শহীদ জননী: আমৃত্যু সংগ্রামী এক মহাপ্রাণ

সুশীল সমাজে উদ্ভূত আন্দোলন দীর্ঘস্থায়ী হওয়ার উদাহরণ খুব কম। তবে শহীদ জননীর নেতৃত্বে প্রতিষ্ঠিত একাত্তরের ঘাতক দালাল নির্মূল কমিটি এক্ষেত্রে ব্যতিক্রম। নির্মূল কমিটির নেতৃবৃন্দ আন্দোলনের একটি প্রাতিষ্ঠানিক রূপ দিয়েছেন।

তপন পালিততপন পালিত
Published : 2 May 2023, 06:17 PM
Updated : 2 May 2023, 06:17 PM

শহীদ জননী জাহানারা ইমাম ছিলেন বহুমুখী প্রতিভাবান মানুষ। রাজনীতির অঙ্গন থেকে বেশ দূরেই তাঁর জীবনের অধিকাংশ সময় কেটেছিল। কিন্তু যখন তিনি হৃদয়ের তাগিদ অনুভব করেছেন তখন আর গৃহকোণে বসে থাকেননি। রাজপথে নেমে এসেছেন এবং মাত্র তিন বছরের সংগ্রামের মাধ্যমে একটা ইতিহাস সৃষ্টি করে গেছেন।

‘একাত্তরের দিনগুলি’ গ্রন্থের মাধ্যমে সৃজনশীল লেখিকা হিসেবে সর্বপ্রথম দেশবাসীর দৃষ্টি আকর্ষণ করেছিলেন। রাজনীতিবিদ না হয়েও রাজনীতির অঙ্গনে প্রবেশ করে সারাদেশে তুমুল আলোড়ন সৃষ্টি করতে পেরেছিলেন। ক্ষমতার মোহ বা কোনো পার্থিব প্রাপ্তির জন্য নয়, নিছক দেশপ্রেম থেকে, দেশের মানুষের প্রতি ভালোবাসা থেকেই তিনি এই আন্দোলনে সম্পৃক্ত হয়েছিলেন। তিনি বলেছিলেন– “দেশের কাছ থেকে আমার পাবার কিছুই বাকি নেই। দেবার আছে অনেক কিছু। আমার স্বামী-সন্তান জীবন দিয়েছে দেশের জন্য, আমার মৃত্যু যদি হয় দেশের জন্যে তাতে আমি গর্বিত।” নিজেকে মাটির প্রদীপের সাথে তুলনা করে তিনি বলতেন, “আমি মাটির প্রদীপ। আমার কর্তব্যটুকু সলতের শেষ তেল বিন্দুটি পর্যন্ত করে যাবার চেষ্টা করবো। তাতেই আমার সার্থকতা।” তাই শহীদের রক্তেভেজা বাংলাদেশে সামগ্রিকভাবে মুক্তিযুদ্ধের চেতনা প্রতিষ্ঠার সংগ্রামে নিজেকে সর্বোতভাবে নিয়োজিত রেখেছিলেন আমৃত্যু সংগ্রামী জাহানারা ইমাম।

