Published : 04 Jan 2018, 08:26 PM
মান্দালে মিয়ানমারের দ্বিতীয় বৃহত্তম নগরী। মান্দালে বহু সংস্কৃতির শহর হিসাবেই কয়েক শতক ধরেই পরিচিত। সেখানে বৌদ্ধ, হিন্দু, মুসলিম, খ্রিস্টান ধর্মাবলম্বী সহ-অবস্থানের চিত্র বেশ পুরানো। শহরটি বাণিজ্যিক পরিচিতিও কয়েক শতকের। ব্রিটিশ শাসিত তৎকালীন বার্মাতে মান্দালে শহরটি একসময় রোমান্টিক শহর হিসাবে সাহিত্যে বিবেচিত হয়ে উঠেছিল।
ব্রিটিশ কবি ও সাংবাদিক রুডিয়ার্ড কিপ্লিং ১৮৩২ সালে মান্দালে'র রোমান্স নিয়ে "মান্দালে" কবিতাটি লিখেছেন। কিপ্লিং লিখেছেন-
"Come you back, you British soldier; come you back to Mandalay! "
Come you back to Mandalay,
Where the old Flotilla lay:
Can't you 'ear their paddles chunkin' from Rangoon to Mandalay ?
On the road to Mandalay,
Where the flyin'-fishes play,
An' the dawn comes up like thunder outer China 'crost the Bay!
কবি রুডিয়ার্ড কিপ্লিং ব্রিটিশ সেনাবাহিনীকে মান্দালের নৈসর্গিক সৌন্দর্য ও বার্মার সুন্দরী তরুণীর টানে বার বার ফিরে আসার আহ্বান জানিয়েছেন। তবে কবি রুডিয়ার্ড কিপ্লিং মান্দালে কখন যাননি, তিনি কলকাতা থেকে জাপান ভ্রমণ করার সময় মান্দালে থেকে কয়েকশ কিলোমিটার দূরে মওলমেইন শহরে অনির্ধারিত যাত্রা বিরতি নেন। আর সেখান থেকেই মান্দাল এর নৈসর্গিক সৌন্দর্য কল্পনা করেন।
তবে মান্দালে এর রোমান্স কেবল কবিতায় নয়, শহরটির কুৎসিত চরিত্রটি বিশ্ব সাহিত্যের গল্প অঙ্গনেও জায়গা করে নিয়েছে।
বিখ্যাত ব্রিটিশ গল্পকার জর্জ অরওয়েল ১৯২২ থেকে ১৯২৭ সাল পর্যন্ত তৎকালীন বার্মাতে ছিলেন। তিনি বছরখানেক মান্দালেও বসবাস করেন। অরওয়েল ব্রিটিশ পুলিশ অফিসার (প্রশিক্ষণ) হিসাবে মান্দালে দায়িত্ব পালন করেন। মান্দালে নিয়ে ওরিয়েলের মন্তব্যটি বেশ মজার। তিনি মান্দালেকে একটি "ডিসএগ্রিবেল" শহর হিসাবে বর্ণনা করেছেন।
বলেছেন- 'শহরটি ধূলিমলিন ও অসহনীয় গরম'। তিনি আরও হতাশার সহিত বলেছেন 'এই মান্দালে' এর পাঁচটি গুরুত্বপূর্ণ পণ্য রয়েছে। পণ্য পাঁচটির নাম ইংরেজি অক্ষর "P" দ্বারা শুরু। পণ্যগুলি হল "Pagodas, Pariahs, Pigs, Priests, and Prostitutes." ।
