মহান ভাষা আন্দোলনের ভিতর দিয়ে বাংলাদেশের মানুষ যে অসাম্প্রদায়িকতা, মৌলবাদ বিরোধিতা, মুক্তচিন্তা, সাম্রাজ্যবাদ বিরোধিতার শিক্ষা অর্জন করেছে , সেই শিক্ষা আজ আন্তর্জাতিক দুনিয়াতে মাতৃভাষা চর্চার দ্যোতনার ভিতর দিয়ে স্বাধিকার প্রতিষ্ঠার লড়াইকে আরো মজবুত করেছে। অবিভক্ত পাকিস্তানের পশ্চিম অংশের শাসকদের নয়া সাম্রাজ্যবাদী মানসিকতার প্রতিবাদ হিন্দু-মুসলিম নির্বিশেষে বাংলাদেশের মানুষ মাতৃভাষার অধিকার প্রতিষ্ঠার ভিতর দিয়ে কায়েম করেছিল। তাদের সেই মায়ের মুখের ভাষার মর্যাদা রক্ষার লড়াইয়ের ভিতর দিয়ে পশ্চিম পাকিস্থানের উর্দু আধিপত্যের মুখোশ পরে তৎকালীন পূর্ব পাকিস্থানের মানুষদের উপর যে আর্থ- সামাজিক- সাংস্কৃতিক অত্যাচার চলেছিল- তার ই প্রতিবাদ ধ্বনিত- প্রতিধ্বনিত হয়েছিল বাহান্নের মহান ভাষা আন্দোলনের ভিতর দিয়ে। আর সেই প্রতিবাদ- প্রতিরোধের ভিতরেই সঞ্জীবিত হয়েছিল পশ্চিম পাকিস্থানের নয়া সাম্রাজ্যবাদী মানসিকতা থেকে মুক্ত হয়ে স্বাধীন সার্বভৌম বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠার বীজমন্ত্র।
শেখ হাসিনা নয়ের দশকে প্রথম দফায় বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী থাকাকালীন প্রধানত তারই উদ্যোগে জাতিসঙ্ঘ একুশে ফেব্রুয়ারিকে 'আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস' হিসেবে ঘোষণা করে। জাতিসঙ্ঘের এই ঘোষণার ভিতর দিয়ে বাংলাদেশের মানুষদের মাতৃভাষার স্বাধিকার প্রতিষ্ঠার লড়াইকে আন্তর্জাতিক দুনিয়াতে সাম্প্রদায়িকতা, মৌলবাদ,জাতি সংঘর্ষ, সাম্রাজ্যবাদ, শোষণ- বঞ্চনার বিরুদ্ধে সংগ্রামের একটি বলিষ্ঠ মাধ্যম হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করে। একুশের লড়াই যে নিছক একটি আবেগের বহিঃপ্রকাশ ছিল না, এই লড়াইয়ের ভিতর দিয়ে জাতি- ধর্ম- বর্ণ – উচ্চ- নীচ নির্বিশেষে বাংলাদেশের মানুষ যে শোষণ, বঞ্চনা, লাঞ্ছনার বিরুদ্ধে মূর্ত প্রতিবাদকে খোদাই করতে সক্ষম হয়েছিল তা আজ বাংলাদেশের ভৌগলিক সীমারেখা অতিক্রম করে আন্তর্জাতিক দুনিয়াতে মর্যাদার সঙ্গে প্রতিষ্ঠিত হয়েছে।
'৫২ সালে মহান ভাষা আন্দোলনের ভিতর দিয়ে যে স্বাধিকারের স্বপ্ন তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানের মানুষ দেখেছিলেন , সময়ের পরিবর্তনের নিরিখে আজ স্বাধীন সার্বভৌম বাংলাদেশে যেমন তার প্রেক্ষিত বদলে গেছে, তেমন ই ভারতীয় উপমহাদেশে বা আন্তর্জাতিক দুনিয়াতেও তার প্রেক্ষিত অনেক বদলেছে। মাতৃভাষার অধিকার প্রতিষ্ঠার লড়াইয়ের ভিতর দিয়ে তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানের মানুষ সাম্প্রদায়িকতা, মৌলবাদ এবং সাম্রাজ্যবাদের বিরুদ্ধে লড়াইয়ের যে পরাকাষ্ঠা তাদের দেশে স্থাপন করতে পেরেছিলেন , সেটি এক চরম উৎকর্ষতা লাভ করেছিল একাত্তরে মহান মুক্তিযুদ্ধের ভিতর দিয়ে। একুশের অভিধারায় সঞ্জীবিত সেই ধর্মনিরপেক্ষ চেতনা মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় রূপান্তরিত হয়ে কেবল রক্তস্নাত বাংলাদেশকেই উজ্জ্বীবিত করেনি, এপার বাংলার আর্থ- সামাজিক- রাজনৈতিক- সাংস্কৃতিক পরিমণ্ডলে ধর্মনিরপেক্ষতার চর্চার পরিমণ্ডল অনেকখানি প্রলম্বিত করেছিল।
মার্কিন ও পাক সাম্রাজ্যবাদী কুচক্রের হাতে স্বাধীন সার্বভৌম বাংলাদেশের স্থপতি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব সপরিবারে শাহাদাত বরণের পরে একুশের চেতনা সঞ্জাত সেই ধর্মনিরপেক্ষ, অসাম্প্রদায়িক, মৌলবাদ বিরোধী উত্তরাধিকারকে বাংলাদেশ ধারণ করে রাখতে পারে নি। মার্কিন সাম্রাজ্যবাদের দোসর, পাক হানাদারিদের মানসিকতা এবং তাদের সহযোগী রাজাকার, আলবদল, আল শামস এবং যুদ্ধাপরাধীরা বাংলাদেশকে আবার পাকিস্তানেরর উপনিবেশ হিসেবে তৈরি করতে প্রথমেই আঘাত হানে একুশ এবং মুক্তিযুদ্ধের চেতনার উপর।শক্তিশালী হয়ে ওঠে সে দেশের সংখ্যাগুরু মৌলবাদ। আর তাদের স্বাভাবিক মিত্র হিসেবে বাংলাদেশের সংখ্যাগুরু মৌলবাদের পাল্টা হিসেবে ভারতবর্ষের সংখ্যাগুরু মৌলবাদীরা একযোগে গোটা ভারতীয় উপমহাদেশ জুড়ে শুরু করে দেয় তাণ্ডব নৃত্য।
একুশের চেতনা এবং সেই ধারা থেকেই নিঃসৃত মুক্তিযুদ্ধের চেতনাকে আবার বাংলাদেশ তথা বিশ্ব মানবিকতার বুকে গেঁথে দিতে গত শতকের নয়ের দশকে শহিদ জননী জাহানারা ইমামের নেতৃত্বে বাংলাদেশে শুরু হয়েছিল মুক্তিযুদ্ধের দ্বিতীয় পর্যায়। সুফিয়া কামাল, শামসুর রাহমান, কলিম শরাফি, কবীর চৌধুরী, অনুপম সেন, দেবেশচন্দ্র ভট্টাচার্য, বদরুদ্দিন উমর, আহমদ শরীফ প্রমুখ সেই আন্দোলনকে একটি ব্যাপক সামাজিক পর্যায়ে উপনীত করেছিলেন।
সেই অর্জনের সাফল্যেই বাংলাদেশে গত শতকের নয়ের দশকে প্রথম প্রতিষ্ঠিত হয় পঁচাত্তরোত্তর সময়ে একটি ধর্মনিরপেক্ষ সরকার। সে সরকার পাক হানাদারদের সহযোগীদের বিচারের বিষয়টি নিয়ে নাড়াচাড়া করতে শুরু করলেই সে দেশের জাতীয় স্তরে তো বটেই আন্তর্জাতিক স্তরেও শুরু হয়ে যায় ভয়ঙ্কর ষড়যন্ত্র। যে ষড়যন্ত্রের জেরে পরাজয় ঘটে আবার ধর্মনিরপেক্ষ শক্তির। এই শক্তি নির্বাচনী সংগ্রামে পরাজিত হয়েও সামাজিক এবং রাজনৈতিক পরিমণ্ডলে একুশ ও মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় সঞ্জাত ধর্মনিরপেক্ষতার