Published : 23 Dec 2017, 04:47 PM
১৯৭৫ সালের ১৫ অগাস্টের পর প্রকাশ্য সভায় বঙ্গবন্ধুর নাম উচ্চারণের মত সাহসী মানুষের সংখ্যা খুব বেশি ছিল না, এমনকি স্বাধীনতা বা বিজয় দিবসের অনুষ্ঠানেও বঙ্গবন্ধু ছিলেন নিষিদ্ধ নাম।
আমি ১৯৮৪ সালে কুয়েতের বিজ্ঞান গবেষণা ইন্সিটিউটে গবেষণা বিজ্ঞানী হিসেবে চাকরি নিয়ে যখন কুয়েতে গেলাম তখন ওখানে বাঙালি ছিল ৭০ হাজারেরও বেশি। অথচ বাংলাদেশ অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি ছিলেন একজন জামাত নেতা, যিনি প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ে আমার এক বছর সিনিয়র ছিলেন এবং বিশ্ববিদ্যালয়ে ইসলামী ছাত্রসঙ্ঘের সভাপতি ছিলেন।
প্রতিবছরই তিনি বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্রসংসদ নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করতেন এবং ২০০০ হাজার ভোটের মধ্যে ৩০ থেকে ৪০টি ভোট তার ভাগ্যে জুটতো। তিনিও আমার মতন ফরিদপুরের অধিবাসী ছিলেন। মানুষ হিসেবে অত্যন্ত সুহৃদ ছিলেন।
আমি আমার পূর্ব পরিচিত কয়েকজন মুক্তিযোদ্ধার সাথে যোগাযোগ করে বললাম, আপনারা থাকতে একজন জামাত নেতা কিভাবে বাংলাদেশ অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি হয়?
এ মুক্তিযোদ্ধাদের মাঝে ছিলেন বাংলাদেশ যুবলীগের প্রতিষ্ঠাতা সাংস্কৃতিক সম্পাদক মিজানুর রহমান মিজান, যিনি প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ে আমার দুই বছর সিনিয়র ছিলেন এবং তিনিও ফরিদপুরের আমার এলাকার সন্তান। অনেক বছর পর দেখা হওয়ায় প্রথম আলাপেই শ্রদ্ধা জানালেন প্রয়াত অধ্যাপক আজিজুল হক খানের প্রতি। বড়ভাই গত বছরই মারা গেছেন। আমার প্রয়াত বড়ভাইয়ের উপদেশ শুনেই মিজান আওয়ামী লীগ ছেড়ে মুল আওয়ামী লীগে ফিরে এসেছিলেন সে কথা আমার সাথে শেয়ার করলেন।
তিনি বললেন, "বাংলাদেশ অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি ঠিক করেন রাষ্ট্রদূত, জনগণ নয়।"
এরশাদের সামরিক শাসনে তখন রাষ্ট্রদূত ছিলেন একজন মেজর জেনারেল। এ ধরনের 'মোটাবুদ্ধির' মানুষ মেজর জেনারেল হতে পারেন বা রাষ্ট্রদূত হতে পারেন, সেটা ঐ ভদ্রলোকের সাথে আলাপ না হলে আমি বুঝতে পারতাম না।
বিশেষ করে উনার সাথে আলাপের অভিজ্ঞতার পর আমি সামরিক শাসনের সমালোচনা করে কুয়েতের ইংরেজি দৈনিক 'কুয়েত টাইমস' এ এক নিবন্ধ লিখি, যার ফলে রাষ্ট্রদূত মহোদয় আমাকে দেশদ্রোহী আখ্যা দিয়ে আমার পাসপোর্ট বাতিলের জন্য সরকারকে লিখলেন। অবশ্য সে যুদ্ধে আমার পাসপোর্ট বাতিল না হয়ে রাষ্ট্রদূত সাহেব চাকরিচ্যুত হয়ে দেশে ফিরে গেলেন।
এরপর একটি বিজয় দিবসের অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথি ছিলেন দূতাবাসের মিনিস্টার যিনি ১৯৭১ সালে জনাব হোসেন আলীর সাথে বাংলাদেশের প্রতি আনুগত্য প্রকাশকারী কলকাতা মিশনের একজন কূটনীতিক।
তিনি তার প্রধান অতিথির ভাষণে বঙ্গবন্ধু তো দূরের কথা মুক্তিযুদ্ধের সত্য ইতিহাসও স্পর্শ করলেন না। ভাষণের পর আমি তাকে বললাম, "একজন মুক্তিযোদ্ধা হয়ে মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস চেপে গেলেন!"
