দেশের পুঁজিবাজারে আস্থার সংকটের কথা দীর্ঘ সময় ধরেই আলোচিত হচ্ছে। বাজারে আস্থা পুনরুদ্ধারে কেউই আন্তরিক ছিল না।
Published : 28 Aug 2024, 04:46 PM
দেশের পুঁজিবাজার ঘুরে দাঁড়াতে শুরু করেছে বলে মনে হচ্ছে। প্রধান শেয়ার বাজার ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জে (ডিএসই) গত তিন সপ্তাহে শীর্ষ পাঁচটি কোম্পানির বাজার মূলধন বেড়েছে ২৩ হাজার ৯৬৯ কোটি টাকা। শেয়ার বাজার সম্পর্কে কোম্পানিগুলোর বাজার মূলধন সংক্রান্ত এ তথ্য দেশের শীর্ষ জাতীয় দৈনিকগুলোর।
ডিএসইর মোট বাজার মূলধনের ১১ দশমিক ৩ শতাংশ নিয়ে ২৫ অগাস্ট শীর্ষে রয়েছে তালিকাভুক্ত টেলিযোগাযোগ খাতের বহুজাতিক কোম্পানি গ্রামীণফোন লিমিটেড। এর বাজার মূলধনের পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ৪৫ হাজার ৪৭৮ কোটি টাকা। যেখানে ৪ অগাস্ট শেষে বাজার মূলধন ছিল ৩৩ হাজার ৩৭৯ কোটি টাকা।
তাছাড়া সপ্তাহখানেক আগে বেশির ভাগ কার্যদিবসে শেয়ার বাজার দুটিতে গ্রামীণফোন, ব্র্যাক ব্যাংক, অলিম্পিক, অরিয়ন ফার্মা, জেএমআই হসপিটাল, সী পার্ল, স্কয়ার ফার্মা, রবি, আইএফআইসি ব্যাংক ও ইসলামী ব্যাংকের লেনদেন বেশ ভালোই ছিল। বিনিয়োগকারীদের মধ্যে উৎসাহ পরিলক্ষিত হচ্ছে।
পুঁজিবাজারকে আস্থার জায়গায় নিয়ে যেতে চান বলে মন্তব্য করেছেন বাংলাদেশ সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশনের (বিএসইসি) নতুন চেয়ারম্যান খন্দকার রাশেদ মাকসুদ। বাজারে পুরোপুরি স্বচ্ছতা ও জবাবদিহি প্রতিষ্ঠার জন্য আগামী চার বছর কাজ করার কথা ব্যক্ত করেছেন তিনি। তিন দিন আগে ক্যাপিটাল মার্কেট জার্নালিস্ট ফোরামের (সিএমজেএফ) সঙ্গে সৌজন্য বৈঠকে বিএসসির চেয়ারম্যান বসেন।
দেশের পুঁজিবাজার নিয়ে পেছনের দিকে তাকাই। আস্থার বেশ অভাব ছিল এ বাজারে বহুদিন। অনেকেই আসল মূলধনটুকুও হারিয়েছেন। কমে যায় বিও হিসাবধারীর সংখ্যা। পুঁজিবাজারের লুণ্ঠনকারী এবং বিভিন্ন সময় কেলেঙ্কারির সঙ্গে যুক্ত দুর্নীতিবাজরা সরকার পতনের আগে ও পরে অনেকেই গা ঢাকা দিয়েছে। মূল হোতা ধরা পড়ে এখন কারাগারে! ফলে লোপাটকারী বেশির ভাগ বাজারে না থাকায় বর্তমান অন্তর্বর্তী সরকারের সময়ে আশা করা যায় বাজারে শৃঙ্খলা ফিরে আসবে। বিনিয়োগকারীরাও তাই প্রত্যাশা করছেন।
২০১২ সালের ২১ অগাস্ট দেশের শেয়ার বাজারের হতশ্রী নিয়ে জনপ্রিয় একটি নিউজ পোর্টালে এক নিবন্ধ লিখেছিলাম। যা আজকের প্রেক্ষাপটে বাস্তবতা। ফেইসবুক বন্ধু ফালগুনী রহমানের স্ট্যাটাসে দেওয়া জোড়া ছবি বিচলিত করেছিল আমাকে। বিষয়টি ছিল বেশ স্পর্শকাতর।
