Published : 05 Apr 2012, 09:55 PM
সম্প্রতি দেশের কিছু বুদ্ধিজীবি বাংলা ভাষা নিয়ে কয়েকটি বিতর্কিত প্রসঙ্গ উত্থাপন করেছেন এবং যেহেতু তারা এই ভাষার দূষণ নিয়ে পীড়িত সেহেতু এই সংকট থেকে উত্তরণের বিষয়েও কিছু প্রস্তাব ও পরামর্শ দিয়েছেন। একটি ইংরেজি সাপ্তাহিকের সাথে এক সাক্ষাৎকারে আমি বলেছিলাম, "ভাষা গতিশীল ও সদা পরিবর্তমান। একটি ভাষার অনেক আঞ্চলিক রূপ বা উপভাষা রয়েছে। এমনকি ব্যক্তি বিশেষের স্বভাষাও গ্রহণযোগ্য যার জন্ম মানুষের দীর্ঘ সময় ধরে বিশেষ বাচনভঙ্গিতে কথা বলার চর্চার কারণে। আইন প্রণয়ন করে ভাষাকে তথাকথিত নির্মল করার চেষ্টা তাই বৃথা। ভাষা পরিবর্তনশীল এবং এর পরিবর্তন অনিবার্য। ভাষার নমনীয়তা, অন্য ভাষা থেকে পরিগ্রহণ এবং অন্য অসংখ্য ভাষার সাথে প্রতিযোগিতা করে টিকে থাকা একটি ভাষার অস্তিত্বকে দীর্ঘায়িত করে এবং তাকে অবলুপ্তি থেকে রক্ষা করে।" আমি দৃঢ়ভাবে বিশ্বাস করি যে ভাষার পরিবর্তন পরম্পরা রোধ করার কোন আইনি শক্তি প্রয়োগ হাস্যকর।
ভাষার পরিবর্তন পরম্পরার একটি অন্যতম প্রধান কারণ হিসেবে ভাষাতত্ত্ববিদরা চিহ্নিত করেছেন বিচ্ছিন্নতা বা বিভাজন প্রক্রিয়াকে। যদি একই ভাষাভাষী মানবগোষ্ঠী কোন কারণে একে অপরের কাছ থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ে এবং কদাচিৎ পরস্পরের সাথে যোগাযোগ বা দেখাসাক্ষাৎ ঘটে তবে তাদের মধ্যে বিশাল ভাষাগত পার্থক্য সৃষ্টি হতে বাধ্য। এই বিচ্ছিন্নতার কারণ বহুবিধ যার অন্যতম হলো ভৌগলিক দূরত্ব, রাজনৈতিক পৃথকীকরণ, পারস্পরিক মতপার্থক্য এবং অপর্যাপ্ত যোগাযোগ। এর ফলে দুটি ভিন্ন ভাষা বা উপভাষার জন্ম হয়।
বিশ্বের বহু ভাষার ক্ষেত্রেই এই ঘটনাটি ঘটেছে এবং সবচেয়ে জ্বলন্ত উদাহরণ হলো ইংরেজি ভাষা। মার্কিনী, ক্যানাডীয়, অস্ট্রেলীয় এবং অন্যান্য ইংরেজি ভাষাভাষীর ইংরেজি এবং যুক্তরাজ্যের ইংরেজি যাকে ইংরেজি ভাষার মূল উৎপত্তি স্থান হিসেবে চিহ্নিত করা হয় ভিন্নতর নি:সন্দেহে। বাংলা ভাষার ক্ষেত্রেও তাই ঘটেছে, কারণ বাংলাদেশের বাংলা এবং পশ্চিমবঙ্গের বাংলাতে চারিত্রিক ও ব্যবহারিক পার্থক্য রয়েছে অনেক।
