Published : 29 Jan 2016, 09:11 AM
১.
কিছুদিন আগে বেগম খালেদা জিয়া মুক্তিযুদ্ধে শহীদদের সংখ্যা নিয়ে সন্দেহ প্রকাশ করেছেন। বলেছেন, তাদের সংখ্যা নিয়ে বিতর্ক আছে, একেক জায়গায় সংখ্যা একেক রকম। বেগম খালেদা জিয়ার বক্তব্য শুনে মনে হতে পারে বাংলাদেশের গণহত্যার একটা সঠিক সংখ্যা থাকা উচিত ছিল। সংখ্যাটি ত্রিশ লক্ষ না হয়ে "উনত্রিশ লক্ষ বাহান্নো হাজার ছযশ পঁয়ত্রিশ" জন কিংবা "ত্রিশ লক্ষ তেত্রিশ হাজার তিনশ একুশ" জন এ রকম একটি সঠিক সুনির্দিষ্ট সংখ্যা হলে তাঁর কাছে বিশ্বাসযোগ্য হত। যেহেতু সংখ্যাটি এভাবে নেই, তাই এটা নিয়ে তাঁর সন্দেহ প্রকাশ করার অধিকার আছে, সংখ্যাটা বিতর্কিত বলা যেতে পারে।
কিন্তু মুশকিল হচ্ছে পৃথিবীর কোনো বড় হত্যাকাণ্ড বা গণহত্যার সংখ্যাই কিন্তু সুনির্দিষ্ট নয়। দ্বিতীয় মহাযুদ্ধের মতো এত বড় একটা বিষয় যেটা নিয়ে গবেষণার পর গবেষণা হয়েছে, সেখানেও মৃত্যুর সংখ্যা সুনির্দিষ্ট নয়। বলা হয়, ৫০ থেকে ৮০ মিলিয়ন (কিংবা পাঁচ থেকে আট কোটি)।
নিউক্লিয়ার বোমা ফেলা হলে কী পরিমাণ ক্ষয়ক্ষতি হতে পারে সেটা সঠিকভাবে অনুমান করার জন্যে আমেরিকা কিছু শহর বেছে নিয়েছিল এবং সেখানে তারা আগে থেকে অন্য কোনো বোমা ফেলেনি। ক্ষয়ক্ষতির এ রকম সুনির্দিষ্ট হিসাব বের করার প্রস্তুতি নেওয়ার পরও হিমোশিমা কিংবা নাগাসাকিতে কত জন মানুষ মারা গিয়েছিল সেটি সুনির্দিষ্ট নয়। বলা হয়, হিরোশিমাতে নব্বই হাজার থেকে দেড় লক্ষ এবং হিরোশিমাতে চল্লিশ হাজার থেকে আশি হাজার লোক মারা গিয়েছিল।
চীনের নানকিংয়ে জাপানিদের চালানো গণহত্যা পৃথিবীর একটি নৃশংসতম গণহত্যা। গবেষকরা এখনও সেই সংখ্যাটি সুনির্দিষ্টভাবে বলতে পারেন না। তাদের হিসেবে সংখ্যাটা দুই থেকে তিন লাখের ভেতরে।
নাৎসি জার্মানিতে ইহুদিদের হত্যাকাণ্ডের সংখ্যা হিসাবে পঞ্চাশ থেকে ষাট লক্ষ ধরে দেওয়া হয়। মাঝে মাঝেই গবেষকরা সংখ্যাটা দেড় থেকে দুই কোটি বলে থাকেন।
সাম্প্রতিক গণহত্যার মাঝে রুয়ান্ডাতে টুটসিদের উপর হত্যাকাণ্ডটি সবচেয়ে আলোচিত। এত সাম্প্রতিক ঘটনা, তথ্য আদান-প্রদানেও কত রকম আধুনিক প্রযুক্তি, তারপরও হত্যাকাণ্ডের সংখ্যাটি সুনির্দিষ্ট নয়। বলা হয়ে থাকে সেখানে পাঁচ থেকে ছয় লাখ মানুষকে হত্যা করা হয়েছে। সোজা কথায় বলা যায়, একটা বড় ধরনের হত্যাকাণ্ডে কখনও সঠিক সংখ্যাটা বলা যায় না।
