Published : 01 Apr 2016, 04:35 PM
২৭ মার্চ রবিবার সন্ধ্যায় পাকিস্তানের লাহোরে গুলশান-ই-ইকবাল অ্যামিউজমেন্ট পার্কের কাছে একটি আত্নঘাতী বোমা বিস্ফোরিত হয়। এতে ৬৯ জন নিহত এবং তিনশ জনের মতো আহত হয়। হতাহতের অধিকাংশই শিশু ও নারী। দিনটি ছিল রবিবার এবং ইস্টারের ছুটি হওয়ায় পার্কে ছিল উপচে পড়া ভিড়। বিস্ফোরণের পর ছিন্নভিন্ন দেহগুলি পার্ক জুড়ে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে পড়েছিল। পুলিশ সূত্রের খবর, নিহতের অধিকাংশ খ্রিস্টান ধর্মাবলম্বী।
হামলার দায় স্বীকার করেছে জামাতুল আহারার। এটি তেহরিক-ই-তালেবান (পাকিস্তান) থেকে বের হয়ে যাওয়া নতুন জঙ্গি গোষ্ঠী। হামলার পর এই গোষ্ঠীর মুখপাত্র এহাসানুল এহসান বলেছেন, এই হামলার মধ্য দিয়ে তারা নওয়াজ শরীফের সরকারের কাছে একটি বার্তা দিতে চান। বার্তাটি হল, জামাতুল আহারার ইতোমধ্যে পাঞ্জাবে প্রবেশ করেছে এবং আরও ভয়ানক হামলার আগাম বার্তা হিসেবে গুলশান-ই-ইকবাল পার্কের কাছে আত্নঘাতী বিস্ফোরণটি ঘটিয়েছে।
হামলার পরপরই নওয়াজ শরীফ সরকার এবং সেনাবাহিনীর কর্মকর্তারা দফায় দফায় মিটিং করছেন। সিদ্ধান্ত নেওয়া হল, সেনাবাহিনী এবং প্যারা-মিলিটারির সমন্বয়ে গঠিত বাহিনী পাঞ্জাব জুড়ে জঙ্গিদের ধরতে সাঁড়াশি অভিযান পরিচালনা করবে। আগেও যতবার জঙ্গি হামলা হয়েছে, ততবারই পাকিস্তানের সরকার এবং সেনাবাহিনী খাঁচায় বন্দি বাঘের মতো হুঙ্কার দিয়েছে।
২০১৪ সালের ১৪ ফেব্রুয়ারিতে পেশোয়ারের স্কুলে গণহত্যার পরপরই পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী নওয়াজ শরীফ ১৬ তারিখে সর্বদলীয় সভা আহ্বান করেছিলেন। জঙ্গিবিরোধী অভিযানের সিদ্ধান্তের জন্য খুব সম্ভবত এটাই মনে হয় পাকিস্তানের একমাত্র সর্বদলীয় সভা। পেশোয়ারের শিশু গণহত্যাটি ছিল পাকিস্তানের ইতিহাসে সবচেয়ে পাশবিক ও ভয়াবহ। সেই সভায় নওয়াজ শরীফ ঘোষণা করেছিলেন, পাকিস্তানের মাটি থেকে সন্ত্রাসীদের পরাজিত না করা পর্যন্ত তাদের জঙ্গি অভিযান চলবে। শরীফ জঙ্গিদের নির্মূল করার দৃঢ় প্রত্যয়ও ব্যক্ত করেছিলেন। কিন্তু কিছুদিন পরেই অদৃশ্য কারণে সেই অভিযান নিষ্ক্রিয় হয়ে পড়ে।