আবার একথাও সত্যি একই ভাষাগোষ্ঠীর মধ্যেও সামাজিক শ্রেণীবিন্যাসের প্রভাবে ভাষাগত বিচ্ছিন্নতা বা বিভাজন ঘটতে পারে। তবে এর ব্যাপকতা অবশ্যই সংকীর্ণ পরিসরে হয়ে থাকে। যদি বিভিন্ন উপভাষা একই ভৌগলিক সীমারেখায় কোন একটি ভাষাগোষ্ঠীর সঙ্গে সহঅবস্থান করে তবে এই ভাষাগুলি পরস্পরকে বিভিন্ন পর্যায়ে প্রভাবিত করে এবং সবগুলি ভাষাতেই কমবেশি পরিবর্তন আসে। এটি মূলত হয় পারস্পরিক সমঝোতা স্থাপনের প্রয়োজনে। বাংলা ভাষার আজকের রূপটা এই পরিবর্তনেরই ফলশ্রুতি।
যদিও সংস্কৃতকেই বাংলা ভাষার উৎসমূল বলে ধরা হয় এবং ইন্দো-য়ূরপীয় ভাষা পরিবারের সদস্য হওয়ায় বাংলা ভাষা ইংরেজি ভাষার দূর সম্পর্কের আত্মীয়, তবে বাংলা মূলত সরাসরি প্রাকৃত ভাষার সাথে সম্পর্কযুক্ত এবং আমরা সবাই জানি এই ভাষাটিকে নিন্মমানের ভাষা হিসেবে চিহ্নিত করা হতো। ইংরেজি ভাষার ইতিহাসও প্রায় একই রকম; ইংরেজি নিম্নবিত্তের মানুষদের ভাষা ছিল।
আমার যা বলতে চাই তা হলো, বাংলা ও ইংরেজি উভয়ই বিচ্ছিন্নতা ও বিভাজন উপাদানের ফলশ্রুতি এবং এই দুটি ভাষাই দৃঢ় অবস্থানে আসার আগে তীব্র পরিবর্তন পরম্পরার মধ্য দিয়ে যেতে বাধ্য হয়েছে।
উপরন্তু দুটি ভাষাই ঐতিহাসিকভাবে নিন্মসামাজিক মর্যাদার জনগোষ্ঠীর ভাষা বলে পরিচিত ছিল। ঠিক একারণেই প্রমিত বাংলার সংজ্ঞাসম্পন্ন রূপ তো আসলে সমাজের সুবিধাভোগী জনগোষ্ঠী দ্বারা নির্বাচিত একটি উপভাষা মাত্র। ভাষা ও নদীর মধ্যে কোন তুলনা বাস্তবসম্মত নয় কারণ একটি প্রকৃতির সৃষ্টি এবং অপরটি মানুষের প্রয়োজনে মানুষেরই সৃষ্টি, একটি প্রকৃতি নির্ভর, অপরটি মানব মনস্তত্ত্ব, আচার-আচরণ, জীবন ধারা এবং মানব উন্নয়নের সাথে সম্পৃক্ত। একমাত্র সাদৃশ্য যা চিহ্নিত করা যায় তা হলো নদী ও ভাষা উভয়ই পরিবর্তণশীল কিন্তু পরিবর্তনের উপাদানগুলি ভিন্নতর।
বিচ্ছিন্নতা বা বিভাজন উপভাষারও জন্ম দেয় এবং প্রতিটি উপভাষার নিজ-নিজ মর্যাদা রয়েছে। ঠিক এই কারণেই নিন্মমানের ভাষায় বলে কিছু নেই এই বিশ্বে–সব ভাষা, উপভাষা সমমর্যাদা সম্পন্ন। কারণ ভাষামাত্রেই একটি নির্দিষ্ট ভাষাগোষ্ঠীর সকল প্রকার যোগাযোগ সম্পন্ন করার জন্য স্বয়ংসম্পূর্ণ। শিক্ষিত সমাজে বুদ্ধিজীবি মহল একটি মানসম্পন্ন ভাষা সৃষ্টি ও চিহ্নিত করতে উদ্যোগী হয়েছেন কিন্তু যখন ভাষার যথার্থতার প্রসঙ্গ বিবেচিত হয় তখন আমরা সবাই ভাষার ব্যবহারিক দিকটিকে বেশি গুরুত্ব দিই বিশুদ্ধতার চেয়ে। এই বক্তব্যের যথার্থতা প্রমাণিত হয় বিশ্বের সকল ভাষায় রচিত সাহিত্য কর্মের উদাহরণে।
