Published : 07 Nov 2018, 06:04 PM
'হাওয়া' শব্দের মধ্যেই দৃশ্যমান অবস্থা অনুপস্থিত। হাওয়া বেগমরাও তেমনি আমাদের জনপরিসরে থেকেও যেন নেই। 'সংবাদ' হওয়ার অবস্থায় এলে কিছুটা টের পাওয়া যায় বটে তাদের উপস্থিতি, তবে রাজনীতি, ক্ষমতা, পালাবদল, নির্বাচন, দাবি-দফা, সংলাপ- এমন আরও অনেক অনেক গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ের তোড়ে হারিয়েও যায় তারা নিমেষে। হাওয়াদের নামকরণের স্বার্থকতা তাই ষোলো আনা ছাড়িয়ে আঠারো আনাই বলতে হয়।
হ্যাঁ, বছর চৌদ্দোর কিশোরী গৃহকর্মী হাওয়া বেগমের কথাই বলছি। পত্রপত্রিকায় প্রকাশিত যার ছবি দেখে ভ্রম হয় কেভিন কারটারের পুলিৎজার পাওয়া সুদানি দুর্ভিক্ষের সেই আলোকচিত্রের চরিত্র বলে; খাদ্যবস্তু নয়, পেটে চালান দেওয়ার মতো কচুঘেঁচুর অভাবে যে শিশুটি মরণাপন্ন, তার মৃত্যুর মুহূর্ত গুনছে পাশে বসা শকুন। সভ্য সময়ের করুণতম সেই 'হত্যা-মিশন'ই ফের মঞ্চস্থ প্রিয় মাতৃভূমি বাংলাদেশে!
অনাহারীর 'মৃত্যুর মুহূর্ত' ক্যামেরায় ক্লিক করে নন্দিত হয়েছিলেন কারটার। তার 'শিল্পিত' চোখে ধরা পড়া সুদানি 'হাওয়া বেগম' শিল্প-উপাদানের এক চুলও বেশি কিছু ছিল না— না জীব, না জড়! এই পোড়া বঙ্গভূমির পোড়াকপালি হাওয়া বেগমের 'কপাল' কিঞ্চিত ভালো। সে মৃত্যুকূপ থেকে বাইরে আসতে পেরেছে। পেয়েছে সে মানবের মর্যাদাহীন জীবনে অন্তত জীবের স্বীকৃতিটুকু! আইন ও সালিশ কেন্দ্রের হিসাবে, গত বছর নির্যাতনের শিকার হয়ে গৃহকর্তাদের বাড়িতেই মারা গেছেন ২৬ জন নারী গৃহকর্মী।
যেখানে মানবিকতা নেই, কেবল প্রাণবিক আয়ু নিয়ে বেঁচে থাকার জীবন কি মানুষের? বর্ণবাদী অন্ধকার যুগের ক্রীতদাসদের সঙ্গে আজকের বহুবর্ণিল আলোকিত সময়ের 'গৃহদাস' হাওয়াদের আদৌ কোনও ফারাক কি আছে? অধিকারে, অর্যাদায়? তথ্যাভিজ্ঞ ইতিহাসবেত্তাদের কাছে হয়তো এর উত্তর আছে। কিন্তু সরল যে জিজ্ঞাসার জবাব মেলে না, একজন গৃহকর্মীর ঘামের দাম কি দিন দুই থালা নুন-ভাতের চেয়েও কম? ন্যূনতম মানবিক আচরণ কি তার প্রাপ্য নয়? শেষ কবে হাওয়ার পেটে ঠিকঠাক দানাপানি পড়েছিল, তাকে দেখে বোঝার সাধ্য নেই। হাওয়ার কাজের 'গাফিলতির' মূল্য সুদে-আসলেই চুকিয়েছেন তার গৃহকর্তা-গৃহকর্ত্রী। হাড্ডিসার দেহে ক্ষতে-ঘাঁয়ে-সংক্রমণে না-মানুষি চেহারার হাওয়াকে যারা দেখেছেন, 'পাশবিকতা' শব্দের এস্তেমাল তারা হাড়েমজ্জায় উপলব্ধি করেছেন; যে পাশবিকতা পশুর সহজাত নয়, মানুষের মজ্জাগত!
