দরকার। হয়তো আরো অনেক কিছুই প্রয়োজন কিন্তু আপাতত এটুকু খুবই প্রয়োজন। কারন কে জানে সমুদ্র বিজয়ের পর যেমন উৎফুল্ল হয়েছিল দেশবাসী, উৎসব হয়েছে দেশ; তারচেয়েও বড় উৎসব হয়তো অপেক্ষা করছে সমুদ্রের নিচে।