যাহোক, সেই সর্বদলীয় সভায় একমাত্র জামায়াতে ইসলামী, পাকিস্তান ছাড়া সকল রাজনৈতিক দল সর্বসম্মতিক্রমে জঙ্গিবাদ নির্মূল করার জন্য একটি কাউন্টার টেরিরিজম পরিকল্পনা গ্রহণ করেছিল। এই পরিকল্পনার মূল দায়িত্বে ছিলেন সামরিক ও আধা-সামরিক গোয়েন্দা সংস্থার কর্মকর্তারা।
লাহোর কিংবা পেশোয়ারের মতো ঘটনা যখনই ঘটে তখনই পাকিস্তান ঘিরে বেশ কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন বিশ্বের সামনে চলে আসে। বিশেষ করে দেশটির সামাজিক নিরাপত্তা ব্যবস্থা, গোয়েন্দা সংস্থাগুলির ব্যর্থতা, জঙ্গি গোষ্ঠীর সক্ষমতা এবং জঙ্গি গোষ্ঠীগুলিকে রাজনৈতিক সমর্থন দেওয়ার বিষয়গুলি আলোচনায় স্থান পায়।
অতীতের জঙ্গিবিরোধী পদক্ষেপ এবং ফলাফলের বিশ্লেষণ সাপেক্ষে লাহোরের ঘটনার পর পাকিস্তানের সমাজ জঙ্গিবিরোধী অভিযান কতদিন পরিচালনা করতে পারবে সে বিষয়ে জোর সংশয় রয়েছে। আগেও যতবার অভিযান পরিচালনা করা হয়েছিল ততবারই কিছুদিন যাওয়ার পর অভিযান থেমে যায়। বন্ধ হযে যায় দফায় দফায় মিটিং। আবার যখনই বড় ধরনের হামলার ফলে সারা বিশ্বে আলোড়ন সৃষ্টি হয় তখন মিটিং ডাকা হয় এবং জঙ্গি নির্মূল না হওয়া পর্যন্ত কঠোর অভিযান চলবে বলে হুঙ্কার ছাড়া হয়।
তেহরিক–ই-তালেবান, পাকিস্তানের (টিটিপি) জঙ্গিদের দ্বারা পেশোয়ারের শিশু গণহত্যার জবাবে পাকিস্তান সরকার, সেনাবাহিনী, রাজনৈতিক দল ও সুশীল সমাজের প্রতিনিধিরা চলমান জঙ্গিবিরোধী অভিযান জোরদারের পক্ষে ছিলেন। কিন্তু দৃশ্যত সেটি মনে হলেও ভিতরে ভিতরে ছিল বহু কুটিল সমীকরণ। লাহোরের বিস্ফোরণের পর একই সব সমীকরণ পাকিস্তানের সমাজে কাজ করছে। ফলে অভিযানের সফলতার সম্ভাবনা সকল প্যারামিটারে শূন্য। সেই সকল সমীকরণ প্রধানত দুটি বিভাজিত অংশের রাজনৈতিক আকাঙ্ক্ষা এবং উদ্দেশ্যের প্রতিফলন। দেশটির প্রধানমন্ত্রী নওয়াজ শরীফের মতো মধ্য-ডানপন্থী ও উদার শক্তি বনাম উগ্রবাদ-বান্ধব ও উগ্রবাদী শক্তির টানাপড়েনে স্পষ্ট হয়ে ওঠে।
পেশোয়ারের হামলার পর ইসলামাবাদের লাল মসজিদের প্রধান ইমাম মাওলানা আবদুল আজিজ ১৯ ডিসেম্বর শুত্রুবার জুমার নামাজের সময় বক্তৃতায় তালেবান-বিরোধী অভিযান 'অনৈসলামিক' বলে রায় দেন। পেশোয়ারে ডাকা নওয়াজ শরীফের সর্বদলীয় মিটিংএ জামায়াতে ইসলামী (পাকিস্তান) তেহরিক–ই-তালেবান (পাকিস্তান) বা টিটিপির বিরুদ্ধে অভিযানের বিপক্ষে মত দিয়েছিল। এমনকি জামায়াতে ইসলামী তেহরিক–ই-তালেবানের সঙ্গে আলোচনার মাধ্যমে সমস্যার সমাধান করার জন্য তাগিদ দিয়েছিল।