ভুলচুক হওয়ায় কিংবা কাজের শর্ত ভঙ্গের দায়ে হাওয়ারা ছাঁটাই হয় না; 'পারিবারিক আদালতে' তাদের দণ্ড ঘোষিত হয়। হাওয়াদের কেতাবি পরিচয় 'গৃহকর্মী' হলেও তারা আদতে এ যুগের 'ক্রীতদাস, গৃহকর্মের জন্য স্বীকৃত পন্থায় খরিদ গোলাম!
তাই মোস্তাকিম শরীফ ও জান্নাতুল নাইমারা গৃহকর্ত্রী-গৃহকর্তার পরিচয় ছাপিয়ে হাওয়াদের 'প্রভু' বনে যান। প্রভুর মতো তারা হাওয়াদের 'ভাগ্য' নির্ধারণ করেন।
এই প্রভুত্ববাদ সাম্রাজ্যবাদী মানসিকতার হুবহু ফটোকপি বললেও যেন কম বলা হয়। রাষ্ট্রিক পর্যায়ের বৈষ্যমের গোড়াটি পোঁতা সামাজিক স্তরের মানুষের মনে। আর্থিক সামর্থ্য ও ক্ষমতার দাপট সমাজের উঁচুতলার বাসিন্দাদের একচ্ছত্র প্রভুগিরির হাতিয়ার। আর সেই হাতিয়ার তলে গর্দান দেওয়াই যেন গরিবের মানে হাওয়াদের নিয়তি! সমাজের এই বলপ্রয়োগের চেনাচিত্রই বিস্তৃত পরিসরে উপনিবেশবাদ; দুর্বলের ওপর সবলের অনাচারি শাসন; যে শাসনব্যবস্থায় দখলদারিত্ব জায়েজ— পিতৃভূমি ও মনোভূমি উভয় ক্ষেত্রেই। দেশ দখল, সম্পদ লুণ্ঠনের সঙ্গে তাদের মালিকদের গণহারে হাতে-পায়ে গণগোলামির জিঞ্জির পরানোকেও বৈধতা দিয়েছিল উপনিবেশবাদীরা, যার পোশাকি পরিচয় বর্ণবাদ, প্রায়োগিক চেহারা ক্রীতদাস প্রথা। মানবেতিহাসের ঘৃণ্যতম সেই কুপ্রথারই বাংলাদেশের আধুনিকতম সংস্করণ যেন 'গৃহকর্ম; যেখানে সেই একই নৃশংসতা, মনুষ্যত্বের চরমতম অবমাননা! বাংলার গৃহকর্মের জন্য কৃত (ক্রীত!) কর্মীদের, বিশেষকরে শিশু গৃহকর্মীদের 'জীবনমানে' সর্বশেষ জনসম্মুখে প্রকাশিত নজির হাওয়া বেগম। আর গৃহকর্মীকে কতটা মানব হিসেবে দেখতে হয়, কতটা অধিকার তাকে দিতে হয়, 'মানবাধিকারকর্মী' পরিচয়ে মোস্তাকিম শরীফ যেন তার মানদণ্ডই দেশের দরবারে তুলে ধরেছেন!