তার উত্তর ছিল, "ভাই চাকরি করতে গেলে অনেক কিছুই চেপে যেতে হয়। সবাই তো সমান সাহসী হয় না।"
এ অতি বিনয়ী কূটনীতিক পরবর্তীতে কাতারে বাংলাদেশের রাষ্ট্রদূত ছিলেন। কয়েক মাস আগে তিনি চলে গেছেন না ফেরার দেশে। এ অবস্থার প্রেক্ষিতে কুয়েতে তখন সবচেয়ে উচু পদে চাকরিরত ডঃ কবীর চৌধুরী এবং বজলুর রহমানের নেতৃত্বে কুয়েতে বসবাসকারী সকল বাংলাদেশের নাগরিকদের ভোটে বাংলাদেশ অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি নির্বাচিত করার আন্দোলন গড়ে ওঠে।
ডঃ কবীর চৌধুরী তখন কুয়েত ফার্মাসিউটিক্যাল কোম্পানির ম্যানেজিং ডিরেক্টর ছিলেন। তিনি এখন লন্ডন প্রবাসী এবং ৭১ সালে লন্ডনে বিচারপতি আবু সায়ীদ চৌধুরীর নেতৃত্বে গঠিত মুক্তিযুদ্ধ স্টিয়ারিং কমিটির সদস্য ছিলেন। অপরদিকে বজলুর রহমান কুয়েত ইকনোমিক ফান্ডে তখন অনেক উঁচু পদে কর্মরত ছিলেন।
ভোটে বাংলাদেশ অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি নির্বাচনকে উদ্দেশ্যকে মূলত সামনে রেখে আমাকে একটা গঠনতন্ত্র তৈরির দায়িত্ব দেয়া হয়। পরবর্তী রাষ্ট্রদূত একজন ঝানু আমলা নজরুল ইসলাম আনন্দচিত্তে এ গঠনতন্ত্রের সাথে একাত্মতা প্রকাশ করেন এবং অনুমোদন দেন। কুয়েতে রাষ্ট্রদূতের অনুমোদন ছাড়া কোন সংগঠন করার বা সভা করার অধিকার ছিল না।
এ গঠনতন্ত্রের পরিপ্রক্ষিতে কুয়েতে অবস্থানরত হাজার হাজার বাংলাদেশি পাসপোর্টধারী মানুষের ভোটে বাংলাদেশ অ্যাসোসিয়েশনের কর্মকর্তা নির্বাচিত হয়। যেহেতু বেশিরভাগ বাংলাদেশি ছিলেন অদক্ষ শ্রমিক, প্রায় ১০০টি বাস ভাড়া করা হয় তাদের দূতাবাসে এসে ভোট দেয়ার ব্যবস্থা করার জন্য।
কুয়েত তথা কুয়েতে কর্মরত অন্যান্য দেশের মানুষেরা বিস্মিত হয়ে দেখছিলো যে দেশে সামরিক শাসন চলছে, সে দেশের জনগণ সুশৃঙ্খলভাবে তাদের ভোটাধিকার প্রয়োগ করছেন।
আমাদের প্যানেলের সাধারণ সম্পাদক ছিলেন প্রকৌশলী হাতেম আলী শাহ যিনি আমার থেকে ৫ বছর আগে প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পাশ করেন। তিনি বর্তমানে যুক্তরাষ্ট্রের টেনেসি অঙ্গরাজ্যে কর্মরত আছেন। আমি যে প্যানেলে ছিলাম সে প্যানেল (২১টি পদ) শতকরা ৭৪ ভাগ ভোট পেয়ে নির্বাচিত হয়। ভাগ্যের নির্মম পরিহাস আমার উপরে উল্লিখিত যুবলীগ নেতা এবং মুক্তিযোদ্ধা আমার বিপরীত প্যানেলে সহসভাপতি হিসেবে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করে পরাজিত হন।
