নারীদের অদৃশ্যকরণের প্রক্রিয়া এবং অদৃশ্যকরণের রাজনীতির বিরুদ্ধে লড়াইয়ে রোকেয়ার অদম্য মনোবলের কাছ থেকে শিক্ষা নিতে হবে।
Published : 09 Dec 2024, 02:13 AM
রোকেয়াকে নিয়ে শিল্পী কবীর সুমনের একটা গান শুনছিলাম,
আপনি জানতেন অবরোধ হয়
মেয়েদের জন্য অবরোধ নয়,
অবরোধ খোলা, প্রতিরোধ তোলা
লেখাপড়া শেখা, খোলা মনে দেখা
যেভাবে আপনি দেখেছেন
বেগম রোকেয়া সাখাওয়াত হোসেন।
খোলা মনে মানে চিন্তার ঘোরাটোপ থেকে বেরিয়ে আসতে নারীদের বারবারই আহবান করেছেন বেগম রোকেয়া। মানসিক দাসত্ব থেকে মুক্ত হতে না পারলে ‘স্ত্রী জাতির’ প্রকৃত মুক্তি অসম্ভব সেটা তিনি ঠিকই জানতেন। আর মাত্র বছর ছয় পর তার মৃত্যুর ১০০ বছর পূর্ণ হবে। এত বছর পরে গিয়েও কি আমরা ‘খোলা মনে’ চিন্তা করতে পারছি? রোকেয়ার উত্তরসূরী হিসেবে ফিরে ফিরে ওই প্রশ্ন তো হাজির হয়। আত্মজিজ্ঞাসা হয়, সামগ্রিকভাবে চিন্তায়, মননে কতখানি অগ্রসর হলাম আমরা? প্রকৃত শিক্ষা বা মানসিক দাসত্ব থেকে কতখানি মুক্তি ঘটল আমাদের?
অবিরাম লড়াকু রোকেয়াকেই বা সমাজ কতটুকু ধারণ করতে পারে? কেবল মেয়েদের স্কুল এবং শিক্ষিতকরণের উদ্যোক্তা তিনি ছিলেন না। বরং নারী স্বাধীনতার জন্য এবং নারী-পুরুষ সমানাধিকারের জন্য তিনি ভিত্তিকাজ হিসেবে নারী শিক্ষার প্রশ্নটিকে সঠিকভাবে চিহ্নিত করেছিলেন। স্কুলের জন্য একা যে লড়াই তিনি জীবনের শেষদিন পর্যন্ত করে গেছেন ওই লড়াইও অনালোচিতই থেকে যায় রোকেয়া সম্পর্কিত আলাপচারিতায়। তার প্রকাশিত মতিচূর, পদ্মরাগ বা সুলতানার স্বপ্ন পাঠ করবার পাশাপাশি বেগম রোকেয়াকে গভীর অনুসন্ধানের জন্য, তাকে সঠিকভাবে ধারণ করবার জন্য বিভিন্ন সময়ে লিখিত তার চিঠিগুলোর পাঠ জরুরি। কেননা দৃঢ় সংকল্প, বিরামহীন রোকেয়ার অনন্য বৈশিষ্ট্য তার চিঠিপত্রের ছত্রে ছত্রে পাওয়া যায়।
আব্দুল কাদির সম্পাদিত বাংলা একাডেমি থেকে প্রকাশিত ‘রোকেয়া রচনাবলী’তে (প্রকাশকাল মার্চ, ১৯৯৯) বেগম রোকেয়ার মোট ৪২টি চিঠি পাওয়া যায়। এরমধ্যে ১৭টি চিঠি স্কুলের বা দাপ্তরিক প্রয়োজনে লেখা। সেগুলো তিনি ইংরেজিতে লিখেছিলেন। বাদবাকি ২৪টি চিঠির বেশিরভাগ ব্যক্তিগত, যেগুলো তিনি বাংলায় লিখেছেন। তবে ব্যক্তিগত বা পারিবারিকভাবে সম্পর্কিতদের লেখা হলেও ওইসব চিঠিও নিতান্তই ব্যক্তিগত আলাপচারিতাকে ছাপিয়ে তার চিন্তা প্রকাশের প্রতিচ্ছবি হয়ে উঠেছে। এ লেখায় রোকেয়ার চিঠিপত্র থেকে নির্বাচিত কয়েকটি চিঠি থেকে তার চিন্তা, কাজ, ভাবনাকে বুঝবার প্রচেষ্টা করব।