হত্যাকাণ্ডের এ রকম পরিসংখ্যান দেখে আমরা মোটেও অবাক হই না। কারণ আমরা সবাই জানি হত্যাকারীরা তালিকা করে হত্যাকাণ্ড ঘটায় না এবং হত্যা করার পর তারা সেই তালিকা প্রকাশও করে না। কাজেই সবাই একটা আনুমানিক সংখ্যা বলে থাকেন। আমাদের বাংলাদেশের বেলাতেও তাই হয়েছে, একটা আনুমানিক সংখ্যা বলা হয়েছে। একাত্তর সালে প্রায় এক কোটি শরণার্থী দেশ ছেড়ে চলে গিয়েছিল। তাদের একটা বড় অংশ রোগে-শোকে মারা গেছে। তাদের সংখ্যাটা ধরা হলে একাত্তরে শহীদের সংখ্যা খুব সহজেই তিরিশ লক্ষ ছাড়িয়ে যেতে পারে।
যারা গণহত্যা করে তারা কখনও স্বীকার করতে চায় না যে, তারা গণহত্যা করেছে। আর্মেনিয়ানরা প্রায় একশ বৎসর ধরে চেষ্টা করে আসছে, তবুও তুরস্ককে স্বীকার করাতে পারেনি যে, তারা গণহত্যা করেছে। পাকিস্তানও বলতে শুরু করেছে তারাও বাংলাদেশে গণহত্যা করেনি! যারা স্বীকার করতে বাধ্য হয়, তারাও সব সময় চেষ্টা করে সংখ্যাটা ছোট করে দেখাতে।
আমাদের বাংলাদেশের উদাহরণটি সবচেয়ে বিচিত্র। একাত্তর সালে জামায়াতে ইসলামী সরাসরি পাকিস্তান মিলিটারির সঙ্গে এদেশে গণহত্যা করেছে। তাই তারা চেষ্টা করে সংখ্যাটা কমিয়ে আনতে। সে জন্যে তাদের কুযুক্তির কোনো অভাব নেই। সবচেয়ে হাস্যকর যুক্তিটি হচ্ছে বঙ্গবন্ধু নাকি সাক্ষাতকার দিতে গিয়ে তিন লক্ষ বলতে গিয়ে ভুলে তিরিশ লক্ষ বলে ফেলেছিলেন! (যার অর্থ তিন লক্ষ পর্যন্ত হত্যা করা কোনো ব্যাপার নয়, তিরিশ লক্ষ হলে একটু বেশি হয়ে যায়। তাই সেটা মেনে নেওয়া যাবে না!)
জামায়াতে ইসলামীর ব্যাপারটা আমরা খুব ভালোভাবে বুঝি। কিন্তু আমি আমাদের বুদ্ধিজীবীদের ব্যাপারটা এখনও বুঝে উঠতে পারিনি। রাষ্ট্রীয়ভাবে আমরা যখন গণহত্যার সংখ্যাটি গ্রহণ করে নিয়েছি এবং সেই সংখ্যাটি যেহেতু একটা আনুমানিক এবং যৌক্তিক সংখ্যা, তখন সেই সংখ্যাটিতে সন্দেহ প্রকাশ করা হলে যে আমাদের মুক্তিযুদ্ধের শহীদদের অসম্মান করা হয় সেটি তারা কেন বুঝতে পারেন না?
পৃথিবীর বড় বড় ঐতিহাসিক হত্যাকাণ্ডের প্রকৃত সংখ্যা এবং আনুমানিক সংখ্যার মাঝে যদি বিশাল ফারাক থাকে এবং সেগুলো নিয়ে যদি আমাদের বুদ্ধিজীবীরা কখনও কোনো প্রশ্ন না করেন, তাহলে তারা কেন আমাদের দেশের গণহত্যার সংখ্যা নিয়ে প্রশ্ন তুলে যুদ্ধাপরাধীদের সাহায্য করার জন্যে এত ব্যস্ত হয়ে যান?