শিক্ষকতার মাধ্যমে তাঁর কর্মজীবনের শুরু হলেও পরবর্তীতে নানা সামাজিক ও সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ডে জড়িয়ে পড়েন। ক্রমশ ব্যক্তিত্বময়ী জাহানারা ইমাম ঢাকার সাংস্কৃতিক পরিমণ্ডলে সুপরিচিত হয়ে ওঠেন। ষাট ও সত্তর দশকে সাহিত্যজগতে জাহানারা ইমাম অল্প-বিস্তর পরিচিত ছিলেন শিশুকিশোর উপযোগী রচনার জন্য। স্বাধীনতা-উত্তর বাংলাদেশে তিনি লেখালেখিতে ব্যস্ত সময় কাটান এবং তাঁর প্রধান গ্রন্থগুলো ওই সময়ে প্রকাশ পায়। তাঁর রাজনৈতিক জীবনের সূত্রপাত মূলত ১৯৮০-এর দশকে। ১৯৮১ সালের ২৭ এপ্রিল ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র-শিক্ষক কেন্দ্রে এক নাগরিক সমাবেশের মাধ্যমে সাম্প্রদায়িকতা ও ফ্যাসিবাদবিরোধী যে নাগরিক কমিটি গঠিত হয়েছিল তিনি ছিলেন ওই কমিটির গুরুত্বপূর্ণ একজন সদস্য। ১৯৮১ সালের ২৫ মে ড. আহমদ শরীফের সভাপতিত্বে বায়তুল মোকাররম প্রাঙ্গণে সাম্প্রদায়িকতা ও ফ্যাসিবাদবিরোধী নাগরিক কমিটির উদ্যোগে ‘ভারতীয় আগ্রাসন, সাম্প্রদায়িকতা ও স্বৈরতন্ত্রের বিরুদ্ধে’ একটি সমাবেশ অনুষ্ঠিত হয়। ওই সমাবেশে জাহানারা ইমাম বক্তৃতা করতে দাঁড়ালে মুক্তিযোদ্ধারা সমস্বরে স্লোগান দিতে থাকেন, ‘মাগো তোমায় কথা দিলাম, অস্ত্র আবার হাতে নেব, মুক্তিযোদ্ধার হাতিয়ার গর্জে উঠুক আরেকবার।’ সমাবেশে তিনি সকল মুক্তিযোদ্ধাকে সন্তান সম্বোধন করে মুক্তিযুদ্ধের অঙ্গীকার বাস্তবায়ন, ভারতীয় আগ্রাসন এবং দেশের স্বাধীনতাবিরোধী শক্তির বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়াবার আহ্বান জানান। ওই সমাবেশের মাধ্যমে তিনি প্রথমবারের মতো প্রকাশ্য জনসভায় বক্তৃতা করেন। এরপর থেকে মৃত্যুর আগপর্যন্ত তিনি আর থামেননি। মানবতাবিরোধী অপরাধীদের বিচার দাবির পাশাপাশি ধর্মনিরপেক্ষ অসাম্প্রদায়িক বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠার লড়াইয়ে সামনের সারিতে থেকে নেতৃত্ব দিয়েছেন।

ক্ষমতার চেয়ে রাজপথকে তিনি উত্তম মনে করেছিলেন। ১৯৮১ সালে রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমান জাহানারা ইমামকে মহিলা বিষয়ক উপদেষ্টা করতে চেয়েছিলেন, কিন্তু তিনি রাজী হননি। ওই সময়ে অনেক বামপন্থী ও কমিউনিস্ট নেতা জিয়াউর রহমানকে সমর্থন করে তাঁর উপদেষ্টা ও মন্ত্রিপরিষদে যোগ দিয়েছিলেন। জেনারেল জিয়াউর রহমান নিহত হওয়ার পর নাগরিক কমিটি নিষ্ক্রিয় হয়ে পড়ে। ১৯৮১ সালের রাষ্ট্রপতি নির্বাচনের সময় পৃথক নাগরিক কমিটি গঠিত হয়। এর প্রধান উদ্যোক্তা ছিলেন লে. কর্ণেল (অবঃ) কাজী নূর-উজ্জামান ও ডা. জাফরউল্লাহ চৌধুরী। জেনারেল ওসমানী ছিলেন রাষ্ট্রপতি নির্বাচনে নাগরিক কমিটির প্রার্থী। জেনারেল ওসমানীর অনুরোধে জাহানারা ইমাম তাঁর নির্বাচন পরিচালনা কমিটির প্রচার ও প্রকাশনা বিভাগের আহ্বায়কের দায়িত্ব গ্রহণ করেন। জাহানারা ইমামের চেষ্টায় জেনারেল ওসমানীর নির্বাচনী ঘোষণায় ধর্মভিত্তিক সাম্প্রদায়িক রাজনীতি নিষিদ্ধ করার কথা বলা হয়েছিল যা অন্য প্রার্থীদের ঘোষণায় ছিল না।