ওদিকে সাবেক ক্রিকেটার ইমরান খানের দল, তেহরিক-ই-ইনসাফ (পাকিস্তান) অভিযানের পক্ষে মত দিয়েছিল। কিন্তু কদিন পরই জামায়াতের চাপে দলটি জঙ্গিবিরোধী অবস্থান থেকে সরে যায়। নানাভাবে জঙ্গিবান্ধব বহু কর্মসূচিতে নৈতিক ও রাজনৈতিক কৌশলী সমর্থন দিতে দলটি বাধ্য হয়।
দেশটির অভ্যন্তরীন ক্ষমতার রাজনীতির পাশাপাশি আন্তর্জাতিক রাজনীতির কারণেও ধর্মীয় জঙ্গিদের নির্মূলের সম্ভাবনায় বড় ধরনের সংশয় রয়েছে। পাকিস্তানের সামাজিক ও ধর্মীয় বাস্তবতাও জঙ্গি গোষ্ঠীগুলিকে নির্মূল করার সহায়ক শক্তি হিসেবে কাজ করে না। এখনও জঙ্গি গোষ্ঠীগুলি দেশের রাজনৈতিক দল ও সেনাবাহিনীর নৈতিক ও বুদ্ধিবৃত্তিক সমর্থন পেয়ে যাচ্ছে।
লাহোরের পার্কটিতে আত্নঘাতী বিস্ফোরণের সময় কোনো ধরনের নিরাপত্তা ছিল না। রবিবার এবং ইস্টারের বন্ধ থাকায় অভিজাত পার্কটিতে ছিল উপচে পড়া ভিড়। ফলে কেন নিরাপত্তা দেওয়া হয়নি সেখানে, এটি একটি বড় প্রশ্ন হয়ে দেখা দিয়েছে। পেশোয়ারের স্কুলে হামলার সময়ও একই প্রশ্ন উত্থাপিত হয়েছিল। মাত্র সাতজন টিটিপি (তেহরিক-ই-তালেবান, পাকিস্তান) জঙ্গি কীভাবে সেনাবাহিনীর সকল নিরাপত্তা বেষ্টনী ভেদ করে ক্যান্টনমেন্ট এলাকাতে সেনাবাহিনীরই পরিচালিত একটি স্কুলে হামলা করতে পারে? কীভাবে বোমা এবং স্নাইপার রাইফেলসহ নিরাপত্তা চৌকিগুলি অতিক্রম করে স্কুলে আক্রমণ করল তারা? স্কুলের পরীক্ষার সময়সূচি জঙ্গিরা কীভাবে জানল, সেটিও একটি রহস্যের বিষয় ছিল।
সেনাবাহিনীর ভিতরকার সহযোগিতা ছাড়া কি এটি সম্ভব? গণমাধ্যমে এ তথ্যও প্রকাশিত হয়েছিল যে, গোয়েন্দারা আগেই নাকি জঙ্গি হামলার বিষয়টি আঁচ করতে পেরেছিলেন। কিন্তু সেনাবাহিনী দ্বারা পরিচালিত স্কুলে গিয়ে জঙ্গিরা এই ধরনের ভয়াবহ গণহত্যা পরিচালনা করতে পারে, তা তারা ভাবতেই পারেননি। যে প্রশ্নের উত্তর পাকিস্তানের সমাজ আজও পায়নি তা হল, 'এটি কি গোয়েন্দাদের ইচ্ছাকৃত ব্যর্থতা, নাকি অনিচ্ছাকৃত?'