রাজধানীর লালবাগে অনাহারী দুই সহোদরার। ক্ষুধার জ্বালায় কাতর। খেতে চেয়েছিলো ওরা। অপরদিকে লুটপাটকারী কটি হাস্যেজ্জ্বল এবং সমাজ শাসানো শাণিত মুখাবয়ব (যারা এখন পলাতক ও কারাগারে)।
ক্ষুধা নিবারণ আর তখনকার শেয়ার বাজার কেলেঙ্কারিতে অভিযুক্ত রাঘব বোয়ালদের নিয়ে একটি ক্যানভাসে পাশাপাশি দুটি ছবি। ক্যাপশনে সমসাময়িককালে সত্য প্রকাশের এক নিগূঢ় বাস্তবতা স্পষ্ট। দুটি ক্যাপশনের একটি ছিল– ‘ক্ষুধার জ্বালায় হতভাগ্য দুবোন একটু খাবার চুরি করেছিলো বীর বাঙালি তাই ওদের ক্ষমা করেনি।’ অপর ছবিটি দেশের ৬ জন ‘বিশিষ্ট শিল্পপতি’ ও শেয়ার ব্যবসায়ীর।
বিশিষ্ট ব্যাংকার প্রয়াত খোন্দকার ইব্রাহিম খালেদের নেতৃত্বে প্রকাশিত শেয়ার কেলেঙ্কারির তদন্ত প্রতিবেদন সংক্রান্ত খবরের পত্রিকা শিরোনাম– অভিযোগের শীর্ষে যারা। নিচে ক্যাপশনে লেখা– ‘এনারা বিশিষ্ট সৈয়দ বংশীয় চোর, হাজার কোটি টাকা চুরি করলেও বীর বাঙালি এদের নাগাল পায়নি।’ কোলাজ ছবি দুটি ছিল কর্মময় জীবনের এক বড় প্রতিবাদ। বিশেষ করে তাদের কাছে, যারা বুঝে বা না বুঝে ডেসটিনি ভেবে দেশের শেয়ার বাজারে পুঁজি হারিয়ে নিঃম্ব। এ প্রতিবাদের ভাষা তাদের স্বজনদের, যারা এখানে বিনিয়োগ হারিয়ে জীবন দিয়ে গেছেন। ফালগুনীর সে স্ট্যাটাসে ছবি দুটি সম্পর্কে ৫ জনের বিরূপ মন্তব্য ছিল। লেখার বিষয়টির সঙ্গে উল্লেখিত বিদ্রুপাত্মক এবং সংবেদনশীল হৃদয়স্পর্শী ঘটনাগুচ্ছের বেশ মিল ছিল।
আমরা যারা শ্রমজীবী মানুষ, দৈনিক কাজ না করলে আহার জোটে না; বিষয়গুলো নিয়ে অসহায় আমাদের শুধু চিন্তা ছাড়া কোনো বিকল্প নেই। গণপিটুনি খাওয়া ওই দুবোনের সঙ্গে পার্থক্য এটুকুই, ওদের উর্পাজন করার মেধা বা জ্ঞান নেই যা দেশের শেয়ার বাজার লুণ্ঠনকারীদের ছিল। আর হাজার কোটি টাকা লুটপাটকারী ‘সৈয়দ বংশীয় চোর’ নামের রাঘব বোয়ালদের সঙ্গে রুটি রুজির সন্ধানে ব্যস্ত থাকা তফাৎ– আমরা চৌর্যবৃত্তির কৌশল জানি না। যে ‘মহাজ্ঞানে ‘ মহিমায় ওই ৬ জন ‘মহারথী’ সমাজে, রাজনীতিতে এবং রাষ্ট্রের নানা কার্যক্রম, অবৈধভাবে ব্যাংক ঋণ গ্রহণ এবং শেয়ার বাজার ম্যানুপুলেশনসহ নানান অপরাধে যুক্ত ছিলেন।
কেন দু বোন চুরি করে খেয়েছিল? ওদের মা-বাবা কি রোজগার করতে অক্ষম, নাকি ওরা অনাথ? সে জন্যই কি ওরা এ অন্যায় করেছিল? এসব প্রশ্নের উত্তর না খুঁজে বরং ওদের আমরা শাস্তি দিয়েছি। কিন্তু পুকুর চোরদের কিছুই আমরা করতে পারিনি। কেননা সরকারের আশ্রয় ও প্রশ্রয়ে থাকা তাদের টিকির নাগাল আমরা পাইনি। সকল সরকারের আমলেই এসব রাঘব বোয়ালরা আদর যত্মআত্তি পায়। বড় বড় রাজনৈতিক দলগুলো এদের কদর করে। যাদের চাঁদা ও পৃষ্ঠপোষকতায় সরকারি এবং বড় দলগুলোর উজ্জীবিত থাকে। বড় বড় অংকের আয়কর ফাঁকি দিয়েও এরা পার পেয়ে যায়। অনেক সময় বিশেষ সুবিধার কাছে সে খবরও ধামাচাপা পড়ে যায়! আর সরকারের ঘাটতি করের বোঝার অধিকাংশ পরোক্ষ করের মাধ্যমে সামলাতে হয় আমাদের মতো সাধারণ মানুষকে।
