Published : 18 Dec 2015, 11:27 AM
বেশ কয়েক বছর আগে আমার একজন তরুণের সাথে দেখা হয়েছিল। সে আমার পা ছুঁয়ে সালাম করে বলল, "আমি অমুক।" বলাই বাহুল্য, আমি তার নাম শুনে তাকে চিনতে পারলাম না। তখন তরুণটি বলল, ''আপনি আমার বাবাকে চিনতে পারেন। নকল করার সময় ধরে ফেলেছিলেন বলে একটা ছাত্র চাকু মেরে আমার বাবাকে খুন করে ফেলেছিল।''
সাথে সাথে আমি তরুণটিকে চিনতে পারলাম। তার শিক্ষক বাবার হত্যাকাণ্ডের খবরটি কাগজে ছাপা হয়েছিল। নকল ধরার জন্যে একজন শিক্ষককে খুন করে ফেলার ঘটনাটি শুধু আমার নয়, সারা দেশের সব মানুষের বিবেকে নাড়া দিয়েছিল। একজন ছাত্র যখন পরীক্ষায় নকল করা শিখে এবং সেটাকে তার অধিকার মনে করে, তখন সেটা খুবই বিপজ্জনক হতে পারে।
এই মুহূর্তে আমার সেই ঘটনাটি মনে পড়ছে এবং আমি এক ধরনের তীব্র হতাশায় দীর্ঘশ্বাস ফেলছি। মাত্র কয়েক বছর আগেও পরীক্ষায় নকল করা বিষয়টি বলতে গেলে ছিল না। এক-দুইজন নকলবাজ আর খুনি প্রায় এক পর্যায়ের অপরাধী ছিল। আমার মনে হয়, এই সরকারের আমলে শিক্ষার নামে এই দেশের যত বড় সর্বনাশ হয়েছে আর কখনও এত বড় সর্বনাশ হয়নি। পরীক্ষায় আগেও কখনও কখনও ঢালাওভাবে বড় ধরনের নকল হয়েছে। কিন্তু আগে কখনও শিশুদের সেই নকল উৎসবের সামিল করা হয়নি।
মাত্র পিএসসি এবং জেএসসি পরীক্ষা শেষ হয়েছে। এই দেশের প্রায় ৩০ লক্ষ ছেলেমেয়ে পিএসসি এবং ২০ লক্ষ ছেলেমেয়ে জেএসসি পরীক্ষা দিয়েছে। আমরা সবাই জানি এই পরীক্ষাগুলো এখন আর সত্যিকারের পরীক্ষা নয়। এগুলো এখন এক ধরনের প্রহসন, বড়জোর উৎকট রসিকতা। ছোট ছোট শিশুরা বড়দের মতো নকল করা শিখেনি। তাই তাদেরকে নকল করতে সাহায্য করার জন্যে শিক্ষকেরা এগিয়ে আসছেন। তাদেরকে উত্তর বলে দিচ্ছেন। কাগজে উত্তর লিখে একজন একজন করে সবাইকে ধরিয়ে দিচ্ছেন। অন্যায় এবং অপরাধ করায় একজন শিশুর হাতেখড়ি হয়ে যাচ্ছে এবং সেই হাতেখড়িটি হচ্ছে শিক্ষাকে উপলক্ষ করে।
আমরা জানি, এই পরীক্ষাগুলোতে ঢালাওভাবে সবাই পাশ করে যাবে এবং নানা ধরনের যাচাই-জরিপ এবং গবেষণা করে দেখা গেছে, এই বয়সী ছেলেমেয়েদের যখন যেটুকু জানা দরকার, ছেলেমেয়েরা তার ধারেকাছে নেই। অর্থাৎ পরীক্ষাগুলো আসলে ছেলেময়েদের মূল্যায়ন করতে পারে না। তাহলে এত হইচই করে এত বড় দজ্ঞযজ্ঞ করে সবাইকে এত কষ্ট দিয়ে কেন খামোকা এই পরীক্ষাগুলো নেওয়া হয়? সবচেয়ে বড় কথা, এই দেশের শিশুদের অন্যায় করতে শেখানো ছাড়া এই পরীক্ষাগুলো নিয়ে কী লাভ হচ্ছে?
