Published : 19 Dec 2011, 11:18 AM
শুক্রবার, ১৫ই মার্চ, নিউজিল্যান্ডের ক্রাইস্টচার্চের দুইটি মসজিদে সন্ত্রাসী হামলার পর আমি আতঙ্কিত। আমি প্রবাসে বসবাসকারী একজন মুসলমান। আমি মসজিদে নামাজ পড়তে যাই। ক্রাইস্টচার্চের দুইটি মসজিদে সন্ত্রাসী হামলার পর আমি মসজিদে যাওয়ার সময় এদিক ওদিক দেখতে দেখতে সতর্কভাবে যাই। নামাজের নিঃশব্দতার ভিতর বাইরের কোনও শব্দ কানে এলেই আমি আঁতকে উঠি। আমাদের স্ত্রী কন্যারা হিজাব পরে বাইরে যায়, শপিং সেন্টারে যায়, আমি ভীত থাকি। আমার মনে হয় মসজিদে, মজলিসে নিউজিল্যান্ড-এর ক্রাইস্টচার্চ মসজিদে শ্বেতাঙ্গ হামলাকারী ব্রেন্টন ট্যারেন্ট-এর স্বয়ংক্রিয় বন্দুকের নল ওঁৎ পেতে আছে। স্কুল কলেজে, পথে ঘাটে, শপিং এ আমাদের স্ত্রী পুত্র কন্যাদের অনুসরণ করছে। আমি আতঙ্কে থাকি। আমি আতঙ্কিত নিরীহ শান্তিপ্রিয় অমুসলিমদের জন্যও হয়েছে। মনে সবসময় ভয়, উৎকণ্ঠা, অচিরেই আরও সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ড ঘটবে, ভয়াবহ, বর্বোরোচিত হামলা। এমনও মনে হয়, এবার কোনো মসজিদে নয়, হামলা হবে অন্য ধর্মালম্বী কোনও জনগোষ্ঠির উপরে, তাদের কোনও ধর্মশালায়, বা অন্য কোথাও।
ক্রাইস্টচার্চের সন্ত্রাসী হামলার পর নিউজিল্যান্ডের প্রধানমন্ত্রী জেসিন্দা অডের্ন কখনও হিজাব পরে মসজিদ প্রাংগনে বক্তৃতা দিয়েছেন, হিজাব পরেই নিজেদের পার্লামেন্টে যোগ দিয়ে নতুন করে অস্ত্র আইন পাশ করার পরিকল্পনা করেছেন । কখনও সন্ত্রাসী হামলায় স্বামী ও তিন বছরের শিশুপুত্র হারানো ক্রন্দনরত মাকে বুকে জড়িয়ে নিজেও কেঁদেছেন। টিভি রেডিওতে আজান প্রচারের ব্যবস্থাও তারই মাথায় এসেছে। অক্লান্তভাবে ছুটে বেড়িয়েছেন। ক্রাইস্টচার্চের একটি স্কুল পরিদর্শনে গিয়ে স্কুলেরই একজন বাচ্চা ছেলের প্রশ্নের জবাবে তিনি আবেগময় হয়ে ওঠেন। স্কুলের ছোট ছোট ছেলেমেয়েদের অনেক প্রশ্নের জবাব দেন তিনি। সবশেষে বারো-তের বছরের এক ছেলে । ছেলেটি খুব ধীরে মায়াভরা গলায় নিউজিল্যান্ডের প্রধানমন্ত্রীকে জিজ্ঞাসা করেছিল, "তুমি কেমন আছ"? প্রধানমন্ত্রী থমকে যান। অনেকক্ষণ চুপ থেকে ছলছল চোখে বলেছিলেন, "আমি কেমন আছি? একটু থেমে বলেছিলেন, "ধন্যবাদ আমাকে এই প্রশ্ন করার জন্যে। আমি অত্যন্ত মর্মাহত!" তিনি আসলেই ভালো ছিলেন না। স্কুল শিক্ষার্থীদের উদ্দেশ্যে বলেছিলেন, "বিশ্বের একজন মুসলমানের ওপর হামলা মানে সকল মুসলমানের ওপর হামলা। একজন নিরপরাধ মানুষের ওপর হামলা মানে পুরো মানবজাতির ওপর হামলা। আমি ভালো থাকি কী করে?"
