Published : 18 Jan 2018, 08:40 PM
ঠিক করে রেখেছি এ মাসের শেষেই যশোর রোডে যাবো। কিন্তু গাছ কাটার টেন্ডার দেয়া হয়েছে, এ মাসেই কাজ শুরুর খবর দেখে কিছুটা দুশ্চিন্তায় পড়েছিলাম। হয়তো গাছগুলো আর দেখাই হবে না।
কিন্তু ১৮ জানুয়ারি আদালত গাছ কাটায় ৬ মাসের স্থিতাবস্থা দিয়েছে। এটা কিছুটা স্বস্তির খবর। শেষ পর্যন্ত হয়তো যশোর রোড আর থাকবে না। কিন্তু দেখার শখটা তো মিটবে।
কেউ কেউ গাছ কাটার বিরোধিতাকারীদের 'পরিবেশ মৌলবাদী' নাম দিয়েছেন। এই নামটা আমার বেশ পছন্দ হয়েছে। তরকারিতে লবণ কম হলে যেমন পুষিয়ে নেয়া যায়, পরিবেশ নিয়ে মৌলবাদী হলেও সেটা সার্বিক অর্থে সবার উপকারেই আসে। তবে লবণ বেশি হলে তখন 'এক্সট্রা' পানি দিয়ে জোড়াতালি দিতে হয়, আসল স্বাদ নষ্ট হয়। পরিবেশের সাথে সে এক্সপেরিমেন্টে মানবজাতি অনেক করেছে, আর কতো?
বাংলাদেশের মতো ছোট দেশে নতুন অবকাঠামো করতে গেলে গাছ কাটা পড়বেই। কিন্তু সেটা না করে বিকল্প উপায়ে উন্নয়ন করা যায় কি না, সে চিন্তা কি আমরা করি? কেন বারবারই আমরা ধরেই নেই গৃহীত সিদ্ধান্ত ছাড়া আর কিছুই করার নেই?
ক্রিকেট খেলাতেও শতভাগ নিশ্চিত না হলে 'বেনিফিট অব ডাউট' দেয়ার নিয়ম রাখা হয়েছে। অথচ যারা আমাদের বেঁচে থাকার অক্সিজেন জোগায়, তাদের আমরা কোন বেনিফিট অব ডাউট দিতে রাজী না। গাছেরা কি এতোটাই তুচ্ছ হয়ে পড়েছে?
এমন সর্বগ্রাসী উন্নয়নের পক্ষে যারা চোখ বন্ধ রেখে সমর্থন দিয়ে যান, তাদেরও আমি একটা নাম দিয়েছি- 'উন্নয়ন সন্ত্রাসী'। মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের মতো এরাও মনে করেন জলবায়ু নিয়ে 'অন্ধ হলেই প্রলয় বন্ধ' থাকবে।
যশোর রোড এবং এর গাছ নিয়ে আমার কথা বলার কারণ শুধু গাছ না, এর সাথে জড়িয়ে থাকা ইতিহাসও। ফলে এখন পর্যন্ত এ নিয়ে যে যুক্তিগুলো উঠে এসেছে, তার প্রেক্ষিতে আমার পাল্টা যুক্তিগুলোই শুধু তুলে ধরার চেষ্টা করছি।
যারা যশোর রোডে গাছ কাটার সিদ্ধান্তকে সমর্থন করছেন, তাদের বেশিরভাগই ইতিহাস, অনুভূতিটুকু বাদ দিয়ে শুধু গাছ কাটার বিরোধিতাকেই হাইলাইট করছেন। এর বড় একটি কারণ, পরিবেশের ক্ষতি পোষাতে, একটি গাছ কাটলে তিনটি গাছ লাগাবো- কথাটি সহজেই বলা যায়। কিন্তু একটি ইতিহাস মুছে গেলে তিনটি ইতিহাস রচনা করবো, বলাটা এতো সহজ না।
এতোদিনে যশোর রোডের গাছগুলোর ইতিহাস মোটামুটি সবাই জেনে গেছেন।
