Published : 24 Mar 2016, 02:11 PM
দোষটা তনুর বাবা মায়ের। কেন জন্মের পর পরই তাকে হত্যা করে ফেলে দেওয়া হয়নি ডাস্টবিনে? আর যদি বা তাকে বাঁচিয়ে রাখা হল, তাহলে কেন তাকে বন্দি করে রাখা হয়নি ঘরের ভিতর? আমাদের দেশে, আমাদের নষ্ট সমাজে একটি মেয়ে জন্ম নিবে, বেড়ে উঠবে, লেখাপড়া শিখবে, নিজে উপার্জন করবে আবার সংস্কৃতিকর্মীও হবে এত বাড় তো সহ্য করা মুশকিল! চাইলেই তাকে ধর্ষণ করা যায়, তাকে হত্যা করা যায় ভয়ংকরভাবে। আর যদি তা না করা হয় তাহলে বুঝতে হবে ধর্ষণ বা হত্যার সময় ছিল না, হাতে অন্য কাজ ছিল কিংবা ইচ্ছা হয়নি। নারীর জীবন এখন পিশাচদের ইচ্ছাধীন!
আবার অনেক সময় ধর্ষণের দায় মেয়েটির উপর চাপিয়ে দিয়ে বলা হয় তার পোশাক নাকি 'যথেষ্ট শালীন' ছিল না। মেয়েদের পোশাক ও চলাফেরার কারণেই নাকি ধর্ষণকারীরা উৎসাহিত হয়| নারীর পোশাক নিয়ে যারা মুখে ফেনা তোলে এবং কৌশলে ধর্ষণের দায় নারীর উপরেই চাপিয়ে দিতে তৎপর হয় তারা এবার নীরব কেন বুঝতে পারছি না। অবশ্য এদেশে এক বছর বয়সী শিশুও ধর্ষণ ও হত্যার শিকার হয়েছে। তনুর মতো হিজাব-পরা তরুণীও রেহাই পায়নি। রেহাই পায়নি মাদ্রাসা ছাত্রীরাও।
হয়তো বলা হবে, তনু কেন চার দেয়ালের ভিতর বন্দি থাকেনি; কেন সে টিউশনি করে নিজের পড়ার খরচ চালাত; কেন সে ভিক্টোরিয়া কলেজে লেখাপড়া করত। বলাও হচ্ছে, কেন সে সংস্কৃতিকর্মী হয়েছিল সে নিয়ে কথা!
নারীর জন্ম তো এসব করার জন্য নয়। নারী ঘরের ভিতর গৃহস্থালি কাজ করবে। তার জন্ম হয়েছে পুরুষকে তৃপ্তি দেওয়ার জন্য। তার চেহারা যেন কেউ না দেখে, তার কণ্ঠও যেন কেউ না শোনে। সবচেয়ে ভালো হত বিশ্বে সে না জন্মালে। নারী নামক প্রাণিটি জীবজগতে না থাকলে সবচেয়ে সুবিধা হত। কিন্তু তাতে মানবজাতির টিকে থাকা সম্ভব হত না বলে নারীকে বাধ্য হয়ে জন্ম নিতে হয়। কিন্তু সে আবার বড় হতে চাইবে, লেখাপড়া শিখতে চাইবে, নিজে উপার্জন করতে চাইবে এ তো বিষম আবদার। সে যদি ধর্ষণের শিকার হয়, তাকে যদি হত্যা করা হয় তাহলে দায় তো তারই।
যারা হত্যা করছে তাদের বরং আড়াল করা হবে, তাদের আশ্রয় দেওয়া হবে, তাদের পেলে-পুষে রাখা হবে যাতে তারা ভবিষ্যতে আবার এমন সুকর্ম করতে পারে!
প্রশ্ন হল, ঘরের ভিতর বন্দি থাকলেই কি তনু নিরাপদে থাকত? আফগানিস্তানে তালেবানি আমলে যে নারীরা ঘরের ভিতর থাকত তারাও তো ধর্ষণ থেকে রেহাই পায়নি। আমাদের মুক্তিযুদ্ধের সময় নারীরা ঘরের ভিতর লুকিয়ে থেকেও কি বাঁচতে পেরেছে? ২০০০ সালে নির্বাচনের পরও ঘরের ভিতর ঢুকে তাদের নির্যাতন করা হয়নি? পুলিশের দ্বারা খুন হয়নি ইয়াসমিন? পুলিশ কাস্টডিতে থানার ভিতর খুন হয়নি সীমা চৌধুরী? নিজস্ব প্রাসাদের ভিতর, নিজের ঘরে ধর্ষণ ও খুন করা হয়নি শাজনীনকে? আদালত প্রাঙ্গণে ধর্ষণ করা হয়নি পাঁচ বছরের শিশুকে?