কায়েমি স্বার্থের গোড়ায় পানি ঢালতে বিশ্বব্যাপী সাম্রাজ্যবাদীদের সংকট তৈরির ভূরি ভূরি আলামত এখনও টাটকা। এখানে-ওখানে যুদ্ধবিগ্রহ, দাঙ্গা-ফ্যাসাদ, দুর্ভিক্ষ, অস্থিরতা জিঁইয়ে রাখায় ওস্তাদ লোক আধিপত্যবাদীরা। আর তাদের হয়ে শুধু নিজেদের পকেটে রেস্ত ভরার ধান্ধায় দেশ 'বিকিয়ে' দেওয়ার শাসকেরও অভাব হয়নি কালে কালে। সুদানের দুর্ভিক্ষের মূলেও ছিল স্বার্থবাদী ও সম্পদভোগী পক্ষগুলোর দোস্তালি। তেলের জবরদখলি অটুট রাখতে ক্ষমতার খড়গ দুর্বলদের বধের কৌশল নেয় সবল এলিটরা। উত্তরের আধিপত্যবাদী শাসকদের বুটের তলায় দক্ষিণের নুবাদের নিষ্পেষণে পশ্চিমাদের ট্যাঁ-ফোঁ শোনা যায় না, তেল উত্তোলনের ভার যখন মার্কিন কম্পানির হাতে। উপসাগরীয় যুদ্ধে সুদান সরকার সাদ্দামের পক্ষে হেলে পড়লে তবে তারা 'সোজা' হয়। ততদিনে সংঘাত-সংঘর্ষে-গৃহযুদ্ধের ফাঁন্দে পড়া বগা সুদান কাঁন্দে। আর অনাহারে কাঁন্দার সামর্থ্যটুকুও হারিয়ে ফেলে সুদানিরা। বিশ্বের সব 'সুদানের'ই রাষ্ট্রিক সংকটের গোড়ার সুলুক সন্ধান তাই জরুরি।
রাষ্ট্রের গাফিলতি, নেতৃত্বের ব্যর্থতা কিম্বা মতলববাজ গোষ্ঠীর কেরামতি— সংকটের কারণ যা-ই হোক, তাতে সাধারণ মানুষের কোনও হাত থাকে না। অথচ জান ও মাল দিয়ে খেসারত দিতে হয় তাদেরই। সাম্রাজ্যবাদী প্রভু আর তাদের দেশীয় স্বার্থান্ধ সাগরেদদের কারসাজিতে সৃষ্ট সংকটে দেশে দেশে হাওয়া বেগমদের অধিকারহীনতা তাই স্রেফ পরিকল্পিত। গৃহকর্মের মোড়কে বাংলাদেশের হাওয়া বেগমদের ভাগ্যও এই একই ফলায় গাঁথা— দুটিই 'মানবসৃষ্ট' সংকট; কেবল প্রতীচ্যের সাম্রাজ্যবাদীদের প্রত্যক্ষ যোগ নেই এখানে। কিন্তু পরোক্ষে প্রভুত্ববাদী মানসিকতাই প্রাচ্যের শরীফ-নাইমারা ধারণ করেন। বাংলার এই নব্য-বর্ণবাদীদের ভোগবিলাসের মূল্য চুকাতে হচ্ছে হতভাগ্য হাওয়াদের! এই বঞ্চনা-ব্যবস্থার শেষ কবে হবে?
রাষ্ট্র হাওয়াদের দুবেলা দুমুঠো খাদ্যের সংস্থান করতে ব্যর্থ। তার চেয়েও বেশি ব্যর্থ তাদের কর্মক্ষেত্রের নিষ্পেষণ থেকে রক্ষায়। আইনে 'শিশুশ্রম' না থাক, পেটপোড়ানি মানুষেরা আইন বোঝে না। হাওয়ারা কুঁড়েঘর ছেড়ে তাই কর্মস্থল ফ্ল্যাটবাড়িতে ওঠে, যে ফ্ল্যাট কারাগার-সমান! যেখানে হাওয়াদের শৈশব হারিয়ে যায়, কৈশোর পালিয়ে যায়; স্বপ্নেরা বেঁচে থাকে না। তারপরও 'মন-মরা' হাওয়াদের প্রাণে বেঁচে থাকা নিয়েও দেখা দেয় সংশয়!
শৈশবের নির্মল রোমাঞ্চকর ব্যাপ্তিকে নাকি মানুষ তার বাকি জীবন দিয়েও ছাড়িয়ে যেতে পারে না। সেই অপাপবিদ্ধ অনতিক্রম্য সময়ে যে 'পাপে' বিদ্ধ হাওয়া, তার ক্ষত শরীরে সারলেও মন থেকে কি মুছবে কোনও দিন?
না মুছুক, তাতে রাষ্ট্র-রাজনীতির কী আসে-যায়? দেশের তলানিতে পড়া থাকা হাওয়ারা ক্ষমতা ও ভোটের পালে হাওয়া দিতে পারে বটে, কিন্তু নিজেরা থাকে হাওয়াবিহীন; যে হাওয়ার নাম অধিকার, অরাজনৈতিক অধিকার!