Published : 07 Sep 2016, 09:51 AM
বরাবরের মতো এবারও পাকিস্তান তাদের বেদনার কথা প্রকাশ করেছে। মানবতাবিরোধী অপরাধের জন্যে চট্রগ্রামের 'ডেথ স্কোয়াড' নামে পরিচিত আল-বদর বাহিনীর কমান্ডার বা বাঙালি খানকে ফাঁসি দেওয়া হল; আর বেদনায় ভারাক্রান্ত হল পাকিস্তানের হৃদয়। চিহ্নিত যুদ্ধাপরাধীদের সাজা কার্যকরের জেরে পাকিস্তান এর আগেও একাধিকবার তাদের নেতিবাচক প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করেছে। বলাই বাহুল্য, এভাবে তারা বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ বিষয়ে প্রত্যক্ষ হস্তক্ষেপ করে কূটনৈতিক শিষ্টাচার লঙ্ঘন করে চলেছে।
পাকিস্তান অত্যন্ত বেদনার্ত হয় যখন 'মীরপুরের কসাই' আবদুল কাদের মোল্লার ফাঁসি হল, তখন (২০১৩ সালের ১২ ডিসেম্বর)। পাকিস্তানের অশ্রু পরে আবারও ঝরল ২০১৫ সালের ১১ এপ্রিল, কামারুজ্জমানের ফাঁসি হওয়ার পর। তখন পাকিস্তান এ নিয়ে তীব্র প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করে। এমনকী মিথ্যা তথ্য নিয়ে ঢাকায় হাজির হয়েছিলেন একজন প্রাক্তন বিচারপতি সালাউদ্দিন কাদের চৌধুরীকে রক্ষার জন্য। কিন্তু ২০১৫ সালের ২১ নভেম্বর সাকাচৌ ও আলী আহসান মোহাম্মদ মুজাহিদের ফাঁসি হয়ে গেল। ১০ মে ২০১৬ মতিউর রহমান নিজামীর ফাঁসি হওয়ার পরও একই ঘটনা।
পাকিস্তানের এমন হৃদয়-ভাঙা বেদনা অনুভবের কারণ কী? অধ্যক্ষ নতুন বাবুকে যখন হত্যা করা হল, কিশোর জসীমকে মেরে কর্ণফুলিতে ফেলে দেওয়া হল, মীরপুরে কয়েকশত লোক এবং পাবনায় গ্রাম ঘেরাও করে শত শত লোককে হত্যা করা হল, তখন তারা একবারও ভাবেনি এই মহাপাপের জন্য অপরাধীদের শাস্তি হতে পারে একদিন।
অবশ্যই মানবতা, আইনের শাসন, সুষ্ঠু বিচারপ্রক্রিয়া এমন সব কথা বা ভাবনা পাকিস্তানের কাছে নিতান্তই অপরিচিত। তবে তারা যে অপপ্রচার করছে তা মারাত্মক। ১৯৭৪ সালে ভারত পাকিস্তান এবং বাংলাদেশ যে ত্রিপক্ষীয় চুক্তি হয়েছে তার প্রতিপালন করার স্বার্থে এমন বিচার হতে পারে না, এটাই তাদের বক্তব্য।
এ হচ্ছে নেহাত একটি ভুল ব্যাখ্যা ও মিথ্যা প্রচারণা। ১৯৭৪ সালের চুক্তিটি ১৯৫ জন পাকিস্তানি যুুদ্ধাপরাধীর প্রত্যাবাসনের মধ্যেই সীমিত ছিল। শর্ত ছিল, পাকিস্তান তাদের বিচার করবে; কারণ, প্রত্যেকের বিরুদ্ধে সুনির্দিষ্ট অভিযোগ ছিল। প্রত্যেকটি ছিল 'কগনেজিবেল অফেন্স' (Cognizable offence) যার বিচার যে কোনো সময় হতে পারে। তাই তাদের স্বদেশে যেতে দেওয়া হল এই শর্তে যে, তাদের বিচার করবে পাকিস্তান।