অন্ন বস্ত্র ও বাসস্থান– জনগণের এ মৌলিক চাহিদা পূরণের দায়িত্ব তো রাষ্ট্রের। সংবিধানেও সে কথা বলা আছে। জনগণের নিরাপত্তা সেটা জীবন বা জীবিকার যেটাই হোক না কেন তা পালনের দায়িত্বও রাষ্ট্রের। ২৭ লাখ বিও (বেনিফিসারি ওনার্স) হিসাবধারীর পুঁজিই বা হারাতে হলো কেন? ‘যারা’ শেয়ারবাজারের লাখ লাখ বিনিয়োগকারীর পুঁজি লুণ্ঠনকারী তাদের কেন বারবার ‘ক্ষমা’ করেছিল সরকারগুলো?
দেশের পুঁজিবাজারে আস্থার সংকটের কথা দীর্ঘ সময় ধরেই আলোচিত হচ্ছে। বাজারে আস্থা পুনরুদ্ধারে কেউই আন্তরিক ছিল না। আন্তরিক হয়নি। ১৯৯৬ সালের শেয়ার কেলেঙ্কারির ঘটনায় জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক আমীরুল ইসলাম চৌধুরী কমিটির প্রকাশ করা সেই তদন্ত প্রতিবেদনের বিচার আজও হয়নি। অভিযুক্তরা পুনর্বাসিত হয়েছেন। বিচারের বদলে ‘ক্ষমা’ পেয়ে পুঁজি বাজারের এই লুটপাটকারীরা বরং বীর বাঙালির মতো অস্ত্র ধরে ক্ষুদ্র বিনিয়োগকারীদের হত্যা করেছিলেন। কলঙ্কজনক সেই ঘটনার অভিযুক্ত একজন ছিলেন ঢাকার শেয়ারবাজার ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জ লিমিটেডের (ডিএসই) সভাপতি, যিনি এখন পৃথিবীতে নেই। সেই ঘটনার অভিযুক্ত ৪৫ জন ছিলেন। যারা বেঁচে আছেন; তাদের এখন বিচার হওয়া উচিত। বছরের পর বছর লুণ্ঠনকারী এরা দেশের শেয়ার বাজারকে ধ্বংসস্তূপে পরিণত করে গেছেন।
২০১০ সালের দেশের শেয়ার বাজারে পুনরায় কেলেঙ্কারি সংঘটিত হয়। কেলেঙ্কারির সঙ্গে উল্লিখিতরাও জড়িত ছিল। তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়। কিন্তু কোন কাজ হয়নি। তদন্ত কমিটির প্রতিবেদন প্রকাশ করা নিয়ে তখন সরকারের মেলোড্রামা মঞ্চস্থ হয়! কমিটির প্রধান সর্বজন শ্রদ্ধেয় প্রবীণ ব্যাংকার খোন্দকার ইব্রাহিম খালেদকে অপ্রত্যাশিত এবং বিব্রতকর অবস্থার মধ্যে পড়তে হয়? আজ খোন্দকার ইব্রাহিম খালেদ বেঁচে নেই!
সময় অনেক অতিবাহিত হয়েছে। কালক্ষেপণ আর নয়। আমীরুল ও খালেদ কমিটির তদন্ত প্রতিবেদনের ওপর ভিত্তি করে অপরাধীদের আদর না করে যোগ্য বিচারসহ কমিটির সুপারিশগুলো দ্রুত বাস্তবায়ন করার জোর পরামর্শ দেই সরকারকে। তা করা গেলে দেশের পুঁজি বাজারে আস্থা বা বিশ্বাস ফেরানো সম্ভব। কেননা, পুঁজিবাজার দেশের তৃণমূলে এখন বিস্তৃত।