Published : 28 Dec 2011, 06:48 PM
কবীর চৌধুরী চলেই গেলেন। যেতে অবশ্যই একদিন হতো। তিনি যেতে পারেন, বা চলে যাবেন এটা কখনও মনে হয়নি। সেই কবে থেকে তাঁকে দেখছি, তার বক্তৃতা শুনছি তাঁর কাছে যাচ্ছি কত আবদার তিনি হাসি মুখে সব শুনছেন। তার নোটবুক দেখছেন, সময় সুযোগ দেখে আমাকেও সময় দিলেন। সেই সময়ে গিয়ে আমার কাজটাও করে এলাম। কখনও 'না' শুনি নি। বড় আপন মানুষ ছিলেন। সদাহাস্য, ভাবগম্ভীর ও বুদ্ধিমত্তা তাঁর চেহারার বৈশিষ্ট ছিল। কবীর চৌধুরী ছিলেন অধ্যাপক, সাহিত্যিক, অনুবাদক, পরে হয়ে উঠলেন শিক্ষাবিদ, জাতীয় অধ্যাপক। তারপর হয়ে উঠলেন সর্বজন শ্রদ্ধেয় জাতীয় বিবেক। কবীর চৌধুরী কিছু বলছেন–সেটা সবাইকে একবার শুনতে হতো। গত চল্লিশ বছর ধরে তাঁকে দেখছি আমাদের রাজনৈতিক-সামাজিক আন্দোলনে বুদ্ধিজীবী হিসেবে অগ্রণী ভূমিকা পালন করতে। বিশেষ করে একাত্তরের ঘাতক দালাল বিরোধী আন্দোলনে এবং যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের দাবিতে তার কণ্ঠ ছিলো সোচ্চার। তিনি ছিলেন এই আন্দোলনের নেতা। সুফিয়া কামাল ও জাহানারা ইমামের মৃত্যুর পর তিনি এই নেতৃত্ব তুলে নেন এবং মৃত্যুর পূর্ব দিন পর্যন্ত তিনি এই দাবিতে ছিলেন অটল দৃঢ়।
কবীর চৌধুরী লেখাপড়া, কাজকর্ম, চলাফেরা ও চিন্তাভাবনা দেখে মনে হতো বয়স তাঁর কাছে হার মেনেছে। জীবনকে তিনি জয় করে এখন চূড়ান্তভাবে উপভোগ করছেন। তিনি হয়ে ওঠেন আমাদের অভিভাবক, বাঙালির মেধা-মনন চর্চায় শ্রেষ্ট ব্যক্তিত্বের আলোকিত উদাহরণ। জীবনাচরণে যথেষ্ট নীতিবান, শুদ্ধতম বাঙালি, সজ্জন, বিনয়ী আদর্শবাদী মানুষ। চাওয়া পাওয়ার অনেক উর্ধে উঠে একজন আত্মত্যাগী মণীষী।
বিশ্ব সাহিত্যের প্রাচীন, মধ্য ও আধুনিক যুগের ধারায় তিনি নিয়মিত পদচারণা করেছেন। ভালো লাগার বিষয়গুলো অনুবাদ করেছেন মনের আনন্দে। সর্বশেষ যে কাজগুলো করেছেন তা অনুবাদ সাহিত্যের অমূল্য ভান্ডার হয়ে থাকবে।
অনুবাদ প্রসঙ্গে তিনি আমাকে দেয়া এক সাক্ষাৎকারে বলেছেন, "আমি ইংরেজী উপন্যাস, প্রবন্ধ, কবিতা ইত্যাদি বাংলায় অনুবাদ করি। বাংলা লেখাও ইংরেজীতে অনুবাদ করি। শওকত ওসমানের 'ক্রীতদাসের হাসি' শিল্পী সুলতানের উপরে একটা বই, সেলিনা হোসেনের উপন্যাস, শামসুর রাহমানের কবিতা, মুনীর চৌধুরীর নাটক এবং আরো অনেকের লেখা ইংরেজিতে অনুবাদ করেছি। আর ইংরেজী বই তো