তনুও তো খুন হল কুমিল্লা সেনানিবাসের নিরাপদ পরিবেশের ভিতরেই। পহেলা বৈশাখে শত শত মানুষের চোখের সামনেই তো নিপীড়ন চালানো হয়েছে নারীর উপর। এদেশে তাহলে কোথায় নারী নিরাপদ? কোন নারী নিরাপদ? কোটিপতির কন্যা থেকে শুরু করে চতুর্থ শ্রেণির কর্মচারীর কন্যা– ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীর নারী, সংখ্যালঘু নারী থেকে শুরু করে হিজাব-পরিহিত মুসলিম নারী– ছিন্নমূল পথবাসী থেকে গৃহবাসী নারী– পাঁচ বছরের শিশু থেকে পাঁচ সন্তানের জননী পর্যন্ত কেউ কোথাও নিরাপদ নয়।
দেশে কোনো ধর্ষণের ঘটনা নিয়ে আলোচনা ও প্রতিবাদ চললে তাৎক্ষণিকভাবে আরেকটি কথা বলা হয়। বলা হয়, উন্নত বিশ্বেও তো ধর্ষণের ও নিপীড়নের ঘটনা ঘটে। হ্যাঁ, ঘটে। জার্মানির মতো দেশে নববর্ষের রাতেও ঘটে। আমেরিকাতে ঘটে, ইউরোপেও। কিন্তু সেখানে অপরাধটি কঠোরভাবেই দেখা হয়, গুরুতর হিসেবেই তাকে বিবেচনা করা হয়। অপরাধীকে আড়াল করার, অপরাধটি জায়েজ করার, 'বিচ্ছিন্ন ঘটনা' বলে অভিহিত করার বা তাকে স্বল্প গুরুত্ব দেওয়ার প্রবণতা থাকে না। পার্থক্য এখানেই।
আমাদের দেশে যদি নারী নির্যাতনের প্রতিটি ঘটনার কঠোর বিচার নিশ্চিত হত তাহলে এমন ঘটনা ঘটাবার আগে অপরাধীরা দশবার ভাবত। এর আগে রাজধানীতে মাইক্রোবাসের ভিতর গারো তরুণী ধর্ষণের ঘটনা ঘটেছে। আরও অনেক ধর্ষণ ও হত্যার ঘটনা ঘটেছে ঢাকাসহ সারা দেশে। ঘটছে প্রতিনিয়তই।
এর আগের ঘটনাগুলোর যদি দ্রুত বিচার হত, অপরাধীদের চিহ্নিত করা যেত, তাদের কঠোর শাস্তি প্রদান করা যেত তাহলে সাম্প্রতিক বীভৎস ঘটনাটি হয়তো ঘটত না। কোনো অপরাধ করে যখন মানুষ পার পেয়ে যায় তখন আরও অনেক অপরাধীর জন্ম হয়। কারণ সম্ভাব্য অপরাধীরা দেখে 'কই কিছুই তো হল না'। তারা নতুন নতুন অপরাধ করতে উৎসাহিত হয়। আজ যদি তনুর খুনি ও ধর্ষকরা রেহাই পায় তাহলে নিঃসন্দেহে দেশে আরও অনেক ধর্ষণের ঘটনা ঘটবে, আরও অনেক অপরাধীর জন্ম হবে। আর পুলিশ প্রশাসন যদি বিষযটি ধামাচাপা দিতে চায় তাহলে তো অপরাধীদের আরও পোয়াবারো।
আরও একটি বিষয বুঝতে হবে। 'বিকৃত পুরুষতন্ত্র' কিন্তু শুধু নারীর উপর নয়, পুরুষের উপরও আঘাত হানে। জেন্ডার বৈষম্যজনিত অপরাধ যখন লঘুভাবে দেখা হয় তখন সেই অপরাধের শিকার নারীর পরিবার, তার পুরুষ আত্মীয়, তার সহপাঠী, সহকর্মী নারী-পুরুষ সকলেই আঘাতপ্রাপ্ত হয়। তনু হত্যার কারণে তার পরিবার ও চারপাশের আপন মানুষরা কিন্তু আর কখনও স্বাভাবিক, নিশ্চিন্ত জীবন যাপন করতে পারবে না। দুঃস্বপ্ন, ভয়াবহতা, বেদনা তাদের তাড়া করবে চিরকাল।