পাকিস্তান এবং আফগানিস্তান-ভিত্তিক জঙ্গি গোষ্ঠীগুলির অপারেশনাল সক্ষমতা পাকিস্তানি গোয়েন্দা সংস্থাগুলির চেয়ে অন্য কোনো দেশের গোয়েন্দা সংস্থার ভালো জানবার কথা নয়। ২০১৪ সালের ৯ জুন তেহরিক–ই-তালেবানের (পাকিস্তান) জঙ্গিরা করাচীর জিন্নাহ আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে হামলা করে তাদের সক্ষমতার জানান দিয়েছিল। তারা বিমান বন্দরটি কয়েক ঘণ্টার জন্য দখল করে নেয়। জঙ্গিদের সঙ্গে কয়েক ঘণ্টার বন্দুক যুদ্ধের পর দেশটির সেনাবাহিনী বিমান বন্দর পুরনদ্ধার করতে সমর্থ হয়। এতে দশ জঙ্গিসহ আটাশ জন নিহত হয়।
২০১২ সালের ১৬ আগস্ট তেহরিক–ই-তালেবান রাজধানী ইসলামাবাদ থেকে ৪৫ মাইল দূরে উত্তর-পশ্চিম দিকে কামরাতে মিনহাজ সামরিক ঘাঁটিতে হামলা চালায়। এই ঘাঁটিতে পাকিস্তানের পারমানবিক অস্ত্রের একটি বড় মজুত রয়েছে। হামলায় নয় জঙ্গি এবং একজন সেনা সদস্য নিহত হয়।
২০০৭ সালের ডিসেম্বরে এবং ২০০৯ সালের আগস্টেও পাকিস্তানের বিভিন্ন সেনা ঘাঁটিতে হামলা চালিয়েছে তেহরিক–ই-তালেবান। ২০১১ সালে করাচীতে একটি নৌ ঘাঁটিতে হামলা চালিয়ে দশ জনকে হত্যা এবং দুটি মার্কিন গোয়েন্দা বিমান ধ্বংস করেছিল ওরা।
পাকিস্তান ও আফগানিস্তান-ভিত্তিক জঙ্গি গোষ্ঠীগুলির অপারেশনাল সক্ষমতা এবং হামলার ভয়াবহতা সম্পর্কে পাকিস্তানের গোয়েন্দা সংস্থাগুলি ভালো জানে। পাকিস্তান সেনাবাহিনীর ভিতরের একটি অংশ জঙ্গিদের হয়ে কাজ করছে বলেই সামরিক এবং নিরাপত্তা বিশেষজ্ঞদের বিশ্বাস। বিশেষ করে ওসামা বিন লাদেন পাকিস্তানের একটি সামরিক আবাসিক এলাকাতে বছরের পর বছর নিরাপদে বসবাস করার পর সেই বিশ্বাস আরও দৃঢ় হয়।
এই জঙ্গি গোষ্ঠীগুলি আন্তর্জাতিক ভূরাজনৈতিক মেরুকরণেও গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখছে। আফগান-সোভিয়েত যুদ্ধে সোভিয়েতের পরাজয়ের পিছনে মুজাহিদিনের ভূমিকা আফগানিস্তান ও পাকিস্তানের সমাজ ও রাষ্ট্রে স্বীকৃত। তাদের অবদান উপেক্ষা করার উপায় নেই। সোভিয়েতের পরাজয়ের পর পরই জম্মু-কাশ্মীরে ভারতবিরোধী কর্মকাণ্ডে পাকিস্তানের শাসক গোষ্ঠী মুজাহিদীনদের কৌশলগত শক্তি হিসেবে ব্যবহার শুরু করে।