ওই সময়ে শহীদ জননীর মুখগহ্বরের ক্যান্সার ধরা পড়ে। তবে এই অসুস্থতা তাঁর জীবন গতিকে এতটুকু কমাতে পারেনি বরং আরও গতিশীল হয়ে গভীরে প্রোথিত হয়। ১৯৮৬ সালে তাঁর লেখা ডায়েরি ‘একাত্তরের দিনগুলি’ বই আকারে প্রকাশিত হয়। একদিকে মুক্তিযুদ্ধের প্রেক্ষাপট, আবেগ, চেতনা, তরুণ মুক্তিযোদ্ধাদের পরিচয় ও সাহস এবং অন্যদিকে যুদ্ধের বিস্তৃতি, নৃশংসতা ও স্বাধীনতাবিরোধী রাজাকার, আলবদর, আলশামসদের ক্রুরতা তরুণ প্রজন্মের কাছে নতুন করে পরিচিত করে। ১৯৭৫-এ বঙ্গবন্ধুকে সপরিবারে হত্যার পর সামরিক সরকার স্বঘোষিত হত্যাকারীসহ স্বাধীনতাবিরোধী ও মানবতাবিরোধী অপরাধীদের সকল বিচার কার্যক্রম বন্ধ করে জাতির বিবেককে তমসাবৃত করে দেয়। শহীদ জননীর লেখনীতে পুরো জাতির বিবেক মুক্তির আলোয় পথ খুঁজে পায়। গড়ে উঠতে থাকে জনমত।

১৯৮৮ সালে জেনারেল এরশাদ রাষ্ট্রধর্ম আইন জারি করেন। জেনারেল জিয়াউর রহমান সংবিধানে ‘বিসমিল্লাহির রাহমানির রাহিম’ যোগ করে সংবিধানের ধর্মনিরপেক্ষ বৈশিষ্ট্যকে নষ্ট করেছিলেন। আর এরশাদ বাংলাদেশকে ধর্মনিরপেক্ষ রাষ্ট্রের পরিবর্তে ইসলামী রাষ্ট্র হিসেবে প্রতিষ্ঠা করেন। তাঁর এই ইসলামীকরণের প্রতিবাদে ১৯৮৮ সালের ২ জুন ‘স্বৈরাচার ও সাম্প্রদায়িকতা প্রতিরোধ কমিটি’ নামে একটি নাগরিক কমিটি গঠিত হয়। এক হাজার এক সদস্যবিশিষ্ট ওই নাগরিক কমিটির সদস্য ছিলেন জাহানারা ইমাম। রাষ্ট্রধর্ম আইন পাশের বিরুদ্ধে কমিটির পক্ষ থেকে সুপ্রিম কোর্টে মামলা দায়ের করা হয়েছিল। নব্বইয়ের গণঅভ্যুত্থানের মাধ্যমে জেনারেল এরশাদ-এর পতনের পর ১৯৯১ সালের ২৭ ফেব্রুয়ারি পঞ্চম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে বিএনপি একক সংখ্যাগরিষ্ঠতা অর্জন করলেও সরকার গঠনের জন্য নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা অর্জন করতে ব্যর্থ হয়। তখন জামায়াতে ইসলামীর সমর্থন নিয়ে বিএনপি সরকার গঠন করে। ওই সুযোগে জামায়াতে ইসলামী ১৯৯১ সালের ২৯ ডিসেম্বর শীর্ষস্থানীয় যুদ্ধাপরাধী ও পাকিস্তানি নাগরিক গোলাম আযমকে দলের আমীর ঘোষণা করলে সারাদেশ বিক্ষোভে ফেটে পড়ে। এর প্রতিবাদে মুক্তিযোদ্ধারা বিক্ষোভ মিছিল করে গোলাম আযম ও রাষ্ট্রপতি আবদুর রহমান বিশ্বাসের কুশপুত্তলিকা দাহ করেন। জাতীয় সংসদে বিরোধী দলের সদস্যরা গোলাম আযমকে সংবিধান লংঘনের দায়ে অভিযুক্ত করে বহিস্কারের দাবি জানান।