আমার দেশের ছেলেমেয়েদের লেখাপড়া নিয়ে যারা খোঁজ-খবর রাখেন তারা এই বিষয়গুলো জেনে কখনও হতাশা অনুভব করেন, কখনও ক্ষুব্ধ হয়ে যান। আমার জন্য বিষয়টি আরও অনেক বেশি বেদনাদায়ক। কারণ আমি একই সাথে অপরাধবোধে ভুগতে থাকি। কারণ এই সরকার যখন জোট সরকারকে নির্বাচনে হারিয়ে দেশ পরিচালনার দায়িত্ব নিয়েছে তখন শিক্ষা নিয়ে নানা ধরনের পরিকল্পনা করার সময় দেশের অনেক বড় বড় শিক্ষাবিদদের সাথে আমাকেও ডেকেছিল। আমাকে সরকার কিংবা মন্ত্রণালয়ের পক্ষ থেকে যখন যে দায়িত্ব দেওয়া হয়েছিল, আমি আমার সাধ্যমতো সেই দায়িত্ব পালন করার চেষ্টা করেছি (বড় বড় মিটিংয়ে অন্য সবাই ঢাকা শহরের এক জায়গা থেকে অন্য জায়গায় যেতেন; আমাকে যেতে হত সিলেট থেকে ট্রেনে-বাসে-গাড়িতে)।
আমাদের দেশের শিক্ষানীতি প্রণয়ন কমিটিতে অন্য অনেকের সাথে আমিও একজন সদস্য ছিলাম। আমি মনে করি, আমাদের দেশের জন্যে সেই শিক্ষানীতিটি যথেষ্ট চমৎকার একটা শিক্ষানীতি ছিল, কিন্তু দুর্ভাগ্যক্রমে সেই শিক্ষানীতির উপর আমাদেরকে না জানিয়ে কাঁচি চালানো হয়েছে। আমরা যে খসড়া শিক্ষানীতিটি মন্ত্রণালয়ে জমা দিয়েছিলাম, সেখানে মাত্র দুটি পাবলিক পরীক্ষার কথা বলা হয়েছিল। যে শিক্ষানীতি গ্রহণ করা হয়েছে, সেখানে কীভাবে কীভাবে জানি তিনটি পাবলিক পরীক্ষার কথা চলে এসেছে। যদি শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের আমলারাই এতগুলো শিক্ষাবিদ থেকে বেশি জানেন এবং বুঝেন এবং তাদের ইচ্ছামতো পাবলিক পরীক্ষার সংখ্যা বাড়িয়ে দিতে পারেন তাহলে কেন এতগুলো শিক্ষাবিদকে একটা শিক্ষানীতি প্রণয়ন করতে দিলেন?