ধর্ষণ ও খুন এমন অপরাধ যার পক্ষে একটি যুক্তিও কোনো সুস্থ মানুষের পক্ষে দেওয়া সম্ভব নয়। মানসিকভাবে অসুস্থ কতিপয় ব্যক্তি যারা সুযোগ পেলে অপরাধী হয়ে উঠতে পারে তারাই একমাত্র এ ধরনের অপরাধ মনে মনে সমর্থন করে এবং একে লঘুভাবে দেখে। ধর্ষণের মতো গুরুতর অপরাধের বিরুদ্ধে সমাজের সব স্তরের, সব শ্রেণি-পেশা, দল-মতের মানুষের, নারী-পুরুষ সম্মিলিতভাবে ঐক্যবদ্ধ হওয়া প্রয়োজন। এ ধরণের গুরুতর অপরাধের বিরুদ্ধে 'জিরো টলারেন্স' থাকতে হবে সবার মধ্যে।
আর এ কথা তো ঠিক যে, যেখানে পুরুষতন্ত্রের বিকৃত রূপ, যেখানে রাষ্ট্র পৃষ্ঠপোষকতা করবে বিকৃত পুরুষতন্ত্রের, সেখানেই নারীর উপর আক্রমণ চলবে, আক্রমণ চলবে তার স্বাধীন চলাচলের উপর, তার মতপ্রকাশের স্বাধীনতার উপর, তার অর্থনৈতিক স্বাধীনতার উপর, যৌনতার উপর। যে রাষ্ট্রে নারী ও শিশু নিরাপদ নয়, সে রাষ্ট্র সভ্য বলা চলে না কোনোভাবেই। যে কোনো মানবাধিকার লঙ্ঘনের ঘটনায় সর্বোচ্চ গুরুত্ব দিতে হবে সর্বাগ্রে। 'বিচ্ছিন্ন' ঘটনা বলে একে এড়িয়ে যাওয়া চলবে না, চলবে না অপরাধীকে আড়াল করার প্রচেষ্টা বা কালক্ষেপণ করা।
তনু হত্যার প্রতিবাদে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে প্রতিবাদ চলছে। প্রতিবাদ চলছে শাহবাগে, কুমিল্লায়, অন্যান্য স্থানে। প্রতিবাদ করছে দেশের সচেতন জনগোষ্ঠী। এই প্রতিবাদ অব্যহত রাখতে হবে।
সোহাগী জাহান তনুর ছবিটার দিকে আমরা তাকাতে পারছি না। সে যেন বলছে, 'আমার কি বেঁচে থাকার অধিকার ছিল না এই দেশে? এই সমাজে?' তনু, ক্ষমা কর আমাদের। এই স্বাধীন দেশে, স্বাধীনতার মাসে তোমাকে হত্যা করল খুনিরা। আমরা পাকিস্তানি ঘাতকদের কাছ থেকে দেশ মুক্ত করতে পেরেছি কিন্তু দেশের নারী ও শিশুদের মুক্ত নিরাপদ পরিবেশ দিতে পারিনি। পিশাচদের হাত থেকে বাঁচাতে পারিনি তনুদের।
তনুকে নিরাপত্তা দিতে পারেনি তার পোশাক, ধর্ম, সমাজ, শিক্ষা। সুরক্ষিত নিরাপদ পরিবেশে তাকে হত্যা করেছে খুনিরা। যত দিন পর্যন্ত রাষ্ট্র নারীর প্রতি নির্যাতনের ঘটনায় সর্বোচ্চ গুরুত্ব দিয়ে সেটি প্রতিরোধ করতে না চাইবে এবং যত দিন পর্যন্ত নারীর উপর নির্যাতনকারীদের কঠোরস্য কঠোর শাস্তি নিশ্চিত না হবে তত দিন আমাদের নারীরা কোথাও নিরাপত্তা পাবে না। আমরা এমন রাষ্ট্র চাই যেখানে নারী, শিশু ও সকল মানুষ নিরাপদ।