১৮৪০ সালে মাকে চিকিৎসার জন্য সড়ক পথে কলকাতা নিতে এই রাস্তা নির্মাণ করেন যশোরের তখনকার জমিদার কালি পোদ্দার৷ ১৮৪৪ সালে এর নির্মাণ শেষ হয়৷ ৷ এরপর ছায়ার জন্য দুই পাশে সারি সারি রেইনট্রি লাগান জমিদার সাহেব৷ বিভিন্ন সূত্রে পাওয়া তথ্য মতে, এসব গাছের বেশিরভাগই বিভিন্ন সময়ে মারা গেলেও এখনই শতবর্ষী গাছ আছে দুই শতাধিক। পরবর্তীতে রাস্তার দুই পাশে আরো অনেক গাছ লাগানো হয়। এখন ৩৮ কিলোমিটার সড়কের পাশে গাছ আছে দুই হাজারেরও বেশি।
গাছ বাদ দিলে শুধু এ সড়কের ইতিহাসটাও বাংলাদেশের জন্মের সাথে ওতপ্রোতভাবে জড়িত। শুধু মার্কিন কবি অ্যালেন গিন্সবার্গ এই সড়ক নিয়ে 'সেপ্টেম্বর অন যশোর রোড' কবিতা লিখেছেন বলেই না, পরবর্তী ইতিহাসেও আছে এর বড় ভূমিকা।
বাংলাদেশের প্রথম শত্রুমুক্ত জেলা যশোর। ১৯৭১ সালের ৬ ডিসেম্বর যশোর মুক্ত করতে এ সড়ক ধরেই ভারত থেকে বাংলাদেশে প্রবেশ করেছিলেন বীর মুক্তিযোদ্ধারা। পরবর্তীতে এই সড়ক দিয়েই ১১ ডিসেম্বর টাউন হল মাঠে এসে জনসভায় যোগ দেন মুজিবনগর সরকারের প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দিন আহমেদ, অস্থায়ী রাষ্ট্রপতি সৈয়দ নজরুল ইসলামসহ অনেকে।
উন্নয়ন সন্ত্রাসীরা বেশিরভাগ ক্ষেত্রে সাধারণত সহজে জনপ্রিয় হওয়া যায়, এমন কিছু কুযুক্তি দেন।
১. গাছ কাটলে গায়ে লাগে? ঠিকই তো বাসায় গিয়ে সেগুন কাঠের বিছানায় ঘুমান।
২. যে কাগজে লেখেন, সেটা আসে কোত্থেকে?
৩. এইখানে গাছ কাটলে সমস্যা, কই ওইখানে যে গাছ কাটলো, সেটা নিয়ে তো কিছু বললেন না!
আজ অমুক সরকার আছে বলে কথা বলতে পারছেন। কই তমুক সরকার যখন গাছ কাটলো, তখন কই ছিলেন আপনারা?
এইসব কুযুক্তির কোন জবাব আমার কাছে নেই। ফলে, এইসব যুক্তির কাছে পরাজয় মেনে নেয়া ছাড়া উপায় নেই।
আমি কোন পরিবেশ বিশেষজ্ঞ না, সাধারণ একজন মানুষ, যিনি পরিবেশের ন্যূনতম ক্ষতি করে চলার চেষ্টা করেন। আমার মতো অনেকেই আছেন, যারা কোন কাজে পরিবেশের ক্ষতি হচ্ছে, কেউ তা চোখে আঙুল দিয়ে বোঝালে সেটা নিয়ে কুতর্ক না করে, কাজটা না করার চেষ্টা করেন।
অনেকের মতে দেশে বন ও গাছের পরিমাণ কমছে, এটা জনগণের ধারণা, ফ্যাক্ট বা সত্যিটা হচ্ছে, বন ও গাছের পরিমাণ ধীরে ধীরে বাড়ছে। এর পক্ষে কোন সত্যতা অবশ্য এখনও পর্যন্ত আমি খুঁজে পাইনি। আসলেই কি এটা ফ্যাক্ট? নাকি এটাই বিশ্বাস করতে চান বলেই তা আপনাদের কাছে ফ্যাক্টে পরিণত হয়েছে, আমার জানা নেই।
যে সরকারের মন্ত্রী 'সুন্দরবনের বাঘ ভারতে বেড়াতে গেছে', যে সরকারের প্রধানমন্ত্রীর উপদেষ্টা 'সুন্দরবন কৃত্রিমভাবে তৈরি করা হবে' বলতে পারেন, সে সরকারের করা বন বিষয়ক তথ্যে ভরসা রাখার কোন কারণ আমি খুঁজে পাচ্ছি না। তারপরও বন অধিদপ্তরের ওয়েবসাইট (http://www.bforest.gov.bd/) ঘুরে দেখেছি । সেখানে দেশের বন বা গাছের পরিমাণ কমেছে না বেড়েছে, বাড়লে কী পরিমাণ, কীভাবে এবং কোথায়, সে বিষয়ে কোন তথ্য নেই।