হপার্স ক্রসিং, মেলবোর্নের দক্ষিণ-পশ্চিমের একটা উপশহর। এখানে বাংলাদেশি সহ প্রচুর মুসলমানের বসবাস। এই এলাকায় কয়েকটা মসজিদ আছে, ইসলামিক স্কুল আছে। ক্রাইস্টচার্চ ঘটনার অব্যবহিত পর পরই এই এলাকার একটি মসজিদে জুম্মার নামাজের জন্যে মুসল্লিরা জড়ো হচ্ছে। নামাজের খুৎবা শুরু হবে। বেশ কিছু মুসল্লি মসজিদের বাইরে যত্রতত্র ছডিয়ে ছিটিয়ে আলাপ আলোচনা করছে। হঠাৎ মসজিদ চত্বরে দুইটা গাড়ি এসে থামলো। একটি গাড়ি থেকে এক মহিলা ও তার পুরুষ সঙ্গী নেমে এলো। সাথে দুটি ছোট ছোট বাচ্চা। দশ/এগারো বছরের ছেলে আর সাত/আট বছরের একটি মেয়ে। অন্য গাড়ি থেকেও নেমে এলো এক মহিলা ও তার পুরুষ সঙ্গী- সাথে সাত/আট বছরের একটি মেয়ে । বাচ্চাগুলোর গলায় কার্ডবোর্ডের কাগজে মোটা হরফে লেখা- "We did not do this" !
বাচ্চাগুলোর প্রত্যেকের মুখ থমথমে, মনে হচ্ছে এখনই কেঁদে ফেলবে। বড়দের ভিতর থেকে একজন এগিয়ে এসে সামনের মুসল্লিকে বললেন- "আমরা দুই পরিবারই নিউজিল্যান্ডের অধিবাসী। মেলবোর্নে বেড়াতে এসেছি। আমাদের বাচ্চাগুলো ক্রাইস্টচার্চের ঘটনায় বিমর্ষ হয়ে পড়েছে আর নিউজিল্যান্ডার হওয়াতে নিজেদের দোষী মনে করছে । আমাদের বাচ্চারা তোমাদের কাছে মাফ চাইতে এসেছে, সেই সাথে আমরাও। We are really sorry"!
ক্রাইস্টচার্চ মসজিদে হামলার ঘটনায় অস্ট্রেলিয়ার সিনেটর ফ্রেজার অ্যানিংয়ের মাথায় ডিম ফাটিয়ে প্রতিবাদ জানিয়েছেন ১৭ বছরের অস্ট্রেলিয়ান তরুণ উইল কনোলি। মেলবোর্নের দক্ষিণ-পূর্ব প্রান্তের একটি উপশহর, নাম মুরাবিন। শনিবার ১৬ই মার্চ, এই উপশহরে সংবাদ সম্মেলনে কথা বলার সময় কট্টর এ অস্ট্রেলিয়ান সিনেটরের মাথায় ডিম ফাটিয়ে প্রতিবাদ জানান কনোলি। শুধু তাই নয় সেই তরুণ তার সংগৃহীত সমস্ত অর্থ নিয়ে ক্ষতিগ্রস্তদের পাশে দাঁড়ানোর ঘোষণা দিয়েছেন।
ক্রাইস্টচার্চের আক্রান্ত মসজিদ দুইটিতে যখন মুসুল্লিরা নামাজ পড়ছিলেন, তখন মসজিদের বাইরে নিরাপত্তা দিয়েছে স্থানীয় তিনটি বাইকি গ্যাং। স্থানীয় নারীরা মাথায় হিজাব পরে নারীদের নামাজের জায়গা পাহারা দিয়েছেন। নিউজিল্যান্ডে মসজিদে হামলার ঘটনার পর যুক্তরাজ্যের মুসলমানদের প্রতি বন্ধুত্বের বার্তা নিয়ে পাশে দাঁড়িয়েছেন অ্যান্ড্রু গ্রেস্টোন নামের এক ব্রিটিশ নাগরিক। যুক্তরাষ্ট্রের ক্যালিফোর্নিয়ার একটি মসজিদে নামাজের সময় পাহারার ব্যবস্থা করেছে স্থানীয় অমুসলিমরা।
নাইন ইলেভেন-এর পর বোধহয় এই প্রথম ইসলাম ধর্মাবলম্বী জনগোষ্ঠি বিশ্ব নেতাদের, বিশ্ব মিডিয়ার সহানুভূতির কথা শুনতে পারল। বিশ্ববাসীর সহানুভূতি বুক ভরে অর্জন করল। নাইন ইলেভেনের পর মুসলমানদের প্রতি এরকম সহানুভুতি, সহমর্মিতার হাত প্রসারিত হতে আগে দেখা যায়নি। নিরীহ মুসলিমদের হত্যাকাণ্ডের দৃশ্য দেখে, বিশ্বজুড়ে লাখ লাখ মানুষের মন ভেঙ্গে গেছে। নিউজিল্যান্ড ও বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্তের হাজার হাজার মানুষের চোখে ভালবাসা, সহানুভূতি, সৌহার্দ্য আর সহমর্মিতায় মুসলিম বিশ্বের সাধারন নিরীহ মানুষ আবেগিত, সেই সাথে উৎকণ্ঠিত- নিউজিল্যান্ডের প্রধানমন্ত্রী জেসিন্দা অডের্ন ও বিশ্ববাসীর সহানুভূতি কতদিন ধরে রাখতে পারবে!