জর্জ অরওয়েল মান্দালে কে নিয়ে 'বার্মিজ ডায়েরি' লিখেছেন ১৯৩৪ সালে। জর্জ ওরিয়েল আজ যদি বেঁচে থাকতেন এবং মান্দালেতে ভ্রমণ করতেন, তিনি আজকেও মান্দালে ইংরেজি আদিক্ষর 'P' সেই পাঁচটি পণ্য দেখতে পেতেন। তিনি দেখতে পেতেন মান্দালের সেই সোনালী প্যাগোডাগুলি আজ উগ্র ধর্মীয় জাতীয়তাবাদের সাক্ষী হয়ে আছে। নিচ-জাতের মানুষগুলি আজও ডলার দুয়েকে শ্রমজীবী মানুষের সারাদিনের শ্রম কিনছে। শুকরছানা গুলি আগের মতই আছে। ধর্মীয় ব্যবসায়ীদের দাপট আগের চেয়ে আরও শক্তিশালী হয়ে উঠেছে। পতিতারাও সময়ের সাথে তাল মিলিয়ে আধুনিকতায় উদ্ভাসিত হয়ে তাদের ব্যবসা চালিয়ে যাচ্ছে।
মান্দালে শহরকে কবি রুডিয়ার্ড কিপ্লিং ও গল্পকার জর্জ অরওয়েল এর মূল্যায়নে আকাশ-পাতাল ব্যবধান। কবি রুডিয়ার্ড কিপ্লিং মান্দালে না গিয়েই প্রেমে পড়েন, আর গল্পকার জর্জ অরওয়েল মান্দালের প্রতিটি অলিগলিতে যে কুৎসিত চরিত্রটি রোমান্স জাগানিয়া মুখোশ পরে আছে, সেটি অবলোকন করেন।
কবি রুডিয়ার্ড কিপ্লিং ও গল্পকার জর্জ অরওয়েলের বার্মা আজ মিয়ানমার। তবে মান্দাল মান্দালেই আছে। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধোত্তর নব্য ভু-রাজনৈ্তিক বাস্তবতায় কেবল পঞ্চ "P" থেকে একটি "P" সরে গেছে। প্রতিস্থাপিত হয়েছে ইংরেজি আরেকটি শব্দ "M" দ্বারা। ইংরেজিতে পুরো শব্দটি দাড়ায় "Monk"।
মান্দালে শহর থেকেই বার্মিজ জাতিস্বত্তা রক্ষার আন্দোলনের শ্লোগান এখন বার্মিজদের মধ্যে ছড়িয়ে পড়ছে। এখানেই অবস্থিত "মা বা থা" এর হেড কোয়ার্টার। "মা বা থা"র বাংলায় অর্থ দাঁড়ায় "মিয়ানমারের দেশপ্রেমিক সংগঠন"। ২০১৪ সালের জানুয়ারিতে সংগঠনটির জন্ম। সংগঠনটির মূল কাজ হচ্ছে জাতিস্বত্তা রক্ষার নামে মুসলিম বিরোধী কর্মকাণ্ড পরিচালনা করা। যার নেতৃত্বে সেসকল কর্মকাণ্ড পরিচালিত হচ্ছে তার নাম অশ্বিন বিরাথু। মিয়ানমারে জাতিস্বত্তা রক্ষার নামে মুসলিম বিরোধী ধর্মীয় জাতীয়তাবাদের নামে যে আন্দোলনটি চলমান সেটির প্রাণপুরুষ বিতর্কিত ধর্মীয় গুরু অশ্বিন বিরাথু।
"মা বা থা" আন্দোলনটিকে প্রথম প্রাতিষ্ঠানিক রূপ দেওয়া হয় ২০০১ সালে। আন্দোলনটি "৯৬৯" নামে প্রথম আত্নপ্রকাশ করে। "৯৬৯" দ্বারা গৌতম বুদ্ধের তিনটি বিশেষগুণের প্রতীকীরূপ বুঝানো হয়।
