Published : 23 Mar 2018, 07:53 PM
মার্চের ২৩ তারিখ বিশ্ব আবহাওয়া দিবস। আবহাওয়া, জল এবং জলবায়ু জনকল্যাণ, জনস্বাস্থ্য এবং খাদ্য নিরাপত্তার সাথে সরাসরি জড়িত। এ প্রয়োজনীয় উপাদানগুলো কখনো কখনো ভয়ংকর দুর্যোগের রূপ ধারণ করে। বিশ্বের ক্রমবর্ধমান জনসংখ্যা প্রতিনিয়ত আবহাওয়া, জলবায়ু এবং জল বিষয়ক নানাবিধ ভয়াল দুর্যোগের সম্মুখীন হচ্ছে। এসব ঝুঁকিপূর্ণ দুর্যোগের অন্যতম হলো ঘূর্ণিঝড়, জলোচ্ছবাস, ভারী বৃষ্টিপাত, ভূমিধ্বস, তাপ ও শৈত্য প্রবাহ, খরা, কালবৈশাখী, শিলা ঝড়, টর্নেডো, অকাল বন্যা প্রভৃতি।
সাম্প্রতিক গবেষণাপত্রের আলোকে বলা যায় দীর্ঘমেয়াদী জলবায়ু পরিবর্তন এ ধরনের দুর্যোগের তীব্রতা এবং মাত্রা বৃদ্ধি করছে। পাশাপাশি সমুদ্রতলের বৃদ্ধি এবং সাগরের অম্লত্ব সৃষ্টি করছে। অপরিকল্পিত নগরায়ণ এবং মেগাসিটির অসুন্দর রকমের বিস্তৃতি আমাদের জনজীবনকে করছে আরও বেশি সঙ্কটাপন্ন। এ বাস্তবতা মোকাবেলায় আমাদের আগের তুলনায় আরও বেশি 'আবহাওয়া প্রস্তুত, জলবায়ু-স্মার্ট' এবং জল-বিষয়ক বোধ-বুদ্ধি সম্পন্ন হতে হবে। এটি এ বছরের বিশ্ব আবহাওয়া দিবসের মূল প্রতিপাদ্য।
এজন্য বিশ্ব আবহাওয়া সংস্থা (ডব্লু এম ও) এবং জাতীয় আবহাওয়া – জলবিজ্ঞান পরিষেবাগুলোর (এনএমএইচএসএস) অন্যতম অগ্রাধিকার হলো আবহাওয়া, জলবায়ু এবং হাইড্রলজি (বৃষ্টিপাত) সম্পর্কিত ঘটনার ঝুঁকির থেকে জীবন, জীবিকা এবং সম্পত্তি রক্ষা করা। এর ফলে, ডব্লুএমও এবং তার সদস্যরা টেকসই উন্নয়ন, জলবায়ু পরিবর্তন অভিযোজন এবং দুর্যোগ ঝুঁকি হ্রাসের ওপর বিশ্বব্যাপী কর্মসূচি সমর্থন করে আসছে।
ডব্লিউএমও এবং জাতীয় আবহাওয়া- জলবিজ্ঞান পরিষেবাগুলি দৈনিক আবহাওয়ার পূর্বাভাস থেকে দীর্ঘমেয়াদী জলবায়ু পূর্বাভাস প্রস্তুত করে যেগুলি জনসমাজকে আবহাওয়া প্রস্তুত ও জলবায়ু স্মার্ট হতে সহায়তা করে। তাছাড়া জাতীয় হাইড্রলজি পরিষেবা কৃষি, শিল্প, জ্বালানি ও মানুষের ব্যবহারের উপযোগী বিশুদ্ধ জলের যথাযথ ব্যবস্থাপনার জন্য অত্যাবশ্যক।এই পরিষেবাগুলি আমাদেরকে আবহাওয়া, জলবায়ু এবং জল সম্পর্কিত দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা এবং অধিকার অর্জনে ক্ষমতায়ন করে।