ইতিমধ্যে রাষ্ট্রদূত নজরুল ইসালাম সাহেব পররাষ্ট্র সচিব হয়ে দেশে ফিরে গেলেন। এই অতি তীক্ষ্ণধর কূটনীতিক আমার সাথে ব্যক্তিগত আলাপে বঙ্গবন্ধুর কথা বলতেন, কিন্তু কোনদিন প্রকাশ্য সভায় বঙ্গবন্ধুর নাম উচ্চারণ করেননি। চাকরী থেকে অবসর নেবার পর তিনি বিএনপি রাজনীতির সাথে জড়িত হন। তখন আমার ধারণা হলো আমার কাছে নিজের নৈতিক অবস্থান উঁচুতে রাখার জন্য তিনি আমার কাছে বঙ্গবন্ধুর স্মৃতিচারণ করতেন।
তখন রাষ্ট্রদূত হয়ে এসেছেন কিংবদন্তী কূটনীতিক কে এম শেহাবুদ্দীন, যিনি বিশ্বে প্রথম বাঙালি কূটনীতিক যিনি সর্বপ্রথম (৬ই এপ্রিল ১৯৭১) বাংলাদেশের প্রতি আনুগত্য প্রকাশ করেন। আমার সাথে তার রাজনৈতিক আদর্শের পরিপূর্ণ মিল থাকায় আমাদের দুই পরিবারের মাঝে এক হৃদ্যতা গড়ে উঠে। তাকে কুয়েতে স্বাগত জানিয়ে আমরা বাংলাদেশ অ্যাসোসিয়েশনের পক্ষ থেকে শত শত বাঙালির উপস্থিতিতে এক গণসম্বর্ধনা দিয়েছিলাম।
পরবর্তীতে তার দেয়া একটা চিঠি আমি সেদিনের বিরোধীনেত্রী শেখ হাসিনার কাছে ঢাকাতে অর্পণ করেছিলাম এবং শেখ হাসিনার জবাব দেওয়া চিঠি তার কাছে অর্পণ করেছিলাম। শেখ হাসিনার প্রথম সরকারের আমলে তিনি ওয়াশিংটনে বাংলাদেশের রাষ্ট্রদূত ছিলেন।
২০১৫ সালে অকস্মাৎ প্রয়াত কিংবদন্তী এ কূটনীতিক গত বছর মরণোত্তর স্বাধীনতা পুরস্কারে ভূষিত হয়েছেন। তাঁর মতন একজন মহান দেশপ্রেমিককে জীবিত থাকাকালীন স্বাধীনতা পদক না প্রদান করাটা আমাদের রাষ্ট্রের জন্য এক চরম দীনতা।
আমাদের প্রথম অনুষ্ঠানটি ছিল বিজয় দিবস উদযাপন। পাকিস্তানসহ ১৩ জন রাষ্ট্রদূত এবং কয়েক হাজার হল ভর্তি বাঙালির উপস্থিতিতে বিজয় দিবসের অনুষ্ঠানে আমি আমার বক্তৃতায় যখন বললাম, "আপনাদের মনে আছে কি ৭ই মার্চের সে বজ্রকন্ঠ? মনে আছে কি সে বজ্রকণ্ঠের সে উদাত্ত আহ্বানের বাণী 'আর যদি একটা গুলি চলে…" ভাষণের এ উক্তির সাথে সাথে হল ভর্তি হাজার হাজার শ্রোতা করতালি দিয়ে দাঁড়িয়ে গেলেন।
দেখলাম অনেকে আবেগে চোখ মুছছেন ৭৫ সালের পর, ৮৭ সালে বিজয় দিবসে বঙ্গবন্ধুর নাম প্রবাসে এই প্রথম উচ্চারণে। রাষ্ট্রদূত মহোদয় প্রধান অতিথির ভাষণেও বিজয়ের পিছনের সত্য ইতিহাস, তিনি কিভাবে তার দুটো শিশু কন্যাকে নিয়ে ১৯৭১ সালের ৬ই এপ্রিল তারিখে, যখন বাংলাদেশ সরকার গঠিত হয়নি, দিল্লীর পাকিস্তান দূতাবাস ত্যাগ বাংলাদেশের প্রতি আনুগত্য প্রকাশ করার ঐতিহাসিক পদক্ষেপ নিলেন তার বিবরণ এবং বঙ্গবন্ধুর নাম উচ্চারণ করে এ মহানায়কের প্রতি শ্রদ্ধা জানালেন।