চর্চা থেকে এক মুহূর্তের জন্যে সরে আসে নি। একুশের চেতনায় স্থিত থেকে ধর্মান্ধতা, সাম্পূরদায়িকতা, মৌলবাদের বিরুদ্ধে, সাম্রাজ্যবাদের বিরুদ্ধে নিরন্তর লড়াইয়ের ভিতর দিয়ে যে কেবল একটি ধর্মনিরপেক্ষ সরকারকেই কেবল ফিরিয়ে আনা যায় না , পাশাপাশি সমাজের বুকে ধর্মনিরপেক্ষতা, যেটি মহান একুশের আন্দোলনের মূল সুর, তার সপক্ষে একটি প্লাবন তৈরি করা যায়। বাংলাদেশের বর্তমান ধর্মনিরপেক্ষ রাজনৈতিক শক্তি সেটি বুকের কলিজার থেকে রক্ত উজার করে প্রমাণ করেছেন।
একুশের চেতনা যে অসাম্প্রদায়িক ভিত্তির উপর বাংলাদেশের সামাজিক ধ্যানধারণার স্তরকে সঞ্জীবিত করেছে, মুক্তিযুদ্ধের চেতনার ভিতর দিয়ে সেই বোধ এতোখানি ই সমাজ জীবনের গভীরে শিকড় বিস্তার করতে পেরেছে যে, প্রতিক্রিয়াশীল শক্তি সেই বোধকে ধ্বংস করার বহু চেষ্টা করে সাময়িক হাসি হাসলেও শেষ হাসিটি হাসতে পারেনি। শেষ হাসি কিন্তু হেসেছে ধর্মনিরপেক্ষ , মৌলবাদ, সাম্রাজ্যবাদ বিরোধী শক্তিই।
একুশের চেতনাকে বিনষ্ট করবার যে ষড়যন্ত্র বাংলাদেশের বুকে মার্কিন সাম্রাজ্যবাদী শক্তি ও পাকিস্তান যৌথভাবে শুরু করেছিল '৭৫ সালের ১৫ অগাস্ট ফজরের নামাজের আগে সপরিবারে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবকে হত্যা করে, তার রেশ যে কেবলমাত্র বাংলাদেশেই সীমাবদ্ধ ছিল, তা ধরে নিলে ভুল হবে। গোটা ভারতীয় উপমহাদেশে বঙ্গবন্ধুকে হত্যার ভিতর দিয়ে মৌলবাদ, সাম্প্রদায়িকতার প্রসারের ক্ষেত্রে নিজেদের আগ্রসনকে অনেকখানি দানবীয় করে তুলেছিল আমেরিকা ও পাকিস্তানের যৌথ প্রচেষ্টা। সেই দানবীয়তার অভিশ্রুতি ভারতবর্ষে সেদিন সেভাবে দাগ কাটতে পারে নি আন্তর্জাতিক দুনিয়ায় সোভিয়েত ইউনিয়নের উপস্থিতি এবং ভারতীয় রাজনীতিতে শক্তিশালী বাম আন্দোলনের নিরিখে।
বাংলাদেশে সেই অপচেষ্টাকে সেদেশের ধর্মনিরপেক্ষ শক্তি আজ অনেকখানি ই প্রতিহত করতে পেরেছে।খোদ আমেরিকার ভ্রুকুটি অস্বীকার করে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবের হত্যার বিচার থেকে শুরু করে কুখ্যাত যুদ্ধাপরাধীদের বিচার ও শাস্তির ভিতর দিয়ে সেদেশের ধর্মনিরপেক্ষ মানুষ এবং প্রশাসন যেভাবে ঐতিহাসিক ভাষা আন্দোলন এবং মুক্তিযুদ্ধের চেতনাকে পুনরুজ্জীবিত করতে পেরেছেন তার সুফল সামগ্রিকভাবেই গোটা বিশ্বের অসাম্প্রদায়িক, ধর্মনিরপেক্ষ, মৌলবাদ বিরোধী, সাম্রাজ্যবাদ বিরোধী শক্তির উপর বর্তিয়েছে।