যাহোক, ২০০১ সালের দিকে অশ্বিন বিরাথুর উগ্র ধর্মীয় জাতীয়তাবাদের নামে আন্দোলন সামরিক সরকার ভালভাবে নেয়নি। সেই সময় মিয়ানমার ছিল বিশ্ব সমাজের বাইরের একটি জনপদ। সামরিক শাসকদের উপর গণতন্ত্র পূর্ণ উদ্ধারের জন্য বর্হির বিশ্ব থেকে কোন ধরনের চাপ ছিল না। এমনকি অং সান সুচির রাজনৈতিকদলের সাংগঠনিক অবস্থাও ছিল নড়বড়ে।
ফলে সরকার বিরোধী জনমতকে ধর্মীয় জাতীয়তাবাদের ট্যাবলেট খাইয়ে ঘুমিয়ে রাখার তেমন প্রয়োজন সামরিক শাসকদের ছিল না। এমতাবস্থায় যখনই অশ্বিন বিরাথুর ধর্মীয় জাতীয়তাবাদের মোড়কে আন্দোলন করতে চাচ্ছিল, তখনই অশ্বিন বিরাথুকে গ্রেপ্তার করে জেলে প্রেরণ করা হয়। অশ্বিন বিরাথুর "৯৬৯" নামের আন্দোলনে যোগদান করে ২০০১ সালের দিকে। তাকে সামরিক শাসক গোষ্ঠী ২০০৩ সালে সন্ত্রাসবাদে উস্কানি দেওয়ার অভিযোগে গ্রেপ্তার করে। অশ্বিন বিরাথুর ২৫ বছরের জেল হয়। তবে অশ্বিন বিরাথু জেলে থাকার সময়টিতে "৯৬৯" আন্দোলনের উগ্রবাদী আদর্শ ক্রমশ দেশটির চারদিকে ছড়িয়ে পড়ে।
মিয়ানমারের অভ্যন্তরীণ রাজনীতি কিংবা ধর্মীয় সংখ্যালঘুদের উপর কাঠামোগত নির্যাতনের কারণ বিশ্লেষণ করতে গেলে মিয়ানমারের উপর চীন, ভারত ও যুক্তরাষ্ট্রের ভূরাজনৈতিক স্বার্থের বিষয়টিকে বিবেচনায় নিতে হবে।
দীর্ঘ কয়েক দশক ধরে মিয়ানমার একটি বিচ্ছিন্ন রাষ্ট্র হিসাবে ছিল। পাশে ছিল কেবল চীন। চীন মিয়ানমারের জ্বালানি ও অবকাঠামোসহ বড় বড় উন্নয়নমূলক কর্মকাণ্ডে একমাত্র অংশীদার ছিল। দক্ষিণ এশিয়াতে চীনের প্রভাবকে মোকাবেলা করতে ভারত যেমন উঠেপড়ে লেগেছে, ঠিক তেমনি যুক্তরাষ্ট্রও। ফলে যুক্তরাষ্ট্রের তৎকালীন প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামা মিয়ানমারে একটি ঐতিহাসিক সফর করেন।
বারাক ওবামার সফরের পরপরই মিয়ানমারের দৃশ্যপট দ্রুতই বদলে যায়। সফরের পরপরই মিয়ানমার দেশটির কয়েকটি বড় প্রকল্প থেকে চীনকে সরিয়ে দেয়। প্রকল্পগুলিকে ভারতের হাতে তুলে দেওয়া হয়। মিয়ানমারের শাসক গোষ্ঠী বিশ্বের তিন মোড়লকে হাত রাখতে চায়। বলা যায়, তিন মোড়ল হাতে রাখার কৌশলে মিয়ানমার সফল। রোহিঙ্গা ইস্যু নিয়ে যুক্তরাষ্ট্র লোক দেখানো চাপ প্রয়োগ ছাড়া মিয়ানমারের স্বার্থবিরোধী কোন পদক্ষেপ নেওয়ার সুযোগ যুক্তরাষ্ট্রের নেই। এমতাবস্থায় মিয়ানমারের অভ্যন্তরীণ সামাজিক ব্যবস্থায় মানবাধিকার লঙ্ঘনের মত গুরুত্বপূর্ণ বিষয়টিতে তিন মোড়ল চোখ বন্ধ করে রাখে।