গোলাম আযমকে যখন আমীর করা হয় তখন জাহানারা ইমাম ক্যান্সার চিকিৎসার জন্য দেশের বাইরে ছিলেন। ১৯৯২ সালের ৬ জানুয়ারি তিনি দেশে ফিরে আসেন। ওই বছরের ১৯ জানুয়ারি শহীদ জননী জাহানারা ইমামকে আহ্বায়ক করে ১০১ সদস্য বিশিষ্ট ‘একাত্তরের ঘাতক দালাল নির্মূল কমিটি’ গঠিত হয়। নির্মূল কমিটির উদ্যোক্তারা যে সব বিবেচনায় জাহানারা ইমামকে তাদের আহ্বায়ক মনোনীত করেন তার ভেতর প্রধান ছিল দেশের সর্বস্তরের মুক্তিযোদ্ধাদের তাঁর প্রতি গভীর শ্রদ্ধা। শহীদ মুক্তিযোদ্ধা রুমির মা হিসেবে মুক্তিযুদ্ধের সময় জীবনের প্রচণ্ড ঝুঁকি নিয়ে বিভিন্নভাবে গেরিলাদের সাহায্য করে তখন থেকেই তিনি এই শ্রদ্ধা অর্জন করেছিলেন। এর কিছুদিন পর ১১ ফেব্রুয়ারি ৭২টি রাজনৈতিক, সামাজিক, সাংস্কৃতিক সংগঠন নিয়ে ‘মুক্তিযুদ্ধের চেতনা বাস্তবায়ন ও একাত্তরের ঘাতক দালাল নির্মূল জাতীয় সমন্বয় কমিটি’ গঠিত হয়। তখন জাহানারা ইমামকে সমন্বয় কমিটির আহ্বায়ক এবং অধ্যাপক আব্দুল মান্নান চৌধুরীকে সদস্য সচিবের দায়িত্ব দেয়া হয়। কাজের সুবিধার জন্য জাহানারা ইমাম জাতীয় সমন্বয় কমিটির একটি স্টিয়ারিং কমিটি গঠন করেন। নির্মূল কমিটির ঘোষণাপত্রে বলা হয়, গোলাম আযমকে যদি অবিলম্বে দেশ থেকে বহিষ্কার না করা হয় তবে ২৬ মার্চ স্বাধীনতার ২১তম বার্ষিকীতে সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে প্রকাশ্য গণআদালতে তার বিচার করা হবে।

প্রথম দিকে অনেকেই এই কর্মসূচির সাফল্য সম্পর্কে সন্দিহান ছিলেন। কিন্তু জাহানারা ইমাম অপরিসীম ধৈর্য, বুদ্ধিমত্তা এবং লক্ষ্যের প্রতি একাগ্রতার দ্বারা সবাইকে এর যৌক্তিকতা অনুধাবন করাতে সক্ষম হয়েছিলেন। তাঁর রাজনৈতিক দূরদর্শিতা, বিচক্ষণতা এবং বিস্ময়কর সাংগঠনিক দক্ষতায় এই আন্দোলন অতি অল্প সময়ের ভেতর প্রত্যাশাকে অতিক্রম করে দেশব্যাপী বিস্তার লাভ করে। ঢাকায় আন্দোলনের পাশাপাশি দেশের বিভিন্ন জেলায় তা বিস্তারের উদ্যোগ গ্রহণ করেন তিনি। জাহানারা ইমামের চেষ্টায় গোলাম আযমের বিচারের দাবি ও নির্মূল কমিটির কার্যক্রমের সাথে ১০০জন সংসদ সদস্য একাত্মতা ঘোষণা করেন। গণআদালতের কার্যক্রমকে বাঁধাগ্রস্থ এবং বন্ধ করে দেয়ার জন্য ১৯৯২ সালের ১৬ মার্চ সুপ্রিম কোর্টের অ্যাডভোকেট আশরাফ-উজ-জামান একাত্তরের ঘাতক দালাল নির্মূল কমিটির আহ্বায়ক জাহানারা ইমামসহ কমিটির ১৫ জনের নামে একটি উকিল নোটেশ জারি করেও তাঁকে দমাতে পারেননি।

