Published : 21 Jun 2012, 08:50 PM
দেশের অর্থনীতি নিয়ে আতংক ছড়ানোর রাজনৈতিক অরাজনৈতিক প্রচেষ্টাটা শেষ হতে না হতেই আতংকজনক কিছু ঘটনাই ঘটে গেলো বাংলাদেশে। ঢাকা ও চট্টগ্রাম স্টক এক্সচেঞ্জ কর্তৃপক্ষ নিজেরা সিদ্ধান্ত নিয়ে হঠাৎ করেই একদিনের জন্য বন্ধ রাখলেন শেয়ারবাজারের লেনদেন। সরকারি দুটি সিদ্ধান্তের জের ধরেই শেয়ারবাজারের লেনদেন বন্ধ রাখা হয়েছে সেটি পরিষ্কার। তবে যে কথাটি পরিষ্কারভাবে কেউ বলছেন না, সেটি হলো – সরকারকে বিশেষ একটি বার্তা দেওয়ার প্রচেষ্টা রয়েছে স্টক এক্সচেঞ্জের এই সিদ্ধান্তে। সেই বার্তাটি কী তা সরকারের খতিয়ে দেখার বিষয়, অনুসন্ধানী সাংবাদিকতা যারা করেন, তারাও এ ব্যাপারে আগ্রহী হতে পারেন। তবে একদিন শেয়ারবাজারের লেনদেন বন্ধ রেখে বিনিয়োগকারীদের, দেশের সাধারণ জনগোষ্ঠীর মনে একটা আতংকভাব তৈরি করা গেছে। আর বিদেশে, আন্তর্জাতিক বাণিজ্যজগতে একটা প্রশ্নবোধক বার্তা পাঠানো গেছে। এটিও হয়তো কেউ কেউ চাচ্ছিলেন।
যে দুটি খবরকে ভিত্তি করে শেয়ারবাজারের লেনদেন বন্ধ করে দেওয়া হলো, সেই খবরগুলো কি সত্যিই আতংক তৈরির মতো খবর? জাতীয় রাজস্ব বোর্ড বলেছে, অপরাধের মাধ্যমে অর্জিত টাকা শেয়ারবাজারে বিনিয়োগ করা যাবে না। এতে তো বিনিয়োগকারীদের খুশিই হবার কথা। যে ৩৩ লাখ বিনিয়োগকারীর কথা আমরা সবসময়ই শুনি, তারা তো আর অপরাধের দ্বারা অর্জিত টাকা এনে শেয়ারবাজারে বিনিয়োগ করেন না। তাহলে তারা আতংকিত হবেন কেন? আতংকিত হবার কথাতো তাদের, যারা অপরাধের মাধ্যমে অর্জিত টাকা শেয়ারবাজারে বিনিয়োগ করে সেগুলোকে সাদা করতে চান। শেয়ারবাজারে কালো টাকা বিনিয়োগ করতে দেওয়া না দেওয়া নিয়েও এমন একটি পরিস্থিতি তৈরি হয়েছে বিভিন্ন সময়। 'অপরাধে অর্জিত টাকা' কিংবা 'অপ্রদর্শিত আয়' নিয়ন্ত্রনের যে কোনো উদ্যোগ যাতে সফল না হয়, সেজন্যে সরকারের উপর চাপ সৃষ্টি করতে এ নিয়ে শেয়ারবাজারে বিভিন্ন সময় অস্থিরতা তৈরি করা হয়েছে। এবারও সেটিকে আরো তীব্র করে তোলা হয়েছে। তার সঙ্গে যুক্ত হয়েছে সাম্প্রতিক সময়ে দেশের অর্থনৈতিক পরিস্থিতি নিয়ে আতংক সৃষ্টির চেষ্টাকারীদের যোগসাজস। তারই অনিবার্য পরিণতি লেনদেন বন্ধ রাখা।