বাংলাদেশে সদ্য সমাপ্ত জাতীয় সংসদের নির্বাচনের আগে আবার সেই দেশটিকে পাকিস্তানের ছায়া উপনিবেশে পরিণত করবার কম ষড়যন্ত্র হয় নি। এক্ষেত্রে বাংলাদেশের পাকিস্তানপন্থী রাজনৈতিক দলগুলি এবং সঙ্কীর্ণতাবাদী রাজনৈতিক শক্তিগুলি প্রায় যৌথভাবে কোমর বেঁধে নেমে পড়েছিল। স্বস্তির বিষয়, বাংলাদেশের ধর্মনিরপেক্ষ মানুষ সেই অপচেষ্টাকে রুখে দিয়ে একুশের চেতনা, মুক্তিযুদ্ধের চেতনার স্বপক্ষেই নিজেদের অবস্থানের কথা দৃঢ় চিত্তে ব্যক্ত করেছেন।
একুশের আন্দোলন আমাদের সামনে মাতৃভাষার প্রতি প্রেমের দৃষ্টান্ত স্থাপনের ভিতর দিয়ে এই শিক্ষাও দিয়ে গিয়েছে যে, নিজের মায়ের মুখের ভাষার প্রতি ভালোবাসার অর্থ কিন্তু কোনো অবস্থাতেই অন্যের ভাষার প্রতি বিরাগ নয়। সেদিন পশ্চিম পাকিস্তান তাদের দেশের সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষের মুখের ভাষাকে কেড়ে তার জায়গায় উর্দুকে বসাতে চেয়েছিল রাষ্ট্রযন্ত্রের সুযোগ নিয়ে। পশ্চিম পাকিস্থানের অগণতান্ত্রিক দৃষ্টিভঙ্গী, অর্থনৈতিক,সামাজিক, সাংস্কৃতিক শোষণের বিরুদ্ধে সংগ্রামেরই বহিঃপ্রকাশ একুশের মহান ভাষা আন্দোলন।এই আন্দোলন কিন্তু কোনো অবস্থাতেই উর্দু ভাষার বিরুদ্ধে ছিল না। ছিল রাষ্ট্রযন্ত্রের সুযোগ নিয়ে , সংখ্যাগরিষ্ঠের অধিকারকে পদদলিত করতে পশ্চিম পাকিস্থানের অগণতান্ত্রিকতার বিরুদ্ধে জাতি- ধর্ম- বর্ণ নির্বিশেষে বাঙালির স্বতঃস্ফুর্ত বিক্ষোভ। যে 'মুসলিম জাতীয়তা' র উপর ভিত্তি করে হিন্দু- মুসলিম উভয় ধর্মের সাম্প্রদায়িক, মৌলবাদী শক্তির সন্মিলিত উদ্যোগে পাকিস্তান সৃষ্টি হয়েছিল, একুশের আন্দোলন ছিল সেই 'মুসলিম জাতীয়তাবাদে' র কফিনে পেরেক ঠুকে ' বাঙালি জাতীয়তাবাদে' র বিজয় বৈজয়ন্তী ওড়াবার প্রাথমিক উদ্যোগ।
একুশের চেতনার মূল থেকে উৎসরিত হয়েছে ভাষা- জাতি- বর্ণ- ধর্মের নামে যেকোনো রকমের উগ্রতার বিরুদ্ধে একরাশ ঘৃণা। মাতৃভাষার পক্ষে লড়াইয়ের রক্তে রঞ্জিত একুশের চেতনা কিন্তু অপরের ভাষার প্রতি এতোটুকু বিদ্বেষকে উৎসাহিত করবার বিন্দুমাত্র চেষ্টা করে নি। মায়ের মুখের ভাষার মর্যাদা রক্ষার লড়াইতে কিন্তু প্রাতিষ্ঠানিক ধর্মের কোনো জায়গা ছিল না। হিন্দু- মুসলমান নির্বিশেষে সেদিন বাংলা ভাষার জন্যে লড়েছিল। এই লড়াইতে জাতি- ধর্ম- বর্ণ- ভাষা- কোনো কিছুর নিরিখেই উগ্রতার, শ্যভিনিজমের কোনো ঠাঁই ছিল না। একুশের চেতনার সবথেকে বড়ো বৈশিষ্ট্য হলো, তার ধর্মনিরপেক্ষ দিকটি।
