Published : 12 Oct 2012, 05:22 PM
বাঙলা ভাষায় ইংরেজির ব্যবহার নিয়ে ভদ্রমহলে অনেক আপত্তি দেখা যায়, এই আপত্তিকে অগ্রাহ্য করার কারণও নেই। সত্যি কথাই, বাঙলা ভাষায় ইংরেজির অপ্রয়োজনীয় 'use' প্রায়শই দৃষ্টিকটু ঠেকে—কিন্তু কথ্য বাঙলায় হিন্দি বা ইংরেজি শব্দের হানা দেয়া নিয়ে উদ্বেগ যতটা দেখা যায়, বাঙলা ভাষার আসল সর্বনাশটি নিয়ে ভাবনা ততটা দেখা যায় না।
মুখের ভাষায় অন্যভাষার শব্দ চলে আসে একাধিক কারণে। হিন্দী শব্দের কথা ভাবা যাক, হিন্দী যে-বিনোদনের জগতে জনসাধারণের বাস, তার তুল্য কিছু যখন মাতৃভাষায় দেয়ার ব্যবস্থা হবে না, অথচ আশা করা হবে সেই ভাষার শব্দগুলো জনতার ভাষায় বিপুল হারে প্রতিস্থাপনের ঘটনা ঘটাবে না—এই এক বিরাট স্ববিরোধিতা। প্রেক্ষাগৃহে কিংবা টেলিভিশনে ভারতীয় ছবির প্রদর্শনের বেলায় এই বিরোধিতা আমরা পাই না। এই না পাওয়াটা সর্বদা যে 'নিরীহ' তাও নয়, বহুক্ষেত্রে এমনকি সাংস্কৃতিক কেন্দ্র ও দুতাবাসের দাওয়াত এবং বিভিন্ন 'খ্যাপ' কার্যক্রমের স্বার্থসংশ্লিষ্টতাও এই নিরবতার কারণ বলে অভিযোগ পাওয়া যায়।
কিন্তু আরও বড় আত্মধ্বংসী ঘটনা ঘটছে মধ্যবিত্ত পরিবারগুলোতে ওই স্যাটেলাইটেরই সৌজন্যে, বাংলাদেশের শিশুরা অনায়াস হিন্দিতে অভ্যস্ত হচ্ছে মাতৃভাষাটা শেখার আগেই। পিতা-মাতার কর্মব্যস্ততার কারণে এই শিশুদের প্রধান সঙ্গী কার্টুনের চরিত্ররা, পরভাষায় তাদের অভ্যস্ত হয়ে ওঠা নিয়ে আহা-উহু নিশ্চয়ই যথেষ্ট নয়।
আর কথ্যভাষায় ইংরেজি শব্দের ব্যবহার? অধ্যাপক সিরাজুল ইসলাম চৌধুরীর খ্যাতি রয়েছে অপ্রয়োজনীয় কোন ইংরেজি শব্দ আদৌ ব্যবহার না করে বাঙলা কথনের। আরেক দিকপাল বদরুদ্দীন উমর প্রচুর ইংরেজি উদ্ধৃতি ব্যবহার করেন, কিন্তু সর্বদাই সাথে সাথেই তা সাবলীল বাঙলায়ও তর্জমা করেন। মধ্যবিত্তের ইংরেজি ব্যবহারের মনস্তত্ব-বিশ্লেষণ তাই বাঙলা নিয়ে এই উহু-আহার মাঝে নেই, সারস্বত সমাজের এমনতর জনা কয়েক ব্যতিক্রমকে বাদ দিলে সাবলীল বাঙলা বলাটা বাঙালি মধ্যবিত্তের বড় অংশের জন্যই এখন একটা কষ্টসাধ্য কাজ।
ভাষায় ইংরেজি শব্দের অনুপ্রবেশ করছে একটা বড় কারণে, সেটা হলো উচ্চতর স্তরে বাঙলায় মানসম্পন্ন শিক্ষাগ্রহণের সুযোগ এখানে প্রায় নেই। ফলে অধিকাংশ ক্ষেত্রে এমনকি প্রকৌশলী বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীটিও বাঙলায় বোঝেন এবং ইংরেজিতে লেখেন; পরীক্ষা-কক্ষে মাতৃভাষায় লিখতে মানা। বাঙলায় উচ্চস্তরের পাঠ্যপুস্তক অনুবাদের যে অনুশীলনটি শক্তিশালী একটি প্রবণতা হিসেবে বিকশিত হয়েছিল, তা এখন যথেষ্টই ম্রিয়মান। ভাষা আন্দোলনের ৬০ বছর আমরা পালন করছি বটে, বাঙলা ভাষায় শিক্ষার উচ্চস্তরের কত ভাগ পাঠ্যপুস্তক আমরা শিক্ষার্থীদের হাতে তুলে দিতে পেরেছি?