কিছু দিন আগে আমাদের দেশের পঞ্চাশ জন বুদ্ধিজীবী মুক্তিযুদ্ধে শহীদদের সংখ্যা নিয়ে প্রশ্ন তুলে আমাকে একই সঙ্গে বিস্মিত, ক্ষুব্ধ এবং আহত করেছিলেন। তার কারণ, যখন এই বিষয়টি নিয়ে প্রশ্ন করা হয় তখন প্রকৃত সংখ্যাটির জন্যে তাদের গবেষকসুলভ আগ্রহ প্রকাশ পায় না, পাকিস্তানি মিলিটারির নৃশংসতা খাটো করে দেখানোর ইচ্ছাটুকু প্রকাশ পায়।
যে দেশের বড় বড় বুদ্ধিজীবীরা মুক্তিযুদ্ধে শহীদের সংখ্যা নিয়ে প্রশ্ন করেন, সেই দেশে খালেদা জিয়ার মতো একজন সেটাকে আরও এক কাঠি এগিয়ে নিয়ে গেলে আমাদের অবাক হবার কিছু নেই। পাকিস্তানের জন্য তাঁর মমতা আছে। একাত্তরে তিনি পাকিস্তানিদের সঙ্গে মিলিটারি ক্যান্টনমেন্টে ছিলেন।
শুধু যে খালেদা জিয়া এই দেশের শহীদদের অসম্মান করেছেন তা নয়, তাঁর দলও খালেদা জিয়ার বক্তব্য সমর্থন করে গেছে। দলটির মাথা থেকে আরও উদ্ভট কিছু বুদ্ধি বের হয়েছে। সেটি হচ্ছে, জরিপ করে মুক্তিযুদ্ধে শহীদদের সংখ্যাটি বের করে ফেলা! জরিপ করে মানুষের পছন্দ অপছন্দের কথা জানা যায়। কিন্তু একটি তথ্য বের করে ফেলা যায়, সেটি আমি জন্মেও শুনিনি!
২.
আমি অনেক দিন থেকে ভেবে এসেছি বই মেলার আগে আমি আমার কিছু প্রিয় বই নিয়ে লিখব, নূতন এবং অপরিচিত লেখকদের পাঠকদের সাথে পরিচয় করিয়ে দেব। কখনও সেটা হয়ে উঠেনি। তবে এবারের বই মেলার আগে আমর সেই সুযোগটি এসেছে। যখন এই দেশে মুক্তিযুদ্ধে শহীদদের সংখ্যা নিয়ে আমাদের দেশের বুদ্ধিজীবীরা এক ধরনের বিতর্ক শুরু করেছেন, ঠিক তখন আমার হাতে একটি বই এসেছে। বইটির নাম 'ত্রিশ লক্ষ শহীদ: বাহুল্য না বাস্তবতা'। বইয়ের লেখকের নাম আরিফ রহমান।
(বইটির প্রকাশকের নামটি দিতে পারলে ভালো হত। কিন্তু আমি যখন এই লেখাটি লিখছি তখন পর্যন্ত বইয়ের লেখক জানে না বইটি এই বছর কোথা থেকে পুনর্মুদ্রণ হবে।)
আরিফ কমবয়সী তরুণ, বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র এবং মুক্তিযুদ্ধকে সে হৃদয় দিয়ে গ্রহণ করেছে। যখন এই দেশের বড় বড় বুদ্ধিজীবীরা মুক্তিযুদ্ধে শহীদদের সংখ্যা নিয়ে তর্ক-বিতর্ক করছে, তখন সে খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে তার মতো করে গবেষণা করে মুক্তিযুদ্ধে শহীদদের সংখ্যা নিয়ে যারা কুযুক্তি-অপযুক্তি দিতে থাকে তাদের একটা জবাব দেবার চেষ্টা করেছে।