মুসলিমদের প্রতি যে সমস্ত অমুসলিমদের অবিশ্বাস সেই মানুষেরা, সেই সাথে মুসলিম বিদ্বেষীরা কেমন ছিল ক্রাইস্টচার্চের ঘটনার পর? তারাও কি প্রধানমন্ত্রী জেসিন্দা আডের্ন এর মতো ভালো ছিল না? তাদেরও কী মন ভারাক্রান্ত ছিল? বিশ্বজুড়ে লাখ লাখ মানুষের মতো তাদেরও কী মন ভেঙ্গে গিয়েছিল? তখনও রক্তের দাগও হয়ত শুকায়নি নিউজিল্যান্ডের ক্রাইস্টচার্চের মসজিদে। অস্ট্রেলিয়ার কুইন্সল্যান্ড অঙ্গরাজ্যের সিনেটর ফ্রেজার অ্যানিং মসজিদে হামলার ঘটনায় মুসলিম অভিবাসীদের দায়ী করে বিবৃতি দিয়েছিলেন । ঘৃণা ছড়িয়ে দিয়ে, বিদ্বেষ জারি রেখে এরা আবার নতুন করে একটি সন্ত্রাসী হামলার বীজ বুনে দেয় উদ্ভট মন্তব্য করে।
ইসলামোফোবিয়া বা ইসলাম বিদ্বেষ হন্তারক। মুসলমানেরা আগেও এর শিকার হয়েছে। অস্ট্রেলিয়া সহ কানাডা, নরওয়ে, যুক্তরাজ্য, যুক্তরাষ্ট্র এবং বিশ্বের বিভিন্ন দেশেই ইসলাম বিদ্বেষের শিকার হয়েছেন অনেক মানুষ। এবং প্রতি নিয়তই হচ্ছে। বিশেষ করে নাইন ইলেভেন এর পর মুসলিম বিশ্বের দেশগুলোর যেকোনও দুর্বলতা গণমাধ্যমে ফলাও করে প্রচার হয়। কেন? ইসলাম বিদ্বেষ বিশ্বব্যাপি ছড়ানোর জন্যে। বিশ্ব রাজনীতির নোংরা কুচক্রে, মুসলিম বিদ্বেষীদের উস্কানিতে বিপথগামী উগ্র ইসলামপন্থিদের প্রলোভনে ও প্ররোচনায় আজ উগ্রপন্থীদের কাতারে মেধাবী, চৌকস মুসলিম তরুণ তরুণীরা যোগ দিচ্ছে, এই খবর গণমাধ্যমে ফলাও করে প্রচার হয়! কিন্তু কাদের উস্কানিতে যোগ দিচ্ছে সেই খবর প্রচারিত হয় না! কলিজার টুকরো এই সোনা মানিকদের চিরতরে হারিয়ে তাদের বাবা মায়ের হৃদয়ের রক্তক্ষরণ প্রচার হয় না। এই বুদ্ধিদীপ্ত নবীনদের অকালে হারিয়ে ইসলাম ধর্ম আর এই ধর্মের জনগোষ্ঠির, সর্বোপরি বিশ্বের ভবিষ্যৎ প্রজন্মের যে অপূরণীয় ক্ষতি হচ্ছে তা কেউ নিরূপন করে না। না ওরা, না আমরা। এরা হয়তো ভবিষ্যতে তাদের উজ্জ্বল পেশাগত দায়িত্বের পাশাপাশি ইসলামের নাম করা আলেম হতে পারতো। এদেরকে হারিয়ে ইসলাম ধর্মের যে কি পরিমাণ ক্ষতি হচ্ছে তা কি কেউ বুঝতে পারছেন না! ভবিষ্যতের ইসলাম যে ক্রমান্বয়ে মেধাশুন্য হয়ে পড়ছে, এই গভীর চক্রান্তের মুল কি কেউ বুঝতে পারছেন না?