যাহোক, ওবামার সফরের পর থেকেই মিয়ানমার ক্রমশ গণতন্ত্রের দিকে যাত্রা শুরু করে। গণতন্ত্রের জন্য মিয়ানমারের সাধারণ জনগণের আকাঙ্ক্ষা কয়েক দশক ধরেই দানা বাঁধতে থাকে। পাঁচ দশকের সামরিক শাসকের প্রাতিষ্ঠানিক সমাপ্তির জন্য ২০১২ সালের দিকে সারা মিয়ানমারে আন্দোলন ছড়িয়ে পড়ে। বহু এলাকায় বড় ধরনের সংঘর্ষ হয় এবং বহু হতাহতের ঘটনা ঘটে। ঠিক তখনি সামারিক শাসক গোষ্ঠী ধর্মীয় ট্রাম্প কার্ড থলে থেকে বের করে খেলতে শুরু করে।
মিয়ানমারের সামরিক শাসকদের ধর্মীয় কার্ড খেলাটি আমাদের দেশের সামরিক শাসক মেজর জিয়াউর রহমান ও হুসেইন মুহাম্মদ এরশাদ কিংবা পাকিস্তানের সামরিক শাসক জিয়াউল হুকের ধর্মীয় কার্ড খেলার মতই। ক্ষমতাকে কুক্ষিগত করার জন্য জিয়াউর রহমানের ধর্মের নামে রাজনীতির লাইসেন্স ও ধর্মীয় উগ্রবাদ প্রসারের জন্য মৌন সমর্থন দেওয়ার কৌশল গ্রহণ করেছিলেন। সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষদের সরকার বিরোধী আন্দোলন থেকে দূরে রাখার জন্য ক্ষমতার শেষাংশে এসে মুহাম্মদ এরশাদ রাষ্ট্র নামক জড় পদার্থটিকে ধার্মিক বানিয়ে ফেলেন; অর্পিত সম্পত্তি আইনের প্রয়োগ ও সাম্প্রদায়িক দাঙ্গার উস্কানি দিতে শুরু করেন। সামরিক শাসক জিয়াউর রহমান ও মুহাম্মদ এরশাদের পদক্ষেপগুলি ছিল মিয়ানমারের সামরিক সরকারের ধর্মীয় জাতীয়তাবাদের আন্দোলনকে মৌন সমর্থন দেওয়ার মত। পাকিস্তানের সামরিক শাসক জিয়াউল হুক ভিন্ন ধর্মাবলম্বীদের মতামতকে উপেক্ষা করে সকল স্তরের জনগণের জন্য জাকাতকে বাধ্যতামূলক করে দিয়েছিলেন। বলা যায়, যখনই সামরিক শাসক গোষ্ঠীর ক্ষমতায় থাকার টানাপড়েন শুরু হয়, তখনই থলে থেকে ধর্মীয় জাতীয়তাবাদের মত সমাজ ধ্বংসকারী কৌশলগত কার্ডটি বের করে খেলতে থাকে।