বাংলায় অনবরত অনুবাদ করে যাচ্ছি। আমার খুব বেশী অসুবিধা হয় না। অনেকে অসুবিধার সম্মুখীন হন বলে আমাকে বলেছেন। তার একটা কারণ হচ্ছে যে এক ভাষা থেকে অন্য ভাষায় অনুবাদ করতে গেলে শুধু দুই ভাষার জ্ঞান থাকলেই হবে না, দুই সংস্কৃতি সম্পর্কেও একটা জ্ঞান থাকতে হবে। কারণ সেই সংস্কৃতি তো ভাষাকে অনেকখানি চালিত করে। আমি অনুবাদ কাজ করার সময় মূল গ্রন্থটি যে সামাজিক পরিবেশ, সাহিত্যিক পরিবেশ, সাংস্কৃতিক পরিবেশে রচিত তা বুঝবার চেষ্টা করি এবং আমার পড়ালেখা মোটামুটি ব্যাপক থাকায় আমি সে কাজটা করতে পারি।
তার ফলেই অনুবাদ ইংরেজী থেকে বাংলায় হোক বা বাংলা থেকে ইংরেজী হোক আমার কাছে তা তেমন সমস্যা হয়ে ওঠে না। বাংলা থেকে ইংরেজীর ব্যাপারে সামাজিক পরিবেশতো জানাই, শুধু ভাষার প্রশ্ন। সেইখানে প্রতিটি ভাষার কিছু নিজস্ব ইডিয়াম আছে। আক্ষরিক অনুবাদ করলে কিছুতেই হবে না। যেহেতু মোটামুটি ইংরেজী এবং বাংলায় একটা কাজ চালাবার মতো জ্ঞান আমার আছে, সে হিসেবে আমি তেমন কোন অসুবিধা বোধ করি না। তবে সময় দিতে হয়, ভাবতে হয়, পরিশ্রম করতে হয়।
বাংলা সাহিত্যের শ্রেষ্ট রচনাগুলোও তিনি ইংরেজি ভাষায় অনুবাদ করেছেন। বিশেষ করে রবীন্দ্রনাথ, নজরুল, জীবনানন্দ দাশ, শামসুর রহমান তো করেছেন, সেই সঙ্গে মুক্তিযুদ্ধের উপন্যাস ও গল্প ইংরেজি ভাষায় অনুবাদ করে বিদেশিদের কাছে বাংলা সাহিত্যের শ্রেষ্টত্ব তুলে ধরার চেষ্টা করেছেন। এ কাজটি বাংলাদেশে একমাত্র তিনিই করার চেষ্টা করেছেন এবং সফল হয়েছেন।
জীবনের শেষ প্রান্তে এসেও তিনি তার প্রিয় কলমটি ছাড়েন নি। প্রতিদিন ভোর পাঁচটায় ঘুম থেকে উঠে বাড়ির খাবার টেবিলে বসতেন তার লেখার খাতা ও কলম নিয়ে।
প্রতি বছর বই মেলায় আট-দশ-বারোটি বই প্রকাশিত হতো। এছাড়া বিভিন্ন দিবস উপলক্ষেও লেখা তৈরি করতে হতো। কারও বা গ্রন্থের সমালোচনা– কিছুই বাদ যেতনা। তার নিজের সৃজনশীল লেখাও তৈরি হতো। তিনি কাউকে ফেরাতেন না, সবার অনুরোধ যথারীতি পালন করার চেষ্টা করতেন। এই দুর্ভল গুণটি অনেকের মধ্যে থাকে না-অথচ জীবনের শেষ প্রান্তে বসেও তিনি কঠোরভাবে তা পালন করে গেছেন। প্রতিদিন সময় ধরে লেখার টেবিলে বসা, কিছু লেখা, হাতের কাছে একটা বই রাখা, নানা কাজের ব্যস্ততায় সুযোগ পেলে কিছু পড়া-এই ছিলো তার দৈনন্দিন কর্তব্য। জ্ঞানের সাধনা ও বুদ্ধিবৃত্তির চর্চা কবীর চৌধুরী জীবনভর করে গেছেন।