প্রাথমিক সতর্কতা ব্যবস্থা এবং দুর্যোগের ঝুঁকি হ্রাসের অন্যান্য ব্যবস্থাগুলি জনসমাজকে স্বাভাবিক অবস্থায় ফেরাতে কার্যকর ভূমিকা রাখে। জলবায়ু পরিষেবা আমাদের জলবায়ু পরিবর্তন প্রশমনসহ অভিযোজনের সিদ্ধান্ত জানিয়ে সহযোগিতা করে। হাইড্রোলজিক্যাল পর্যবেক্ষণ ডাটা জলসম্পদের গুণগত ও পরিমাণগত ধারণার পাশাপাশি জলচক্র অনুধাবনে সাহায্য করে যা দিয়ে বন্যা ও খরার পূর্ব প্রস্তুতি নেয়া সম্ভব।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে আবহাওয়া বিজ্ঞান বিষয়ে মাস্টার্স কোর্স চালু হয়েছে এ বছরের শুরুতে। বাংলাদেশের আবহাওয়া বিজ্ঞানের ইতিহাসে এটি একটি মাইলফলক। বিশ্বে আবহাওয়া ও জলবিদদের অবদানের ক্ষেত্র অনেকগুলো। উল্লেখযোগ্য ক্ষেত্রগুলো হলো আবহাওয়া ও জলবায়ু নিরীক্ষণ, বৈজ্ঞানিক উন্নয়ন, এভিয়েশন শিল্প, পর্যটন ও বিনোদন, জনস্বাস্থ্য ও নিরাপত্তা, কৃষি, জ্বালানি, দূষণ নিয়ন্তণ, জল সম্পদ ব্যবস্থাপনা, পরিবহন, উন্নয়ন কৌশল, আন্তর্জাতিক সহযোগিতা, পরিবেশ সুরক্ষা প্রভৃতি। টেকসই উন্নয়নের স্বার্থে আবহাওয়া ও জলবিজ্ঞান গবেষণায় আন্তরিক উদ্যোগ প্রয়োজন।
সম্প্রতি বাংলাদেশ সরকার বিশ্ব ব্যংকের অর্থায়নে ১১৩ মিলিয়ন ডলারের (৯৩৮ কোটি টাকা সমতুল্য) 'আবহাওয়া এবং জলবায়ু পরিষেবা বিষয়ক আঞ্চলিক প্রকল্প' বাস্তবায়নের উদ্যোগ নিয়েছে। এ মেগা প্রকল্পের অন্যতম উদ্দেশ্য হলো জনসমাজের এবং বিশেষভাবে কৃষকের নির্ভরযোগ্য আবহাওয়া, জল ও জলবায়ুর পূর্বাভাস প্রদান যাতে কৃষকেরা সহজে এ ধরণের বিশ্বাসযোগ্য পূর্বাভাস কাজে লাগাতে সমর্থ হয়।
এ ধরনের মেগা প্রকল্পের দীর্ঘমেয়াদী সুফল অব্যাহত রাখতে হলে আবহাওয়া জলবায়ু বিজ্ঞানের সাম্প্রতিকতম বিষয়গুলোর গবেষণায় উল্লেখযোগ্য অগ্রাধিকার অনস্বীকার্য। আবহাওয়া জলবায়ু বিজ্ঞান বিষয়ক প্রশিক্ষণ ও গবেষণা এই প্রকল্পের অন্যতম অগ্রাধিকার হবে এটা প্রত্যাশিত।
বাংলাদেশের একমাত্র আবহাওয়া বিজ্ঞান বিষয়ক ঢাকাস্থ সার্ক আবহাওয়া গবেষণা কেন্দ্র (এস এম আর সি) আবহাওয়া বিজ্ঞান গবেষণায় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখে আসছিলো। সার্ক আবহাওয়া গবেষণা কেন্দ্রের বিজ্ঞানীগণ এবং গবেষণা কর্মকর্তারা বিগত সময়ে তাদের বৈজ্ঞানিক গবেষণাকর্ম শতাধিক গবেষণা জার্নালে প্রকাশ করেছেন। তাদের ওই সকল গবেষণাকর্ম আমেরিকা, ভারত, জাপান, জার্মানিসহ বিশ্বের বিভিন্ন বিজ্ঞান জার্নালে প্রকাশিত এবং সমাদৃত হয়েছে। অনেক দেশ এই গবেষণাকর্মের ফলাফল উচ্চতর গবেষণা, পূর্বাভাস সংশ্লিষ্ট কাজে ব্যবহার করছে। এ সকল গবেষণা আন্তর্জাতিক জার্নালে প্রায়শ, উদ্ধৃত করা হয়।
