অস্ত্রব্যবসায়ী ক্ষুদ্র এক ধনিক গোষ্ঠীর কুক্ষিগত হয়ে পড়া এই পৃথিবীকে পুনরায় উদার আদর্শের মানবিক বিশ্বে রূপান্তর করতে না পারলে দেশে দেশে আরও অনেক রক্তাক্ত দিনরাতের আবির্ভাব ঘটবে।
Published : 27 Mar 2025, 05:05 PM
যুক্তরাষ্ট্র ও ইসরায়েলের যৌথ গণহত্যা প্রকল্পের নতুন মাত্রায় ১৮ মার্চ থেকে গাজায় শুরু হয় ফিলিস্তিনিদের জন্য ‘রক্তাক্ত সেহরি’ পর্ব। ইসরায়েল জানুয়ারিতে হামাসের সঙ্গে করা যুদ্ধবিরতি চুক্তিকে এককভাবে ভঙ্গ করে ওই দিন ভোর রাতে সেহরির সময় বর্বর আক্রমণ করে গাজায় চারশো পঞ্চাশ জনের বেশি নিরীহ মানুষকে এক ভোররাতে হত্যা করে, যাদের মাঝে ২০০ জনই শিশু। ফিলিস্তিনিদের কাছে ইতিহাসের এই ভয়ঙ্কর বর্বরতম ভোররাত ‘রক্তাক্ত সেহরি’ বলে পরিচিত হয়েছে।
আন্তর্জাতিক অপরাধ ও বিচার আদালতে চিহ্নিত ইসরায়েলের যুদ্ধাপরাধী প্রধানমন্ত্রী বিনিয়ামিন নেতানিয়াহুর মতে, “এ হচ্ছে শুরু মাত্র।” ইসরায়েলের প্রতিরক্ষা মন্ত্রী ইসরায়েল কাৎজের মতে, এর সমাপ্তি হবে গাজার সম্পূর্ণ ধ্বংসপ্রাপ্তিতে এবং ফিলিস্তিনিদের অন্যত্র চলে যাওয়ায়। তাদের স্পষ্ট বার্তা, গাজাবাসীদের জন্য এরপর আর কোনো বিকল্প নেই।
আঠারো মাস ধরে ইসরায়েল সংঘটিত গণহত্যার এ নতুন পর্বটা ডনাল্ড ট্রাম্প ও ইলন মাস্কের নবনির্মিত ‘মাফিয়া বিশ্বে’ তাদের উল্লেখযোগ্য উপহার! হ্যাঁ, ট্রাম্প ও মাস্কের এই রূপান্তরিত বিশ্বকে ‘মাফিয়া বিশ্ব’ নামে অভিহিত করেছেন কানাডার খ্যাতিমান লেখিকা ও চলচ্চিত্রকার নাওমি ক্লেইন, ২৩ মার্চ সাংবাদিক মেহেদি হাসানের সঙ্গে জেটিও-র এক কথোপকথন অনুষ্ঠানে। নাওমি বলেন, “যা রূপ নিচ্ছে তা একরকম বিভাজিত মাফিয়া বিশ্ব।” মেহেদি এর চরিত্র সম্পর্কে বলেছেন, “যুক্তরাষ্ট্র ও যুক্তরাজ্য ইসরায়েলকে অনুমোদন করেছে জেনেভা চুক্তি, আন্তর্জাতিক মানবাধিকার আইন বলতে আমরা যা কিছু বুঝি তা সব পুড়িয়ে ফেলার।”
গাজায় ‘রক্তাক্ত সেহরি’ এসেছে ও চলছে যুক্তরাষ্ট্রের সহায়তা ও সমর্থনে, এখন আর ইসরায়েলে বা মার্কিন মুল্লুকে এ নিয়ে কোনো রাখঢাক নেই, বরং এ ঘটনা গর্বভরে প্রচারিত। এই নতুন ‘মাফিয়া বিশ্বে’ যেখানে আন্তর্জাতিক আইনের বদলে মাফিয়া কোড অনুযায়ী সব পরিচালিত হবে সেখানে ‘রক্তাক্ত সেহরি’ একটা নিয়মে পরিণত হতে পারে। গাজায় এখনকার গণহত্যা বিশ্বের এই রূপান্তরের প্রমাণ দিচ্ছে।