কেউ হয়তো বলবেন, বাজার আরো পড়ে যাওয়ার আশংকায় লেনদেন বন্ধ রাখা হয়েছে। আমি বিনীতভাবে একই প্রশ্ন করবো, অপরাধের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়ার কথা বললে বাজার পড়ে যাবে কেন? বাজারে তো ইতিবাচক প্রতিক্রিয়া হওয়ার কথা। আর বাজার যদি পড়তেই শুরু করে তাহলে, বড় বিনিয়োগকারী, প্রাতিষ্ঠানিক বিনিয়োগকারী তারা কোথায়? তারা বাজারকে সাপোর্ট দিয়ে ভারসাম্য আনতে পারবেন না? দু:সময়ে যদি তারা ভূমিকা না রাখেন তাহলে তাদের কাজ কী? আইন শিথিল করে ব্যাংকগুলোকে যে শেয়ারবাজারে ব্যবসা করার সুযোগ করে দেওয়া হলো তারা কোথায়? দুই স্টক এক্সচেঞ্জের কর্তাব্যক্তিদের কেউই কিন্তু বাজারকে সাপোর্ট দেওয়ার চিন্তা করেন নি, তারা বাজার বন্ধ রাখাকেই অধিকতর গুরুত্ব দিয়েছেন। সেটা দিয়েছেন সরকারকে চাপে ফেলার অভিলাষ থেকেই, বাজারকে সহায়তা দেওয়া কিংবা বিনিয়োগকারীদের স্বার্থ চিন্তা করে নয়।
আর সরকারি চাকরীজীবীরা শেয়ারবাজারে বিনিয়োগ করতে পারবেন না কেন? সরকারের ভেতরে এমন বুদ্ধিমান লোকগুলো কারা যাদের মাথা থেকে এই উর্বর পরামর্শটি জন্ম নিয়েছে? বলা হচ্ছে, এটা নাকি পুরনো আইন, নতুন করে স্মরণ করিয়ে দেওয়া হচ্ছে মাত্র। বিশ্বের কোনো দেশেই তো এমন নজির নেই যে কোনো পেশাজীবী বা কোনো গোষ্ঠীর জন্য বিনিয়োগ নিষিদ্ধ করা হয়েছে। বাংলাদেশে যদি এই আইনটি থেকে থাকে তাহলে সেটি অনতিবিলম্বে বাতিল করা উচিত।বাংলাদেশে বিনিয়োগের আর কোনো উপাদান নেই বলে সবাই শেয়ারে বিনিয়োগ করতে ছুটে। উন্নত দেশগুলোতে নানা রকম বিনিয়োগ উপাদান আছে এবং সেখানে সবার জন্যই সব বিনিয়োগ উন্মুক্ত। তবে ওইসব দেশে বিনিয়োগের জন্য কঠিন আইনি কাঠামো আছে। সেই কাঠামোর ভেতর থেকেই সবাইকে বিনিয়োগ করতে হয়। প্রতিটি বিনিয়োগ এবং সেই বিনিয়োগ থেকে আয় তাদের ঘোষণা করতে হয়। বাংলাদেশে আইনি কাঠামোকে শক্তিশালী করার উদ্যোগ কখনোই শক্তভাবে নেওয়া হয়নি।
দুই স্টক এক্সচেঞ্জেই স্বয়ংক্রিয় লেনদেন ব্যবস্থা আছে, লেনদেন পরিচালনার জন্য সুনির্দিষ্ট নিয়মাবলী আছে। তাহলে সরকারি চাকরীজীবীরা শেয়ারবাজারে বিনিয়োগ করলে সমস্যা কোথায়। এখানে স্বার্থের দ্বন্ধটা কোথায়? হ্যাঁ, নিয়ন্ত্রক সংস্থা এসইসি,স্টক এক্সচেঞ্জের কর্মকর্তা কর্মচারীরা লেনদেনে জড়িয়ে পড়লে স্বার্থের দ্বন্ধ হতে বাধ্য। স্বার্থের দ্বন্ধতো বরং হয়, মন্ত্রী এমপিরা কোনো ব্যবসায়ের সঙ্গে জড়িয়ে পড়লে। কই, সেগুলো নিয়ে তো তেমন উচ্চবাচ্চ হতে দেখি না। আর যদি বলা হয়, সরকারি কর্মচারীরা অফিস ফেলে রেখে শেয়ারবাজার নিয়ে ব্যস্ত হয়ে পড়েন, তাহলে বলবো সেটা সংশ্লিষ্ট অফিসের শৃংখলাজনিত ব্যর্থতা।