দেশের সকল প্রগতিশীল জোটের সহযোগিতায় ঘাতক-দালাল নির্মূল কমিটি ১৯৯২ সালের ২৬ মার্চ ‘গণ-আদালত’ বসিয়ে গোলাম আযমের বিচারের আয়োজন করে। গণআদালতের বিচারে পাকিস্তানি বাহিনীর সহযোগী জামায়াতে ইসলামীর নেতা গোলাম আযমকে গণহত্যা, মানবতার বিরুদ্ধে অপরাধ এবং যুদ্ধাপরাধসহ ১২টি অপরাধে অভিযুক্ত করে প্রতীকী মৃত্যুদণ্ড দেয়া হয়। গণআদালত যেহেতু কোনো প্রচলিত আদালত ছিল না এবং রায় কার্যকর করারও ক্ষমতা ছিল না, তাই গণআদালতের রায় বাস্তবায়নের জন্য তৎকালীন বিএনপি জোট সরকারকে অনুরোধ জানানো হয়। কিন্তু বিএনপি সরকার গণআদালতের ওই রায় কার্যকর না করে জাহানারা ইমামসহ ২৪ জনের বিরুদ্ধে রাষ্ট্রদ্রোহিতার মামলা দায়ের করে। গণআদালতের সফলতার পর গোলাম আযম ছাড়াও অন্যান্য যুদ্ধাপরাধীদের অপরাধ তদন্তের জন্য সুফিয়া কামালকে প্রধান করে ১১ সদস্য বিশিষ্ট একটি জাতীয় গণতদন্ত কমিশন গঠন করা হয়। ওই কমিশন ১৯৯৪ ও ১৯৯৫ সালে তদন্ত করে দুই দফায় ৮ জন করে মোট ১৬ জন শীর্ষ যুদ্ধাপরাধীর অপরাধের কথা প্রকাশ করে। গণআদালতের সাফল্যে জাহানারা ইমামের খ্যাতি দেশের গণ্ডি পেরিয়ে আন্তর্জাতিক পরিমণ্ডলে ছড়িয়ে পড়ে। বিভিন্ন দেশ থেকে সাংবাদিকরা তাঁর সাক্ষাৎকার নিতে আসেন। জাপানের এনএইচকে গণআদালত ও জাহানারা ইমামের ওপর এক ঘন্টার প্রামাণ্য চলচ্চিত্র নির্মাণ করে। জার্মান, ফরাসি, ডাচ, সুইডিশ, স্প্যানিশ প্রভৃতি দেশ থেকে সাংবাদিকরা এসে তাঁর সাক্ষাৎকার নিয়েছেন।

১৯৯২ সালের ২৬ এপ্রিল বঙ্গবন্ধু অ্যাভিনিউতে লক্ষাধিক মানুষের সমাবেশে জাহানারা ইমাম আন্দোলনের ৪ দফা দাবি ঘোষণা করেন- ১. বিশেষ ট্রাইব্যুনাল গঠন করে গণআদালতের রায় কার্যকর করা, ২. জামায়াত-শিবির চক্রের সাম্প্রদায়িক রাজনীতি নিষিদ্ধ করা, ৩. গণআদালতে উদ্যোক্তা ২৪ জন বরেণ্য নাগরিকের বিরুদ্ধে রাষ্ট্রদ্রোহিতার মিথ্যা মামলা প্রত্যাহার এবং ৪. জাতীয় সমন্বয় কমিটির কর্মী ও নেতাদের ওপর পুলিশি নির্যাতন বন্ধ করা। ৪ দফা দাবি আদায়ের জন্য সমন্বয় কমিটি বড় বড় জনসভা করেছে, কয়েকবার হরতাল ডেকেছে এবং সফলও হয়েছে। সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি ও যুদ্ধাপরাধী সাম্প্রদায়িক শক্তির বিরুদ্ধে ঘৃণা প্রকাশের জন্য বিভিন্ন জেলায় মানববন্ধন কর্মসূচি পালন করা হয়েছে। সমাবেশ আয়োজন করতে গিয়ে জাহানারা ইমামসহ সমন্বয় কমিটির নেতৃবৃন্দ পুলিশের দ্বারা শারীরিকভাবে লাঞ্ছিত হয়েছেন, কিন্তু আন্দোলন থেমে থাকেনি। ১৯৯৪ সালের ২৬ মার্চ জাহানারা ইমামের সভাপতিত্বে বিশাল জনসভায় তদন্ত কমিশনের রিপোর্ট প্রকাশ করা হলো। দ্বিতীয় পর্যায়ে আরও ৮ জন যুদ্ধাপরাধীদের নাম তিনি ঘোষণা করেন। এবারের সাফল্যে তিনি আরও আত্মবিশ্বাসী হয়ে উঠলেন।