একুশের চেতনার এই ধর্মনিরপেক্ষ দিকটি বহু চড়াই উতরাইয়ের ভিতর দিয়ে বাংলাদেশের মানুষ রক্ষা করেছেন। এই অর্জনের জন্যে সেদেশের হিন্দু- মুসলিম নির্বিশেষে বহু বাঙালির রক্ত ঝরেছে। বাংলাদেশ বহু যন্ত্রণাবিদ্ধ পথে হেঁটেও একুশের ধর্মনিরপেক্ষ চেতনাকে বুকে লালন করতে পারলেও আমাদের ভারতবর্ষের সাম্প্রতিক প্রেক্ষেপটে একুশের চেতনার সবথেকে বড়ো বৈশিষ্ট্য, এই ধর্মনিরপেক্ষতার দিকটি আজ ভয়ঙ্কর বিপদের সামনে। ধর্মের ভিত্তিতে, জাতির ভিত্তিতে, বর্ণের ভিত্তিতে , ভাষার ভিত্তিতে ভারতের মানুষের ভিতরে বিভাজনরেখাকে তীব্র থেকে তীব্রতর করে তোলবার এক ভয়াবহ প্রতিযোগিতা চলেছে। অতি সম্প্রতি কাশ্মীরের পুলওয়াতে জঙ্গিদের হাতে সেনাবাহিনীর জওয়ানদের আত্মবলিদানের মর্মান্তিক ঘটনার পর উগ্র জাতীয়তার ভয়প্রদ আস্ফালনে ভারতবর্ষের চিরকালীন সহনশীলতার ঐতিহ্যকে পদদলিত করে দেওয়া হচ্ছে।
একুশের আন্দোলন দেশপ্রেমের নামে যে কোনো উগ্রতার বিরুদ্ধে নিজের অভিঘাতকে প্রতিষ্ঠিত করেছিল।বাংলাদেশ নানা পরীক্ষা নিরীক্ষার ভিতর দিয়ে সাময়িক বিচ্যুতিকে অতিক্রম করে আবার একুশের চেতনার সেই চিরনাতন ধারাতে নিজেকে উপস্থাপিত করতে পেরেছে। বাংলাদেশ এটা অর্জন করতে পারলেও ভারতবর্ষ তার চিরনাতন অর্জনের সেই স্বর্ণালী ঐতিহ্য থেকে ক্রমেই বিচ্যুত হতে শুরু করেছে। ভারতে সংখ্যাগুরু রাজনৈতিক হিন্দু সাম্প্রদায়িক শক্তি রাষ্ট্র ক্ষমতা দখল করার পর নিজেদের ক্ষমতাকে স্থায়ী করার জন্যে দেশপ্রেমের নামে উগ্রতার সৃষ্টি করে পাকিস্তানের দিকে সমস্ত নজর ঘোরাবার নাম করে পাকিস্তানের সংখ্যাগুরু নাগরিক মুসলমানদের প্রধান অভিযুক্ত হিসেবে সাধারণ মানুষের কাছে তুলে ধরে। পাকিস্তানের সংখ্যাগুরু মুসলমানেদের সঙ্গে অত্যন্ত কৌশলে তারা মিলিয়ে দেয় ভারতবর্ষের সংখ্যালঘু মুসলমানেদের। এই মুসলমানেরাই রাজনৈতিক হিন্দুদের সব থেকে বড়ো আক্রমণের লক্ষ্যবস্তু। রাজনৈতিক হিন্দুদের গুরু গোলওয়ালকর এই সংখ্যালঘু মুসলমানেদের টার্গেট করেই তৈরি করে গিয়েছিলেন তার 'সাংস্কৃতিক জাতীয়তাবাদ' তত্ত্ব। পরবর্তীতে সেই তত্ত্ব আরও শাঁস, জল দিয়ে উগ্র করে তোলেন রাজনৈতিক হিন্দুদের তাত্ত্বিক ভিত্তির আর এক নির্মাতা দীনদয়াল উপাধ্যায় তার 'একাত্ম মানবতাবাদ' তত্ত্বের ভিতর দিয়ে।
কার্গিল সমস্যাকে ঘিরে ভোটে জেতার স্বার্থে এভাবেই দেশপ্রেমের নামে উগ্রতার আমদানি ঘটিয়েছিলেন অটলবিহারী বাজপেয়ী তার প্রধানমন্ত্রিত্বকালে। তের মাসের সরকারের পতনের পর মধ্যবর্তী নির্বাচনে নিজের দল বিজেপিকে ক্ষমতায় ফিরিয়ে আনতে বাজপেয়ী ব্যবহার করেছিলেন কার্গিল ইস্যুকে, উগ্র থেকে উগ্রতম রূপ দিয়েছিলেন দেশপ্রেমের নামে ভয়াবহ চন্ডরূপ স্থাপনে। এই শ্যভিনিজমের ভিতর দিয়ে মুসলিম বিদ্বেষকে তীব্র করে দিয়ে রাজনৈতিক হিন্দুদের নির্বাচনী সাফল্য কিনেছিল আরএসএস এবং তাদের রাজনৈতিক সংগঠন বিজেপি।