বাংলাদেশে যারা স্টকব্রোকার বা ডিলার হিসেবে লাইসেন্স নিয়েছেন- তারা কি বিনিয়োগবাজার সংক্রান্ত কোনো পেশাদার পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়ে লাইসেন্স নিয়েছেন? কিসের ভিত্তিতে তাদের লাইসেন্স দেওয়া হলো? পশ্চিমা দেশগুলোতে ব্রোকার ডিলার তো বটেই, ব্রোকারেজ হাউজে বসে যারা কেনা বেচার অর্ডার নেবেন,তাদেরও নির্দিষ্ট পরীক্ষায় পাশ করে লাইসেন্স নিতে হয়। আর যারা পেশাদার হিসেবে বিনিয়োগ সংক্রান্ত পরামর্শ দেবেন,তাদের লাইসেন্স পাওয়া যে কতোটা কঠিন সেটা না হয় নাই বললাম। আমি নিশ্চিত করে বলতে পারি, এই ধরনের কোনো উদ্যোগ নেওয়া হলে বাংলাদেশের শেয়ারবাজার অনির্দিষ্টকালের জন্য বন্ধ করে দেওয়া হবে।
বাংলাদেশের শেয়ারবাজারকে নিয়ে স্পষ্টতই একটা খেলা চলছে। সেই খেলার নিয়ন্ত্রকদের নির্দিষ্ট কোনো রাজনৈতিক পরিচয়ে ব্র্যাকেটবন্ধী করার সুযোগ নাই।নানা রাজনীতির, নানা মহলের স্টেইক রয়েছে তাতে। সমস্যাটা হচ্ছে, সেটা বোঝার মতো দূরদৃষ্টি সরকারের আছে বলে মনে হচ্ছে না।
শেয়ারবাজার নিয়ে সরকারের কথা বলার সুযোগই থাকা উচিত না। শেয়ারবাজার নিয়ে চিন্তা করবে নিয়ন্ত্রক সংস্থা। সরকারের দায়িত্ব হচ্ছে প্রয়োজনীয় অবকাঠামোগত এবং নৈতিক সমর্থন দেওয়া। পেশাদার যোগ্য নিয়ন্ত্রক সংস্থা তৈরি করে তাদের স্বাধীনভাবে কাজ করতে দেওয়া হচ্ছে সরকারের দায়িত্ব। কিন্তু সরকার যদি শেয়ারবাজার তথা বিনিয়োগবাজারকেও আওয়ামী লীগের অঙ্গ সংগঠন ভাবতে শুরু করে তাহলে হিতে বিপরীত হতে বাধ্য। অবস্থাদৃষ্টে মনে হচ্ছে, কেবল সরকারই নয় অন্যান্যরাও শেয়ারবাজারকে এখন আওয়ামী লীগের একটি অঙ্গ সংগঠনের মতো ভাবতে শুরু করেছে। সরকার নিজে যেমন শেয়ারবাজার নিয়ে বিজ্ঞ কোনো সিদ্ধান্তে পৌঁছুতে পারছে না, তেমনি, অন্যদিকে, সরকারকে 'কোনঠাসা করার' জন্যও শেয়ার বাজারই যেন যুতসই একটি হাতিয়ারে পরিণত হচ্ছে প্রতিনিয়ত।
শওগাত আলী সাগর : সাবেক বিজনেস এডিটর, দৈনিক প্রথম আলো।