এস এম আর সি ১৯৯৫ সালে প্রতিষ্ঠা থেকে ২০১৫ সালে পর্যন্ত নিউমেরিকাল ওয়েদার প্রেডিকশন, ডাটা এসিমিলেশন, সিজনাল ওয়েদার প্রেডিকশন প্রভৃতি বিষয়ে দক্ষিণ এশিয়ার আবহাওয়া অধিদপ্তরের কর্মকর্তাদের দেশে-বিদেশে প্রশিক্ষণ ও প্রযুক্তি দিয়ে আসছিলো।
এই কেন্দ্রের গবেষণার সুবিধা নিয়ে ঢাকা, জাহাঙ্গীরনগর, শাহজালাল, রাজশাহী, খুলনা বিশ্ববিদ্যালয়, বুয়েট, খুয়েট প্রভৃতি থেকে শিক্ষার্থীরা এমএস, এমফিল, পিএইচডি ডিগ্রি নিয়েছেন ও অনেকে দেশের বাইরে গবেষণা চালিয়ে যাচ্ছেন। এ ধরনের গবেষণা কেন্দ্র দেশে থাকলে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা উন্নত গবেষণা করে দেশকে এগিয়ে নিয়ে যেতে পারবে। পাশের দেশ ভারতে অনেক বিশ্ববিদ্যালয়ে আবহাওয়া-জলবায়ু বিজ্ঞান পড়ানো হয়। এমনকী সরকারি ও বেসরকারি পর্যায়ে শতাধিক আবহাওয়া-জলবায়ু বিজ্ঞান বিষয়ক প্রতিষ্ঠান আছে। চাকরী সুবিধা ও উন্নত গবেষণার সুযোগ থাকায় তাদের দেশের তরুণ বিজ্ঞানীরা উচ্চ শিক্ষা শেষ করে দেশে চলে আসে। এমন সুন্দর ভাবনা আমাদের দেশে বাস্তবে হোক এই প্রত্যাশা।
গণপূর্ত মন্ত্রণালয়ের ব্যয়ে নির্মিত এসএমআরসি ভবনটিতে রয়েছে কোটি কোটি টাকার সম্পদ ও উন্নতমানের কম্পিউটার সরঞ্জামাদি। যা দুই বছরের ও বেশি সময় অব্যবহৃত থেকে নষ্ট হতে চলেছে।
কেন্দ্রটির গবেষকরা সকলে স্ব স্ব ক্ষেত্রে শিক্ষা জীবনে উজ্জ্বল নক্ষত্রের মত ছিল। গবেষকরা আবহাওয়া বিজ্ঞান, জল বিজ্ঞান, পরিবেশ বিজ্ঞান ইত্যাদি বিষয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের সর্বোচ্চ ডিগ্রি পিএইচডি ও আন্তর্জাতিক মানের প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত। বিশ্বের স্বনামধন্য বিজ্ঞানীদের তত্ত্বাবধানে চাকুরী ও গবেষণা কর্মের সুযোগ পেয়ে তারা দেশকে কিছু দিতে পারবে বলে আত্মপ্রত্যয়ী, উদ্যোগী ও আশাবাদী ছিল।
সারা বিশ্ব এখন আবহাওয়া-জলবায়ু বিজ্ঞান গবেষণায় এগিয়ে যাচ্ছে। বাংলাদেশের একমাত্র আবহাওয়া-জলবায়ু বিজ্ঞান গবেষণা চালু রাখা অত্যন্ত দরকার। বাংলাদেশ সরকার এখন টেকসই উন্নয়নের উপর গুরুত্ব দিচ্ছে। এজন্য আবহাওয়া, জলবায়ু, সমুদ্র বিজ্ঞান, দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা, জল বিজ্ঞান বিষয়ে গবেষণায় অধিকতর মনোযোগ দেয়া প্রয়োজন।