ইরানে নিউক্লিয়ার বিজ্ঞানী গুপ্ত ঘাতকের গুলিতে নিহত হন। দুবাইতে আততায়ীর হাতে নিহত হন প্যালেস্টাইনের রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব! মুসলিম বিশ্বের যে দেশগুলোই, একটি বিশেষ দেশের তাবেদার দেশগুলো ছাড়া, সমৃদ্ধির পথে এগিয়ে যাচ্ছে, অর্থনীতি, শিল্প, বিজ্ঞান, ঐতিহ্যে এগিয়ে যাচ্ছে, তখনই তাদের ছিন্নভিন্ন করে ফেলা হচ্ছে। লিবিয়া ইরাক সিরিয়া তার জলন্ত প্রমাণ। প্যালেস্টাইনে কোনও ইসলামি স্কলার, বুদ্ধিজীবি তরুণ বিজ্ঞানী বেশিদিন বেঁচে থাকতে পারেন না। আততায়ীর হাতে শেষ হয়ে যান। মধ্যপ্রাচ্যের সমৃদ্ধশালী দেশগুলোকে ছিন্ন ভিন্ন করা গেছে। তরুণ মেধাবী প্রজন্ম নিয়ে এখন আর ভয়ের কিছু নেই। সবকিছু নিয়ন্ত্রণে। এই অবস্থায়, মুসলিম জনগোষ্ঠির উপর সহানুভূতি, সহমর্মিতা! অসম্ভব ব্যাপার!
অবশেষে ঘটেই গেল, ঘটানো হলো শ্রীলঙ্কায়। গত রোববার ২১শে এপ্রিল, ক্রাইস্টচার্চ ঘটনার প্রায় পাঁচ সপ্তাহ পর, শ্রীলঙ্কার স্থানীয় সময় ৮টা ৪৫ মিনিটে তিনটি হোটেল ও গির্জায় চারটি বোমা হামলা হয়। পরের ২০ মিনিটে আরও দুটি বোমা হামলা হয়। বিকেলের দিকে চতুর্থ হোটেল ও একটি বাড়িতে বোমা হামলা হয়। পুলিশের তথ্যের বরাত দিয়ে এএফপি জানিয়েছে, হামলায় নিহত মানুষের সংখ্যা ৩২১ জনে পৌঁছেছে। আহত হয়েছে আরও পাঁচশ জন । শ্রীলঙ্কান কর্তৃপক্ষ এখনও নিশ্চিতভাবে বলতে পারছেন না সঠিক কারা এই হামলা ঘটিয়েছে! কাদের প্ররোচনায় ঘটানো হয়েছে। শ্রীলঙ্কার প্রেসিডেন্ট মাইথ্রিপালা সিরিসেনা এই হামলার পেছনে আন্তর্জাতিক চক্রের যোগসূত্র থাকার ইঙ্গিত করেন। তার কার্যালয় থেকে এক বিবৃতিতে বলা হয়, "গোয়েন্দা প্রতিবেদন ইঙ্গিত করছে যে এই হামলার ঘটনায় স্থানীয় সন্ত্রাসীদের পেছনে বিদেশি সন্ত্রাসী গোষ্ঠী রয়েছে।"
সামগ্রিকভাবে মনে হচ্ছে, এটা এমন কোনো তৃতীয় শক্তি করেছে, যা পুরোদস্তুর একটা সন্ত্রাসী হামলামাত্র। যদিও দায়িত্ব স্বীকার করেছে আইএস। তবে ভারতীয় ও শ্রীলঙ্কার কিছু সূত্র হামলার পেছনে 'ন্যাশনাল তৌহিদী জামাত (এনটিজে) নামে স্থানীয় একটি মুসলমান প্রধান সংগঠনের দিকে ইঙ্গিত করলেও তারা বিষয়টি অস্বীকার করছে এবং হামলাকারীদের খুঁজে বের করে কঠোর শাস্তির দাবি তুলেছে। বিবিসির সাংবাদিক আনবারাসান এথিরাজন বলেন, এই হামলার মাত্রা, এর ধরন, সময় নির্ধারণ সবকিছু এর সঙ্গে বিদেশি যোগসূত্রের ইঙ্গিত দেয়। ন্যাশনাল তৌহিদী জামায়াত জড়িত কি না, তা এখনও স্পষ্ট নয়, তবে তারা যদি জড়িত থাকেও তাদের সঙ্গে আন্তর্জাতিক কোনো গোষ্ঠী ছিল। বেশ কিছু মিডিয়াতে শ্রীলঙ্কায় এই হামলার কারণ আর কারা জড়িত তা "ধোঁয়াশার চাদরে ঢাকা" মন্তব্য করলেও, নিরীহ সাধারণ মানুষ বুঝতে পারছে, তা কেন করা হয়েছে।