বাস্তবে কী হল? ৯০ হাজার আত্মসমর্পণকারী দস্যু দেশে ফিরে গেল নীরবে, কিছুই হল না। অদ্যাবধি পাকিস্তান তাদের বিচারের ধারেকাছেও যায়নি। অথচ যুদ্ধশেষে পাকিস্তানের পরাজয়ের জন্যে হামিদুর রহমান কমিশন হয়েছিল। সেই কমিশন এমন জঘন্য হত্যাকারী ও নারী ধর্ষণকারীদের শাস্তির জন্যে সুপারিশ করেছিল।
পাকিস্তানের প্রয়াত নেতা জুলফিকার আলী ভুট্টো ১৯৭৪ সালের চুক্তির প্রতি বৃদ্ধাঙ্গুলি প্রদর্শন করেন। কারণ, তিনি নিজেও ছিলেন ওই ভয়াবহ গণহত্যার অন্যতম ষড়যন্ত্রকারী। তাই এই ত্রিপক্ষীয় চুক্তি পাকিস্তান 'রেটিফাই' করেনি। চুক্তিতে কোথাও এমন কথা ছিল না যে, বাংলাদেশে তার দেশের অভ্যন্তরে ১৯৭১ সালের খুনি ও হত্যাকারীদের বিচার করতে পারবে না। বাংলাদেশ বারবার বলেছে, এ হচ্ছে বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ বিষয়। কিন্তু উদ্দেশ্যমূলকভাবে পাকিস্তান বিশ্বজনমত বিভ্রান্ত করতে প্রতিটি রায় কার্যকরের পর তার বিরুদ্ধে প্রতিক্রিয়া জানাচ্ছে, মিথ্যাচার করছে– যা আসলে কূটনৈতিক শিষ্টাচারবহির্ভূত।
পকিস্তান বলছে, ত্রুটিপূর্ণ বলে ১৯৭১ সালের ডিসেম্বরের আগের ওইসব অপরাধের বিচার সমর্থনযোগ্য নয়। ত্রুটিপূর্ণ বিচার কী করে হল তার কোনো ব্যাখ্যা কিন্তু নেই। বিচারের প্রক্রিয়ায় ট্রাইব্যুনালে সাক্ষ্য-প্রমাণ মিলেছে এবং অপরাধ প্রমাণিত হয়েছে। তারপর আপিল হয়েছে এবং আপিল রিভিউ করার সুযোগ পেয়েছে অভিযুক্তরা। বিশ্বের কোথাও গণহত্যার বিচারের জন্যে আপিল আবেদন বা রিভিউ করার সুযোগ নেই। সেই ন্যুরেমবার্গ ট্রায়াল থেকে টোকিও ট্রায়াল– কোথাও এমন নজির নেই।
যুদ্ধাপরাধের এই বিচার গণতান্ত্রিক চেতনার পরিপন্থী বলেও মত দিচ্ছে পাকিস্তান। গণতান্ত্রিক চেতনার বিষয়ে পাকিস্তানের সরকার বা সে দেশের জনগণের ধারণা আছে কি? জন্মলগ্ন থেকে দেশটিতে সামরিক শাসন চলছে। হত্যা-সন্ত্রাস হচ্ছে তাদের নিত্যসঙ্গী। এখন বিশ্বে পাকিস্তান একটি ব্যর্থ রাষ্ট্র হিসেবে বিবেচিত; সন্ত্রাসী দেশ হিসেবে চিহ্নিত। শুধুমাত্র আমেরিকার মদদ পায় বলে এমন একটি সন্ত্রাসী রাষ্ট্র জাতিসংঘে কথা বলার সুযোগ পাচ্ছে।
বাংলাদেশকে এ বিষয়ে কঠোর হতে হবে। ১৯৭৪ সালের ত্রিপক্ষীয় চুক্তির যে ব্যাখ্যা পাকিস্তান করছে তার পারিষ্কার জবাব দিতে হবে। পাকিস্তান বাংলাদেশের কাছে গুরুত্বপূর্ণ কোনো দেশ নয়। তাই প্রয়োজনে তার সঙ্গে কূটনৈতিক সর্ম্পক ছিন্ন করতে হবে, অথবা সম্পর্ক তৃতীয় সচিব পর্যায়ে আনতে হবে।
পাশাপাশি আমরা যে এখন ২৫ মার্চ কালরাত হিসেবে পালব করছি তা বাদ দিয়ে পাকিস্তানিদের বর্বরতার প্রতিবাদ হিসেবে এ দিনটিকে 'ঘৃণা দিবস' হিসেবে পালন করতে হবে। সেদিন পাকিস্তানিদের প্রতি ঘৃণা প্রদর্শন করা হবে বাংলাদেশের সর্বত্র। পাকিস্তানের এবং সেই সঙ্গে তুরস্কের এমন আচরণ নিয়ে ওআইসিতে প্রশ্ন তুলতে হবে। প্রয়োজনে যেতে হবে জাতিসংঘের মানবাধিকার কমিশনের কাছে, যেখানে পাকিস্তানি যুদ্ধাপরাধীদের বিচার চাইবে বাংলাদেশ।