সবচেয়ে মজার কথা হচ্ছে, শিক্ষানীতিতে তিনটি পাবলিক পরীক্ষার কথা বলা হলেও আমরা সবাই জানি, এই দেশের ছেলেমেয়েদের একটি নয়, দুটি নয়, এমনকি চার-চারটি পাবলিক পরীক্ষা দিতে হয়। যারা এই সিদ্ধান্তগুলো নেন, আমার কেন জানি মনে হয়, তাদের ছেলেমেয়েরা আমাদের দেশের মূলধারার শিক্ষা ব্যবস্থায় লেখাপড়া করে না, তারা সম্ভবত ইংরেজি মাধ্যমের 'ও লেভেল' কিংবা 'এ লেভেলে' পড়াশোনা করে। তাই সাধারণ ছেলেমেয়েদের দুঃখ-কষ্ট-যন্ত্রণার কথা তারা কোনোদিন টের পান না কিংবা সেটা নিয়ে মাথা ঘামান না।
পিএসসি এবং জেএসসি পরীক্ষাতে ছোট শিশুদের নকল করতে শেখানোই যে আমাদের বর্তমান শিক্ষা ব্যবস্থার একমাত্র সমস্যা তা কিন্তু নয়। আমরা সবাই জানি, পরীক্ষার প্রশ্নপত্র ফাঁস এখন মোটামুটি নিয়মিত ঘটনা হয়ে গেছে। মাত্র কিছুদিন আগে মেডিকেল ভর্তিপরীক্ষার প্রশ্নপত্র ফাঁস হয়েছে। সরকার তোতা পাখির মতো বলে গেছে যে, আসলে প্রশ্নপত্র ফাঁস হয়নি। আমাদের দেশের বড় বড় শিক্ষাবিদেরা নিজেদের উদ্যোগে তদন্ত করে নিশ্চিত হয়েছেন যে, আসলেই প্রশ্ন ফাঁস হয়েছে, কিন্তু তাতে উনিশ-বিশ কিছু হয়নি। ফাঁস হয়ে যাওয়া প্রশ্নে যারা পরীক্ষা দিয়েছে তারাই সবার আগে মেডিকেলে ভর্তি হয়েছে। যারা সারা বছর মনোযোগ দিয়ে লেখাপড়া করেছে, দুর্বৃত্তরা তাদেরকে এই দেশে তাদের স্বপ্ন পূরণ করতে দেয়নি।
কমবয়সী ছেলেমেয়েদের জীবনের শুরুতে এই ভয়ংকর অভিজ্ঞতাটুকু তাদেরকে যে হতাশার দিকে ঠেলে দিয়েছে তার দায়িত্ব কে নেবে? এই দেশে পদ্মা ব্রিজ তৈরি হচ্ছে, এই দেশে বঙ্গবন্ধু স্যাটালাইট মহাকাশে পাঠানো হবে, এই দেশে নিউক্লিয়ার বিদ্যুৎ কেন্দ্র তৈরি হবে, কিন্তু যে ছেলেটি বা মেয়েটির জীবনের সব স্বপ্ন এই দেশ কেড়ে নিয়েছে, তার কাছে এর কোনো গুরুত্ব নেই। আমাদের এই দেশটি গড়ে তুলবে নূতন প্রজন্ম, এখন যারা শিশু, কিশোর, কিশোরী কিংবা তরুণ, তরুণী। তারা যদি এখন বুঝে যায় এই দেশে সততার মূল্য নেই, এই দেশে আসলে অসৎ-অপরাধী-দুর্বৃত্তের– তাহলে তারা কোন আশায় ভবিষ্যতের দিকে তাকিয়ে থাকবে? একটি দেশের সরকার যে এত অবহেলায় একটা জাতির ভবিষ্যৎ পা দিয়ে ধুলোয় মাড়িয়ে দিতে পারে সেটি নিজের চোখে দেখেও আমার বিশ্বাস হয় না।
যখন প্রশ্নপত্র ফাঁস হয় না তখনও কি পরীক্ষা ভালো হয়? না, আমরা এখন সেটিও দাবি করতে পারি না। আমাদের দেশে লেখাপড়া নিয়ে যে বাণিজ্য হয়, সে রকম বাণিজ্য বুঝি আর কোথাও হয় না। দেশে যখন সৃজনশীল প্রশ্নপদ্ধতি শুরু হয়েছিল, ঠিক তখনই সৃজনশীল গাইড বই বের হতে শুরু করল। এর থেকে বড় রসিকতা আর কী হতে পারে!
