Published : 30 Nov 2015, 12:09 PM
এই নভেম্বরের প্রথমার্ধ্বে একই দিনে দুটো বিশেষ ঘটনা প্রত্যক্ষ করতে হয় বাংলাদেশকে। মহামান্য আদালত কর্তৃক 'পিতামাতা-হন্তারক' ঐশীর ফাঁসির আদেশটি পেয়েছি আমরা যে দিন, সে রাতেই নারায়ণগঞ্জের নৃশংস সাত হত্যাকাণ্ডের জন্য অভিযুক্ত পলাতক আসামি নূর হোসেনের ভারত হতে প্রত্যাগমন। দুটোই 'চাঞ্চল্যকর' ঘটনা। নিম্ন আদালতের রায়ে অল্পবয়সী, মতান্তরে হত্যাকাণ্ড সংঘটনের সময় অপ্রাপ্তবয়স্ক ঐশীর ফাঁসির আদেশ নিয়ে পক্ষে-বিপক্ষে তর্ক-বিতর্ক, জল্পনা-কল্পনার সময় এ জন্য জনতা কমই পেয়েছে। সন্ধ্যা ঘনিয়ে আসতেই নূর হোসেনের 'অতি-গুরুত্বপূর্ণ' সংবাদটি টিভি চ্যানেলের স্ক্রল রঙিন করে ফেলল। একাকী মামলা-লড়াই চালানো ঐশী তার জীবনের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ দিনটিতেও সুশীল সমাজ, বুদ্ধিজীবী, গণমাধ্যম, সাধারণ জনগণ, সাংবাদিক ও শিশু সুরক্ষাকর্মীদের দিক থেকে পক্ষে-বিপক্ষে মতামতপ্রাপ্তির সুযোগটি পেল না।
২০১৩ সালে যখন ঘটনাটি সংঘটিত হয়, তখন থেকেই মেয়েটি পুরো রাষ্ট্রের জনগণের চোখে অত্যন্ত ঘৃণিত, নৃশংস 'একটি' (জন নয়) খুনি, হত্যাকারী, আসামি হিসেবে অভিহিত হয়ে 'কুখ্যাত' হয়ে গিয়েছিল, যা রায় ঘোষণার পর আরও বেড়েছে। ইতোমধ্যেই সামাজিক গণমাধ্যমসহ প্রিন্ট, ইলেকট্রনিকসহ অনেক মিডিয়াতে অনেকেই রায়-পরবর্তী মতামত দিয়েছেন। সে মতামতগুলো বেশিরভাগই ঐশী ব্যক্তিটিকে দায়ী করে, সর্বোপরি সমাজকে দায়ী করে অত্যন্ত সুচিন্তিত বিশ্লেষণধর্মী লেখা যা সত্যিই চিন্তার খোরাক যোগায়। সামাজিক গণমাধ্যমে সে লেখাগুলোর নিচে সাধারণ পাঠকের কখনও সুচিন্তিত, কখনও আবেগী সহানুভূতির চাইতে তীব্র ঘৃণা প্রকাশের অনুভূতি বেশি জোরালো দেখা গেল। এমনকি, কেউ সহানুভূতিমূলক কিছু লিখলেও তাকে অন্যদের 'যৌক্তিকতার' কোপানলে পড়ে পাল্টা আক্রমণের শিকার হতে দেখা গেছে।
অথচ ঘটনাটি ঘটানোর আগে থেকেই যদি দেখি, তাতে ভিকটিম কিন্তু প্রথম থেকে সেই ঐশী। যদিও হত্যাকাণ্ডের সঙ্গে সঙ্গে যেভাবেই হোক জড়িত হয়ে সে আজ সবার চোখে 'নির্মম খুনি'। পরিবারে একটি শিশুর আগমন সব সময় পরম আরাধ্য। আর সে যদি হয় প্রথম শিশু, সর্বোপরি কন্যাশিশু, তবে ক্ষেত্রবিশেষে সে হয়ে উঠে লক্ষ্মী, মা-বাবার চোখের মনি, জীবন্ত খেলনাস্বরূপ। ঐশীর জন্মলগ্নেও নিশ্চয়ই তার মা-বাবার তেমনটি লেগেছিল। সে বেড়ে ওঠে মা-বাবার আদরে, শাসনে এবং সম্ভবত সে ক্ষেত্রে বলা যায়, একটু ভারসাম্যহীন পরিচালনে।
শিশু মনোবিদগণের মতে, শিশুর জীবনের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ সময়টি হল, তার জীবনের প্রথম দশ বছর। এ ক'টি বছরে তার সারাজীবনের ভিত্তি তৈরি হয়ে যায়। পরবর্তীতে সে যে পরিবেশে যেভাবেই বেড়ে উঠুক না কেন, এ দশটি বছর তাকে সারাজীবন চালিত করে, ধাবিত করে।
