Published : 22 Jun 2017, 10:50 PM
রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষকতা করে ছেলেটি, আমার পরিচিত ও স্নেহের পাত্র। খুবই আনন্দের সঙ্গে আমাকে ফোন করে বলে, "দাদা, আমার পিএইচডি গবেষণাটি শেষ করেছি।"
জানতে চাই, "তোমার বিষয় কী?"
সে কোনো রূপ দ্বিধায় না পড়ে বলল, "বাঙালি মুসলমানের দর্শন চিন্তা।"
তার মুখে ওই কথা শুনে একটু থমকে গেলাম। ছেলেটি প্রগতিশীল ধারার শিক্ষক প্যানেলে আছে। রাজনীতি করে, কিন্তু খুব যে রাজনীতি-সচেতন, তা বলব না। তারপরেও সে 'বাঙালির দর্শন চিন্তা' নিয়ে গবেষণা না করে 'বাঙালি মুসলিমের দর্শন চিন্তা' নিয়ে গবেষণা করল?
না, ছেলেটির কোনো দোষ নেই। কারণ, যে বাঙালি হিসেবে আমরা স্বাধীন হয়েছিলাম সেই 'বাঙালিত্ব' ঘুচিয়ে দিয়ে 'বাঙালি হিন্দু' ও 'বাঙালি মুসলিম' করার প্রচেষ্টা তো সেই স্বাধীনতার পরদিন থেকেই, বলা যায়, শুরু হয়। সেদিনের সর্বাধিক প্রচারিত দৈনিক 'ইত্তেফাক' পত্রিকা এর নেতৃত্ব নেয়। আর সেখানে সর্বজন শ্রদ্ধেয় আবুল মনসুর আহমদ ও স্বাধীনতাবিরোধী খোন্দকার আব্দুল হামিদ নানান অজুহাতে বলতে থাকেন 'বাঙালি মুসলমান' ও 'বাঙালি হিন্দু'; এ কথা বলে সুকৌশলে অস্বীকার করতে থাকেন একক বাঙালিত্ব, ভেঙে ফেলতে চান বাঙালির ঘরের সব ভাইবোনের মিলনকে ধর্মের নাম দিয়ে।
আবুল মনসুর আহমদ বাঙালি মুসলিমের জন্যে আলাদা সংস্কৃতির কথা বলেন সেদিন। জিয়াউর রহমানের আমলে এসে একদিকে খোন্দকার আব্দুল হামিদ যেমন বসন্ত চ্যাটার্জ্জীর উদ্ভাবিত 'বাঙালি'র পরিবর্তে 'বাংলাদেশি' হওয়ার জন্যে বাংলা একাডেমির এক ভাষণে বলেন, তেমনি আবুল মনসুর আহমদ বলেন, বাংলাদেশের মুসলমানরা তাঁকে পঞ্চাশ বছর পরে হলেও বুঝবেন, তিনি বাঙালি মুসলমানের জন্যে যে আলাদা সংস্কৃতির কথা বলছেন– তা কত প্রয়োজনীয়।
অর্থাৎ বঙ্গবন্ধুর আমলে 'ইত্তেফাক' পত্রিকার মাধ্যমে বাঙালিত্বর ভেতর যে বিভাজনের কাজটি তাঁরা শুরু করেছিলেন ধর্মের নামে, সেটা জিয়াউর রহমানের আমলে খোলাখুলিভাবে বলতে শুরু করেন। এবং তাঁরা আজ যে সফল হয়েছেন, তার প্রমাণ কিন্তু ওই তরুণ ছেলেটি। সে না-বুঝে বা অবেচতনভাবে মেনে নিয়েছে: 'বাঙালি মুসলিম' ও 'বাঙালি হিন্দু' দুটি গোষ্ঠী।
এভাবে চলতে থাকলে এরা আগামীতে মেনে নেবে 'বাঙালি মুসলিম' ও 'বাঙালি হিন্দু' দুটি জাতি।