দেশে যখন এ রকম ঘটনা ঘটে তখন সাধারণত সংবাদ মাধ্যম বিষয়টি নিয়ে হইচই শুরু করে। বিষয়টি দশ জনের চোখে পড়ে, দুর্বৃত্তরা তখন পিছিয়ে যায়। আমাদের দেশে সেটি কখনও হবে না। কারণ এই দেশের যত বড় বড় পত্রিকা রয়েছে, তারা নিজেরাই তাদের পত্রিকায় গাইড বই ছাপিয়ে যাচ্ছে। দেশে গাইড বই বেআইনি, কিন্তু যখন সবার সামনে পত্রিকাগুলো তাদের পাতায় দিনের পর দিন গাইড বই ছাপিয়ে যাচ্ছে, তখন তাদের বিরুদ্ধে কথা বলার একটি মানুষ খুঁজে পাওয়া যায় না।
এই দেশের ছেলেমেয়েদের সাথে আমার এক ধরনের যোগাযাগ আছে, কিছু একটা অঘটন ঘটলেই তারা আমার কাছে সেটা নিয়ে অভিযোগ করে। তাই যখন সৃজনশীল গাইড বই বের হতে শুরু করল এবং শিক্ষকেরা সেই গাইড বই থেকে প্রশ্ন তুলে দিয়ে তাদের ছাত্রছাত্রীদের পরীক্ষা নিতে শুরু করল, তখন ছেলেমেয়েরা আমার কাছে নানাভাবে অভিযোগ করতে শুরু করল। আমি তখন তাদেরকে বলেছি, স্কুলের পরীক্ষায় একজন শিক্ষক গাইড বই থেকে প্রশ্ন তুলে দিতেই পারে এবং একজন ছেলে বা মেযে গাইড বই মুখস্ত করে সেই প্রশ্নের উত্তর দিয়ে সেই শিক্ষকের কাছে ভালো নম্বর পেয়েও যেতে পারে, কিন্তু তাতে কিছু আসে যায় না। কারণ যে পরীক্ষাগুলো তাদের ভবিষ্যৎ নির্ধারণ করবে, সেই পরীক্ষায় কখনও কোনো গাইড বই থেকে কোনো প্রশ্ন দেওয়া হবে না। গুরুত্বপূর্ণ শিক্ষকেরা সেই প্রশ্নগুলো প্রথমবারের মতো তৈরি করবেন এবং পৃথিবীর কেউ আগে সেই প্রশ্নগুলো দেখবে না। কাজেই গাইড বই মুখস্ত করে কখনোই সেই প্রশ্নের উত্তর দেওয়া যাবে না। সেই প্রশ্নের উত্তর দেওয়ার জন্যে ছেলেমেয়েদের পাঠ্যবইটা মন দিয়ে পড়তে হবে, তার বিষয়বস্তুটা বুঝতে হবে। কাজেই গাইড বই নামক এই কুৎসিত বিষয়টা একটা ছেলে বা মেয়ের জীবনে কোনো ভূমিকা রাখবে না।
ঠিক তখন একটা ভয়ানক ঘটনা ঘটল। আমি দেখতে পেলাম, পাবলিক পরীক্ষার প্রশ্নগুলো গাইড বই থেকে নেওয়া শুরু হয়েছে। সৃজনশীল পরীক্ষার মতো এত সুন্দর একটা পরীক্ষা পদ্ধতি মুহূর্তের মাঝে আমাদের শিক্ষা ব্যবস্থা ধূলিষ্যাৎ করে দিল। সৃজনশীল পদ্ধতি শুরু করার আগে ছেলেমেয়েরা শুধু পাঠ্যবই মুখস্ত করত; এখন তারা পাঠ্যবই এবং একাধিক গাইড বই মুখস্ত করে। একটা ছেলে বা মেয়ের সৃজনশীলতা যাচাই করার আর কোনো উপায় থাকল না।
