Published : 06 Mar 2019, 06:21 PM
রাজনীতি ও সমাজ বিচ্ছিন্ন কিছু না। আমাদের বেলায় আরো সত্য । বলতে গেলে রাজনীতিই সমাজকে আচ্ছন্ন করে রেখেছে। আজকাল মিডিয়া রাজনীতির বাইরে কিছু বুঝতে চায় না। আপনি মানুন আর না মানুন, দেশে রাজনীতি থাকুক আর না থাকুক মিডিয়া তার বাইরে কিছু চিন্তাই করতে পারেনা। জনগণ কতটা চিন্তা করে বা আদৌ করে কি না সেটা বোঝা মুশকিল। সাধারণ মানুষদের এক বিরাট অংশ রাজনীতি বিমুখ। আবার যেকোনও ঘটনায় মানুষের সবেগ আপ্রাণ অংশগ্রহণ আমাদের চমকে দেয়। মনে হয় তারা রাজনীতি ভোলে নি। তাদের অন্তরে জেগে আছে শুদ্ধ রাজনীতির সঠিক ধারা। সৈয়দ আশরাফের মৃত্যুর পর তার জন্য মানুষের শোক জানাজায় ঢল প্রমাণ করে রাজনীতিতে ভালো মানুষের মৃত্যু নাই। দল-মত-ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে তার জানাজায় লাখো মানুষ হাজির হয়ে জানিয়ে দিয়েছিলেন তারা তাকে কত ভালোবাসেন।
সৈয়দ আশরাফের পর আওয়ামী লীগের সম্পাদক হয়েছেন ওবায়দুল কাদের। তার নাম জানি সেই ছাত্রবেলা থেকে। চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র সংসদ নির্বাচনে ছাত্রলীগের হয়ে প্রচার ও সমর্থন জানাতে এসেছিলেন চুন্নুকে সাথে নিয়ে। এখন আর কাদের ভাইয়ের সাথে একত্রে উচ্চারিত না হলেও বাহলুল মজনুন চুন্নু ছিলেন অসম্ভব জনপ্রিয়। কাদের-চুন্নু প্যানেল ডাকসুতে পরাজিত হলেও তাদের নাম ছড়িয়ে পড়েছিল সারাদেশে। সেই তাদেরকে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের আলাওল হলে সারা রাত আটকে রেখেছিল জাসদের লোকজন। পরদিন ক্যাম্পাসে গিয়ে দেখি তারা স্লোগান দিয়ে মিছিল করছে: "আলাওলের ভিতরে কাদের চুন্নু কাঁদে রে"। তারপর কত জল গড়ালো। কাদের ভাই নেতা থেকে বড় নেতা হলেন। যখন তিনি মন্ত্রী হননি ফেইসবুকে সচল ছিলেন খুব। সে সময় মাঝে মাঝে কথা হতো। দু একটা বিষয়ে আমার লেখা নিয়ে আপত্তিও জানিয়েছিলেন ইনবক্সে।
মন্ত্রী হবার পর সে যোগাযোগ ক্রমেই কমে আসে। তারপর যখন সেক্রেটারি হলেন তখন আর তার সময় কোথায়?
সবসময় তাকে সমর্থন করিনি। তার কথা বলার ধরন আর অতিকথন মাঝে মাঝে ভালো লাগতোনা। সামাজিক মিডিয়ায় তাকে নিয়ে কতো কথা। কত কটূ বাক্য। সমর্থনও কম ছিলোনা। যে যাই বলুক কাদের ভাই ছিলেন সক্রিয় ও সচল। রাজপথে সড়কে সর্বদা চলমান এই নেতা হঠাৎ অসুস্থ হয়ে পড়েছেন। এই আকস্মিক অসুস্থতায় নড়ে উঠেছে দেশ। আমি দেখেছি মানুষের শুভবোধ এদেশে কোনওদিন মরে না। তারা সঠিক জায়গায় সময় মতো তাদের কথা বলতে পিছ পা হন না। যে ভালোবাসা তাদের অন্তরে লুকায়িত থাকে তা তখন ঠিকই বেরিয়ে আসে। এবারেও তাই হয়েছে। কিন্তু সে অনুভবের জায়গাটা নিয়ে মিডিয়ার খেলাধুলা এখন সত্যি হাস্যকর। খেলাধুলা শব্দটা বলতে হলো এই কারণে কোনটা যে শোক আর কোনটা উল্লাস বোঝা মুশকিল।
কেউ গুরুতর অসুস্থ হলে তাকে একলা রাখা, ঝামেলা মুক্ত রাখা সকলের দায়িত্ব। আধুনিক দেশের চিকিৎসা শাস্ত্র তো বটেই সাধারণ নিয়মও তাই। এখানে হাসপাতালে ভিড় জমালে খবর আছে। এবং সেটা অসম্ভব। রোগিদের নিকট আত্মীয়জনও নিয়মের বাইরে দেখা করতে পারেননা। সময় মেপে, ঘড়ি মেপে যাওয়া আসার বাইরে কেবল ডাক্তার নার্সরাই পারেন যাতায়াত করতে। সেখানে একজন গুরুতর হৃদরোগীকে এভাবে ঘিরে রাখার অনৈতিক বিষয়ও জায়েজ করে ফেলেছি আমরা। ভারতের নামকরা বিশেষজ্ঞ শেঠী সাহেব এসেছিলেন। তা নিয়েও দেখলাম মিডিয়ার বাড়াবাড়ি । এমন বিখ্যাত বিশেষজ্ঞ নিয়ে মাতম করার কারণ ও বুঝিনি। তিনি তার পেশাগত দায়িত্ব পালন করেছেন। এটাকে গল্প বানিয়ে মিডিয়া কি প্রমাণ করলো? আমরা এমন এক জাতি যে যাদের কোন ও ডাক্তার নাই বা ডাক্তার দেখার অভিজ্ঞতা নাই?