মুসলিম বিদ্বেষীরা তৎপর ছিল! ক্রাইস্টচার্চের ঘটনায় বিশ্ববাসীর সহানুভূতি আর সহমর্মিতায় তারা নির্ঘুম রাত কাটাচ্ছিল। তাদের বেশি কিছু করার প্রয়োজন ছিল না। তাদেরই তৈরি কোনো একটা জঙ্গি গ্রুপকে অর্থ, অস্ত্র ক্ষমতা দেওয়ার প্রলোভন দেখিয়ে উসকে দিতে পারলেই হলো। এটা কোনো কঠিন বিষয় না! তাই শঙ্কা ছিল আমাদের সাধারণ মানুষদের ভিতর, যদি এমন কোনো ঘটনা সহসাই ঘটে যায়! বিশ্ববাসীর সহানুভূতিকে নসাৎ করতে যদি মুসলিম বিদ্বেষী কোনও দেশ বা গোষ্ঠি কোনও একটা উগ্রজঙ্গি গোষ্ঠিকে ব্যবহার করে এরকম একটা সর্বনাশা কাণ্ড ঘটিয়ে ফেলে! যদি সর্বনাশা কাণ্ড ঘটে যায়, নিউজিল্যান্ডের কোনো একটা চার্চে, বা স্কুলে, কিংবা ট্রেনে, বাসে বা শপিং মলে, কিংবা অস্ট্রেলিয়ার কোথাও, বা যুক্তরাজ্যে অথবা অন্য কোনো একটা পশ্চিমা দেশে, অথবা অন্য কোনও দেশে! তখন নিউজিল্যান্ডের প্রধানমন্ত্রী জেসিন্দা অডের্ন বিশ্ববাসীকে কী জবাব দেবেন! কাদের পাশে গিয়ে দাঁড়াবেন? তিনি যে জোর গলায় বলছেন, "আপনাদের বলতে চাই, মুসলমানরা সন্ত্রাসী নয় এবং সন্ত্রাসবাদের কোনও ধর্ম নেই। মুসলমানদের যারা সন্ত্রাসী সম্প্রদায় মনে করে, তাদের মাথা অ্যানিংয়ের মতোই শূন্য"।
মুসলিম বিশ্বের জনগোষ্ঠির বিরুদ্ধে অপপ্রচার, ভাবমূর্তি নসাৎএর ষড়যন্ত্র এর জন্যে কি শুধুই মুসলিম বিদ্বেষীরা দায়ী? বিশ্ব রাজনীতির নোংরা কুচক্রেরই কারসাজি? মুসলিম বিশ্বের সাধারণ মানুষদের প্রতি বিশ্ববাসীর সহানুভূতি অর্জনে নিউজিল্যান্ডের প্রধানমন্ত্রীর ভূমিকা অনস্বীকার্য। তিনি নিজে অমুসলিম হয়েও মুসলিমদের প্রতি বিশ্ববাসীর সহানুভূতি অর্জনে সোচ্চার হয়েছেন, প্রতিবাদী হয়েছেন। মুসলিম বিশ্বের নেতারা, পণ্ডিতেরা তারাই বা কি করেছেন বা করছেন এই অপপ্রচার রোধে, ভাবমূর্তি নস্যাৎ এর ষড়যন্ত্র প্রতিরোধে? আমরা জানতাম ক্রাইস্টচার্চের ঘটনার পর বিশ্বব্যাপি মুসলিমদের প্রতি যে সহানুভূতি সৃষ্টি হয়েছে তা নস্যাৎ করবেই কেউ না কেউ! এই বোধোদয় আমাদেরকে কতটুকু সচেতন করেছে, সংশোধিত করেছে? যখন ইন্দোনেশিয়ার বালি দ্বীপে, অথবা এই শ্রীলঙ্কায় জঘন্য বর্বোরচিত আক্রমণ নিরীহ অমুসলিমদের উপর হচ্ছে, তখন আমরা মুসলমানেরা কতদূর তাদের দিকে সহমর্মিতা আর সৌহার্দ্যের হাত প্রসারিত করে এগিয়ে যাই বা গেছি!