যাহোক, ২০১২ সালে অশ্বিন বিরাথুকে সাধারণ ক্ষমা করে দেওয়া হয়। জেল থেকে বের হয়ে অশ্বিন বিরাথু আরও বেপরোয়া হয়ে উঠেন। বিশ্ব মিডিয়া অশ্বিন বিরাথুকে নিয়ে একে একে প্রতিবেদন প্রকাশ করতে থাকে। অশ্বিন বিরাথুকে নিয়ে মিডিয়া ও সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে অতিরঞ্জন সংবাদ পরিবেশন করছে বলেও সামরিক সরকার থেকে প্রতিবাদও জানানো হয়েছিল। সামরিক শাসকের সহযোগিতায় উগ্র ধর্মীয় জাতীয়তাবাদের নামে মুসলিম বিরোধী আন্দোলনকে মিন্দালের ঘরে ঘরে ছড়িয়ে দেওয়া হয়। প্রসঙ্গত, মিন্দালে বসবাসকারী অমুসলিমেরাও "মা বা থা" আন্দোলনে সর্বদাই আতঙ্কে থাকেন। এমনকি চীনের ব্যবসায়ীরা যারা দীর্ঘ কয়েক দশক ধরে মিন্দালে বসবাস করছেন তারাও ভয়ে তটস্থ থাকেন।
সামরিক শাসক গোষ্ঠীকে অশ্বিন বিরাথু জেল থেকে মুক্তি পাওয়ার প্রতিদান দিয়েছেন। ২০১৫ সালের সাধারণ নির্বাচনে অশ্বিন বিরাথুর সমর্থক গোষ্ঠী সামরিক শাসক গোষ্ঠীর পক্ষে কাজ করেন। যদিও শেষ রক্ষা হয়নি। তবু অশ্বিন বিরাথুর প্রভাব কমেনি, বরং বহুগুণে বেড়েছে। অং সান সুচির দল ক্ষমতায় আসার পরে অশ্বিন বিরাথু রাখাইনে সফর করে বৌদ্ধ জাতীয়তাবাদীদের সংগঠিত করেছেন। মুসলিম বিরোধী সভা সমাবেশ করে কট্টরপন্থীদের সাম্প্রদায়িক সন্ত্রাসের জন্য উস্কানি দিয়েছেন। রাখাইনে যখন সহিংসতা ছড়িয়ে পড়েছিল, তখন অশ্বিন বিরাথু সেখানে ভ্রমণ করেছেন। অথচ কোন আন্তর্জাতিক পর্যবেক্ষক গোষ্ঠীকে সেখানে যেতে দেওয়া হয়নি।
২০১৭ সালে মার্চের মাসের দিকে সমর্থকদের উদ্দেশ্যে অশ্বিন বিরাথুর বক্তব্য রাখার উপর একটি নিষেধাজ্ঞা মিয়ানমার সরকার জারি করে। বিশ্ব মিডিয়ার সমালোচনার কারণে অনেকটা বাধ্য হয়েই মিয়ানমার সরকার এই পদক্ষেপটি নেয়। বিষয়টি অনেকটা পাকিস্তানের লস্কর-ই-তৈয়েবার প্রধান হাফিজ সাইদকে গৃহবন্দি করার মতোই। হাফিজ সাইদ মুম্বাই হামলার প্রধান সমন্বয়ক। অথচ সন্ত্রাসী হাফিজ সাইদ পাকিস্তানে একজন সমাজ সেবকের মর্যাদা পায়। যুক্তরাষ্ট্র ও ভারতের চাপে জাতিসঙ্ঘের তালিকাভুক্ত সন্ত্রাসী হাফিজ সাইদকে পাকিস্তান গৃহবন্দি করে রাখতে বাধ্য হয়।
রাখাইনে কয়েক মাসব্যাপী ধর্মীয় সংখ্যালঘুদের উপর মিয়ানমারের সেনাবাহিনী দ্বারা যে পাশবিক নির্যাতন ও গণহত্যাটি সংগঠিত হয়ে গেল, সেটির পিছনে অশ্বিন বিরাথুর "মা বা থা"র আন্দোলন বড় নিয়ামক। "মা বা থা"র আন্দোলনের কর্মীরা রাখাইনে সামরিক বাহিনীর সহযোগী হয়ে গ্রামের পর গ্রাম আগুনে জ্বালিয়ে দিয়েছে। অস্ত্র হাতে নিয়ে নির্বিচারের মানুষ হত্যা করেছে। রক্ষা পায়নি নারী-শিশু, এমনকি সন্তানসম্ভবা নারীও। কেবল তাই হয়, ধর্মীয় সংখ্যালঘুদের ধর্মীয় প্রতিষ্ঠানগুলিকেও ধ্বংস করে দেওয়া হয়েছে।তাদের ফসলের মাঠ আগুনে পুড়িয়ে দেওয়া হয়েছে।