পাকিস্তানের সাবেক সামরিক শাসক পারভেজ মোশারফ গণমাধ্যমে প্রকাশেই বলেছেন যে, জঙ্গি গোষ্ঠীগুলি পাকিস্তানের কৌশলগত সম্পদ। ভারতে ২০০৮ সালের ২৬/১১ মুম্বাই হামলার মাস্টার মাইন্ড লস্কর-ই-তৈয়বার প্রধান হাফেজ সাইদকে ক্লিন চিট দিয়েছে পাকিস্তানি আদালত। সাইদকে সেনাবাহিনীর সঙ্গে পাকিস্তানের ২০১৪ সালের বন্যার সময় দুর্গত এলাকায় ত্রাণসামগ্রী বিতরণ করতে দেখা গেছে। ভারতে নিয়োজিত পাকিস্তানি হাইকমিশনার আবদুর বাসিত প্রকাশ্যেই স্বীকার করেছিলেন যে, হাফেজ সাইদ মুক্ত। তিনি পাকিস্তানের যে কোনো জায়গায় যেতে পারবেন। পাকিস্তানের অনেক প্রভাবশালী কূটনৈতিক ব্যক্তিত্বও টাইমস নাউএর নিউজ আওয়ার ডিবেটে সাইদকে পাকিস্তানের 'জাতীয় বীর' আখ্যা দেন।
অথচ এই সাইদ আমেরিকা এবং জাতিসংঘের মোস্ট ওয়ান্টেড তালিকার প্রথম দিকে। তাকে ধরার জন্য পুরস্কার ঘোষণাও করা হয়েছে। পেশোয়ারে শিশু গণহত্যার পরপরই হাফেজ সাইদ দাবি করলেন, পেশোয়ারের শিশু গণহত্যার জন্য ভারতের প্রধানমন্ত্রী দায়ী। এটি ভারতীয়দের ষড়যন্ত্র। সাইদের সুরে সুর মিলিয়ে পারভেজ মোশারফও পেশোয়ারের গণহত্যার জন্য ভারতকে দায়ী করেছিলেন।
পাকিস্তান-শাসিত কাশ্মীরের জামাত-উদ-দাওয়াসহ বহু জঙ্গি সংগঠন দীর্ঘ দিন যাবত পাকিস্তানের সেনাবাহিনীর সমর্থন পেয়ে আসছে। জামাত-উদ-দাওয়া আমেরিকা এবং জাতিসংঘ দ্বারা নিষিদ্ধ হলেও পাকিস্তানে তাদের কর্মকাণ্ড স্বাভাবিকভাবেই পরিচালিত হচ্ছে। জামাত-উদ-দাওয়ার মতো সংগঠনগুলির উদ্দেশ্য ভারত-শাসিত জম্মু-কাশ্মীরে অনুপ্রবেশ করে জঙ্গি হামলা পরিচালনা করা।
আন্তর্জাতিক বিশ্বও বিশ্বাস করে যে, পাকিস্তানের অভ্যন্তরে থাকা জঙ্গি গোষ্ঠীগুলিকে পাকিস্তান ভারতের স্বার্থের বিরুদ্ধে কৌশলগতভাবে দশকের পর দশক ব্যবহার করে আসছে। জঙ্গি গোষ্ঠীগুলি পাকিস্তানের পররাষ্ট্রনীতির অপরিহার্য অংশ হয়ে গেছে।
পাকিস্তানের মাটিতে শতাধিক জঙ্গি গোষ্ঠী রয়েছে। উদ্দেশ্য এবং সক্ষমতা অনুসারে তাদেরকে দুভাগে ভাগ করা যায়: দেশীয় জঙ্গি গ্রুপ এবং বহুজাতিক জঙ্গি গ্রুপ। অপারেশনাল সক্ষমতার দিক দিয়ে বারটি দেশীয় জঙ্গি সংগঠনের অবস্থান প্রায় একই। তবে প্রচার-প্রচারণার দিক দিয়ে দিয়ে তেহরিক-ই-তালেবান, পাকিস্তান (টিটিপি), লস্কর-ই-ওমর (লিইও) এবং শিপ-এ-সাহাবা, পাকিস্তান (এসএসপি) প্রথম দিকে রয়েছে।