বেগম রোকেয়ার ব্যক্তিগত চিঠিগুলোর প্রাপকের তালিকায় তার চাচাত বোন মরিয়ম রশীদ, মোহসেনা রহমান মনা, শামসুন নাহার মাহমুদ, স্কুল সেক্রেটারি খান বাহাদুর তসদ্দক আহমদ, মামলুকুন ফাতেমা খানম, মোমেনাতুল ফাতেমা, কবি খান মুহম্মদ মঈনউদ্দীন এবং একজন অভিভাবক বাবর আলী খানও রয়েছেন। এরমধ্যে মরিয়ম রশীদকে লেখা ৬টি চিঠি পাওয়া যায়। প্রতিটি চিঠিতে অত্যন্ত দরদী বড় বোনের মতো তিনি মরিয়মকে সম্বোধন করেছেন। মরিয়ম রশীদের চিঠির প্রত্যুত্তর দিতে দেরি হওয়ার কারণ হিসেবে বেগম রোকেয়া তার সময়াভাবের উল্লেখ করে আক্ষেপ করেছেন, “আমার হাড়ভাঙা খাটুনির পরিবর্ত্তে সমাজ বিস্ফারিত নেত্রে আমার খুঁটিনাটি ভুলভ্রান্তি ছিদ্র অন্বেষণ করিতেই বদ্ধপরিকর।” যদিও রোকেয়া ওইসব থোড়াই কেয়ার করে নিজের অভীষ্টে অটল থেকে আরও এগিয়ে যেতে নিজেকে প্রস্তুত করছেন। সবকিছুকে ভ্রুকুটি দেখিয়ে তিনি ম্যাট্রিক পরীক্ষা দেবার প্রস্তুতি নিচ্ছেন জানিয়ে বোনকে লেখেন, “এখন পড়া তৈরী করিতেছি।”
বেগম রোকেয়া জীবনব্যাপী যে অক্লান্ত লড়াই করে গেছেন এর বিনিময়ে তিনি কী পেয়েছেন তা যেমন তার চিঠিতে স্পষ্ট তেমনি তিনি কী চেয়েছেন সেটিও সুস্পষ্ট। এক চিঠিতে রোকেয়া লিখেছেন, “সমাজের কাছ থেকে সম্মান বা খ্যাতি কিছুই চাই না।” (পত্রনম্বর ০৯)। এমনকি নিজের ‘স্বামীর স্মৃতি রক্ষা’ও তার স্কুল প্রতিষ্ঠার উদ্দেশ্য নয়। তিনি সুস্পষ্টভাবে বলেছেন, ‘‘... আমি আমার স্বামীর নামের কাঙাল নই। কারণ আমি জানি তার সত্যিকারের স্মৃতি আমার সঙ্গেই রয়েছে ও আমার সঙ্গেই লুপ্ত হয়ে যাবে।” বেগম রোকেয়ার এত পরিশ্রমের উদ্দেশ্য তাহলে কী? তিনি নিজেই এর উত্তর দিয়েছেন, “চিরকাল আমি স্ত্রী স্বাধীনতার জন্য কিছু করবার চেষ্টা করেছি ...।”
মেয়েদের স্কুল প্রতিষ্ঠা নিয়ে রোকেয়ার লড়াইয়ের অনেক অনালোচিত দিকও তার চিঠিপত্রে পাওয়া যায়।
১৯০৯ সালের ১ অক্টোবর ভাগলপুরের তদানীন্তন ডেপুটি ম্যাজিস্ট্রেট সৈয়দ আব্দুল মালেকের সরকারি বাসভবনে স্থাপিত স্কুল পারিবারিক বিরোধিতার মুখে মাত্র দু-বছরের মাথায় ১৯১১ সালে কলকাতার ওলীউল্লাহ লেনে স্থানান্তর করতে বাধ্য হন বেগম রোকেয়া। সেখান থেকে আবারও ১৯১৩ সালে ইউরোপিয়ান অ্যাসাইলাম লেনে স্কুলটি স্থানান্তরিত হয়। সবশেষে বেগম রোকেয়ার মৃত্যুর বছর দুই আগে ১৯৩০ সালে স্কুলটি লোয়ার সার্কুলার রোডে আসে। এত ধকলের পরও প্রতিষ্ঠার কুড়ি বছর পর তার অক্লান্ত শ্রমে ১৯২৯ সালে ওই স্কুলের ছাত্রী সংখ্যা গিয়ে দাঁড়ায় ১৩৩-এ। ১৯৩১-এ তিনজন মুসলিম ছাত্রী ম্যাট্রিক পরীক্ষায় অংশগ্রহণ করেন।