'ইতিহাস কথা কও' নামের যে গীতিআলেখ্য্যটি পরিবেশিত হল সেটিতেও মঞ্চের পিছন থেকে ভেসে আসলো বঙ্গবন্ধুর ভাষণের সে অংশটুকু, 'আর যদি একটা গুলি চলে… এবারের সংগ্রাম মুক্তির সংগ্রাম, এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম, জয় বাংলা।'
একইভাবে হাজার হাজার দর্শক শ্রোতার করতালি এবং আনন্দধ্বনিতে বিরাট অডিটোরিয়ামটি মুখরিত হয়ে উঠলো । এ অনুষ্ঠানটির বাংলায় ধারাবর্ণনা করেছিলেন আমার স্ত্রী লেখিকা তাসরীনা শিখা, ইংরেজিতে করেছিলেন বাংলাদেশের এবং কুয়েতে টিভির বিখ্যাত ইংরেজি সংবাদ পাঠিকা আয়েশা জায়গীরদার।
এ অনুষ্ঠানটির সম্পূর্ণ পরিকল্পনা করেছিলেন বাংলাদেশ অ্যাসোসিয়েশনের সাংস্কৃতিক সম্পাদক কুয়েত বিমান বাহিনীতে কর্মরত বাংলাদেশ বিমান বাহিনীর জনাব মহিউদ্দিন আহমেদ।
অনুষ্ঠান শেষে আমি এবং রাষ্ট্রদূত মহোদয় একে অপরকে আনন্দে জড়িয়ে ধরলাম। আমি বললাম, "১৯৭৫ সালের পর আপনি বোধহয় প্রথম রাষ্ট্রদূত যিনি হাজার হাজার বাঙালির উপস্থিতিতে আমাদের স্বাধীনতার মহানায়ককে স্মরণ এবং শ্রদ্ধা জানালেন, যদিও এখন বঙ্গবন্ধু বিদ্বেষী সরকার দেশ শাসন করছেন। আপনার এ সাহসকে আমি আর একবার শ্রদ্ধা জানাচ্ছি।"
রাষ্ট্রদূত মহোদয় বললেন, "৭১ সালে যখন সব ভয়কে অতিক্রম করেছিলাম, আজকের এ স্বাধীন বাংলাদশে কোন সরকারের রক্তচক্ষুকে আমি ভয় পাইনা।"
আজকের এ অনুকূল পরিস্থিতিতে সেদিনের সে বিজয় দিবস উদযাপনের ঐতিহাসিক গুরুত্ব অনেকেই অনুধাবন করতে পারবেন না।
এ বিজয় দিবসের কথা রাষ্ট্রদূত শেহাবুদ্দীন তাঁর বই 'আ ডিপ্লোম্যাটস টেল' এ লিখেছেন- "আমি যখন কুয়েতে আসি তখন বাংলাদেশ অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি এবং সাধারণ সম্পাদক ছিলেন ডঃ মোজাম্মেল খান এবং হাতেম আলী শাহ। … বাঙালি সমাজের মঙ্গলের জন্য তারা বিরাট অবদান রেখেছিলেন।… তাদের নেতৃত্বে আমি ১৯৮৭ সালে কুয়েতে আসার পর পরই বাংলাদেশ অ্যাসোসিয়েশন যে ঐতিহাসিকভাবে বাংলাদেশের স্বাধীনতার সত্য ইতিহাস তুলে ধরে বিজয় দিবস উদযাপন কর সেটা আমি কোনদিন ভুলবো না।"