এই রূপান্তরিত বিশ্বে নেতৃত্বদানকারী ট্রাম্প, মাস্ক ও নেতানিয়াহুর ভয়ে ইউরোপও সুবোধ বালকের মত লাইনে দাঁড়াচ্ছে। ইসরায়েল কর্তৃক গাজায় এ নতুন মাত্রার হামলাকে ইউরোপিয়ান রাষ্ট্রপ্রধানদের নিয়ে গঠিত ইউরোপিয়ান কাউন্সিল নিন্দা করেছে এমনভাবে যেন এজন্য গাজার অধিবাসীরাই দায়ী আর ইসরায়েল ধোয়া তুলসি পাতা। অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনালের ইউরোপীয় প্রতিষ্ঠান কার্যালয়ের পরিচালক ইভ গেডি তাদের বার্তাকে তাই বলেছেন, “ফিলিস্তিনিদের বিরুদ্ধে ইসরায়েলি গণহত্যা ও যুদ্ধাপরাধের পক্ষে সাফাই গাওয়ার আরেক লজ্জাজনক প্রয়াস।”
ইসরায়েল ও হামাসের মধ্যেকার ১৯ জানুয়ারি থেকে শুরু হয় যুদ্ধবিরতির ১ম পর্ব শেষ হয় ১ মার্চে। এ সময়ে চুক্তি অনুযায়ী হামাস ৩০ জন জীবিত ও ৮ জন মৃত আটক ব্যক্তিকে ইসরায়েল সরকারের হাতে তুলে দেয়। ইসরায়েল মুক্তি দেয় তাদের কারাগারে বছরের পর বছর ধরে নির্যাতিত প্রায় ১৯০০ ফিলিস্তিনিকে। চুক্তির দ্বিতীয় পর্বে ইসরায়েলি সৈন্যদের অধিকৃত অঞ্চল থেকে পুরোপুরি চলে যাওয়ার কথা। আর সে কারণেই ইসরায়েল একতরফাভাবে হামাসকে শর্ত দেয় তাদের হাতে আটক বাকি সবাইকে ছেড়ে দিতে হবে। হঠাৎ শুরু করে এই আক্রমণ এবং আগের মতই তারা গাজায় খাদ্য, পানি, ওষুধ, বিদ্যুতের সব সরবরাহ বন্ধ করে দেয়। যা মূলত ট্রাম্পের ক্ষমতাগ্রহণের পূর্বেকার ঘোষণারই বাস্তবায়ন। ট্রাম্প হুমকি দিয়েছিলেন, নরক নেমে আসবে সমগ্র মধ্যপ্রাচ্যে।
ডনাল্ড ট্রাম্প তার প্রতিশ্রুতি অনুযায়ী এ প্রক্রিয়া শুরু করেছেন। হুতিরা ফিলিস্তিনকে সমর্থন করে ইসরায়েলের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করার জন্য যুক্তরাষ্ট্র ১৫ মার্চ ইয়েমেনে হামলা করে অন্তত ৫৩ জন মানুষকে হত্যা করেছে। আর সেই থেকে প্রায় প্রতিদিনই সেখানে হামলা চলছে। যুক্তরাষ্ট্রের সবুজ সংকেত অনুযায়ী সিরিয়ার ওপর নিয়মিত হামলা চালাচ্ছে ইসরায়েল। ট্রাম্প ও নেতনিয়াহু যৌথভাবে ইরানকে আক্রমণের জন্য প্লট তৈরি করছেন। যে আক্রমণের পরিকল্পনা মূলত ইসরায়েলের অনেক আগে থেকে করা। এতদিনকার যুদ্ধবিরোধী বলে বুক ফুলিয়ে বেড়ানো ট্রাম্প এবার তার আসল চেহারাটা দেখাবেন— ইসরায়েলের স্বার্থে ও আদেশে হেন কোনো অপরাধ ও যুদ্ধ নেই যা করতে তিনি পিছপা হবেন। সঙ্গে পেয়েছেন বিজ্ঞানী ইলন মাস্ককে, যিনি কিনা পৃথিবীবাসীকে বাঁচাতে তাদের জন্য সুদূর মঙ্গলগ্রহে বসতি গড়ে তোলার মহান পরিকল্পনা করছেন। ঠিকই, পৃথিবীটাকে নরক বানিয়ে বসবাসের অযোগ্য করে না ছাড়লে মঙ্গলগ্রহ দিয়ে মানুষ কী করবে? পৃথিবী থেকে সব মঙ্গল ঝেঁটিয়ে বিদায় না করলে এতিম মঙ্গল গ্রহটাকে বাজারে বেচবেন কি করে? পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ ধনী এই মাস্ক ২০২৩ সালে হামাসের আক্রমণের পরের মাসে ইসরায়েলে ছুটে যান ও নেতানিয়াহুর সঙ্গে বৈঠক করেন। ভদ্রলোক টুইটার (বর্তমানে এক্স) কিনে নেয়ার পর থেকে সেখানে ধর্ম-জাতি-বর্ণ বিদ্বেষী পোস্ট ৫০ শতাংশ বেড়েছে— গবেষণায় বলছে। ফিলিস্তিন নিয়ে ট্রাম্প ও তার পরিকল্পনা অভিন্ন।