শিশু সুরক্ষাকর্মী হিসেবে, শিশুদের নিয়ে বেশ কিছু বছরের কাজের অভিজ্ঞতায় দেখেছি, প্রাক-কৈশোর, কৈশোর এবং তারুণ্যে প্রবেশের সন্ধিক্ষণটি কত বিশেষ সংবেদনশীল সময়, যে সময়টিতে একটি শিশুর মানসিক যত্ন নিতে হয় সবচেয়ে বেশি। আর এ ক্ষেত্রে মা-বাবাকেই পালন করতে হয় সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা, যা বলতে গেলে তাদের জন্য এক কঠিন পরীক্ষা। এ সময়টি মা-বাবার সঙ্গে তৈরি হয় সবচেয়ে বড় দূরত্ব অথবা আন্তরিক নৈকট্য।
দ্বিতীয়টি অবশ্য আমাদের দেশের প্রেক্ষিতে বেশ অপ্রতুল বা বলা যায় অ-প্রকাশ্য, যেটির প্রয়োজনই সবচেয়ে আকাঙ্ক্ষিত সন্তানদের কাছে, এ সংকটময় মুহূর্ত পাড়ি দিতে। হাঁটতে শিখিয়ে দেবার পর একমাত্র এ সময়টিতেই আবার সন্তানদের আগলে রাখার প্রয়োজন হয়ে পড়ে সবচেয়ে বেশি। কারণ আকস্মিক, বিড়ম্বনাময় নিয়মিত শারীরিক পরিবর্তনগুলোর পাশাপাশি মনোজগতে যে বিপুল প্রশ্ন, আগ্রহ, চিন্তা, কৌতূহল, আবেগের ঝড় বইতে থাকে কোনো শিশু বা কিশোরের পক্ষে, এই বৈশ্বিক পরিবর্তনের সময়ে একাকী মোকাবেলা করা অসম্ভব। তাদের এ সময়ে নানা প্রশ্ন থাকবে; মনে এ সময়ে বিপুল আবেগের যে অস্থিরতাময় সংবেদনশীল সময়টি যেতে থাকবে তাতে নিজের জন্য সঠিক বা সঠিক নয় বিচারের ভার বা বোধ থাকার কথা নয়। কারণ, এ সময়টিতেই মানবদেহের হরমোনাল পরিবর্তন হয় সবচেয়ে বেশি এবং অতি দ্রুততার সঙ্গে।
ভুলে গেলে চলবে না, আমাদের আবেগ নিয়ন্ত্রিত হয় এই হরমোনের দ্বারাই। এ সময়টায় শিশুকে 'বুঝতে না পারলে' সে যতটা একাকী হয়ে যায় তখন তার চেয়ে হতভাগ্য আর কেউ হয় না।
মেনে নিচ্ছি, ঐশী বড় সন্তান হওয়ায় এবং এ সমাজের অনিরাপদ ও প্রতিকূলতায় 'কন্যাসন্তান' হিসেবে বেড়ে ওঠায় মা-বাবার শাসন ছিল বেশি; তা থাকবেই। তবে, সম্ভবত বেশ কড়াই ছিল– যখন যে পরিস্থিতিতে তা লঘু হবার ছিল এবং বেশ লঘু বা আদৌ ছিলই না– যখন তার সে 'শাসন'এর বড্ড প্রয়োজন ছিল।
আমি মা-বাবার এ 'দেখে রাখার' ভূমিকাকে 'শাসন' বলতে নারাজ। কারণ, অভিধানে শাসন শব্দের অর্থ কোনো রাজা বা রাষ্ট্রীয় সর্বোচ্চ ক্ষমতাধর ব্যক্তির দ্বারা কোনো দেশ পরিচালনা। আমাদের সমাজে মা-বাবার এই শাসনের কোনো সমার্থক বাংলা বা ইংরেজি শব্দ নেই, বরং আছে, 'গুড প্যারেন্টিং' যার বাংলা হতে পারে সু-অভিভাবকত্ব। মা-বাবার ভূমিকা শাসকের ভূমিকা হতে যাবে কেন? তাহলে, জীবনের প্রথম বন্ধুর ভূমিকা পালন করবে কে বিপদসঙ্কুল সময়ের সমুদ্রে পতিত হাবুডুবু খাওয়া কিশোর বা কিশোরীটির? সে একা নিজেকে উদ্ধার করবে?