হাসপাতাল থেকে বিমানবন্দর সর্বত্র ক্যামেরা আর মাইক্রোফোনের ছড়াছড়ি। কী তারা বলতে চায়, কেন বলতে চায়- বোঝা কঠিন। এটা এখন একটা রোগের মত। সেই রানা প্লাজার ঘটনার কথা মনে করবো। ভবন ধসে গেছে। মানুষ আহাজারী করছে স্বজনদের জন্য। বাইরে উদ্বিগ্ন মা বাবা ভাইবোন আত্মীয় স্বজনদের মুখ। সাধারণ মানুষ কাঁদছে অঝোর ধারায়। এদিকে টিভির মাইক্রোফোন ঘুরছে দেয়ালের ভেতর চাপা পড়া ইটের ফাঁকে আটকা পড়া মানুষের চোখের কাছে মুখের কাছে। তাদের বাঁচার আর্তি, মৃত্যুভয় কিছুই কিছু না। টিভি জানতে চায় কিভাবে এতটা ইটের নিচে চাপা পড়লো, কেন বের হতে পারলো না। ওখানের আবহাওয়া কেমন? এসব আষাঢ়ে গল্প। শুধু প্রশ্ন করতে পারেনি আপনি না মরে বেঁচে আছেন কেন?
এখনো সে ধারাবহিকতা চলছে সমানে। চকবাজারের আগুনের সময় ও দেখলাম টিভির উদ্বিগ্নতা আর মিডিয়ার পর্দায় সব পিছে ফেলে কাহিনী বানানোর ধুম। রাজনীতির তামাশা কাভার করতে করতে টিভি ক্যামেরা ভুলে গিয়েছে জীবন আর রাজনীতির নাটক এক বিষয় না। প্রিন্ট মিডিয়া, ইন্টারনেট পোর্টালগুলো দায়িত্বশীল হবার কারণ হয়তো তাদের চলমান ক্যামেরা নাই। আর চব্বিশঘণ্টা খোলা রাখার নামে যা খুশি তা দেখাতে হয়না। টিভি সাতদিন চব্বিশ ঘণ্টা চলতে গিয়ে যে খেই হারিয়ে ফেলে সেটা এখন প্রকাশ্য। সাথে জুটেছে সামাজিক রোগ।
সামাজিক অসুস্থতা বুঝতে হলে সোশ্যাল মিডিয়ায় চোখ রাখুন। কত কি দেখবেন ভাবতেও পারবেন না। ওবায়দুল কাদের অসুস্থ হবার পর তাকে নিয়ে এমন সব লোকেরা লিখেছে, যা একমাত্র উম্মাদের দ্বারাই সম্ভব। বিকৃতি না থাকলে এমন সব কথা বলা অসম্ভব। এমন ভাবনাও আসতে পারে না। এরা ভদ্রবেশি উন্মাদ। কত ধরনের মানসিক ব্যাধি থাকে। তার কটা জানি আমরা? কটাই বা বুঝি। আপনি সামাজিক মিডিয়ায় চোখ রাখলেই দেখবেন জন্ম বা মৃত্যু কিছুই বিষয় না। উন্মাদনা চলছে, চলবে।
কাদের ভাই এখন সিঙ্গাপুরে। ভালোয় ভালোয় ফিরে আসুন এই আমাদের কামনা। তার অসুস্থতার রেশ না ফুরাতেই দেখলাম খালেদা জিয়ার চিকিৎসার খবর। মির্জা ফখরুল ছুটেছেন মন্ত্রীর কাছে। মন্ত্রী কথা দিয়েছেন অচিরেই খালেদা জিয়াকে বঙ্গবন্ধু মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হবে। নিশ্চিত এ নিয়ে এখন মেতে উঠবে মিডিয়া। আর সামাজিক মিডিয়ায় শুরু হবে সরকারের হয়ে আর সরকার বিরোধীদের কূটক্যাচাল। এতসব ঘটনার ফাঁকে অন্তত একটা সুখবর আছে।
ওবায়দুল কাদেরকে দেখতে হাসপাতালে গিয়েছিলেন মির্জা ফখরুল। তার সাথে ছিলেন মওদুদ আহমেদ ও মঈন খান। তারা কাদের ভাইয়ের স্ত্রীর সাথেও যোগাযোগ রাখছেন। উস্কানির রাজনীতি ও বিভেদকামী সমাজে এই খবর গুরুত্বপূর্ণ না। তাই তেমন প্রচার পায়নি। না গেলে দুই দলে ভাগ হয়ে গালাগাল আর সমর্থন করতাম আমরা। জীবনের উপর নৌকা ধানের শীষ কিছুই থাকেনা। থাকে কীর্তি আর বোধ। আশা করবো এরপর বন্ধ হবে দুভাগে ভাগ হয়ে গালাগাল আর মারামারি।
শারীরিক অসুস্থতা আর সামাজিক অসুস্থতা এ দুই থেকে মুক্ত হোক আমাদের সমাজ। আমাদের দেশ । তবেই না আমরা এগুতে পারবো সামনের দিকে।