ওয়েস্টার্ন অস্ট্রেলিয়ার পার্থের ৫২ বৎসর বয়সী পিটার হিউ ইন্দোনেশিয়ার বালি কোর্টে সাক্ষীর কাঠগড়ায় দাঁড়িয়ে যখন তার ও তার সঙ্গীদের ভয়াবহ মরণ যন্ত্রণার কথা বর্ণনা করছিল, কোর্টরুমের প্রতিটা মানুষের চোখ ভিজে উঠেছিল। ইন্দোনেশিয়ার বালি দ্বীপের পর্যটন সমৃদ্ধ কুটা জেলায় ২০০২ এ সংগঠিত হয় ভয়াবহ বোমা বিস্ফোরণ । এই আক্রমণের ঘটনায় ২০২ নিরীহ ব্যক্তি নিহত হন যাদের মধ্যে ৮৮ জন অস্ট্রেলিয়, ৩৮ জন ইন্দোনেশিয় এবং অবশিষ্টরা বিশ্বের ২০টিরও অধিক দেশের অধিবাসী। এতে আরও ২০৯ জন আহত হন।
ওই বিস্ফোরণে সুঠাম দেহের সুপুরুষ পিটারের শরীরের ৬০ ভাগ দগ্ধ হয়ে যায়, বাম হাত শরীর থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে যায়। শুধু চোখ দুটি খোলা রেখে সমস্ত শরীর ব্যান্ডেজে মোড়া অবস্থায় তাকে এক বৎসরের অধিক কাল হাসপাতালের বিছানায় শুয়ে কাটাতে হয়। স্থবির অবস্থায়। পুরোপুরি সুস্থ হতে তার দশটি বছর লেগে যায় । নিজের জীবন মৃত্যুর সাথে সংগ্রামের কাহিনি নয়, তার মুখে যে কাহিনিটি শুনে কোর্ট ভরা মানুষ ঝর ঝর করে কেঁদে ফেলে তা ২২/২৩ বছরের একটি তরুণীকে নিয়ে।
পিটার বোমা বিস্ফোরণের ধ্বংসস্তুপের নিচে পড়ে আছে, অদূরেই দাউ দাউ করে আগুন জ্বলছে। নিজের উঠে বসার ক্ষমতা নেই। পাশেই দেখে একটি তরুণী উঠে দাঁড়ানোর আপ্রাণ চেষ্টা করছে। মেয়েটির দুই হাত শরীর থেকে বিচ্ছিন্ন। ডান পা ভেঙ্গে গেছে। একটি চোখ কোটর থেকে বেরিয়ে এসেছে। আর একচোখের ভিতর দিয়ে রক্ত পড়ছে। মেয়েটি ভাঙা গলায় চিৎকার করছে, "এনি বডি হিয়ার! প্লিজ হেল্প মি! আই কান্ট সি"! বিস্ফোরিত হলো আরও শক্তিশালী দ্বিতীয় বোমাটি। পিটার জ্ঞান হারিয়ে ফেলে।
সেই ২০০২ সালের ঘটনা, অনেক কিছুই বিস্মরণ হয়েছে। তাই হয়ত মনে পড়ে না বালির এই ঘটনার অব্যবহিত পরপরই মুসলিম বিশ্বের কোনও নেতা অথবা খোদ ইন্দোনেশিয়ার প্রেসিডেন্ট বা ভাইস প্রেসিডেন্ট ওই নিহত, আহতদের কাছে গিয়ে, তাদের বাবা মা আপনজনদের পাশে দাড়িয়েছিল কি-না, বুকে জড়িয়ে ধরেছিল কি-না। ওই ঘটনার সময়ও ইন্দোনেশিয়ার প্রেসিডেন্ট ছিলেন একজন নারী, প্রেসিডেন্ট সুকর্নের মেয়ে মেগাওয়াটি সুকার্নোপুত্রী। যতদুর মনে পড়ে প্রচণ্ড সমালোচনার রোষানলে পড়ে তিনি এলাকায় একটা সংক্ষিপ্ত পরিদর্শন দেন, তার হাঁটা-চলা, কথা-বার্তায় স্পটতই মনে হয়েছিল, "না এলেই নয়, তাই এসেছি"।