cape of good hope এর বাঙলা হিসেবে উত্তমাশা অন্তরীপ আজকে বাঙলাভাষী কারো অপরিচিত নয়, কিন্তু এই অন্তরীপ এবং এর সাথে আরো অনেক নতুন বাঙলা শব্দকে প্রবর্তিত ও প্রতিষ্ঠিত করতে উনিশ শতকের বিদ্যোৎসাহী মহলকে যথেষ্ট উদ্যোগ নিতে হয়েছে, নিজেদের সন্তানদের "উচ্চমূল্যের" মানসম্পন্ন শিক্ষা প্রদান করে দেশবাসীর ভাষার মান নিয়ে তারা কুম্ভীরাশ্রু বর্ষণ করেন নি। মাতৃভাষার মানোন্নয়নে তারা রক্তপাত করেছেন, প্রাণান্ত পরিশ্রম করেছেন, অশেষ ক্লেশ স্বীকার করেছেন। তাদের মত গুরুভার মানুষেরা যৌথভাবে শব্দগুলোর প্রচলন করেছেন বলেই সেগুলো প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল। আজকে এমনই পরিহাস যে, সেই ভাষাভাষীরা স্বাধীন যে রাষ্ট্র গঠন করেছেন, সেখানকার উচ্চআদালত, আমলাতন্ত্রসমেত সর্বস্তরেই মাতৃভাষা যথাসন্মানে প্রতিষ্ঠিত নয়, ইংরেজির ব্যবহার সেখানে বিশেষ সন্মান ও ক্ষমতার প্রতীক। ফলে ভাষায় যে অসচনভাবে অপ্রয়োজনীয় ইংরেজি শব্দের প্রয়োগ ঘটবে কিংবা সচেতনভাবেই ভাষাজ্ঞান প্রদর্শনের উদ্দেদ্যে ইংরেজি শব্দ ব্যবহার করা হবে, তাতে অবাক হবার কি আছে?
শিশুদের শিক্ষার বিষয়টিও গুরুত্বপূর্ণ। এমন একটা দেশের বাসিন্দা আমরা, যেখানে মাতৃভাষায় কোন একটি বাক্য না পড়েও উচ্চবিত্ত অংশের একটা বড় অংশ মানুষ হচ্ছে। খেয়াল করলেই দেখা যাবে, এদের বাঙলা উচ্চারণটি কি ভয়াবহ রকমের ইংরেজি প্রভাবিত, এবং মাতৃভাষার ধ্বনিগুলো উচ্চারণ করতে অক্ষমতাই কিভাবে এখানে উচ্চসমাজের স্মারক হিসেবে দিন দিন প্রতিষ্ঠিত হয়ে যাচ্ছে। এদেরই গাঁ-ঘেষতে গিয়েই মধ্যবিত্তেরও একটা অংশ তাদের অনুকরণ করছে—এবং সূর্যের চেয়ে বালি গরম নীতিটির বিশেষ উদাহরণ হিসেবে আমাদের চারদিকে ঘুরে বেড়াচ্ছে।
বক্তব্য খুব পরিস্কার, বাঙলিশ ভাষা কি বাঙহিশ ভাষাকে যদি সমস্যা হিসেবে মনে করেন, সেটা রোগের উপসর্গ মাত্র। এই ভাষার চাহিদা কেন তৈরি হচ্ছে, সেটা যদি বিচার করা যায়, আমাদের শিক্ষাব্যবস্থার একটা ঘোরতর একটা অসঙ্গতিই চোখে পড়বে। দেশের সকল শিশুর জন্য যদি আমরা এক মাধ্যমে শিক্ষার বন্দোবস্ত করতাম, বাঙলাভাষার নিজের মাঝে আঞ্চলিক বহু বৈচিত্র আমাদের সমৃদ্ধই করতো, কিন্তু ইংরেজি-হিন্দী মিশ্রিত কিংবা বিকৃত উচ্চরণের বাঙলার অত্যাচার আমাদের নিজের রাজধানীতে ঘটতো না।