আন্তর্জাতিক এনজিও গ্লোবাল ফরেস্ট ওয়াচের ওয়েবসাইটে (http://www.globalforestwatch.org/country/BGD) অন্যান্য সব দেশের মতো, বাংলাদেশের ট্রি কভার লসের হিসাবটা ২০০১ থেকে ২০১৭ পর্যন্ত দেয়া আছে।
দেখা যাচ্ছে, ২০১৪ সালে ৬,১০৭ হেক্টর জমির ট্রি কভার লস হয়েছে। পরের বছরই সেটা প্রায় দ্বিগুণ বেড়ে ১২,২৭৯ হেক্টর। ২০১৬ সালে সেটা আবারও দ্বিগুণ হয়েছে। এবার পরিমাণটা ২১,৫৮৪ হেক্টর।
২০০১-২০১৬ সালের মধ্যে ট্রি কভার লস হয়েছে ১০৬,৮৬৫ হেক্টর জমির, ২০০১-২০১২ সালের মধ্যে ট্রি কভার লস পুষিয়ে দেয়া গেছে মাত্র ৭,০২২ হেক্টর জমির। অবশ্য ট্রি কভার গেইনের ২০১২-২০১৬ সালের হিসেব এখানে নেই। কিন্তু সরকারে কর্মপদ্ধতি দেখে আর যাই হোক, চার বছরে ১ লাখ হেক্টর জমির ট্রি কভার লস পুষিয়ে দিয়েছে, এটা বোধ হয় পাগলেও বিশ্বাস করবে না।
যাই হোক। এবার আসি অন্য উন্নয়নের পক্ষে কথা বলিয়েদের অন্যসব যুক্তিতে-
১. এ রাস্তা হবে এশিয়ান হাইওয়ে। ফলে চাইলেও রাস্তা এভাবে রাখা সম্ভব না।
২. আরো অনেক রাস্তা দিয়েই তো শরণার্থীরা গেছে, পুরো দেশই তো যুদ্ধবিধ্বস্ত ছিলো, দেশজুড়ে স্মৃতি ছড়িয়ে আছে। এসব চিন্তা করলে তো আর দেশের কোথাও কিছুই করা যাবে না।
৩. এই গাছগুলো তো কদিন পরে এমনিতেই মরে যাবে, তখন কী হবে?
৪. ১৯৭১ সালে যে রাস্তা ছিলো, সেটাও তো সেরকম নাই, অনেক চেঞ্জ হয়েছে।
৫. রাস্তা অন্য জায়গা দিয়ে নিতে হলে অধিগ্রহণ করতে হবে। এতে মানুষের ক্ষতি হবে, আর্থিক ক্ষতি হবে, আন্দোলন হতে পারে।
জ্বি, সরলমনে এগুলো সঠিক বক্তব্য। তবে এসবেরই ততোধিক সরল উত্তরটাও আছে।
আসলে এটা কোন যুক্তি হিসেবেই ধরতে পারছি না। এশিয়ান হাইওয়ে তৈরির পরিকল্পনায় অক্ষাংশ, দ্রাঘিমাংশ মেপে রাস্তা নির্ধারণ করা হয়নি। ফলে, চাইলেই একে আশেপাশে কিছুটা সরিয়ে নেয়াই যেতে পারে। মেট্রোরেলেও নকশা অনুযায়ী বিজয় স্মরণি হয়ে ফার্মগেট লাইন যাওয়ার কথা থাকলেও শোনা যায় বিমানবাহিনীর আপত্তিতে পরবর্তীতে তা জাতীয় সংসদের পাশ দিয়ে নেয়া হয়েছে।
দেশে তো অনেক গণকবর আছে, একটা রেখে বাকিগুলোতে ক্ষেতখামার বানালেই হয়। আমার এই যুক্তিটা যেমন আপত্তিকর, আপনাদের যুক্তিটাও তেমনই। দেশের অন্য সব রাস্তা, মাঠঘাট, এই সাতান্ন হাজার বর্গমাইল জুড়েই শরণার্থীর ঢল ছিলো। যশোর রোড কেন আলাদা, সেটা জানতে খুব বেশি গবেষণা না করে গুগলে যশোর রোড সার্চ দিলেই চলে।
গাছ কেন, কদিন পর তো পৃথিবীও থাকবে না, আপনিও থাকবেন না। সবকিছুই ক্ষণস্থায়ী। কদিন পর আপনি থাকবেন না বলে আপনাকে কেউ এখনই বৃদ্ধাশ্রমে দিয়ে আসবে? এ কেমন কথা!