আমি এই বইটির জন্যে একটা ভূমিকা লিখে দিয়েছি। ভূমিকাটি এ রকম:
'ত্রিশ লক্ষ শহীদঃ বাহুল্য না বাস্তবতা'
ভূমিকা:
''১৯৮৭ সালের দিকে আমি যখন মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে আমার পিএইচডি করছি, তখন স্টিভ মোজলে নামে একজন গবেষক মাইক্রোবায়োলজি নিয়ে গবেষণা করার জন্যে বাংলাদেশে আসার প্রস্তুতি নিচ্ছিল। বাংলাদেশ সম্পর্কে বাস্তব কিছু ধারণা নেওয়ার জন্যে সে ইউনিভার্সিটি অব ওয়াশিংটনে আমাকে খুঁজে বের করেছিল। নূতন ভাষা শেখার তার এক ধরনের বিস্ময়কর প্রতিভা ছিল এবং আমি তাকে কাজ চালানোর মতো বাংলা শিখিয়ে দিয়েছিলাম। বাংলাদেশের জন্যে তার এক ধরনের মমতার জন্ম হয়েছিল। তাই একাধিকবার এখানে ফিরে ফিরে এসেছে।
স্টিভ মোজলের সাথে আমার এক ধরনের বন্ধুত্ব গড়ে উঠেছিল, বাংলাদেশ নিয়ে তার অভিজ্ঞতা সে আমাকে খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে বলত। তার একটি কথা শুনে সে সময়ে আমি বেশ অবাক হয়েছিলাম। সে বলেছিল, ''১৯৭১ সালে তোমাদের দেশে যে ভয়ংকর গণহত্যা, ধর্ষণ, ধ্বংসযজ্ঞ, দেশত্যাগ, গ্রামের পর গ্রাম পুড়িয়ে দেওয়ার মতো ঘটনা ঘটেছে সেটা এত অবিশ্বাস্য যে আজ থেকে দশ বিশ বৎসর পর পৃথিবীর কেউ এটি বিশ্বাস করবে না।''
মুক্তিযুদ্ধের পর তখন মাত্র সাত আট বৎসর পার হয়েছে। আমি তাই স্টিভ মোজলের কথা হেসে উড়িয়ে দিয়েছিলাম। তাকে বলেছিলাম, এটি একটি ঐতিহাসিক সত্য, এই সত্যটির কথা পৃথিবীর মানুষ ভুলে যাবে এটি কিছুতেই হতে পারে না।
মুক্তিযুদ্ধের চার যুগ পার হওয়ার আগেই আমি হঠাৎ করে আবিষ্কার করেছি, স্টিভ মোজলের ভবিষ্যদ্বাণী অক্ষরে অক্ষরে সত্যি প্রমাণিত হয়েছে। পৃথিবীর কিছু কিছু গণহত্যা পশ্চিমা জগৎ জোর গলায় প্রচার করতে চায়। কিছু কিছু গণহত্যা নিয়ে তাদের আগ্রহ নেই। আইরিশ চ্যাংয়ের লেখা 'রেপ অব নানকিং' বইটির ভূমিকা পড়লে মনে হয় তিনি যেন আমাদের দেশের ঘটনাটি নিয়েই তার হতাশা ব্যক্ত করছেন। আমাদের মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে আন্তর্জাতিক মানের গবেষণা বলতে গেলে কিছু হয়নি। বরং শর্মিলা বসুর মতো জ্ঞানপাপীদের দিয়ে মুক্তিযুদ্ধের বিরুদ্ধে গবেষণা করানো হচ্ছে।
