পররাষ্ট্রমন্ত্রীর নামে যুক্তরাষ্ট্র সংক্রান্ত যে বক্তব্য আমরা গণমাধ্যমে পড়েছি, তা আসলে দিয়েছিলেন জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক উপাচার্য অধ্যাপক মীজানুর রহমান।
Published : 30 Oct 2022, 07:04 PM
ঢাকার গণমাধ্যমে সম্প্রতি এক আশ্চর্য ঘটনা ঘটে গিয়েছে। ডজনখানেক গণমাধ্যম একজন বক্তার বক্তব্য আরেকজন গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তির নামে চালিয়ে দিয়েছে– এই বিভ্রাটই একটি বড় খবর হওয়ার দাবি রাখে। অবশ্য এসব নিয়ে এখন আর তেমন আলোচনা হয় না, ভুলকে স্পর্শকাতর ভাবার দিন বোধহয় ফুরোচ্ছে। গণমাধ্যমের সংখ্যাগত বিস্ফোরণের যুগে সংবাদ পরিবেশন ও ব্যবস্থাপনায় আমরা এমন সব নজির রেখে ফেলেছি যে, সামনে কেবল অত্যাশ্চর্য ভুলই আমাদের ভাবাতে পারে।
২৬ অক্টোবর জাতীয় প্রেসক্লাবে এক আলোচনায় অতিথি ছিলেন পররাষ্ট্রমন্ত্রী এ কে আব্দুল মোমেন। স্বাভাবিকভাবেই গণমাধ্যমের আগ্রহ রয়েছে তার প্রতি। বৈশ্বিক পরিস্থিতি, বাংলাদেশের বাস্তবতা– সব মিলিয়ে সময়ের একটি জটিল পর্ব পার করছি আমরা। এসবের মধ্যে বেফাঁস বচনও গণমাধ্যমের পররাষ্ট্রমন্ত্রীর পিছু নেওয়া বাড়িয়েছে।
প্রচার মাধ্যমের ‘কড়া নজরের’ মধ্যেও ওইদিন পররাষ্ট্রমন্ত্রীর বরাত দিয়ে এমন সংবাদ চালিয়ে দেওয়া হয়েছে, যার ধারকাছেও তিনি বলেননি মোট ৪১ মিনিটের বক্তব্যে। যুদ্ধ পরিস্থিতি তৈরি করাই যুক্তরাষ্ট্রের কাজ, যুক্তরাষ্ট্র যুদ্ধপ্রিয় দেশ, যুদ্ধ ছাড়া আমেরিকার অর্থনীতি চলবে না, ইউক্রেইন যুদ্ধ বন্ধ হলে তাইওয়ানে যাবে আমেরিকা– এমন সব ঝুঁকিপূর্ণ বক্তব্য পররাষ্ট্রমন্ত্রীর নামে আসছিল; বিশেষ করে টেলিভিশনে।
অবশ্যই যুক্তরাষ্ট্রের মতো শক্তিধর দেশগুলোর অর্থনীতির বড় চালিকাশক্তি অস্ত্র ব্যবসা। মোড়লিপনা ধরে রাখতে শতাব্দীজুড়ে তারা পৃথিবীর কেন্দ্র থেকে প্রান্ত পর্যন্ত বিবাদ, উত্তেজনা জিইয়ে রেখেছে। আর কোটি কোটি ডলারের সমরাস্ত্র প্রতিযোগিতায় প্রাণ যাচ্ছে শত-সহস্র মানুষের; যুদ্ধে, ক্ষুধায়।
এসব চরম সত্য কথা। এটিও সত্য, জাতিসংঘে বাংলাদেশের স্থায়ী প্রতিনিধি হিসেবে কূটনৈতিক দায়িত্ব পালনের পর মন্ত্রিত্ব পেলেও এ কে আব্দুল মোমেন কূটনীতির ধার না ধেরেই বহু কথা বলেছেন। যা নিকট অতীতে বাংলাদেশকে বিব্রত করেছে। এরপরও যুক্তরাষ্ট্রের নাম ধরে এমন স্পর্শকাতর কথা একজন পররাষ্ট্রমন্ত্রী বলবেন কিনা, তা কয়েকবার ভেবে দেখা উচিত। এখানেই সংবাদ কক্ষের দায় ও দায়িত্বের বিষয় থাকে। বিশেষ করে যেখানে বাংলাদেশের মতো দেশগুলোকে মোড়লদের সমঝে চলতে হয়। বৈশ্বিক জ্বালানি সংকট আর অর্থনৈতিক টানাপোড়নে পরিস্থিতি এখন আরও জটিল।
শুধু এই ঘটনাই নয়– এখন হামেশাই প্রচারমাধ্যমে এমন সব বিষয় ধরা পড়ছে, তাতে নির্ভুল সংবাদের স্পর্শকাতরতার বিষয়টি বার্তাকক্ষে গুরুত্ব হারাচ্ছে কিনা ওই প্রশ্ন উঠতে বাধ্য। এক্ষেত্রে আমাদের গণমাধ্যমের সাম্প্রতিক প্রবণতাই সবচেয়ে বড় হয়ে আসবে। যাছাই-বাছাই ছাড়াই দ্রুত সংবাদ দেওয়ার এক ইঁদুর দৌড়ে নেমেছে অধিকাংশ গণমাধ্যম। ঘটনাস্থলে প্রতিবেদক থাকুক বা না থাকুক, বিষয়টি খতিয়ে দেখা হোক বা না হোক– প্রতিযোগিতায় পিছিয়ে পড়া যাবে না।