তিনি ভালো বলতেন ও লিখতে পারতেন। বাঙালী মনীষী ও জ্ঞানের সাধকদের জীবনাচরণে এই গুণগুলো আমরা দেখতে পাই। কবীর চৌধুরী মনে-প্রাণে একজন আধুনিক মানুষ ছিলেন। তিনি তরুণদের কাছে একজন আদর্শবাদী পৃষ্ঠপোষক ছিলেন। বিশেষ করে জ্ঞানের চর্চায় তরুণদের বেশি করে মনোযোগী হবার জন্য সব সময় বলতেন। তিনি স্বাধীনতার পর বঙ্গবন্ধু সরকারের শিক্ষা সচিব ছিলেন। আর সে কারণে শিক্ষাকে যুগোপযোগী, বিজ্ঞানসম্মত ও দেশজ সংস্কৃতির ধারায় চর্চার পক্ষপাতী ছিলেন। শিক্ষা নীতিমালা বাস্তবায়িত হলে এদেশে শিক্ষায় যুগান্তকারী অবদান রাখবে বলে তিনি বিশ্বাস করতেন। মাতৃভাষার প্রতি ছিল তাঁর গভীর দরদ।
মাতৃভাষায় শিক্ষার্জনে ছেলেমেয়েদের সৃজনশীলতা শুধু বৃদ্ধি পাবে না, জ্ঞানের সাধনাও করতে পারবে বলে মনে করতেন। শুদ্ধ করে বাংলা বলা ও লেখার উপর বিশেষ গুরুত্ব দিতেন। এই শিক্ষাটা শৈশব থেকে পরিবার দিলে ভালো হয় বলে মনে করতেন। পারিবারিক ও সামাজিক শিক্ষা এবং মূল্যবোধ থেকে যে শ্রেষ্ট মানুষ হওয়া সম্ভব সেই উদাহরণও কবীর চৌধুরী ও মুনীর চৌধুরীর মধ্যে আমরা প্রত্যক্ষ করেছি।
কবীর চৌধুরীর মানসচেতনা ছিল মানবিক ও সাংস্কৃতিময়। বিশেষ সামাজিক সমস্যাগুলো তিনি গভীরভাবে পর্যবেক্ষণ করতেন। সামাজিক আন্দোলনেও তিনি দায়িত্ব নিয়ে কথা বলতেন। মানুষকে সচেতন এবং সংগঠিত করলেই সামাজিক সমস্যা থেকে উত্তরণ ঘটতে পারে এটাই ছিল তার অভিমত। বরীন্দ্রনাথও বলেছেন, আইন দ্বারা কখনও সামাজিক সমস্যা দূর হতে পারে না। যতক্ষণ পর্যন্ত না সমাজবদ্ধ মানুষ সচেতন হবে।
কবীর চৌধুরীর মত একজন বিজ্ঞ ও বড় মাপের মানুষ চলে যাওয়ায় বাংলাদেশের অপূরণীয় ক্ষতি হয়েছে– একথা আমাদের স্বীকার করতেই হবে। বিশেষ করে আজকের বাংলাদেশ যখন তার জাতিসত্ত্বার বিকাশ, গণতান্ত্রিক অধিকার প্রতিষ্ঠা, মুক্তিযুদ্ধের মূল্যবোধ চর্চা ও অসাম্প্রদায়িক সমাজ গঠনে সংগ্রামরত তখন তিনি পারতেন বিদেশে আমাদের ভাবমূর্তি তুলে ধরতে। তাঁর মত করে বাংলাদেশের ভবিষ্যৎ নিয়ে ভাববার মানুষের অভাব থেকেই যাবে আমাদের। একজন দেশপ্রেমিক ও মানবিক হৃদয়ের অধিকারী হিসেবে কবীর চৌধুরী মুক্ত চিন্তা ও বুদ্ধিবৃত্তির চর্চা করেছেন। তার প্রভাব দীর্ঘদিন আমাদের শিল্প-সাহিত্য-সাংস্কৃতি তো বটেই মানুষের জীবনকেও তা আন্দোলিত করে রাখবে।
বেবী মওদুদ: লেখক ও সাংবাদিক।