আমাদের দেশের সত্যটুকু আমাদেরই প্রচার করার কথা। কিন্তু এই দেশে মিলিটারি শাসনের সময় ঠিক তার উল্টো ব্যাপারটি হয়েছে। একাধিক প্রজন্মের জন্ম হয়েছে যারা মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস না জেনে বড় হয়েছে, অপপ্রচার বিশ্বাস করেছে এবং চোখে আঙুল দিয়ে দেখানোর পরও তারা সত্য খুঁজে বের না করে নাকি কান্না ফেঁদে অনুযোগ করেছে, প্রকৃত সত্য না বলে তাদেরকে বিভ্রান্ত করা হয়েছে বলে। তারা জানে না একাত্তরে কী হয়েছিল।
আমরা হঠাৎ করে আবিষ্কার করেছিলাম এই দেশের কয়েক প্রজন্মকে আবার নূতন করে পাকিস্তানি মিলিটারি আর তাদের এদেশীয় অনুচরদের গণহত্যা, ধর্ষণ আর ধ্বংসযজ্ঞের কথা এবং মুক্তিযুদ্ধদের বীরত্ব আর অর্জনের ইতিহাস আবার নূতন করে করতে হচ্ছে। এই ব্যাপারে আমাদের বুদ্ধিজীবীদের সবচেয়ে বড় ভূমিকা রাখার কথা। কিন্তু আমাদের খুবই দুর্ভাগ্য এই দেশের সকল বুদ্ধিজীবী সেই দায়িত্ব পালন করতে রাজি নন। 'নিরপেক্ষতা', 'বাকস্বাধীনতা' এ রকম বড় বড় শব্দ ব্যবহার করে তারা মুক্তিযুদ্ধের প্রতিষ্ঠিত সত্যগুলোর মূল ধরে টানাটানি শুরু করেছেন।
ঠিক কী কারণ জানা নেই, সাদা চামড়ার প্রতি আমাদের দেশের অনেক বুদ্ধিজীবীদের এক ধরনের দাসসুলভ আনুগত্য আছে। বছর খানেক আগে মুক্তিযুদ্ধে শহীদ মানুষের সংখ্যা নিয়ে একজন সাংবাদিকের উক্তির জন্যে তাকে আন্তর্জাতিক অপরাধ আদালত শাস্তি দিয়েছিল। এই দেশে এ রকম ঘটনা কিংবা এর কাছাকাছি ঘটনা অনেক বার ঘটেছে। কিন্তু কখনও আমাদের বুদ্ধিজীবীরা সেটা নিয়ে ব্যস্ত হননি।
সম্ভবত এবারের মানুষটি সাদা চামড়ার হওয়ার কারণে একজন নয়, দুই জন নয়, পঞ্চাশ জন বাংলাদেশি বুদ্ধিজীবী তার পিছনে সারিবদ্ধভাবে দাঁড়িয়ে গেলেন। তাদের অত্যন্ত সুলিখিত বক্তব্যের চাঁছাছোলা বাংলা অনুবাদ হচ্ছে, মুক্তিযুদ্ধে শহীদ মানুষের সংখ্যা নিয়ে সন্দেহ প্রকাশ করে একটা বিতর্ক তৈরি করার অধিকার দিতে হবে!
এই বিষয়গুলো আমাকে আহত করে। কিন্তু বাংলাদেশের স্বনামধন্য এতজন বুদ্দিজীবীর বিবৃতি অস্বীকার করার সাধ্য কার আছে?