বাঙালির যে একটি নিজস্ব রাষ্ট্রের প্রয়োজন– এ কথাটি প্রথম লিখেছিলেন এস ওয়াজেদ আলী। তিনি তখন মোটেই বলেননি বাঙালি হিন্দু ও বাঙালি মুসলিমের মিলে একটা রাষ্ট্রের দরকার। তিনি বাঙালির রাষ্ট্রই চেয়েছিলেন।
ব্রিটিশ ভারতে বসে সৈয়দ মুজতবা আলী লিখেছিলেন:
"বাঙালি একটি স্বতন্ত্র জাতি।"
বাঙালি রাজনীতিবিদরা ঠিক ওইভাবে সবাই বুঝতে পারেননি। শেরে বাংলা এ কে ফজলুল হক বাঙালির নেতা থেকে সর্বভারতীয় নেতা হয়ে তিনি শেষ অবধি মুসলিম লীগের নেতা হয়ে গিয়েছিলেন। চিত্তরঞ্জন দাশ ওই সময়ে বাঙালির সব থেকে বড় সর্বভারতীয় নেতা ছিলেন, তিনি আর্থিক ও শিক্ষায় পিছিয়ে পড়া জনগোষ্ঠী হিসেবে মুসলিম ধর্মাবলম্বীদের এগিয়ে আনতে চেয়েছিলেন, যাতে ভবিষ্যতে হিন্দু-মুসলিম বিরোধ না হয়। তিনি তা পারেননি। তার আগেই মারা যান। তবে তাঁর আশঙ্কা সত্য হয়।
বাঙালি একপর্যায়ে হিন্দু ও মুসলিমে বিভক্ত হয়ে একে অপরকে হত্যায় মেতে উঠেছিল। যার ভেতর দিয়ে বাঙালি ভাগ হয়ে যায় হিন্দু-মুসলিমের নামে।
সুভাষ বসু বাঙালি নেতা ছিলেন। তিনি অবশ্য এক করেছিলেন সব ভারতীয়কে। তাই তাঁকে বাঙালির রাষ্ট্রের ভেতর টানা যায় না। তারপরেও বলতে হয়, বাঙালি তাদের চিরাচরিত স্বভাব অনুযায়ী একাংশ তাঁর বিরোধিতা করেছিল। এটা অবশ্য বাঙালি চরিত্রের দীনতা। বাঙালি কোনো বড়কে ধারণ করতে পারে না।
বাঙালি রবীন্দ্রনাথকে সম্পূর্ণ ধারণ করতে পারেনি। তাঁকে নিয়ে নানান নীচতার পরিচয় দিয়েছে। নানানভাবে নিগৃহীত হতে হয়েছে নজরুলকে। বাঙালিই একমাত্র জাতি তারা তাদের জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবকে এখনও এককভাবে মেনে নেয়নি। অথচ পাকিস্তানিরাও কায়েদে আজম মোহাম্মদ আলী জিন্নাকে সবাই মিলে 'জাতির পিতা' বলতে কুণ্ঠিত হয় না।
বাঙালি চরিত্রের এ দীনতার ফাঁক দিয়েই এই দুষ্টগ্রহ অর্থাৎ বাঙালিকে হিন্দু ও মুসলিমে বিভেদ করার দুর্বুদ্ধি বাঙালি সমাজে প্রবেশ করে।
বাঙালির হাজার বছরের শ্রেষ্ঠ নেতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান যদিও ছাত্রজীবনে পাকিস্তান আন্দোলনের কর্মী ছিলেন, তবে তিনি কখনও 'বাঙালি মুসলিম' হিসেবে নিজেকে 'আধখানা' বাঙালি করেননি। তিনি তাঁর ভাষণে স্পষ্ট বলেছেন:
"আমি বাঙালি, বাংলা আমার ভাষা, বাংলাদেশ আমার মা, আমি ফাঁসিতে যাবার আগে বলব 'জয় বাংলা'।"
বঙ্গবন্ধু তাঁর নেতৃত্বের বিশালতা দিয়ে, তাঁর চরিত্রের উদারতা ও দৃঢ়তা দিয়ে বেশিরভাগ বাঙালিকে বাঙালিতে পরিণত করতে পেরেছিলেন। আর শেখাতে পেরেছিলেন বাঙালিকে মৃত্যুর মুখে বাঙালি নাম নিয়ে দাঁড়াতে হয় কীভাবে।
পৃথিবীতে মানুষ যখন জীবন উপেক্ষা করে মৃত্যুর মুখে দাঁড়াতে পারে তখনই কেবল হয় তার পরম ঐক্য। ১৯৭১ সালে তাই মৃত্যুর মুখে দাঁড়িয়ে বাঙালি একবারের জন্যে বাঙালি হয়েছিল তাদের হাজার হাজার বছরের ইতিহাসে। তবে এর পাশাপাশি এ-ও সত্য, বাঙালি কিন্তু হাজার হাজার বছর ধরে ধর্মকে নিজের বুকের ভেতর রেখে সংস্কৃতিতে সে বাঙালিই ছিল। রাজনৈতিক চতুরতা ও বুদ্ধিবৃত্তির দাসদের স্বার্থে ঊনিশ শতক থেকেই বাঙালিকে ধর্মের নামে ভাগ করা শুরু হয়েছে। তবে মৃত্যুর মুখে দাঁড়িয়ে ১৯৭১-এ বাঙালি সেখান থেকে বের হয়ে আসে।
এই বের হয়ে এসেও বাঙালি টিকতে পারেনি। তার কারণ, ধর্মের নামে যে বাঙালিকে ভাগ করা হয়েছিল পাকিস্তান আন্দোলনের ভেতর দিয়ে তার প্রেতাত্মারা স্বাধীনতার পরে আবার সরব হয়ে ওঠে।
তাঁর প্রতি সব শ্রদ্ধা রেখেও বলতে হয়, মওলানা ভাসানীও সেদিন বাঙালিকে হিন্দু-মুসলমানে ভাগ করার কাজে নেমে পড়েন। নেমে পড়ে তাঁর 'হক কথা' পত্রিকা। আর শুরুটা হয়েছিল 'ইত্তেফাক' দিয়ে।
মুজিবনগর সরকার ঢাকায় স্থানান্তরিত হওয়ার পরপরই মোশতাকের ইঙ্গিতে 'ইত্তেফাক' সম্পাদক মইনুল হোসেন রিপোর্ট করান আওয়ামী লীগ সরকারে অস্থিরতা নিয়ে। তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দিন আহমদ তাঁকে ডেকে নিয়ে জানিয়ে দেন, এ ধরনের কাজ তিনি দ্বিতীয়বার করলে মানিক ভাইয়ের ছেলে বলে তাঁকে ক্ষমা করা হবে না।
এরপর এই কাজটি অধিক বুদ্ধিমত্তার সঙ্গে করা হয়, একদিকে তাদের ভারত বিদ্বেষ জাগানোর নামে হিন্দু বিদ্বেষ জাগানো বিশেষ রিপোর্ট, অন্যদিকে আবুল মনসুর আহমদের ও খোন্দকার আব্দুল হামিদের ধর্মের নামে ভাগ করার জন্যে নানানভাবে লেখা হয় উপস্পাদকীয়। আর তার ভেতর দিয়েই প্রশস্ত হয় দেশে সামরিক শাসনের নামে জিয়াউর রহমানের চরম সাম্প্রদায়িক সরকার ক্ষমতায় আসার পথ। আর বঙ্গবন্ধু সবাইকে নিয়ে যে বাঙালি জাতীয়তাবাদ গড়ে তুলেছিলেন তা ভেঙে যায় জিয়াউর রহমানের আমলে। এ কাজে বুদ্ধিবৃত্তিক নেতৃত্ব দেন খোন্দকার আব্দুল হামিদ ও আবুল মনসুর আহমদসহ আরও অনেকে।