সন্তান এ সময়টিতে অনেক অযৌক্তিক, অগ্রহণযোগ্য আচরণ করবেই। সব দেশের, সব সমাজের মা-বাবাদেরই সন্তানের এ বয়ঃসন্ধিকালীন সময়ে (যাকে ইংরেজিতে এডোলেসেন্ট বলা হয়) তা পার করতে হয় অত্যন্ত ধৈর্যের সঙ্গে, বলা যায় অসীম ধৈর্যের পরীক্ষা দিয়ে। কোনটি যৌক্তিক ও কোনটি অগ্রহণযোগ্য, অযৌক্তিক সেটা বুঝতে পারার মতো শক্তি এ বয়ঃসন্ধিকালীন সময় তাদের দেয়ইনি। ওরা ভুল করবেই, যা তাদের চিন্তাশক্তিতে ভুল হয়তো-বা নয়ই। সে ক্ষেত্রে বন্ধু মা-বাবাই একমাত্র বোঝাতে পারেন কেন সেটি সঠিক নয়, দারুণ কাউন্সেলিংয়ের মাধ্যমেই।
প্রথমদিকে সন্তানের কাছ থেকে যে প্রতিক্রিয়া তাঁরা পাবেন, তা হয়তো সুখকর নাও হতে পারে। সেখানেই প্রয়োজন অসীম ধৈর্যের। পাশাপাশি দরকার সমসাময়িক সংশ্লিষ্ট বিষয় সম্পর্কে যথাযথ বৈশ্বিক জ্ঞান। আর গ্রামাঞ্চলে যে মা-বাবাদের সে যথাযথ শিক্ষা বা অবস্থা নেই, সেখানে এ মূল্যবান ভূমিকা পালন করবেন বিদ্যালয় ও কলেজের শিক্ষকবৃন্দ। আমরা সবাই জানি, শহর আর গ্রামের প্রেক্ষাপট অবশ্যই ভিন্ন। কিন্তু একটি বয়ঃসন্ধিকালীন সময়ের শিশু বা কিশোর কিন্তু মানসিকভাবে একই দুর্যোগের পৃথিবীতে ভ্রমণরত।
ঐশী যখন ঘটনাটির সঙ্গে জড়িত হয় তখন সে শিশু অর্থাৎ আঠারর কমবয়সী ছিল। সে নিজে কাজটি সম্পাদন করলেও তার বাবা নিহত পুলিশ ইন্সপেক্টর মাহফুজুর রহমানের ভাই যিনি বাদী হয়ে মামলা করেছিলেন, বলেছেন, ঐশী সজ্ঞানে, শুধু নিজের আক্রোশেই এত বড় কাণ্ড একা ঘটাতে পারে না। যাহোক, তদন্তের বিষয় বলে সে দিকে যাব না। শুধু বলছি, সে সময়ে ঐশীর প্রতি যে প্রাপ্য উদারতা একজন 'শিশু' হিসেবে তার পাওনা ছিল, তা কি সে পেয়েছিল? ওকে 'আসামি', 'খুনি', 'হত্যাকারী, 'ফাঁসি চাই' বলে অভিবাদন জানানো হচ্ছিল। প্রকাশ্যে তাকে আনা-নেওয়া, টিভি মিডিয়ার সাংবাদিকদের এক্সক্লুসিভ ফুটেজ জোগাড়ের জন্য নারী পুলিশ কর্তৃক জোর করে ওর মুখের আচ্ছাদন তুলে গর্বভরে 'এত বড় আসামি' (মনে হচ্ছিল যুদ্ধাপরাধের চেয়েও বড়) সবাইকে দেখানো, এসবই আমরা দেখেছি।
অথচ, বিভিন্ন দেশের আইন এবং বাংলাদেশের একাধিক আইনেও বলা আছে, আসামি ও ভিকটিম, কারও পরিচিতি-সংশ্লিষ্ট ছবি ও আইডেন্টিক্যাল তথ্যাদি জনসমকক্ষে প্রকাশ করা যাবে না। বিশেষ করে আসামি ও ভিকটিম যদি শিশু ও নারী হয় তার জন্য এটি বিশেষভাবে পালনীয়। আমরা কি তার প্রতিফলন দেখেছি ঐশীর ঘটনায়?