নিউমেরিকাল ওয়েদার প্রেডিকশন এর ধারাবাহিক উন্নতি আগাম পূর্বাভাস ও সতর্কতায় এক যুগান্তকারী অর্জন। বর্তমান সময়ে পাঁচ দিনের পূর্বাভাস দুই দশক আগের দুই দিনের পূর্বাভাসের চেয়ে ও ভালো। এ চলমান অগ্রগতি আগাম সতর্কতা ব্যবস্থায় উল্লেখযোগ্য অবদান রেখে চলেছে। ঘূর্ণিঝড়ের আগাম পূর্বাভাস এখন সারা বিশ্বে বিশ্বাসযোগ্যতা অর্জন করেছে পাশাপাশি জীবন ও সম্পদের ক্ষয়-ক্ষতি অনেকগুণ কমিয়ে দিয়েছে ।
বজ্রপাত, টর্নেডো ও কাল বৈশাখীর মতো প্রলয়ংকারী ঘটনার সময় এবং স্থান ভিত্তিক আগাম বিশ্বাসযোগ্য পূর্বাভাস জনজীবন নিরাপত্তায় অপরিহার্য। এটি আবহাওয়া বিজ্ঞানের একটি অন্যতম চ্যালেঞ্জ। এজন্য সুদক্ষ গবেষক দলের সুনিবিড়, সুনিপুন গবেষণা অব্যাহত রাখা একান্ত প্রয়োজন।
২০০৯ সালে ঢাকায় প্রতিষ্ঠিত সার্ক আবহাওয়া গবেষণা কেন্দ্র 'সার্ক স্টর্ম' (সার্ক সিভিয়ার ঠান্ডারস্টর্ম অবসার্ভেশনস অ্যান্ড রিজিওনাল মডেলিং) প্রকল্প বজ্রপাত গবেষণায় অনবদ্য ভূমিকা রেখেছিলো। তাদের অর্জন অত্যন্ত মর্যাদাপূর্ণ পাবলিকেশন 'বুলেটিন অব আমেরিকান মিটিওরোলোজিক্যাল সোসাইটি – বামস' এ প্রকাশিত হয়েছে।
(দেখুন: Das Someshwar, U. C. Mohanty, Ajit Tyagi, D. R. Sikka, P. V. Joseph, L. S. Rathore, A. Habib, S. Baidya, K. Sonam, and A. Sarkar, 2014: The SAARC STORM – A Coordinated Field Experiment on Severe Thunderstorm Observations and Regional Modeling over the South Asian Region. Bull. Amer. Meteor. Soc. DOI: http://dx.doi.org/10.1175/BAMS-D-12-00237.1)
গবেষণা কেন্দ্রটি ২০১৫ সালে বন্ধ করে দিয়ে এ ধরণের অতীব প্রয়োজনীয় জনবান্ধব গবেষণার মৃত্যু সুনিশ্চিত করা হয়েছে কিনা এ প্রশ্ন সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ ও মন্ত্রণালয়গুলোর কাছে থাকলো।
২০১৫ সালের ডিসেম্বর মাসে দেশের একমাত্র আবহাওয়া বিজ্ঞান গবেষণা প্রতিষ্ঠানের অন্তিমযাত্রার অপরিণামদর্শী অমানবিক সিদ্ধান্ত গবেষণার ধারাবাহিকতায় এক ব্যাপক ক্ষতি। সবচেয়ে বড় অমানবিকতা ছিল ২০ বছর ধরে ধাপে ধাপে গড়ে উঠা কেন্দ্রটির স্থায়ী কর্মচারী- কর্মকর্তা ও তাদের পরিবার পরিবারের ভবিষ্যত ঝুঁকিপূর্ণ করে রাখা।
জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব মোকাবেলায় টেকসই উন্নয়নের জন্য উন্নত, দক্ষ ও সক্ষমতা সম্পন্ন মেধাশক্তি ও প্রযুক্তি দরকার। এজন্য সার্ক আবহাওয়া গবেষণা কেন্দ্র (এস এম আর সি)-র আদলে একটি আবহাওয়া-জলবায়ু-দুর্যোগ গবেষণা কেন্দ্র এখন সময়ের দাবী।