দুটি আলোচ্য বিষয় প্রসঙ্গক্রমে উত্থাপন করতে চাই: বিকৃত বা কৃত্রিম উচ্চারণে বাংলা বলা এবং অতিমাত্রায় দ্বিভাষিক শব্দ ও বাক্য সংমিশ্রণ। বিষয় দুটিকে নিন্দা করার আগে আমাদের বুঝতে হবে এগুলোর কারণসমূহ কী।
প্রথমত, বিকৃত বা কৃত্রিম উচ্চারণে কথা বলার প্রবণতা ঘটে ব্যক্তি বিশেষের স্বভাববৈশিষ্টের কারণে। অনেক ক্ষেত্রেই এর মূল কারণ ফ্যাশন প্রবণতা এবং বহুলাংশে খ্যাতিমান ও প্রসিদ্ধ ব্যক্তিদের অনুকরণের প্রচেষ্টা। বাংলাদেশে ডিস্কো জকি অথবা রেডিও জকিদেরকে এই প্রবণতার জন্য দায়ি করা হয়। আমি মনে করি এই প্রবণতা অধিকাংশ ক্ষেত্রে স্থায়ী হয় না যদিও দু'একটি উচ্চারণ দীর্ঘমেয়াদী হওয়া সম্ভবও।
দ্বিতীয়ত, দ্বিভাষিক শব্দ ও বাক্য সংমিশ্রণ খুবই স্বাভাবিক। এমনটা ঘটে যখন একটি দেশে মাতৃভাষা ছাড়াও অন্য এক বিশ্বপর্যায়ের প্রভাবশালী ভাষার ব্যবহার দৈনন্দিন জীবন ও শিক্ষা ব্যবস্থায় প্রচলিত থাকে। বাংলাদেশের ক্ষেত্রে সেই ভাষাটি হলো ইংরেজি। আমরা সকলেই কমবেশি এই দ্বিভাষিক শব্দ ও বাক্য সংমিশ্রণ করে থাকি আমাদের কথোপোকথনে, এমন কি নিন্মবিত্তের অর্ধ ও অশিক্ষিত জনগোষ্ঠীও।
এই প্রভাব থেকে পরিত্রাণ আছে কিনা জানি না, তবে ঘটনাটি অনিবার্য হবার কারণে আমি মনে করি এ বিষয়ে পরিগ্রহণের মনভাবই শ্রেয়- কারণ ভাষা তো মূলত যোগাযোগ স্থাপনের জন্যই। সচেতন সমাজ শিক্ষায়তনিক এবং জ্ঞানজাগতিক অঙ্গনে সচেতনভাবে এই সংমিশ্রণ না করতে চাইতেই পারেন।
বিশ্বের সকল জীবিত ভাষাই সদা পরিবর্তমান। ভাষার উৎপত্তির ইতিহাস আমাদের কাছে স্পষ্ট করেছে যে ভাষার অন্তর্গত সচলতা নতুন শব্দ, নতুন বাক্য বিন্যাস, নতুন প্রকাশভঙ্গী, পুরাতন অভিব্যক্তির নতুন রূপ, পরিবর্তিত উচ্চারণ এবং এমনকি নতুন ভাষার জন্ম দিয়েছে। বিভিন্ন ভাষা পরিবার এর সাক্ষ্য দেয়। ভাষার গভীরে যে সচল শক্তি রয়েছে তাকে শৃঙ্খলিত করার ক্ষমতা কারও নেই। আইন পাশ করে বিকৃত ও কৃত্রিম উচ্চারণ, ভুল ও অশুদ্ধ ভাষা বিন্যাস কিংবা দ্বিভাষিক শব্দ ও বাক্য সংমিশ্রণের প্রবণতাকে রোধ করা সম্ভব নয়। সচল জীবিত ভাষা পরিবর্তনশীল কিন্তু অ-দূষণীয়।
আব্দুস সেলিম: অনুবাদক, প্রাবন্ধিক ও ভাষাতাত্ত্বিক। নর্থ সাউথ বিশ্ববিদ্যালয়ে ইংরেজি বিভাগের অধ্যাপক।