যুক্তরাষ্ট্রে এই যুদ্ধবাজ ট্রাম্প-মাস্ক চক্রের ক্ষমতায় আরোহন নেতানিয়াহুর জন্য যেন ঈশ্বরের আশীর্বাদ। তার ঘাড়ের ওপর কেবল আন্তর্জাতিক অপরাধ আদালতের গ্রেপ্তারি পরোয়ানাই ঝুলছে না, নিজ দেশেও তিনি ঘুষ ও দুর্নীতির দায়ে হাতকড়া পরার অপেক্ষায়। এখন জেলের বাইরে থাকার একটাই উপায় যেভাবেই হোক না কেন যুদ্ধকে জিইয়ে রাখার মাধ্যমে ক্ষমতায় টিকে থাকা। তাই তার অজুহাত হামাস এই নতুন প্রস্তাব মানছে না বলেই পুনরায় গণহত্যা শুরু করতে তিনি বাধ্য হচ্ছেন!
দ্য ইকোনোমিস্ট লিখেছে, “তার কোয়ালিশন সরকার সংখ্যাগরিষ্ঠের অভাবে বাজেট পাশ করতে ব্যর্থ হচ্ছিল। এটি না পারলে তাকে দ্রুত নির্বাচন দিতে হবে। যুদ্ধবিরতি চুক্তি স্বাক্ষরের পর চরম দক্ষিণপন্থী জুয়িশ পাওয়ার দলের নেতা ইতামার বেন-গাভির সরকার থেকে বেরিয়ে গিয়েছিল, কিন্তু গাজায় সাম্প্রতিক আক্রমণের পরই সে আবার ঘরে ফিরছে।”
ইসরায়েলের গোয়েন্দা সংস্থার প্রধান ও অ্যাটর্নি জেনারেলের সঙ্গে তার দ্বন্দ্বও তাকে রাজনৈতিক ঝুঁকিতে ফেলেছে। যুদ্ধই তার ক্ষমতা বজায় রাখার ও পিঠ বাঁচানোর একমাত্র উপায়। হামাসের হাতে ৭ অক্টোবর নিহত ও জিম্মিদের স্বজনরা আগে থেকেই নেতানিয়াহুকে তার ব্যর্থতার জন্য দায়ী করে আসছিলেন। তারা কোনো দীর্ঘমেয়াদী যুদ্ধ নয়, বরং তাদের প্রিয়জনদের জীবিত অবস্থায় ফেরত চান, যুদ্ধ যা অনিশ্চিত করছে। আর এই গত আঠারো মাস ধরে তাদের প্রধানমন্ত্রী প্রমাণ করেছেন যে, আটক ইসরায়েলি নাগরিকদের জন্য ন্যূনতম মাথাব্যথা নেই তার। বরং তারাই তার গণহত্যা চালিয়ে যাওয়ার জন্য খেলার ঘুঁটি। এবার যুদ্ধবিরতিকে একতরফাভাবে বাতিল করে পুনরায় হত্যাযজ্ঞ শুরুর জন্য বন্দিদের স্বজনরা আবার ক্ষিপ্ত। ইসরায়েলে তাদের হোস্টেজেস ফ্যামিলি ফোরাম বলেছে, “হামাসের বিপজ্জনক হাত থেকে আমাদের প্রিয়জনদের ফিরিয়ে আনার প্রক্রিয়াটি ধ্বংস করার জন্য আমরা আহত, ক্ষিপ্ত ও আতঙ্কিত।”
অস্ত্রব্যবসায়ী ক্ষুদ্র এক ধনিক গোষ্ঠীর কুক্ষিগত হয়ে পড়া এই পৃথিবীকে পুনরায় উদার আদর্শের মানবিক বিশ্বে রূপান্তর করতে না পারলে দেশে দেশে আরও অনেক রক্তাক্ত দিনরাতের আবির্ভাব ঘটবে। ফিলিস্তিনিদের স্বাধীনতা ও মুক্তি তাই বিশ্বব্যাপী নির্যাতিত মানবতার মুক্তির সঙ্গে ওতপ্রোতভাবে জড়িত।