রাজনৈতিক দলের নেতাদের অধিকাংশই জাহানারা ইমামের সঙ্গে সরাসরি পরিচিত ছিলেন না। কিন্তু তিনি তাদের সবাইকে অপরিসীম ধৈর্যের সঙ্গে এবং তাঁর শাণিত যুক্তির সাহায্যে বুঝিয়ে নিজের নেতৃত্বগুণ প্রমাণ করেছেন। এ সময় তিনি রাজনৈতিক দলের প্রতি বিক্ষুব্ধ নির্মূল কমিটি ও সমন্বয় কমিটির নেতা-কর্মীদের বোঝাতেন এই বলে যে, “আমাদের অবস্থা হচ্ছে কন্যাদায়গ্রস্থ পিতার মতো। যে যাই বলুক আমাদের শুনতে হবে, যুক্তি দিয়ে বিনয়ের সঙ্গে তাদের বোঝাতে হবে। মাথা গরম করলে চলবে না। এ কাজ একার নয়।” জাহানারা ইমামের যোগ্যতা সম্পর্কে যারা সন্দিহান ছিলেন গণআদালতের সাফল্য তাদের ভ্রান্তির অবসান ঘটায়।

১৯৯৪ সালের ২৬ জুন জাহানারা ইমাম দূরারোগ্য ক্যান্সারের কাছে পরাস্ত হয়ে মৃত্যুবরণ করেন। সমন্বয় কমিটির দায়িত্ব পালনকালে তাঁকে অনেক প্রতিকূলতা মোকাবেলা করতে হয়েছে। ওই সময়ে তিনি আক্ষেপ করে বলেছিলেন, “অনেকগুলো জীবন্ত ব্যাঙকে একসাথে এক ঝুড়িতে রাখা যেমন কষ্টকর তেমনি অনেকগুলো রাজনৈতিক দলকে একসাথে করে আন্দোলন চালিয়ে যাওয়াও কষ্টসাধ্য। কারণ জীবন্ত ব্যাঙ একটিকে ঝুড়িতে উঠিয়ে রাখলে অন্যটি যেমন লাফ দিয়ে মাঠিতে পড়ে। তেমনি একেক দলের একেক দাবি পূরণ করে সমন্বয় কমিটির কাজ চালিয়ে যেতে হচ্ছে।” তারপরও সকল প্রতিকূলতা অতিক্রম করে রাজনৈতিক দলগুলোর দাবি-দাওয়া পূরণ করে দৃপ্তপ্রত্যয়ে তিনি সংগঠনের নেতৃত্ব দিয়েছিলেন।

জাহানারা ইমামের মৃত্যুর পর সমন্বয় কমিটি ভেঙ্গে যায় এবং নির্মূল কমিটি পুনর্গঠন করে আন্দোলনের নতুন পর্যায় শুরু হয়। শহীদ জননীর মৃত্যুর পর মানবতাবিরোধী অপরাধীদের বিচারের দাবিতে চলমান আন্দোলনে খানিকটা ভাটা পড়ে। তখন শাহরিয়ার কবির ও কাজী মুকুল নির্মূল কমিটির কার্যক্রমকে বেগবান করেন। শামসুর রাহমান দীর্ঘদিন কমিটির সভাপতি ছিলেন। এছাড়া শ্যামলী নাসরিন চৌধুরী, কবীর চৌধুরী, কামাল লোহানী, মুনতাসীর মামুন প্রমুখ এই আন্দোলনে উল্লেখযোগ্য ভূমিকা পালন করেন। নির্মূল কমিটি পুনর্গঠনের সময় সবচেয়ে বেশি গুরুত্ব দেয়া হয়েছে নতুন প্রজন্মকে। এই আন্দোলনের সঙ্গে তাদের যুক্ত করতে এবং দেশবরেণ্য বুদ্ধিজীবীদের আরও বেশি সম্পৃক্ত করতে কাজ করা হয়। কারণ মৃত্যুর আগে শহীদ জননী এই আন্দোলনের দায়িত্বভার কোনো একক ব্যক্তি বা দলের ওপর দিয়ে যাননি। তাঁর অন্তিম বাণী ছিল, “এই আন্দোলনকে এখনো অনেক দুস্তর পথ পাড়ি দিতে হবে। দেশের বিভিন্ন রাজনৈতিক, সাংস্কৃতিক, মুক্তিযোদ্ধা, ছাত্র ও যুব শক্তি, নারী সমাজসহ দেশের সর্বস্তরের মানুষ এই লড়াইয়ে আছে। তবু আমি জানি জনগণের মতো বিশ্বস্ত আর কেউ নয়। জনগণই সকল শক্তির উৎস। তাই একাত্তরের ঘাতক ও যুদ্ধাপরাধী বিরোধী মুক্তিযুদ্ধের চেতনা বাস্তবায়ন ও ’৭১-এর ঘাতক দালাল নির্মূল সমন্বয় আন্দোলনের দায়িত্বভার আমি আপনাদের বাংলাদেশের জনগণের হাতে অর্পণ করলাম। জয় আমাদের হবেই।”