একুশের আন্তর্জাতিক চেতনা, সম্প্রীতি- ধর্মনিরপেক্ষতা- মৌলবাদ- সাম্রাজ্যবাদ বিরোধিতার চেতনাকে পদদলিত করে বিভাজনের বৃত্ত নির্মাণের ভিতর দিয়েই ভারতবর্ষে রাষ্ট্রক্ষমতা দখল করেছিলেন নরেন্দ্র মোদি।এই বিভাজনকে তীব্র করার সর্বাত্মক প্রয়াস তিনি তার ক্ষমতার পাঁচ বছরের প্রতিটি মুহূর্তে সর্বাঙ্গীনভাবে করেছেন। ভারতের লোকসভা নির্বাচন দরজায় কড়া নাড়ছে। দেশের আর্থ- সামাজিক প্রতিটি প্রশ্নে চূড়ান্তভাবে ব্যর্থ মোদি প্রশাসন আবার ক্ষমতায় ফিরে আসার তাগিদে বাজপেয়ীর আমলের দেশপ্রেমের নামে উগ্রতাকেই সামাজিক বিভাজনের বৃত্ত সম্পূর্ণ করবার শেষ আশ্রয় হিসেবে বেছে নিয়েছে। কাশ্মীরের পুলওয়ামাতে জঙ্গিদের হাতে সেনা জওয়ানদের মৃত্যুর ব্যর্থতাকে মোদি অতিক্রম করতে শেষ মরীয়া প্রচেষ্টায় বেছে নিয়েছেন উগ্র জাতীয়তার মোড়কে দেশপ্রেমের নামে চরম মুসলিম বিদ্বেষকে।
পুলওয়ামার হৃদয় বিদারক ঘটনাকে কেন্দ্র করে মোদির মূল চালিকা শক্তি আরএসএস এবং তার হরেক বর্ণের শাখা সংগঠনগুলি এবং প্রত্যক্ষ রাজনৈতিক সংগঠন বিজেপি, শিবসেনাসহ পরোক্ষ রাজনৈতিক সহযোগী তৃণমূল কংগ্রেস গোটা দেশে উগ্র জাতীয়তাবাদকে একদম বাজারের আলু, পটলের মতো পণ্যে নামিয়ে এনেছে। এই দেশপ্রেমের নামে উগ্রতার জেরে অতি দেশপ্রেমিকদের মূল আক্রমণের লক্ষ্যবস্তু হয়ে উঠছেন কাশ্মীরীরা, প্রকারান্তে মুসলমানেরা। অথচ মোদি সরকারের মন্ত্রী শহিদ জওয়ানের কফিনের সঙ্গে নিজস্বী তুলে যা সামাজিক গণ মাধ্যমে দিতে ব্যস্ত। বিজেপি সাংসদ সাক্ষী মহারাজ মৃত জওয়ানের শেষযাত্রাকে কার্যত নির্বাচনী রোড শো তে পরিণত করছেন। এই কলকাতা শহরে যা স্বাধীনতার দীর্ঘদিন পরের সময়কালে কেউ কল্পনা করতে পারেন নি, জন্মসূত্রে কাশ্মীরি হওয়ার কারণে এই শহরে এক কর্মরত চিকিৎসকের বাড়িতে উগ্র দেশপ্রেমিকেরা হামলা করছে, সেই চিকিৎসকের সন্তানকে তার ইস্কুলে একঘরে করে রাখা হচ্ছে।
আরএসএস একদিকে সামাজিক মেরুকরণের এই প্রক্রিয়াকে গোটা দেশে তীব্র করে তুলে তাদের রাজনৈতিক সংগঠন বিজেপিকে আসন্ন লোকসভা নির্বাচনে ভালো ফল করার সুযোগ করে দিচ্ছে। অপরপক্ষে বিজেপিকে ' স্বাভাবিক মিত্র' এবং তাদের মূল সংগঠন আরএসএস-কে ' অন্যরকম' মনে করা মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়, যাকে একদিন এই আরএসএস-ই 'দেবী দুর্গা' পর্যায়ভূক্ত করেছিল, তার বদান্যতায় এই পশ্চিমবঙ্গ এখন সাম্প্রদায়িক, উগ্র জাতীয়তাবাদীদের মুক্তাঞ্চলে পরিণত হয়েছে, যার জেরে রাজনৈতিক হিন্দু ব্যতীত অন্য ধর্ম, বর্ণ- মতামতের মানুষের আমাদের রাজ্যে বসবাস করাই দুষ্কর হয়ে উঠতে শুরু করেছে।