এখানেই যদি শেষ হয়ে যেত তাহলেও একটা কথা ছিল, এখানেই কিন্তু শেষ নয়। সারা পৃথিবীতে স্কুলে কিংবা কলেজে ছেলেমেয়েরা ক্লাস করে সেখানে শিক্ষকেরা পড়ান। আমাদের দেশে শিক্ষকেরা ক্লাসরুমে পড়ান না, তারা প্রাইভেট পড়ান, একসাথে অনেককে নিয়ে ব্যাচে পড়ান। একেকটা ব্যাচে কোনো একটা ঘরে অনেক ছেলেমেয়ে গাদাগাদি করে থাকে এবং শিক্ষকেরা আন্তরিকভাবে তাদেরকে পড়ান। কারণ পড়ানোর জন্যে তারা ছাত্রছাত্রীদের কাছ থেকে নগদ টাকা নেন। আমি সাংবাদিক নই। তাই অনুসন্ধান করে একজন শিক্ষক ঘণ্টাখানেকের মাঝে কত টাকা কামাই করে ফেলেন, সেটা বের করতে পারব না। তবে ব্যাচে যারা পড়ে তারা বলেছে, টাকার অংক পঞ্চাশ থেকে সত্তর হাজার টাকা হতে পারে।
আমি যতদূর জানি, বেশিরভাগ শিক্ষকই নাকি এ রকম। কিন্তু এখনও একজন দুজন শিক্ষক আছেন যারা প্রাইভেট পড়ান না, ব্যাচে পড়ান না, তাঁরা সত্যিকারের শিক্ষকের মতো ক্লাসরুমে এসে পড়ান। এই সব শিক্ষকের জীবন খুব কষ্টের। ভালো ভালো স্কুল-কলেজে তাঁরা টিকতে পারেন না। তাদের শক্তিশালী সহকর্মীরা তাদেরকে মফস্বলে বদলি করে দেন।
এই দেশের স্কুল-কলেজের ছেলেমেয়েদের জীবন খুবই বিচিত্র। তারা কোনো একটি স্কুল কিংবা কলেজের ছাত্র কিংবা ছাত্রী, কিন্তু তাদের লেখাপড়া হয় কোচিং সেন্টারে কিংবা কোনো একজন শিক্ষকের বাসায়। ছাত্র কিংবা ছাত্রীরা এর মাঝে কোনো অস্বাভাবিকতা খুঁজে পায় না, বাবা-মায়েরা এটাকেই নিয়ম বলে মেনে নিয়েছেন। কোচিং সেন্টারগুলোর রমরমা ব্যবসা। যখন পরীক্ষার প্রশ্ন ফাঁস হয়, তখন মাঝে মাঝে কোনো কোনো কোচিং সেন্টারের নাম শুনতে পাই।
কিছুদিন আগে একটি কোচিং সেন্টারের মালিক আমার সাথে দেখা করতে এসেছেন। সৌজন্যের কথা শেষ করে বললেন, ''আমার একটা কোচিং সেন্টার আছে, সেখানে একটা অনুষ্ঠান করব। আপনাকে প্রধান অতিথি হিসেবে নিতে চাই।"
আমি কিছুক্ষণ তার মুখের দিকে তাকিয়ে থেকে বললাম, "যদি দেশের পকেটমাররা একটা সংগঠন তৈরি করে, তাদের বার্ষিক ডিনারে আমাকে প্রধান অতিথি হিসিবে নিতে চায়, আমার কি যাওয়া উচিৎ হবে?"
ভদ্রলোক একেবারে থমমত খেয়ে বললেন, ''না, উচিৎ হবে না।"
আমি বললাম, ''তাহলে আমারও আপনার কোচিং সেন্টারের অনুষ্ঠানে যাওয়া উচিৎ হবে না। কারণ আমার কাছে কোচিং সেন্টার আর পকেটমারের সংগঠন মোটামুটি একই ব্যাপার।''
ভদ্রলোক খুবই মনক্ষুণ্ন হয়ে চলে গেলেন। আমি জানি আমার এই লেখাটা পড়ে দেশের অনেক মানুষ মনক্ষুণ্ন হবেন। বলবেন, "হতে পারে কোচিং সেন্টার বিষয়টা ভালো না, তাই বলে তাকে পকেটমারের সাথে তুলনা করতে হবে? ছি! ছি! ছি!''
