Published : 23 Feb 2018, 08:07 PM
১৮ ফেব্রুয়ারি উত্তর-পূর্ব ভারতের পাহাড়ী রাজ্য ত্রিপুরার বিধানসভা নির্বাচনে ভোট শেষ হয়েছে। এবার এই রাজ্যের নির্বাচন সারা ভারতের দৃষ্টি কাড়তে সক্ষম হয়েছে। এমনিতে এর আগের নির্বাচনগুলো নিয়ে সারা ভারতব্যাপী এত আলোচনা এর আগে হয়নি। কেননা আগের নির্বাচনগুলোতে একটি দৃশ্যই নিত্য ছিল (ব্যতিক্রম শুধু ১৯৭২ আর ১৯৮৮ এর নির্বাচন)। সেটি হলো লাল ঝাণ্ডার জয়। কিন্তু এবারের নির্বাচনে ভারতের ক্ষমতাসীন উগ্র সাম্প্রদায়িক শক্তি বিজেপি বামপন্থার প্রধান প্রতিদ্বন্দ্বী হয়ে উঠেছে। এমনিতেই উত্তর-পূর্ব ভারতের বেশ কয়েকটি রাজ্যে সাম্প্রদায়িক মেরুকরণের জয়জয়কার ঘটেছে। সেই প্রতিক্রিয়ার ঝড় এবার প্রগতির ঝাণ্ডাবাহক বামপন্থীদের দুর্ভেদ্য দুর্গে কেমন আঘাত হানে সেটিই দেখবার বিষয়।
১৯৭২ সালে রাজ্য হিসেবে ঘোষিত হওয়ার পর এবারের নির্বাচনে প্রথমবারের মত মূল প্রতিদ্বন্দ্বিতায় কংগ্রেস নেই। ভারতীয় জনতা পার্টি বা বিজেপিই এবারের নির্বাচনে ভারতীয় কমিউনিস্ট পার্টির (মার্কসবাদী) প্রধান প্রতিদ্বন্দ্বী হিসেবে বিবেচিত হচ্ছে। আর বিজেপি এই নির্বাচনে জেতার জন্য মরিয়া হয়ে উঠেছে। তারা তথাকথিত উন্নয়নের আওয়াজ তুলে বাজিমাত করতে চাইছে। তাদের হেভিওয়েট নেতা থেকে শুরু করে বিভিন্ন রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রীদের নির্বাচনী প্রচারণায় অংশগ্রহণ এই নির্বাচনকে ভিন্ন মাত্রা দিয়েছে।
এমনকী প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদিও একাধিকবার এই রাজ্যে নির্বাচনী প্রচারণায় অংশ নিয়েছেন। বিজেপি আরো জড়ো করেছিল তাদের সমর্থক বিনোদন জগতের তারকাদের। আর তারা টাকার স্রোতও বইয়ে দিয়েছে। বিজেপির সবচেয়ে বড় তুরুপের তাস আদিবাসীদের সংগঠন ইন্ডিজেনাস পিপলস ফ্রন্ট অব ত্রিপুরা (আইপিএফটি)। তাদের সমর্থন আদিবাসী অধ্যুষিত ২০টি কেন্দ্রে বিজেপিকে বড় ধরনের সহায়তা করতে পারে বলে বিশ্লেষকদের ধারণা।
সিপিআইএম নেতৃত্বাধীন ত্রিপুরার বামপন্থীদের নেতৃত্ব দিচ্ছেন রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী মানিক সরকার। বিজেপির সাম্প্রদায়িক মেরুকরণের বিপরীতে তাদের স্লোগান-'শান্তি, একতা, উন্নয়ন: ত্রিপুরার অখণ্ডতা'। ২০১৩ সালের নির্বাচনে ৬০টি কেন্দ্রের মধ্যে বামপন্থীরা জিতেছিল ৫০টিতে। এর মধ্যে সিপিআইএমের একারই ৪৯টি এবং অন্য শরীক সিপিআইয়ের ১টি।
বামপন্থীরা ৫২ দশমিক ৩৩ শতাংশ ভোট পেয়েছিল যার মধ্যে সিপিআইএমের একারই ৪৮ দশমিক ১১ শতাংশ। কংগ্রেস ৪৮টি কেন্দ্রে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করে ৪৫ দশমিক ৭৫ শতাংশ ভোট পেয়েছিল। অন্যদিকে বিজেপি ৫০টি কেন্দ্রে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করে ১ দশমিক ৮৭ শতাংশ ভোট পেয়েছিল। আর ২০১৪ সালের লোকসভা নির্বাচনে বামপন্থীরা দুটি আসনেই