এই গাছ মারা গেলে পাশেই নতুন গাছ লাগাবেন। এরই মধ্যে যশোর রোডে পুরোন গাছের সংখ্যাই বরং কম, নতুন লাগানো গাছের সংখ্যাই বেশি। সোহরাওয়ার্দী উদ্যানের গাছ মারা যাবে বলে সেখানে আর গাছ না লাগিয়ে ফ্ল্যাট বানানো শুরু করবেন নাকি মশাই?
বৈদ্যনাথতলার সেই আমবাগানে ১৯৭১ সাল থাকা আমগাছগুলোর অনেকগুলোই মরে গেছে, সেখানের রাস্তাও পরিবর্তন হয়েছে, পরিবেশও। কিন্তু এখনও যারা সেখানে যান, নতুন আমগাছ দেখলেও তাদের সেই '৭১-এর অনুভূতিই হয়। তাই বলে, 'মেহেরপুরের আমবাগান' কেটে এখানে পাওয়ার প্ল্যান্ট বসিয়ে দেই, আমবাগানের সমান গাছ সন্দীপের উরির চরে লাগিয়ে দেবো'- এটাও নিশ্চয়ই কোন যুক্তিবাদি মানুষের কথা হলো না।
হ্যাঁঁ, রাস্তা তো আর হুবহু রেখে দেয়া যাবে না। কিন্তু যতোটা সম্ভব স্মৃতিটুকু তো সংরক্ষণ জরুরি, তাই না? সেটা পুরো ৪০ কিলোমিটার রাস্তা না হয়ে ৫ কিলোমিটারও হতে পারে। ধানমন্ডি ৩২ নম্বর বাংলাদেশের ইতিহাসে একটা গুরুত্বপূর্ণ জায়গা। এই সড়কটিতে যান চলাচল পুরোপুরি বন্ধ করে দিয়ে সংরক্ষণ করা হচ্ছে না? হচ্ছে তো, তাই না?
জমি অধিগ্রহণ করলে স্থানীয়দের তো ক্ষতি হবেই, এ নিয়ে কোন বিতর্ক নেই। কিন্তু ছোট্ট একটা দেশজুড়ে যখন বিশাল বিশাল ক্যান্টনমেন্ট তৈরি হয়, তখন তো সরকার সে রিস্ক নেয়। আর দেশের ইতিহাসের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ রাস্তাটা সংরক্ষণের জন্য মুক্তিযুদ্ধে নেতৃত্বদানকারী দলের সরকার জনগণকে বুঝিয়ে কিছু জায়গা অধিগ্রহণ করতে পারবে না, তা বিশ্বাসযোগ্য নয়।
আমি উন্নয়নের বিপক্ষে না। ইউটোপিয়াতে বাস করি না বলে, গাছ একেবারেই কাটা যাবে না- ধরনের কথাও আমি বলি না। তবে পৃথিবীর জলবায়ু কোথায় যাচ্ছে, সেটা আমি মনন, মগজ দিয়ে বুঝতে পারি এবং শরীরের চামড়া দিয়ে অনুভব করি।
ফলে আমি চাই, নিতান্তই নিজের স্বাভাবিকভাবে বেঁচে থাকার জন্য যতোটুকু প্রয়োজন, তার বেশি যাতে প্রাণ-প্রকৃতি-পরিবেশের ক্ষতি না হয়।
স্বাধীন বাংলাদেশের অভ্যুদয়ের কথা মাথায় রাখুন। 'মোরা একটি ফুলকে বাঁচাবো বলে' যুদ্ধ করা জাতি। ভবিষ্যত প্রজন্মের জন্য কি সে ফুলের ছবিটাই শুধু রেখে যেতে চান?
আপনার উন্নয়নে আমিও লাভবান হবো, আমার পরিবেশ বাঁচলেও আপনি লাভবান হবেন। তবে একটা নগদ, আরেকটা বাকি।
আপনি বলতেই পারেন, 'বাকির নামে নগদ পাওনা, কে ছাড়ে এ ভুবনে?' আমার জবাব থাকবে, 'রাস্তা দিয়ে কীই বা হবে, সে রাস্তা ধরে যাওয়ার কোন জায়গাই যদি না থাকে?'