স্কুল-কলেজের কোচিংয়ের পাশাপাশি ভর্তি কোচিং বলেও একটা অন্য রকম কোচিং আছে। রাস্তাঘাটে, দেয়ালে ভর্তি কোচিংয়ের বিজ্ঞাপন দেখি। বিশ্ববিদ্যালয়ের নাম দিয়ে ভর্তি কোচিং করা হয়। মেডিকেল কোচিং করার জন্যে বাংলাদেশের প্রত্যন্ত শহর থেকে ছেলেমেয়েরা ঢাকা চলে এসে বাসা ভাড়া করে থাকে। অথচ আমরা সবাই জানি পুরো ব্যাপারটা একটা প্রতারণা ছাড়া আর কিছু নয়। পুরো দেশটা কিছু প্রতারকের হাতে আটকা পড়ে আছে।
অথচ কত সহজেই এই পুরো ব্যাপারটার নিস্পত্তি করা যেত। এইচএসসি পরীক্ষা শেষ হওয়ার এক সপ্তাহের ভেতর যদি ভর্তিপরীক্ষা নিয়ে নেওয়া যেত, তাহলে চোখের পলক এই পুরোপুরি অর্থহীন কোচিং ব্যবসার মূল উৎপাটন করে দেওয়া যেত।
আমি যখন এটা লিখছি তখনও বিশ্ববিদ্যালয়ের ভর্তিপরীক্ষা চলছে। বাবা-মায়েরা তাদের ছেলেমেয়েদের নিয়ে এক শহর থেকে অন্য শহরে ভর্তিপরীক্ষা দিয়ে বেড়াচ্ছেন। সেখানে তাদের থাকার জায়গা দূরে থাকুক, বাথরুমে যাবার সুযোগ পর্যন্ত নেই। একটা বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তিপরীক্ষা দিয়ে তারা বাসে উঠে সারারাত জার্নি করে অন্য কোনো অচেনা শহরে গিয়ে হাজির হয়। তাদের খাওয়া নেই, ঘুম নেই, শ্রান্ত-ক্লান্ত-বিধ্বস্ত। তার মাঝে তারা ভর্তিপরীক্ষা দেয়, এর চাইতে নিষ্ঠুর কোনো ব্যাপার আমার চোখে পড়ে না। আমাদের দেশের কিশোর-কিশোরী, তরুণ-তরুণীদের সাথে এই নিষ্ঠুরতাগুলো কারা করছে? করছে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকেরা। কেন করছে?
শুধুমাত্র কিছু বাড়তি টাকার জন্যে। শুধুমাত্র বাড়তি কিছু টাকার জন্যে। শুধুমাত্র বাড়তি কিছু টাকার জন্যে।
(না, একই বাক্য তিনবার লেখা কোনো মুদ্রণ-প্রমাদ নয়, আমি ইচ্ছে করে লিখেছি যেন যারা পড়ছে তারা বিষয়টি জানে)।
খুব সহজেই সব বিশ্ববিদ্যালয় মিলে একটি সমন্বিত ভর্তিপরীক্ষা নেওয়া সম্ভব। আমাদের দেশের বড় বড় বিশ্ববিদ্যালয়গুলো যেহেতু টাকার লোভ ছেড়ে এই ধরনের একটা ভর্তিপ্রক্রিয়ার মাঝে যেতে রাজি নয়, তাই আমরা একবার ছোট দুটি বিশ্ববিদ্যালয় মিলে প্রক্রিয়াটা শুরু করেছিলাম। উদ্দেশ্য ছিল, সবাইকে দেখনো কাজটি কত সহজ এবং সেটি দেখে পরের বার হয়তো আরও বিশ্ববিদ্যালয় এগিয়ে আসবে। প্রায় সব আয়োজন শেষ করার পরও সেটি করা যায়নি। কারণ এই দেশের বামপন্থী রাজনৈতিক দলগুলো তার বিরুদ্ধে আন্দোলন শুরু করে দিল।
আমি তাই এই দেশের বামপন্থী রাজনৈতিক দলের নেতাদের, বড় বড় কমিউনিস্টদের খুঁজে বেড়াই এ কথা জিজ্ঞেস করার জন্যে যে, ''আপনারা না দেশের শোষিত মানুষের কষ্ট লাঘব করার জন্যে রাজনীতি করেন? তাহলে এই কমবয়সী কিশোর-কিশোরীরা কী দোষ করেছে? তাদের কষ্ট একটুকু কমানোর জন্যে চেষ্টা করা হলে আপনারা কোন যুক্তিতে তার বিরুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়েন?"