বিপুল জয়লাভ করে যার দুজন প্রার্থীই ছিলেন সিপিআইএমের। তখন তারা পেয়েছিল ৬৪ দশমিক ৭ শতাংশ ভোট। কংগ্রেস পেয়েছিল ১৫ দশমিক ৩৮ শতাংশ আর বিজেপি ৫ দশমিক ৭৭ শতাংশ। কিন্তু দৃশ্যপট কিছুটা পাল্টাতে থাকে ২০১৫ এবং ২০১৬ এর চারটি বিধানসভা কেন্দ্রের উপনির্বাচনে। ঐ নির্বাচনগুলোতে তিনটি আসনেই দ্বিতীয় হয় বিজেপি। অর্থাৎ কংগ্রেস বিজেপির কাছে তার স্থান হারায়। আর সেখান থেকেই রাজ্যটিতে বিজেপির চোরাস্রোত বইতে থাকে।
অবশ্য এই ধরনের স্রোত ত্রিপুরায় নতুন নয়। ২০১৬ সালে ভারতের আরেক রাজ্য পশ্চিমবঙ্গ বিধানসভা নির্বাচনে ক্ষমতাসীন তৃণমুল কংগ্রেসের বিরুদ্ধে বামপন্থীরা এবং কংগ্রেস জোট বাঁধে। কংগ্রেসের এই অবস্থানকে বিরোধিতা করে তখন তাদের ছয়জন বিধায়ক তৃণমুল কংগ্রেসে যোগ দেন। কিন্তু তৃণমুলের এই স্রোত বেশি দিন টেকেনি। ২০১৭ এর অগাস্টে ঐ ছয়জন বিধায়ক বিজেপিতে যোগ দেন। এছাড়া কংগ্রেসের আরো দুইজন বিধায়কও বিজেপিতে যোগ দিয়েছেন। বিজেপি এবার ত্রিপুরার নির্বাচন জিততে যথেষ্ট মরীয়া হয়ে উঠেছে। তারা ইতিমধ্যে উত্তর-পূর্ব ভারতের অরুণাচল, মনিপুর এবং আসামের শাসনব্যবস্থা নিজেদের করায়ত্ত করেছে। তাই এবার ত্রিপুরা তাদের জন্য বড় চ্যালেঞ্জ। এজন্য তারা সর্বশক্তি নিয়োগ করেছে। তারা ত্রিপুরায় তাদের নির্বাচনী প্রচারণার প্রধান তত্ত্বাবধায়ক হিসেবে নিয়োগ দিয়েছে আসামের জনপ্রিয় বিজেপি নেতা এবং মন্ত্রী হিমান্ত বিশ্বশর্মাকে।
ত্রিপুরায় বিজেপির জয়লাভের প্রধান অন্তরায় বর্তমান সিপিআইএমের মুখ্যমন্ত্রী মানিক সরকারের ভাবমুর্তি। মানিক সরকারকে ভারতের দরিদ্রতম মুখ্যমন্ত্রী হিসাবে ডাকা হয়। তাঁর ব্যাঙ্ক ব্যালান্স মাত্র ২ হাজার ৪১০ রুপি এবং তাঁর হাতে নগদ আছে মাত্র ১ হাজার ৫২০ রুপি। তিনি তাঁর বেতনের সবটাই পার্টি তহবিলে জমা দেন। তাঁর সম্পত্তি বলতে আগরতলার বাইরের ৫১৫ স্কয়ারফিটের একখণ্ড জমি, যেটি তিনি তাঁর বোনের সঙ্গে উত্তরাধিকারসূত্রে ভোগ করছেন। অবশ্য বিজেপি তাঁর এই স্বচ্ছ ভাবমূর্তিকে আক্রমণ করে ফায়দা লুটতে চাইছে। তাদের অভিযোগ মানিক সরকার দুর্নীতির প্রশ্রয়দাতা। বিজেপি অভিযোগ তুলেছে যে বামপন্থী সরকার চিট ফান্ড কোম্পানি রোজ ভ্যালি দুর্নীতির সঙ্গে জড়িত, যার মালিক গৌতম কুন্ডু এখন জেলে।
ভারতীয় সিবিআই ইতিমধ্যে দুজন সিপিআইএম শীর্ষ নেতাকে জিজ্ঞাসাবাদ করেছে। এছাড়া বর্তমান সরকারের জন্য আরেকটি বিব্রতকর বিষয় হলো ২০১৭ সালের মার্চে সুপ্রিম কোর্ট সরকারী বিদ্যালয়ে ২০১৪ সালে নিয়োগপ্রাপ্ত ১০ হাজার ৩২৩ শিক্ষকের নিয়োগ অনিয়মের অভিযোগে বাতিল করে দিয়েছে। এছাড়া বেকারত্বের সমস্যাও তাদের স্বচ্ছ ভাবমূর্তির জন্য আরেকটি প্রতিবন্ধকতা। ৩৭ লাখ জনসংখ্যার ৯৭ শতাংশ স্বাক্ষরতাসক্ষম হলেও বেকারত্বের হার ১৯ দশমিক ৭ শতাংশ।