তারপরে এই দীর্ঘ পথ পাড়ি দিয়ে, আওয়ামী লীগ সরকারের টানা আট বছর ক্ষমতাকালের পরেও প্রগতিশীল শিক্ষক ব্যানারের এক শিক্ষক বাঙালির একটা বিশেষ দশকের বা সময়ের দর্শন চিন্তার ওপর গবেষণা না করে গবেষণা করছেন 'বাঙালি মুসলিমের দর্শন চিন্তা'র ওপর। এরপরে আরেকজন করবে 'বাঙালি হিন্দুর দর্শন চিন্তা'র ওপর।
এরপরে সবকিছু ভাগ হয়ে যাবে বিলকুল। শুধু ছবিতে থাকবেন নজরুল আর শেখ মুজিব। বর্তমানে যেভাবে চলছে এভাবে চললে আমাদের ভবিষ্যত এর বেশি কিছু নয়। কিন্তু সব কালে, সব জাতিকে ভরসা রাখতে হয় তার নতুন প্রজম্মের ওপর।
আমি আশাবাদী মানুষ। জীবনের কোনো অবস্থাতে নিরাশ হওয়া কারো উচিত নয় বলে আমার ধারণা। মনে করি, বাংলাদেশের প্রগতিশীল তরুণ সমাজ এখনও ফুরিয়ে যায়নি। তাদের পূর্বপুরুষরা মৃত্যুর মুখে সারিবদ্ধভাবে দাঁড়িয়ে বাঙালি হয়েছিল। এই প্রজম্মেরও মৃত্যুর মুখে সারিবদ্ধভাবে বুকটান করে দাঁড়াতে হবে বাঙালি হওয়ার জন্যে।
ধর্মের নামে যারা জাতিকে বিভেদ করছে তারা শুধু বাঙালি ও বাঙালিত্বের রাজনৈতিক প্রতিপক্ষ নয়, তারা তাদের দীর্ঘ প্রচেষ্টার ভেতর দিয়ে ঢুকে গেছে আমাদের মনোজগতে, আমাদের সাংস্কৃতিক মননে। তাই প্রতিদিন ধর্মীয় নানান অপব্যাখ্যা এসে অধিকার করছে একটি জাতির জাতিসত্তাকে। যেহেতু তারা মনোজগতে ঢুকে দুর্বল করে ফেলেছে মানসিকতাকে, তাই সচেতন ও অবচেতনভাবে তাদের চেতনাই মেনে নিচ্ছে সমাজ।
এ মুহূর্তে একমাত্র জাগ্রত তরুণ ছাড়া বাঙালির আর ভরসার কোনো স্থান নেই। জাগ্রত তরুণকে তার মনোজগতে ঢুকে পড়া ওই বিকার ঝেড়ে ফেলে বুকটান করে দাঁড়াতে হবে। এ-ও মনে রাখতে হবে, যারা ধর্মীয় জাতীয়তাবাদ নিয়ে এগোচ্ছে তাদের হাতে অস্ত্রও আছে। তাই মৃত্যুকেও আলিঙ্গন করার প্রস্তুতি নিতে হবে তাদের আবার বাঙালি হওয়ার জন্যে।
ধর্মের নামে জাতীয়তায় ঢুকে পড়ার অর্থই হচ্ছে অন্ধত্ব মেনে নিয়ে পশ্চাতে চলে যাওয়া, নিজেকে হাজার বছর পেছনে নিয়ে যাওয়া। বরং জাতীয়তাবাদ সঙ্গে নিয়ে বিশ্বায়নের পথে এগোনোই আধুনিক সময়ের দাবি। এ দাবি পূরণের স্বার্থে, জাতিকে বাঁচানোর স্বার্থেই আবার বাঙালি হতে হবে। বিকল্প কিছু ভাবার অর্থ হবে আত্মহত্যা।