আমি এই প্রশ্ন করার জন্য এখনও কাউকে খুঁজে পাইনি।
২.
আমি যেহেতু ছোটদের জন্যে লেখালেখি করি, তাই ছোট ছোট ছেলেমেয়েরা আমার কোনো লেখা দেখলেই এটা তাদের জন্যে লেখা মনে করে সেটা পড়ে ফেলার চেষ্টা করে বলে শুনেছি। আমার এই লেখাটাও যদি তাদের চোখে পড়ে যায় এবং তারা যদি এটা পড়ে ফেলে, তাহলে তাদের খুব মন খারাপ হবে। কারণ এই পুরো লেখাটিতে এখন পর্যন্ত আমাদের দেশের লেখাপড়া নিয়ে একটি ভালো কথা লেখা হয়নি। এই দেশের লেখাপড়ার ব্যাপারে বলার মতো ভালো কথা একটিও নেই সেটাও তো সত্যি নয়। যেমন এই দেশের প্রায় ত্রিশ লক্ষ ছেলেমেয়ে পিএসসি পরীক্ষা দেয় এবং তার মাঝে ছেলে ও মেয়ে প্রায় সমান সমান। সত্যি কথা বলতে কী, ছেলে থেকে মেয়েদের সংখ্যা একটু বেশি। জেএসসি পরীক্ষা দেয় প্রায় বিশ লক্ষ; এসএসসি পরীক্ষা দেয় পনেরো লক্ষ এবং এইচএসসি পরীক্ষা দেয় প্রায় দশ লক্ষ ছাত্রছাত্রী। যদি হিসেব করি তাহলে দেখব, শুধু স্কুল আর কলেজেই তিন কোটি ছেলেমেয়ে লেখাপড়া করে। সবাই যখন ঠিক করে লেখাপড়া করবে, তখন কী একটা অসাধারণ ব্যাপার ঘটবে, সেটি কি কেউ চিন্তা করে দেখেছে?
এই তো সামনে ইংরেজি নববর্ষ এবং তখন দেশের সব ছাত্রছাত্রীর হাতে নুতন বই তুলে দেওয়া হবে। জানুয়ারির এক তারিখ স্কুলের ছেলেমেয়েরা তাদের নূতন বইগুলো বুকে চেপে ধরে মুখে বিশাল একটা হাসি নিয়ে বাড়ি ফিরে যাচ্ছে এর থেকে সুন্দর দৃশ্য পৃথিবীতে আর কী হতে পারে? শুধু তাই নয়, পাঠ্যবইগুলো আগের তুলনায় অনেক ভালো হয়েছে। ছাত্রছাত্রীরা আর কিছু না পড়ে যদি শুধুমাত্র পাঠ্যবইগুলো মন দিয়ে আগাগোড়া পড়ে তাহলেই কিন্তু লেখাপড়ার পুরোটুকু হয়ে যাবে। তাদের প্রাইভেট টিউটর কোচিং কিংবা ব্যাচে পড়তে যেতে হবে না। গাইড বই যদি ভুলেও খুলে না দেখে তাহলে তো কথাই নেই।
আমি নিশ্চিত, আগে হোক পরে হোক, আমাদের দেশের লেখাপড়ার বিষয়টা ঠিক হয়ে যাবে। তার প্রধান কারণ, তার জন্যে তো এই মুহূর্তে আলাদা করে কিছু করতে হবে না। ছেলেমেয়েদের আমরা শুধু একটু খালি উৎসাহ দেব, তাদের মাথার ভেতরের মস্তিস্কটাকে একটুখানি উসকে দেব, হাতে নূতন নূতন বই তুলে দেব, শিক্ষকদের একটুখানি সম্মান দেব, এর বেশি তো আমরা কিছু চাইছি না। একটা দেশে, সেই দেশের মানুষ কি আমাদের সেটুকুও দেবে না?
নিশ্চয়ই দেবে। যদি না দেয়, আমি আমার ভাঙা রেকডটি বাজিয়েই যাব।
মুহম্মদ জাফর ইকবাল: লেখক ও অধ্যাপক, শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়।