টিটিপি পাকিস্তানের দেশীয় জঙ্গি গোষ্ঠীর মধ্যে সবচেয়ে ভয়ঙ্কর। টিটিপির উদ্দেশ্য হল, পাকিস্তানে শরিয়া শাসন কায়েম করা। পাহাড়ি উপজাতি এলাকার সাধারণ মানুষকে শরিয়া শাসনের দাবিতে এক করা এবং দেশটির সামরিক বাহিনী ও ন্যাটোর বিভিন্ন স্থাপনা উচ্ছেদের জন্য চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে তারা। যেহেতু এই সকল দেশীয় সংগঠন পাকিস্তানের অভ্যন্তরীন নিরাপত্তা ও শান্তির জন্য হুমকি, তাই পাকিস্তানের নীতিনির্ধারকরা এই সংগঠনগুলিকে 'ব্যাড তালেবান' বলে আখ্যায়িত করে থাকেন।
অন্যদিকে, বত্রিশটি বহুজাতিক জঙ্গি সংগঠন পাকিস্তানের মাটিতে রয়েছে। পাকিস্তানের অভ্যন্তরে থেকে এই সংগঠনগুলি দেশের বাইরে বড় ধরনের জঙ্গি কর্মকাণ্ড পরিচালনা আসছে। এদের অধিকাংশই ভারতের স্বার্থের বিপক্ষে কর্মকাণ্ড পরিচালনা করে। সবচেয়ে ভয়ানক জঙ্গি সংগঠনগুলি হল, লস্কর-ই–তৈয়বা (এলটি), জয়শে-মুহাম্মদ, মুজাহিদিন-ই-তানজিম এবং হাক্কানি নেটওয়ার্ক।
উল্লেখ্য, লস্কর-ই–তৈয়বা (এলটি) জামাত-উদ-দাওয়া (জেডি) নামেই বেশি পরিচিত। এসব বহুজাতিক জঙ্গি সংগঠনগুলি পাকিস্তানের ভূরাজনৈতিক সুবিধা-বান্ধব হওয়ায় তাদেরকে পাকিস্তানের কর্ণধাররা 'গুড তালেবান' হিসেবে স্বীকৃতি দিয়ে থাকেন। পাকিস্তানের শাসক শ্রেণি এই সব জঙ্গি সংগঠনকে ভারতের বিরুদ্ধে যেমন ব্যবহার করছেন, একই সঙ্গে জঙ্গি দমনের নামে আমেরিকার কাছ থেকে বিলিয়ন বিলিয়ন ডলারও নিয়েছেন।
বিশ্বসম্প্রদায় দক্ষিণ এশিয়ায় জঙ্গি গোষ্ঠীর উপর আগের মতো নজর দিচ্ছে না। কারণ আইএসের উত্থানের ফলে বিশ্বের দৃষ্টি এখন ইসলামিক স্টেস্টের দিকে। আমেরিকা পাকিস্তানের জঙ্গি গোষ্ঠীগুলিকে মোকাবেলায় পাকিস্তান-আফগান সীমান্ত এলাকাতে আফগানিস্তান থেকে নির্দিষ্ট টার্গেট লক্ষ্য করে ড্রোন হামলা চালিয়ে যাচ্ছে। জঙ্গিবিরোধী অভিযানে পাকিস্তান এবং আমেরিকার মধ্যে কোনো ধরনের সমন্বয় নেই। আমেরিকা তার সেনাবাহিনীকে আফগানিস্তান থেকে সরিয়ে নিচ্ছে। মার্কিন প্রশাসন জানে, পাকিস্তানের সহায়তা ছাড়া আফগানিস্তানে নিরাপত্তা নিশ্চিত করা সম্ভব নয়।