এর পরের ঘটনাটি অবশ্য রীতিমতো কৌতুকের মতো। আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল যখন এই বুদ্ধিজীবীদের তাদের বিবৃতি ব্যাখ্যা করার নির্দেশ দিয়েছে, তখন হঠাৎ করে প্রায় সকল বুদ্ধিজীবীর আদর্শ এবং অধিকারের জন্যে বুক ফুলিয়ে সংগ্রাম করার সাহস উবে গেল এবং তারা বিনাশর্তে ক্ষমা প্রার্থনার জন্যে রীতিমতো হুড়োহুড়ি শুরু করে দিলেন। এই দেশের যে বুদ্ধিজীবীরা এ রকম একটি বিষয়ে এ রকম কঠিন বিবৃতি দিয়ে চোখের পলকে নিজেদের পিঠ বাঁচানোর জন্যে ক্ষমা প্রার্থনা শুরু করে দেন, তাদের জন্যে নিজের ভেতরে সম্মানবোধ বজায় রাখা খুব কঠিন।
যে বুদ্ধিজীবীরা এই দেশের তরুণ প্রজন্মকে দিকনির্দেশনা দিবেন তারাই যদি উল্টো তাদেরকে বিভ্রান্ত করতে শুরু করেন তাহলে আমার হতাশা অনুভব করা উচিত ছিল। কিন্তু আমি বিন্দুমাত্র হতাশ নই।
তার কারণ, একদিকে আমি যে রকম বিভ্রান্ত খ্যাতিমান বুদ্ধিজীবীদের দেখছি, ঠিক সে রকম অন্যদিক দিয়ে নূতন প্রজন্মের কিছু তরুণদের দেখছি যাদের ভেতর নিজের দেশ নিয়ে কোনো বিভ্রান্তি নেই। মাতৃভূমির জন্যে ভালোবাসায় তাদের কণামাত্র খাদ নেই। তারা তরুণ কিন্তু অন্য অনেক তরুণদের মতো তারা শুধু আবেগ পুঁজি করে কথা বলে না। তারা তাদের আগ্রহের বিষয় নিয়ে লেখাপড়া করে, গবেষণা করে। যারা মুক্তিযুদ্ধকে নিজের চোখে না দেখেও সেটাকে শুধু মস্তিষ্কে নয় হৃদয়েও ধারণ করে। যারা এই দেশে যুদ্ধাপরাধীদের বিচার নিশ্চিত করেছে।
'আরিফ রহমান' ঠিক সেই রকম একজন তরুণ। যে কাজটি এই দেশের বড় বড় গবেষকদের করা উচিৎ ছিল সেই কাজটি বিশ্ববিদ্যালয়ের একজন ছাত্র হয়েও সে করে ফেলার সাহস পেয়েছে।
'ত্রিশ লক্ষ শহীদ: বাহুল্য নাকি বাস্তবতা' নামে একটি বইয়ের ভেতরে মুক্তিযুদ্ধ শহীদ মানুষের সংখ্যা এবং আনুষঙ্গিক যে সব বিষয় নিয়ে এই দেশে প্রতিনিয়ত বিভ্রান্তি ছড়ানোর চেষ্টা করা হয়, সেই বিষয়গুলো নিয়ে লিখেছে। সম্ভাব্য সকল তথ্য-প্রমাণ সংগ্রহ করেছে, বিশ্লেষণ করেছে এবং সেটি গ্রন্থাকারে প্রকাশ করেছে। এই বইটিতে সে অসংখ্য তথ্যসূত্র দিয়েছে অনেক ছবি সংযোজন করেছে, তালিকা তুলে ধরেছে। দেশোদ্রাহীর যে দলটি এককভাবে মিথ্যাচার করে যে মিথ্যাগুলোকে প্রায় বিশ্বাসযোগ্য করে ফেলেছিল, আরিফ রহমান সেই মিথ্যাগুলো সবার সামনে প্রকাশ করে দিয়েছে। যারা মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে একাডেমিক গবেষণা করবেন তারাও এই বইয়ের অনেক তথ্য ব্যবহার করতে পারবেন।
আমি আশা করছি বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র এই তরুণ গবেষক মুক্তিযুদ্ধকে নিজের গবেষণার বিষয় হিসেবে ধরে নিয়ে ভবিষ্যতে আরও কাজ করবে, পৃথিবীর তথ্য-ভাণ্ডারে আমাদের মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে একাডেমিক গবেষণার যে শূন্যতা আছে সেই শূন্যতা পূরণ করবে।
পঞ্চাশ জন 'নিরপেক্ষ' বুদ্ধিজীবী আমাদের মুক্তিযুদ্ধে শহীদের সংখ্যা নিয়ে সন্দেহ প্রকাশ করে আমাকে যেটুকু মর্মাহত করেছিল, একজন তরুণ ছাত্র আরিফ রহমান একা আমার মনের সেই পুরো কষ্টটুকু দূর করে দিয়েছে।
তার জন্যে আমার অভিনন্দন। তার জন্যে আমার ভালোবাসা।''