শিশু আইন ২০১৩এ বলা আছে, আঠারর নিচে কোনো শিশু যদি এ ধরনের কোনো অপরাধ ঘটায়, তাকে অপরাধ বলা যাবে না এবং শিশুটিকে 'আসামি', 'খুনি', 'হত্যাকারী' বলে অভিহিত করা যাবে না। বরং বলতে হবে, 'আইনের সঙ্গে সাংঘর্ষিক শিশু'। তার অপরাধ সংঘটনের বয়সটি বিশেষভাবে বিচার্য থাকে। তার বিচার করতে হবে শিশু আদালতে। গৃহকর্মী সুমির বেলায় তার বয়স সন্দেহাতীতভাবে শিশু ছিল বলে তা অবশ্য করা হচ্ছে। কিন্তু গণমাধ্যম-সংক্রান্ত নিয়মগুলো সুমির বেলায়ও পালন করা হয়নি।
অনেকেই বলেছেন, ঐশীর বেলায় দৃষ্টান্তমূলক শাস্তিটির প্রয়োজন ছিল যাতে অন্য সবাই সাবধান হয়। এমন ঘটনা কি দেশে বা পৃথিবীতে এটি প্রথম ঘটল? বা, ঐশী কি নিজেও জানত না এ ধরনের ঘটনার পরিণতি কী হতে পারে? অবশ্যই জানত। অন্যরাও জানে। তাই বলে কি এহেন ঘৃণ্য অপরাধ সংঘটন রাতারাতি বন্ধ হয়ে যাচ্ছে? মাথাব্যথায় মাথা কেটে ফেলে, চোখের বদলে চোখ তুলে এভাবে নিরাময় সম্ভব কি? যদি সামাজিক ব্যাধিটি কোথায় তা-ই বুঝে না বুঝে দুটি ডানায় ঢেকে দিয়ে বসে থাকি?
আমাদের সামাজিক কাঠামোর কিছু বিষয়ও প্রশ্নাতীত রয়ে যায়। এখানে পুরুষদের প্রাধান্য ও কর্তৃত্ব অবিতর্কিতভাবে মেনে নেওয়া হয়। ফলে বাবাদের ইগো এত প্রবল হয়ে ওঠে যে, সন্তানের সামনেও তাদের প্রবল পরাক্রমশালী পুরুষের ভূমিকা পালন করে যেতে হয়। নইলে সন্তান শাসন মানবে না! বাবা কি তবে রাশভারি, অনেক দূর আকাশের ভয়-করা তারা? মাকেই-বা কেন মেয়ের বন্ধু না হয়ে পদে পদে ভুল ধরিয়ে দেওয়া, কড়া শাসনে রাখা, শারীরিক পরিবর্তনের সময় মেয়ের নিজের নতুন শরীরকে তার সঙ্গে পরিচয় না করিয়ে বরং উল্টো তাকেই বিব্রত করে, অপরাধবোধে ভুগিয়ে তীব্র অপ্রস্তুত করে ফেলা মা হতে হবে?
মা আর বাবা হওয়া তবে কি শুধু নিজেদের প্রয়োজনে? সে তো জন্মদাতা-জন্মদাত্রী পৃথিবীর আপামর সমস্ত প্রাণিকূল। মা-বাবা হয়ে ওঠা আরও একটু মানবিক পরিশ্রমলব্ধ দায়িত্ব বৈকি।
ঐশীর মা-বাবা বেঁচে নেই। এ লেখাটি তাদের আর কোনোদিনই পড়ে ওঠা হবে না, প্রয়োজন হবে না। তবে, আজ কিছু বর্তমান 'জন্মদাতা-জন্মদাত্রী' এবং ভবিষ্যতের ঐশী নামের সন্তানের হবু মা-বাবারা যদি এতটুকু পড়ে থাকেন, আর তার মাধ্যমে যদি একজন সুপথে পরিচালিত ঐশী মা-বাবার জন্যে নিজেকে গর্বিত ভাবে, এ লেখা সেই অনাগত ঐশীর জন্যে। আর কোনো ক্ষমাহীন আদরের নিঃসঙ্গ ঐশী এমন কোনো জন্মদাতা-জন্মদাত্রীর মাধ্যমে পৃথিবীতে না আসুক।
ফোটার আগেই ঝরে যাওয়া, আলো ছড়াবার আগেই নিভে গিয়ে হৃদয়-পোড়ানো কোনো প্রাণ আর যেন আঁধারে ডুবে না যায়।