ভাষার বিশেষ বিকাশ হয় ব্যবহারে, বাঙলাদেশের জনগণ ভাষাটি ব্যবহার করেই একে জীবন্ত রেখেছেন, কবিরা কবিতা লিখে, গল্পকাররা গল্প লিখে একে জীবন্ত রেখেছেন। কিন্তু রাষ্ট্রের উচ্চস্তরে ব্যবহারের দরুণ এর যে বিশেষ বিকাশ হবার কথা ছিল, সেটা ঘটেনি। 0mbudsman এর বাঙলা ন্যায়পাল কিন্তু বাংলাদেশের সংবিধান অনুবাদ করতে গিয়েই উদ্ভাবিত হয়েছিল, ভারতে বলা হয় লোকপাল। ভাষা আন্দোলন তো ভাষা আন্দোলন, দেশটা স্বাধীন হলো এত বছর, আমাদের দেশে প্রচলিত সবগুলো আইন সরকারীভাবে স্বীকৃত হয়ে বাঙলা অনুবাদে জনগণের মাঝে প্রচার করবে কোন আদালতের আদেশে? কত বছর লাগবে তাতে? বাঙলা ভাষা কি রবীন্দ্রসঙ্গীত গাইবার ভাষা হিসেবেই থাকবে, তাতে গুরুভার কাজকর্ম আর করা হবে না? বিচারকরা কবে তাদের রায়গুলো বাঙলায় দেবেন? যে ভাষা সমাজের উচ্চঅংশ থেকে পুষ্টি জোগার করতে পারে না, তারই তো দূষণের শিকার হবার কথা।
আদালতের এই রায় বিষয়ে শুধু একটি কথা বলি, ভাষার এই অশুদ্ধতা যতই কানে লাগুক, শুদ্ধ ভাষার মানদণ্ড নির্ধারণ করতে যাওয়াটা আদলতের অতীতের আরও অনেক অকার্যকর আদেশের মতই উপেক্ষিত হবে। এই ভাষা সমাজে আছে, তারা সংখ্যায় যতই ক্ষুদ্র হোক, বিশেষভাবে প্রতাপশালী। বাজারে এর চাহিদা আছে, ক্রমাগত তা বাড়ছে এবং ঘরে ঘরে তা বন্ধ করার সাধ্য জাগতিক কোন আদালতের নেই। অপরদিকে ভাষা দূষণ নদী দূষণের মত ক্ষতিকর হলেও তার চে অনেক বড় কথা হলো ভাষা নদীর মতই সতত প্রবাহশীল। আইন করে পরিবর্তন বন্ধ করার এবং মানদণ্ড নির্ধারণের এখতিয়ার প্রদানটিও বিপদ ডেকে আনতে পারে। বরং এই দূষণের সামাজিক-অর্থনৈতিক যে কারণ, সেই মূলে হাত দেয়াটাই অনেক বেশি জরুরি কাজ। সেটা করতে গেলে শিশুদের শিক্ষার বৈষম্য দূর করতে হবে, জাতীয় সংস্কৃতির উপাদানে পূর্ণ বিনোদনের বন্দোবস্ত করতে হবে, উচ্চস্তরে মাতৃভাষায় পড়ার বন্দোবস্ত করতে হবে, কোন ধরনের যোগ্যতার মাপকাঠি হিসেবে ইংরেজিকে বিবেচনার উপনিবেশিক দৃষ্টিভঙ্গি থেকে অন্তত চাকরি ক্ষেত্রকে মুক্ত করতে হবে, — বাঙলা ভাষার বিকাশে উচ্চ আদালতের সেই রকম একটি হুকুমের অপেক্ষায় আমরা থাকলাম, আশা করি সেই রায়টিও বাঙলাভাষাতেই হবে।
ফিরোজ আহমেদ : রাজনৈতিক কর্মী, প্রাবন্ধিক ও গবেষক।