রাখাইনের এমন মানবিক বিপর্যয়ে ভারত ও চীনের মত শক্তিশালী প্রতিবেশী রাষ্ট্রগুলি নীরব ছিল। তাদের নীরবতার পিছনে রয়েছে বাণিজ্য ও জাতীয় নিরাপত্তার প্রশ্ন। মিয়ানমার চীনের কৌশলগত ভূ-রাজনৈতিক বন্ধু ও বড় ধরনের বাণিজ্যিক অংশীদার। তাছাড়া চীনের ভিতরেও রয়েছে ধর্মীয় সন্ত্রাসী গোষ্ঠী। রাখাইনে যে দেশীয় ও আন্তজাতিক সন্ত্রাসী গোষ্ঠীর উপস্থিতি রয়েছে সেটি এখন বিশ্বের কোন গোয়েন্দা সম্প্রদায় অস্বীকার করে না। ভারতের গোয়েন্দারা দাবী করে আসছে রাখাইনের সন্ত্রাসবাদীদের সাথে পাকিস্তানের আইএসআইয়ের নিবিড় যোগাযোগ রয়েছে। ফলে ভারত ও চীন নিজের ভূ-রাজনৈতিক স্বার্থেই নীরব ছিল।
এমতাবস্থায় মিয়ানমারে চলমান উগ্র বৌদ্ধ জাতীয়তাবাদীদের মুসলিম বিরোধী আন্দোলনটিকে আঞ্চলিক ও আন্তর্জাতিক ভূ-রাজনৈতিক হিসাব থেকে স্পষ্টভাবে পৃথক করা দুরূহ। আর সেই সুযোগটি নিচ্ছেন অশ্বিন বিরাথুরা।
অশ্বিন বিরাথুর ধর্মের মোড়কে রাজনৈতিক দর্শন বহুলাংশে আফগানিস্তানে জঙ্গি শাসক তালেবান প্রধান মোল্লা ওমরের মত। মোল্লা ওমরের আন্দোলনও শুরু হয়েছিল একটি মফস্বল শহরের মাদ্রাসা থেকে। প্রথম দিকে চল্লিশ-পঞ্চাশ জন মাদ্রাসার শিক্ষক ও শিক্ষার্থী তার সাথে ছিল। খুব অল্প সময়েরই ধর্মীয় জাতীয়তাবাদের শ্লোগান দিয়ে, ধর্ম ও জাতিস্বত্বা রক্ষার প্রতিশ্রুতি শুনিয়ে ধর্মপ্রাণ মানুষদের সমর্থন আদায় করে নেয়।
অশ্বিন বিরাথুর নেতৃ্ত্বের মধ্যে তেমনি একটি প্রবণতা স্পষ্টই রয়েছে। মোল্লা ওমর অন্যান্য ধর্মাবলম্বীদের উপাসনালয়কে গুঁড়িয়ে দিয়েছিল, বোমায় উড়িয়ে দিয়েছিল বামিয়ানের বৌদ্ধ মুতিটি। রাখাইনেও আমরা অশ্বিন বিরাথুর অনুসারীদের একই ধ্বংসাত্নক কর্মকাণ্ড করতে দেখতে পাই। মোল্লা ওমর ও অশ্বিন বিরাথুর মধ্যে পার্থক্য একটাই। মোল্লা ওমর ক্ষমতা হাতে নিতে সক্ষম হয়েছিল, আর অশ্বিন বিরাথু এখনো ক্ষমতার খেলোয়াড়দের কৌশলী সম্পদ হিসাবে কাজ করছেন।