এই প্রবণতায় ন্যূনতম বিবেচনা ছাড়াই কপি-পেস্ট জার্নালিজম আরও বেড়েছে। বিশেষ করে দৈনিক ঘটনাবলীতে এখন নিউজ চ্যানেল ও কয়েকটি অনলাইন সংবাদপত্রই হয়ে উঠেছে অনেক গণমাধ্যমের সোর্স।
সোশ্যাল মিডিয়ায় এক শ্রেণির অডিয়েন্স তৈরি হয়েছে, যারা নির্দিষ্ট বিষয়ে শুনতে আগ্রহী থাকে। কিছু গণমাধ্যমও যে ভাইরালের ওই ঝোঁক নিজের দিকে টেনে নিতে চায়, তা তাদের কনটেন্ট দেখলেই বোঝা যায়। সেক্ষেত্রে ধর্ম, রাজনীতি, ভারত, ইরান, তুরস্কের মতো যুক্তরাষ্ট্র ইস্যুও গণমাধ্যমের কাছে বিশেষ কিছু।
এসব কিছু মিলিয়েই হয়তো পররাষ্ট্রমন্ত্রী আসলে ঠিক কী বলেছেন, তা যাচাইয়ের প্রয়োজনটুকুও অনুভব করেনি অনেক গণমাধ্যম। ফলে বেশ কিছু টেলিভিশন, নিউজ পোর্টাল (অনলাইন, টেলিভিশন, রেডিও, পত্রিকা) ও পত্রিকা ভুল তথ্যই প্রচার করে দেয়। পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের দ্রুত প্রতিবাদ না এলে হয়তো জল আরও ঘোলা হতো। এরপরও পরদিন যে একাধিক পত্রিকার প্রথম পাতায় ভুল সংবাদটি এসেছে, একে আমরা কোন ধরনের সাংবাদিকতা বলব?
পররাষ্ট্রমন্ত্রীর নামে যুক্তরাষ্ট্র সংক্রান্ত যে বক্তব্য আমরা গণমাধ্যমে পড়েছি, তা আসলে দিয়েছিলেন জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক উপাচার্য অধ্যাপক মীজানুর রহমান। এই দুজনই গণমাধ্যমে এত বাক্য ব্যয় করেছেন যে, আমার ধারণা সচেতন যে কেউ তাদের চেহারা না দেখেও গলার পার্থক্য ধরে ফেলতে পারবেন। এরপরও এরকম ভুল কীভাবে হলো? ঘটনাস্থলে প্রতিনিধি ছিল, এমন একাধিক গণমাধ্যমের ভুল প্রতিবেদনে আরেকটি প্রশ্নও উঠতে বাধ্য। সেটি হচ্ছে, যথাযথ প্রশিক্ষণ ছাড়াই কি তাদের ইভেন্ট কাভার করতে পাঠিয়ে দেয়া হচ্ছে?
এখানেই দেশের গণমাধ্যমে সম্পাদকীয় নীতির দুর্বলতা, স্পষ্ট করে বললে অনুপস্থিতির বিষয়টি ধরা পড়বে। সংবাদ প্রতিবেদন আর ফেইসবুক-টুইটারের পোস্ট যে এক বিষয় নয়, তা যেন আমরা ভুলে যেতে বসেছি। সংবাদ পরিবেশন, সরিয়ে নেওয়া কিংবা সংশোধনের ক্ষেত্রে সম্পাদকীয় প্রক্রিয়া মানার বালাই যেন এখন আর নেই।
পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় তাদের প্রতিবাদে, ভিত্তিহীন সংবাদ প্রকাশ করা গণমাধ্যমগুলোকে ভুল স্বীকার করে দুঃখ প্রকাশসহ সঠিক সংবাদ প্রকাশ করতে বলেছিল। এটি একটি মৌলিক বিষয়, সর্বোচ্চ সতর্কতার পরও ভুল হয়ে গেলে আপনি তার দায় স্বীকার করে নেবেন। সেখানে গণমাধ্যমগুলো সংবাদ সরিয়ে নেওয়ার আগে ন্যূনতম ভুল স্বীকারের প্রয়োজন অনুভব করেনি। আরও দুঃখজনক বিষয় হলো, এখনো অনেক প্রতিষ্ঠানের ইউটিউব ও ওয়েবসাইটে ভুল সংবাদটিই রয়ে গেছে।
এসবের কোনোটিই দায়িত্বশীল আচরণ না। আমাদের গণমাধ্যমে এখন অহরহই এর ব্যত্যয় ঘটছে। আমাদের অপেশাদার আচরণে সাধারণের কাছে গণমাধ্যমের বিশ্বাসযোগ্যতা তলানিতে নেমেছে। ভুল তথ্য দিয়ে বিভ্রান্তি তৈরির চেয়ে নির্ভুল তথ্য দেওয়া জরুরি, কিন্তু কঠিন পথ বেছে নিতে না পারলে– এই নেমে যাওয়ার কোনো তল খুঁজে পাওয়া যাবে না। বিপজ্জনক এই গন্তব্য ঠেকাতে প্রয়োজন দায়িত্বশীল ও বস্তুনিষ্ঠ সাংবাদিকতা।