শুধু স্থানান্তর নয় বাংলা শাখা প্রবর্তন নিয়েও বেগম রোকেয়াকে কঠিন পথ পাড়ি দিতে হয়। ১৯১৭ সালে তিনি স্কুলে বাংলা ভাষা শাখা চালু করলেও ১৯১৯ সালে তা বন্ধ হয়ে যায়। কারণ, তখনকার উর্দুভাষী কলকাতার মুসলমান সমাজের বাংলা ভাষা বিমুখতা। সেকালে স্কুল প্রতিষ্ঠা এবং সেটিকে একটি শক্ত প্রতিষ্ঠান হিসেবে রূপান্তর করা কতখানি কঠিন ছিল ওই কথা ১৯২৬ সালে ‘দ্য মুসলমান’ পত্রিকার সম্পাদক মুজিবর রহমানকে রোকেয়ার চিঠি থেকে খানিক জানা যায়। ওই চিঠিতে তিনি জানান, ১৩ বছর আগে যখন সাখাওয়াত মেমোরিয়াল স্কুল প্রতিষ্ঠত হয় তখন কলকাতায় মুসলিম মেয়েদের জন্য কোনো স্কুল ছিল না। ‘পাবলিক ওয়ার্ক’ করা মোটেও সহজ কাজ নয়— এ কথা রোকেয়া জানতেন। সেখানে একা রোকেয়া এমনভাবে সফল হয়েছিলেন যে, ১৯২৬ সালে যখন কলকাতায় হাফ ডজন মুসলিম মেয়েদের স্কুল, ট্রেনিং সেন্টার চালু হয় সেখানে কমপক্ষে ৪টি স্কুলের হেড মিস্ট্রেস সাখাওয়াত মেমোরিয়াল স্কুলের সাবেক শিক্ষার্থীরা ছিলেন। তবে এইসব সাফল্যকেই রোকেয়া চূড়ান্ত গন্তব্য মনে করেননি। তিনি বরং পরবর্তী ধাপে অগ্রসর হতে চেয়েছেন। তাই সম্পাদককে লেখেন, “So you see field is now quite ready for taking up the cause of female regeneration.” (পত্র নম্বর ৪০)।
বেগম রোকেয়াকে নিয়ে আলোচনায় অনালোচিত এসব নিদারুণ প্রতিকূলতা তার লড়াইকে সুস্পষ্ট করে আমাদের সামনে হাজির করে। ১৯১৩ সালে মো. ইয়াসীনকে লেখা এক চিঠিতে তিনি ভাগলপুরে সাখাওয়াত হোসেন এবং দুই অকালপ্রয়াত সন্তানের কবর দেখতে না পারায় তার ব্যাকুলপ্রাণের কষ্টের কথা জানান। যদিও ওই কষ্টের কাছে তিনি পরাজিত হননি। বরং সাহসী রোকেয়া বলেন যে, কেবলমাত্র এবং একমাত্র স্কুলের জন্যই ভাগলপুর ছেড়েছেন। (পত্র নম্বর ২৮)। কথা বলাই যায় যে, মাত্র ৫২ বছর বয়স পর্যন্ত রোকেয়া যত কাজ করেছেন তা করা খুব সহজসাধ্য নয়। যদিও তিনি নিজের সম্পর্কে অত্যন্ত মৃদুভাষী ছিলেন। রোকেয়া সম্পর্কে জানতে চাইলে মামলুকুল খাতেমা খানমকে রোকেয়া বলেছিলেন, “কুকুরের কাজ নাই, দৌড় ছাড়া হাঁটা নাই।” অথচ এ দৌড় নিজের যশ, খ্যাতি, অর্থবৈভবের জন্য নয়। কেবল সমাজের জন্য। ‘স্ত্রী জাতির অবনতি’-এর কারণ অনুসন্ধান ও সেখান থেকে তাদের উত্তরণের উপায় বের করার জন্য।
রোকেয়ার সুস্পষ্ট অবস্থান কেবল তার কাজ নিয়েই ছিল না। তিনি যা বিশ্বাস করতেন তা নিজে চর্চাও করতেন। এমনকি স্পষ্টভাষী রোকেয়া প্রিয়জনদেরও সঠিক কথা বলতে দ্বিধা করতেন না। মোহসেনা রহমানকে লেখা ১৯২৯ সালের এক চিঠিতে তিনি লিখেন, “তুমি কাসন্দ না পাঠিয়ে যদি স্কুলের ফান্ডে চার পাঁচ টাকা পাঠাতে তা’তে আমি বেশী সুখী হতুম।” কষ্ট নিয়ে তিনি আরও লিখেছিলেন “এক ব্যক্তি সুদূর রেঙ্গুন থেকে স্কুলের জন্য চাঁদা সংগ্রহ করে পাঠাচ্ছেন ...। আর তোমরা আমার আপন লোক হয়ে স্কুলটাকে ভুলে থাক।’ (পত্র নম্বর ০৭)। অথবা কখনো স্নেহাস্পদ মরিয়মকে শ্লাঘার স্বরে কর্তব্য ঠিক করে দিয়ে বলেন, “মাশাল্লাহ সেলিমসহ পৃথক বাসায় থাকতে পারবে না কেন? আমি ত একাই ২২ বছর ধরে আছি— তা তুমি বলবে যে তুমি বুড়ো মানুষ। কিন্তু ২২ বছর পূর্বে ত বুড়ো ছিলুম না। ফলকথা, তুমি ভাল করে চিন্তা করে দেখ। এখন এই উন্নতির যুগে তুমি একটা আলাদা বাসায় থাকতে সাহস না করলে চলবে কেন?” (পত্র নম্বর ২০)।
অদম্য রোকেয়া প্রবল মনোবলের অধিকারী ছিলেন। নিজেই এক চিঠিতে তিনি লিখেছেন, “বাইবেল বলে, শরীরে জোর না থাকলে মনের জোরও থাকে না। কিন্তু আমার শরীরের জোর না থাকলেও মনের জোর আজো আছে।” এই মনের জোরেই শৈশবে বাবার আদর বঞ্চিত, বিবাহিত জীবনে কেবল স্বামীর রোগের সেবাকারী, অকালে দু সন্তানকে হারিয়েও যেন কর্তব্য দিশা হারাননি। ২২ বৎসর যাবত বৈধব্যের আগুনে’র পুড়ে পুড়ে রোকেয়া যেন নিজেকে ইস্পাতদৃঢ় করে গড়ে তুলেছিলেন।
রোকেয়াকে যতই আমরা পাঠ করি, অনুসন্ধান করি, ততই তার উত্তরসূরী হিসেবে বার বার নিজেদের প্রশ্ন করি, কতদূর এগুলাম আমরা? পুঁজিবাদী পিতৃতান্ত্রিক মানসিকতা থেকে কতখানি নিজেদের মুক্ত করতে পারলাম? সম্প্রতি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের এক ছাত্রী যখন রোকেয়ার গ্রাফিতি কাল রঙে ঢেকে দেন তা রোকেয়ার উত্তরসূরীদের শুধু আহতই করে না। নানা আশঙ্কার মেঘও উঁকি দেয় তাদের মনে। হয়তো এটি একজন শিক্ষার্থীর ‘ব্যক্তিগত বিচ্ছিন্ন’ ঘটনা। এটি আবারও দেখিয়ে দিল যে, খোলামনের চিন্তাশীল মানুষ হতে আমাদের আরো বহুপথ পাড়ি দিতে হবে।
একদিকে বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনে নারীদের বিপুল অংশগ্রহণ আমাদের আশাবাদী করে। আবার অন্যসব আন্দোলনের মতো আন্দোনের পরে সমাজ বিনির্মাণকালে ওই লড়াকু নারীদের ম্রিয়মান উপস্থিতি মনে করিয়ে দেয়, লড়াই শেষ হয়নি, যেতে হবে বহুদূর।
এই যে নারীদের অদৃশ্যকরণের প্রক্রিয়া, অদৃশ্যকরণের রাজনীতি তার বিরুদ্ধে লড়াইয়ে রোকেয়ায় অদম্য মনোবলের কাছ থেকে শিক্ষা নিতে হবে। নিজেদের কর্তাসত্ত্বার বিকাশ ঘটাতে হবে। ঘরে-বাইরে, চিন্তা-দর্শনে, লেখালেখিতে, রাজপথে সর্বত্র লড়াইয়ের ময়দানে নারীদের প্রবলভাবে হাজির থাকতে হবে। মিছিলের উত্তাল স্লোগানের মতো নিজেদের দাবি, স্বাধীনতার প্রশ্নে উচ্চকিত থাকতে হবে।
জুলাই অভ্যুত্থানের লড়াকু নারীদের হাত ধরে আগামীর বাংলাদেশ রোকেয়া সাখাওয়াত হোসেনের ঘাঁটি হিসেবে আরও পোক্ত হয়ে উঠুক। বাংলার নারীরা রোকেয়ার লড়াইয়ের পতাকাতলে সমবেত হোক; এগিয়ে চলুক। কবীর সুমনের গানের মতো তারা বলে উঠুক, “মনে রাখা পথ, পথের শপথ, যেভাবে তিনি শিখিয়েছেন, বেগম রোকেয়া সাখাওয়াত হোসেন।”