ত্রিপুরার বামপন্থীদের এবার আরেকটি উদ্বেগের বিষয় হিসেবে বলা হচ্ছে বিজেপির সঙ্গে ইন্ডিজেনাস পিপলস ফ্রন্টের জোট। অবশ্য তারা এই জোটকে তেমন একটা পাত্তা দিচ্ছেন না। কেননা আদিবাসীদের মধ্যে তাদের শক্ত অবস্থান রয়েছে। আদিবাসী অঞ্চলগুলোর স্থানীয় নির্বাচনে গত ১৫ বছর ধরে সিপিআইএমের আদিবাসী সংগঠন গণমুক্তি পরিষদ জয়লাভ করে আসছে। ২০০৫, ২০১০ এবং ২০১৫ এর স্থানীয় নির্বাচনে বামপন্থীরা ২৮টি আসনের মধ্যে সবগুলোতেই জয়লাভ করেছে। ২০১৫ সালের গ্রাম-পঞ্চায়েত নির্বাচনে তারা ৯৬ শতাংশ আসন পেয়েছে এবং তাদের প্রাপ্তভোট ছিল ৫৮শতাংশ।
ইন্ডিজেনাস পিপলস ফ্রন্ট বা আইপিএফটি আলাদা রাজ্যের দাবিতে গত প্রায় ১৫ বছর ধরে সশস্ত্র সংগ্রাম করছে। তাদের কিছুটা সমর্থন আদিবাসীদের মধ্যে রয়েছে। গত বছরের সেপ্টেম্বরে তাদের সঙ্গে সিপিআইমের সংঘর্ষে শান্তনু ভৌমিক নামে একজন সিপিআইএম সমর্থক সাংবাদিক নিহত হন। তবে এর মানে এই নয় যে আদিবাসীদের সিংহভাগ অংশ আইপিএফটির এই দাবিকে সমর্থন করে। বরং তাদের এই সহিংসতার সবচেয়ে বড় বলি হলো আদিবাসীরা। সিপিআআইএম নেতৃত্বাধীন বামপন্থী সরকার এই সহিংসতাকে ভালোভাবেই মোকাবেলা করেছে এবং শান্তি ও উন্নয়ন আনতে বড় ভূমিকা রেখেছে। তাই আদিবাসীরা এবার বিজেপির দিকে ঝুঁকবে তা বলা যাচ্ছে না।
কংগ্রেসের ভোটও একটা উল্লেখযোগ্য অনুঘটক হিসাবে কাজ করবে বলে ধারণা করা যাচ্ছে। তবে তাদের ভোট বিজেপির দিকে যাবে এটাও মনে করা ভুল হবে। বরং শহুরে আসনগুলোতে ত্রিমুখী লড়াই হবে। আর কংগ্রেস যদি কেন্দ্রগুলোতে এক-দেড় হাজার ভোট কাটতে সক্ষম হয় তবে পোয়াবারো হবে বামপন্থীদের। আর এদিকে বিজেপির যথেষ্ট সাংগঠনিক শক্তি এবং শক্তিশালী নেতৃত্বের অভাব রয়েছে।
ত্রিপুরার নির্বাচনে বামপন্থীরা এবার অজানা প্রতিদ্বন্দ্বীর সঙ্গে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করছে। তবে তাদের কাছে এটা বড় চ্যালেঞ্জ হলেও বিজেপির কাছেও এটা গুরত্বপূর্ণ। সম্প্রতি তারা রাজস্থান এবং গুজরাটে ধাক্কা খেয়েছে। তথাকথিত উন্নয়নের ফানুস দেখিয়ে ভারতীয় কর্পোরেট শক্তির প্রতিনিধিত্বকারী উগ্র সাম্প্রদায়িক মোদী ম্যাজিক আগামীতে কতটা প্রভাব ফেলবে তার কিছুটা ইঙ্গিত এই নির্বাচন দেবে। আগামীতে যে কয়টি বিধানসভা নির্বাচন রয়েছে এবং ২০১৯ এর লোকসভা নির্বাচনেও এর প্রভাব পড়বে।
ভারতীয় গণতন্ত্র একটি বিপজ্জনক পরিস্থিতিতে রয়েছে। ভারতীয় ধর্মনিরেপক্ষতা আজ ভয়াবহ হুমকির সম্মুখীন। বিজেপির নেতৃত্বে যে সাম্প্রদায়িক মেরুকরণ চলছে তা যদি রোখা না যায় তবে ভারতের ধর্মনিরেপক্ষ শক্তিগুলো মারাত্মক বিপদের সম্মুখীন হবে। আর বামন্থীরাই যে একমাত্র আপসহীন ধর্মনিরপেক্ষ শক্তি তা বলার অপেক্ষা রাখে না। বহুত্ববাদী ভারতের এই চরিত্রকে তারা রক্ষা করতে পারবে। তাই ত্রিপুরার এই নির্বাচন ভারতে যে সাম্প্রদায়িক মেরুকরণের অগ্রযাত্রাকে আরো বেগবান করবে নাকি বামপন্থার দুর্ভেদ্য দুর্গকে রক্ষা করবে তা জানা যাবে ৩রা মার্চ।