এ অবস্থায়, জঙ্গিবিরোধী অভিযানের জন্য আমেরিকা পাকিস্তানকে খুব একটা চাপ প্রয়োগ করতে পারছে না। ওসামা বিন লাদেনকে হত্যার পর উপরের স্তরের কিছু জঙ্গি নেতাদের ড্রোন হামলা চালিয়ে হত্যা ছাড়া আমেরিকাকে পাকিস্তানে জঙ্গিবিরোধী অভিযানে তেমন সহযোগিতা করতেও দেখা যায়নি।
চীন দেশটির শিনজিয়াং প্রদেশের ধর্মীয় জঙ্গি গোষ্ঠীর রাজনীতি নিয়ে বেশ চিন্তিত হলেও জঙ্গিদের সক্ষমতা সরকারের নিয়ন্ত্রণের বাইরে যায়নি। দেশটির নিরাপত্তা বাহিনী বেশ কঠোর হাতেই জঙ্গিদের দমন করছে। চীন সরকার যে কোনো সময় নিয়ন্ত্রণ করার ক্ষমতাও রাখে। বরং পাকিস্তানে জঙ্গিদের সক্ষমতা কাজে লাগিয়ে যদি ভারতকে নিরাপত্তা ইস্যুতে ব্যস্ত রাখা যায় তা এই অঞ্চলে চীনের প্রভাব বৃদ্ধির জন্য সহায়ক হবে।
উল্লেখ্য, বেলুচিস্তানে পাকিস্তান এবং চীনের স্বার্থের পরিপন্থী কর্মকাণ্ডে ভারতীয় গোয়েন্দাদের উস্কানি রয়েছে বলে চীন ও পাকিস্তানের গোয়েন্দারা দীর্ঘ দিন ধরেই দাবি করে আসছেন।
পাকিস্তান নামক রাষ্ট্রটি চরম ইমেজ সংকটে পড়ছে। ভারতের বিরুদ্ধে আন্তর্জাতিক কোনো ফোরামে জম্মু-কাশ্মীর ইস্যুতে গ্রহণযোগ্যতা পাওয়ার সম্ভাবনা পাকিস্তানের আর নেই বললেই চলে। জাতিসংঘের প্রতি বছরের সাধারণ পরিষদে দেশের সেনাবাহিনীর চাপে নওয়াজ শরীফ জম্মু-কাশ্মীর ইস্যুটি উত্থাপন করলেও অতীতের মতোই বিশ্বনেতারা বিষয়টি এড়িয়ে যাচ্ছেন। একমাত্র জম্মু-কাশ্মীরে প্রক্সি-ওয়ার ছাড়া যে বিশ্ববাসীর মনোযোগ আকর্ষণ সম্ভব নয় তা পাকিস্তানের ভারতবিরোধী গোষ্ঠীটি বুঝে গেছে। জঙ্গি গোষ্ঠী দিয়ে হামলা চালিয়ে বিশ্বের দৃষ্টি আকর্ষণ ছাড়া জম্মু-কাশ্মীর নিয়ে পাকিস্তানের তেমন কিছুই করার নেই।
পাকিস্তানের অভ্যন্তরীন রাজনীতিও এখন অনেকটা জঙ্গি-নির্ভর। ২০১৩ সালের জাতীয় নির্বাচনে পাকিস্তান পিপলস পার্টি (পিপিপি) জঙ্গিদের টার্গেটে পরিণত হয়। দলটি কোথাও নিরাপত্তার কারণে সমাবেশ করতে পারেনি। অন্যদিকে নওয়াজ শরীফের মুসলিম লীগ নিরাপত্তার ঝুঁকি ছাড়াই দেশব্যাপী সমাবেশ করেছে। খাইবার পাখতুনখোয়া প্রদেশে উপজাতি গোষ্ঠী, জঙ্গি গোষ্ঠী এবং জামায়াতে ইসলামী, পাকিস্তানের সমর্থনে ইমরান খানের নেতৃত্বে পাকিস্তানের তেহরিক-ইনসাফ ২৯টি আসনে জয় লাভ করে তৃতীয় বৃহত্তম রাজনৈতিক দল হিসেবে উঠে আসে।
প্রসঙ্গত, ২০০৯ সালের জাতীয় নির্বাচনে পাকিস্তানের তেহরিক-ইনসাফ একটি আসনেও জয়লাভ করতে পারেনি।