মোট কথা, দেশের অভ্যন্তরীণ বিষয়ে পাকিস্তান ও তুরস্কের অযথা নাক গলানোর প্রশ্নে বাংলাদেশকে নমনীয় হলে চলবে না।
কয়েকটি পদক্ষেপও জরুরি–
প্রথমত, যেহেতু বোঝা যাচ্ছে যে, ১৯৫ জন যুদ্ধাপরাধীর বিচার পাকিস্তান আর করবে না। তাই বাংলাদেশকে তাদের তালিকা প্রকাশ করে তাদের অনুপস্থিতিতে বিচারকাজ শুরু করতে হবে। এইসব জঘন্য অপরাধীর তালিকা ইন্টারপোলে দিয়ে তাদের ধরিয়ে দেওয়ার জন্যে উদ্যোগ নিতে হবে। সেখানে তারা একাত্তরে কী ধরনের হত্যাকাণ্ড পরিচালনা করেছে তার ফিরিস্তি প্রকাশ করা যেতে পারে। ত্রিশ লক্ষ শহীদের মৃত্যু এবং দুই লক্ষ মা-বোনের সম্ভ্রমহানির জন্যে তাদের হত্যাকারী, ধর্ষক তথা যুদ্ধাপরাধী হিসেবে চিহ্নিত করতে হবে।
দ্বিতীয়ত, বাংলাদেশে যে সব বিহারি আছে এবং যারা পাকিস্তানের পক্ষে আনুগত্য প্রকাশ করেছিল, তাদের ফিরিয়ে নিতে হবে। যদি ফিরিয়ে না নেওয়া হয় তাহলে এ সব পাকিস্তানির ভরণ-পোষণ বাবদ যাবতীয় ব্যয় পাকিস্তানকে বহন করতে হবে।
তৃতীয়ত, পাকিস্তানকে বাংলাদেশের হিস্যা বা প্রাপ্য অর্থ ফেরত দিতে হবে। এ সম্পর্কে বাংলাদেশকে একটি দাবিনামা উপস্থাপন করতে হবে। একটি নির্দিষ্ট সময়সীমা বেঁধে দিতে হবে যে সময়ের মধ্যে তারা বাংলাদেশের দাবি পূরণ করবে। তারা যদি এতে ব্যর্থ হয়, তবে আন্তর্জাতিক আদালতে বিষয়টি তুলে মামলা চালিয়ে যেতে হবে।
চতুর্থত, পাকিস্তানকে সার্কভুক্ত দেশ থেকে বাদ দেওয়ার প্রস্তাব দিতে হবে যদি সে সন্ত্রাসবাদ বন্ধ না করে এবং সন্ত্রাসীদের লালন ও ভরণ-পোষণ থেকে বিরত না হয়।
তুরস্ক কেন বাংলাদেশে মানবতাবিরোধীদের বিচার নিয়ে উৎকণ্ঠিত? তুরস্কে বর্তমানে জামায়াতপন্থী সরকার ক্ষমতায় আছে। পাকিস্তান ও তুরস্ক 'রিজিওনাল কো-অপারেশন ফর ডেভেলপমেন্ট'এর (RCD) সদস্য। তারা সেন্টোভুক্ত দেশ। তুরস্ক গণহত্যার জন্য কুখ্যাত, তুর্কি সরকার ঐতিহাসিকভাবে রক্তে রঞ্জিত হয়েছে। এবারও যখন সেখানে সরকারের বিরুদ্ধে সামরিক অভ্যুত্থান হয়, তখন হাজার হাজার লোককে প্রকাশ্যে হত্যা করা হল। এখন তাদের যুদ্ধ চলছে সিরিয়ার সঙ্গে, প্রতিদিন চলছে হত্যাযজ্ঞ।
এহেন তুর্কি সরকার আবদুল কাদের মোল্লা ও মাওলানা নিজামীর নামে সে দেশে রাস্তার নামাকরণ করেছে। পরে জনগণের প্রতিবাদে তা প্রত্যাহার করতেও বাধ্য হয় তারা।
মনে রাখতে হবে, বিশ্বে খুব কম দেশই স্বাধীনতার জন্যে এত রক্ত দিয়েছে। বাংলাদেশ যেখানে এত মূল্য দিয়েছে, সেখানে নিজেদের অবস্থান স্পষ্ট রেখেই সামনে এগোতে হবে। এর বিকল্প নেই।