প্রতিশোধ কখনও শান্তি বয়ে আনতে পারে না। বরং বিশ্বশান্তি, সৌহার্দ্য, সম্প্রীতি, একাত্মতা ভেঙ্গে খান খান করে ফেলে, ছিঁড়েখুঁড়ে ফেলে। মহানবীর (সা.) মক্কা বিজয়ের সময় তার চিরশত্রুরা ভেবেছিল তিনি বোধ হয় উপযুক্ত প্রতিশোধ নিবেন। প্রায়শ্চিত্তের ভয়ে শত্রুদেরও প্রাণ ছিল ওষ্ঠাগত। কিন্তু সকল জল্পনা-কল্পনার অবসান ঘটিয়ে রাসূলুল্লাহ (সা.) তাদের জন্য ঘোষণা করলেন কালজয়ী ও ঐতিহাসিক সাধারণ ক্ষমা। নবীজির (সা.) শিক্ষা আমরা বুঝি, সাধারণ ধর্মপরায়ন মানুষেরা বোঝে । আর তাই ক্রাইস্টচার্চে মসজিদে হামলার ঘটনায় নিহত হোসনে আরা পারভীনের স্বামী ফরিদ উদ্দিন তার স্ত্রীর হত্যাকারীকে ক্ষমা করে দিয়েছেন। নিউজিল্যান্ড হেরাল্ডকে দেওয়া এক সাক্ষাতকারে তিনি এ কথা জানিয়েছেন। তিনি বলেন, "তার (হত্যাকারী) জন্য প্রার্থনা করি, আল্লাহ তাকে সঠিক পথ দেখাবেন"।
একতরফা ভালোবাসা, সহানুভূতি কখনও দীর্ঘস্থায়ী হয় না। আমাদেরকেও এদের বিপদে দুর্যোগে, এদের পাশে গিয়ে দাঁড়াতে হবে। সহানুভূতির দুহাত বাড়িয়ে বুকে জড়িয়ে ধরতে হবে। সারা পৃথিবীর অমুসলিম লোক যেভাবে নিউজিল্যান্ডের নিরীহ মুসলিমের মৃত্যুতে শোক প্রকাশ করছে, যেভাবে সমব্যাথী হচ্ছে, মুসলিমদেরও এ থেকে শেখা উচিত। অমুসলিমদের নৃশংসভাবে হত্যা করা হলে মুসলিমদেরও এভাবে শোক প্রকাশ করা উচিত, এভাবে সমব্যথী হওয়া উচিত। এখন সময় শ্রীলঙ্কার মানুষদের পাশে গিয়ে দাঁড়ানোর। তাদের প্রতি সহানুভূতির, সহমর্মিতা আর সৌহার্দ্যের হাত বাড়িয়ে দিতে হবে। তাদের সাথে একই কাতারে দাঁড়িয়ে বিশ্বের সন্ত্রাসীদের, সন্ত্রাসী কর্মকান্ডের মদদ দাতাদের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়াতে হবে, প্রতিরোধ করতে হবে। সন্ত্রাসীদের কোনও ধর্ম নেই। এরা বিশ্বমানবতার জঞ্জাল, জঙ্গল, এদেরকে সমুলে উৎপাদন করতে হবে। নবীজির শিক্ষা বুঝতে পারেন না মুসলিম বিশ্বের নেতারা, উগ্রপন্থীরা, তথাকথিত ইসলামের পণ্ডিতরা। তাই হয়ত তুরস্কের প্রেসিডেন্ট এরদোগান এর মতো ব্যক্তিত্বও হুংকার দেন, "ওদেরকে আমরা কফিনে পাঠাবো, যেমন পাঠিয়েছিলাম তাদের পিতা-পিতামহদের দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় গ্যালিপলিতে"।
সহানুভূতি, সহমর্মিতা সমঝোতার চেয়ে কফিনে পাঠানোটাই বোধহয় সব সমস্যার সমাধান হয়ে পড়ে অনেকের কাছে। আর এই সহজ সমাধানের জন্যে নিজেদের মানুষকে মেরে ফেলতেও দ্বিধায় পড়তে হয়না। তথ্যে প্রকাশ, অন্যান্য সন্ত্রাসী বোমা বিস্ফোরণে নিহত ছাড়াই শুধু মসজিদে নামাজ পড়তে এসে ২০০১-২০১৭ পর্যন্ত নিজেদের সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ডে পাকিস্তানে ৩৫ হাজার মানুষ নিহত হয়েছে ।
মধ্যপ্রাচ্যের একটি শক্তিশালী মুসলিম দেশ যারা ইসলাম ধর্মের অন্যতম রক্ষক বলে দাবী করে আসছে এবং এই দাবী প্রতিষ্ঠাও করে ফেলেছে, এদের কর্মকাণ্ডের ফিরিস্তি দেওয়ার প্রয়োজনই নেই। মধ্যপ্রাচ্যের অনেক নিরীহ মুসলিম দেশেই পশ্চিমা শক্তি নয়, এই শক্তিশালী মুসলিম দেশটি একটি ত্রাসের নাম। ক্রাইস্টচার্চ ঘটনায় পৃথিবীর মোটামুটি সমস্ত দেশেরই সমবেদনা বিবৃতি এমনকি ভ্যাটিকান সিটির বিবৃতিও চোখে পড়েছে কিন্তু এই শক্তিশালী মুসলিম দেশটির কোনো সমবেদনা বিবৃতি চোখে পড়েনি।