ইমরান খানের বিরুদ্ধে জঙ্গি গোষ্ঠীগুলিকে সমর্থন দেওয়ার অভিযোগ বহু আগে থেকেই রয়েছে। জিন্নাহ আন্তর্জাতিক বিমান বন্দরে জঙ্গি হামলার পর সরকার নওয়াজ শরীফ জঙ্গি নির্মূলে অভিযান পরিচালনা করার পরপরই ইমরান খান এবং কানাডা থেকে আমদানিকৃত তাহিরি কাদেরির নেতৃত্বে নওয়াজ শরীফ সরকারের পতনের দাবিতে মাত্র আঠার-বিশ হাজার কর্মী সারা পাকিস্তান অচল করে দিয়েছিল। সেনাবাহিনীর একটি শক্তিশালী অংশের মদদে ইমরান খান এবং তাহিরি কাদেরির নির্দেশনায় সরকারবিরোধী নাটকটি মঞ্চায়ন হয়েছিল। তখন নওয়াজ শরীফ বহু দেন-দরবার করে তার চাকরি টিকিয়ে রেখেছিলেন। সেই আন্দোলনের পিছনে মূল উদ্দেশ্য ছিল জঙ্গিবিরোধী অভিযান প্রতিহত করা।
পাকিস্তানের সাধারণ জনগণ এখনও 'ধর্ম ধর্ম' বলে মাতম করে। সমাজের সকল স্তরে ধর্ম এখন রাজনৈতিক অস্ত্র। রাজনৈতিক নেতৃত্ব নিজেদের স্বার্থের জন্য ব্লাসফেমি আইনের মতো বিতর্কিত আইন সমাজ ব্যবস্থায় চাপিয়ে দিয়েছে। জিহাদের নামে অর্থ সংগ্রহের জন্য জাতীয় দৈনিকগুলিতে রাষ্ট্রের বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান বিজ্ঞাপন দেওয়ার ইতিহাস বহুদিনের।
ক্ষমতা রক্ষার জন্য প্রতিটি সামরিক সরকার এবং বেসামরিক সরকার সস্তা ভারত-বিরোধিতা করে সাধারণ মানুষকে ভারত-ফোরিয়াতে আক্রান্ত করেছে। অমুসলিম সম্প্রদায়ের প্রতি রাষ্ট্রের বিরাগভাজনপূর্ণ মনোভাব পাকিস্তানি সমাজ কাঠামোতে বিষের মতো ছোবল মেরেছে। কথায় কথায় ভিন্ন বিশ্বাসী ও অমুসলিমদেরকে ব্লাসফেমির মতো আইনে ফাঁসিয়ে দেওয়া হচ্ছে। এই আইনের বিরোধিতা করায় ২০১১ সালে সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের প্রাদেশিক মন্ত্রী শাহবাজ ভাট্টিকে গুলি করে হত্যা করে তেহরিক-ই-তালেবান, পাকিস্তান। এখনও শত শত মানুষকে এই কালো আইনে বিচার করা হচ্ছে।
ধর্মীয় কুসংস্কার এবং উগ্রতা, রাজনৈতিক ইসলামের প্রাধান্য, দলগুলির জঙ্গি-বান্ধব নীতি, ভারতবিরোধী কর্মকাণ্ডে ধর্মীয় জঙ্গিদেরকে এন্ডোর্স করা এবং বিশ্ব মোড়লের দাবার গুটি হয়ে উগ্রপন্থী নীতি জিইয়ে রেখে পাকিস্তান থেকে ধর্মীয় জঙ্গিদের নির্মূল করা খুব কঠিন। তাহলে পেশোয়ার ও লাহোরের মতো ভবিষ্যতে পাকিস্তানকে আরও বড় ধরনের মূল্য দিতে হতে পারে।