আন্দোলনের ধারাবাহিকতায় ২০০৮ সালের নির্বাচনে আওয়ামী লীগ নেতৃত্বাধীন মহাজোট বিপুল ভোটে জয়লাভ করে এবং সংসদের প্রথম অধিবেশনে মানবতাবিরোধী অপরাধীদের বিচারের বিষয়টি সর্বসম্মতভাবে পাশ হয়। ২০১০ সালের ২৫ মার্চ আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল গঠন করে মানবতাবিরোধী অপরাধীদের বিচার কার্যক্রম শুরু হয়। ১৯৭২ সালের ২৭ ফেব্রুয়ারি যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের দাবিতে রাজপথে প্রথম মিছিল করে যে আন্দোলনের সূত্রপাত হয় ওই আন্দোলন শহীদ জননী জাহানারা ইমামের গণআদালতে গোলাম আযমের বিচারের মাধ্যমে সারা বাংলায় ছড়িয়ে পড়ে। আন্দোলনের ধারাবাহিকতায় কাদের মোল্লার রায়কে কেন্দ্র করে ২০১৩ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে শাহবাগ চত্বরে জন্ম নেয় তারুণ্যের মহাজাগরণ। জাহানারা ইমামের আন্দোলন এই তরুণ প্রজন্মকে আলোকিত করে। আন্দোলন মঞ্চে শহীদ জননীর বিশাল ছবি রেখে তরুণ প্রজন্ম তাঁকে স্মরণ করে।

সুশীল সমাজে উদ্ভূত আন্দোলন দীর্ঘস্থায়ী হওয়ার উদাহরণ খুব কম। তবে শহীদ জননীর নেতৃত্বে প্রতিষ্ঠিত একাত্তরের ঘাতক দালাল নির্মূল কমিটি এক্ষেত্রে ব্যতিক্রম। নির্মূল কমিটির নেতৃবৃন্দ আন্দোলনের একটি প্রাতিষ্ঠানিক রূপ দিয়েছেন। মুক্তিযুদ্ধোত্তর বাংলায় শকুনির মচ্ছবে শহীদ জননী শোকাভিভূত হয়ে নীরবে শুধু অশ্রুবর্ষণ করেননি। তিনি হৃদয়ের সব অনুভূতি ও চেতনার তাগিদে পাকিস্তানি দখলদার বাহিনীর নির্মম নির্যাতনের পৈশাচিক কাহিনী বিধৃত করেছেন তাঁর হৃদয়স্পর্শী লেখায়। কিন্তু শুধু আবেগ প্রকাশ করে ক্ষুব্ধ লড়াইয়ের দিনলিপিই রচনা করে তিনি ক্ষান্ত হননি। তাঁর বুকের ভেতর যে ঘৃণার পাহাড় ক্ষোভের আগ্নেয়গিরি সৃষ্টি করেছিল, এক দিন তারই বহিঃপ্রকাশ ঘটল, সূচিত হলো চেতনাদীপ্ত গণআন্দোলনের। বাংলাদেশ একটি অসাম্প্রদায়িক ধর্মনিরপেক্ষ রাষ্ট্র হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হলে বঙ্গবন্ধুর সোনার বাংলার স্বপ্ন এবং মানবতাবিরোধী অপরাধীদের বিচারের দাবিতে আমৃত্যু সংগ্রামী জাহানারা ইমামের নেতৃত্বে পরিচালিত আন্দোলন সত্যিকারের সফলতা লাভ করবে।

৩ মে শহীদ জননী জাহানারা ইমাম (৩ মে ১৯২৯-২৬ জুন ১৯৯৪)-এর ৯৪তম জন্মদিন। শহীদ জননীর স্মৃতির প্রতি বিনম্র শ্রদ্ধা জ্ঞাপন করছি।