মুসলিম বিদ্বেষ বা ইসলাম বিদ্বেষ আজ পশ্চিমা বিশ্বে ব্যাপক। এর জন্য যেমন অনেক পশ্চিমা দেশের রাজনৈতিক চক্রান্ত দায়ী, তেমনি ভাবেই দায়ী ইসলামের কিছু তথাকথিত রক্ষকদেশ, আর উগ্রপন্থী জঙ্গিরা। প্রবাসে আমরা যারা বসবাস করছি, তারা হাড়ে হাড়ে টের পাচ্ছি মুসলিম ধর্মের জনগোষ্ঠিকে পশ্চিমারা কিভাবে সন্ত্রাসবাদীদের সাথে সমার্থক শব্দ করে ফেলেছে। মুসলিম বিশ্বের অনেক নেতা, আলেমরা প্রায়ই একটি বা দুইটি দেশের নাম নিয়ে বা একটি বা দুইটি দেশের ভিন্ন ধর্মালম্বীদের নাম নিয়ে বলেন, তারা এগুলো করাচ্ছে। কিন্তু এই নেতারা, ইসলামী 'আলেম'রা হয়ত জানেন না, বা উপলব্ধি করেন না যে আমাদের সন্তানেরা, আমাদের নবীনেরা, পশ্চিমা কিশোর কিশোরী, বালক বালিকা তরুণ, তরুণী, এরা ধর্মের আর্ন্তজাতিক রাজনীতি, চক্রান্ত বোঝেনা, মাথা ঘামায় না। নবীনেরা দেখছে কারা করছে, তারা দেখছে না কারা করাচ্ছে ! এই নবীনদের ভুল ভাঙানোর, তাদের সামনে সত্য তুলে ধরার দায়িত্ব আমাদের প্রবীণদের। আমাদের এই প্রবীণদের সেদিকে ভ্রূক্ষেপ নেই, তাকানোর অপরিহার্যতা নেই। তাছাড়া এই প্রবীণদের ধৈর্য নেই, দূরদর্শিতা নেই। এই প্রবীণদের কাছে কখনই মনে হবে না যে আমাদেরও আত্মশুদ্ধির প্র্রয়োজন আছে। । মনে হলেও এই পন্ডিতেরা কখনই তা স্বীকার করবেন না!
আশার কথা ক্রাইস্টচার্চের ঘটনায় উইল কনোলিরা জেগে উঠেছে! শ্রীলঙ্কার ঘটনায় হাজারও উইল কনোলি জেগে উঠবে, রুখে দাঁড়াবে। সাধারণ নিরীহ মানুষদের একমাত্র ভরসা, শুধু অস্ট্রেলিয়ার নয়, মুসলিম-অমুসলিম সারা বিশ্বের উইল কনোলিরা। উইল কনোলিরা বুঝতে শিখছে বিশ্ব রাজনীতির পরিহাস, নোংরা কুচক্র, পথভ্রষ্ট ধর্মীয় উগ্রবাদ, স্বার্থান্বেষীদের ষড়যন্ত্র!
আমাদের আশা উইল কনোলিরা এমন ঘটনা আর হতে দেবে না। তারা এখন সোচ্চার, তারাই এখন বিশ্বসমাজে একে অন্যের প্রতি সৌহার্দ্য, সহমর্মিতা, সম্প্রীতি আর বিশ্বশান্তি প্রতিষ্ঠার অগ্রদুত! সন্ত্রাস, উগ্র ধর্মীয় ও বর্ণগত মতবাদ, সংকীর্ণ জাতীয়তাবাদী ধারণার বিরুদ্ধে বিশ্ববাসীকে ঐক্যবদ্ধ সংগ্রাম তারাই চালাবে । অবিশ্বাস, ঘৃণা ও প্রতিহিংসায় নয়- মৈত্রী, সহিষ্ণুতা ও ভালবাসার বিশ্ব গড়ে তোলার দায়িত্ব নিতে এরা এগিয়ে আসছে! পৃথিবীর সমস্ত উইল কনোলিদের বুকে বেজে উঠুক বাংলার মধ্যযুগের এক কবি চণ্ডীদাস এর মানব-ইতিহাসের সর্বশ্রেষ্ঠ মানবিক বাণী- 'সবার উপরে মানুষ সত্য, তাহার উপরে নাই"।