শিক্ষকতাকে জীবিকা অর্জন এবং রাজনৈতিক লেজুড়বৃত্তির কেন্দ্রবিন্দু থেকে বের করে শিক্ষার্থীর হৃদয়ে নীতি ও নন্দনবোধ জাগানোর চিরায়ত ধারায় ফিরিয়ে আনতে হবে।
Published : 05 Oct 2024, 03:38 PM
অযুত দিবসের ভিড়ে বিশ্ব শিক্ষক দিবস স্বতন্ত্র মহিমায় মহিমান্বিত একটি দিন। ইউনেসকোর বদৌলতে প্রতিবছর ৫ অক্টোবর বিশ্ব শিক্ষক দিবসটি আসে ভিন্ন ভিন্ন বার্তা নিয়ে। বাংলাদেশেও বেশ দিবসটি পালিত হয়ে আসছে সরকারি, বেসরকারি নানা কর্মসূচির মধ্য দিয়ে। কিন্তু এবছর বাংলাদেশে একটি ভিন্ন পরিস্থিতির মধ্যে দিবসটি এসেছে। এবার বিশ্ব শিক্ষক দিবসের প্রতিপাদ্যটি যখন– শিক্ষায় শিক্ষকের মতামতকে মূল্য দেওয়ার কথা বলছে, ঠিক তখন বাংলাদেশে শিক্ষকতা পেশায় থাকা মানুষেরা পার করছেন এক অস্থির সময়। অবক্ষয়গ্রস্থ শিক্ষায়তন, শিক্ষক, শিক্ষার্থী। ধসে পড়া মূল্যবোধ। ঝড়ে বিধ্বস্ত ক্ষেতের মতোন আমাদের শিক্ষাব্যবস্থা। শিক্ষার সাধনা থেকে শিক্ষকের জীবনাদর্শ— অধঃপতনের মুখে পথ হারিয়ে, আলো হারিয়ে যেন দাঁড়িয়ে আছে খাদের কিনারে।
শিক্ষক দিবসে পুরো পৃথিবী শপথ নিচ্ছে সমাজকে এগিয়ে নিতে শিক্ষকদের ক্ষমতায়নের। বিপরীতে, বাংলাদেশে সরকার নিজেদর গঠিত পাঠ্যপুস্তক সংশোধন ও পরিমার্জনের জন্য সমন্বয় কমিটি বাতিল করতে হলো গঠনের মাত্র ১২/১৩ দিনের মাথায়, একটি বিশেষ গোষ্ঠীর চাপে। শুধু তাই নয়, ওই কমিটি বাতিলের যে ব্যাখ্যা দিল তা মেনে নেওয়ার মতো নয়। এই যখন ঘটছিল উপরমহলে তখন প্রায় একই সময়ে কুমিল্লার দেবিদ্বার উপজেলার মোহনপুর উচ্চ বিদ্যালয়ে প্রধান শিক্ষকের পদত্যাগ দাবি করে তার চেয়ারে বসে ওই স্কুলের দশম শ্রেণির এক শিক্ষার্থী ছবি তুলে ছড়িয়ে দেয় সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে। এরসঙ্গে আরও একটি ঘটনা যুক্ত করা যায়।
গত ২৪ সেপ্টেম্বর ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়ে উপাচার্য হিসেবে যোগ দেন অধ্যাপক ড. নকীব মোহাম্মদ নসরুল্লাহ। যোগদানের দিন বিশ্ববিদ্যালয়ের বিএনসিসি নবনিযুক্ত উপাচার্যকে গার্ড অব অনার প্রদান করে। সেই অনুষ্ঠানে উপাচার্যের সঙ্গে উপস্থিত ছিলেন বৈষম্য বিরোধী ছাত্র আন্দোলন, ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়ের সমন্বয়ক এস এম সুইট এবং সহ-সমন্বয়ক নাহিদ। বিশ্ববিদ্যালয়ের সাধারণ শিক্ষার্থী হয়েও অন্য শিক্ষার্থীদের কাছ থেকে গার্ড অব অনার নেওয়ায় ক্যাম্পাসে বেশ বিতর্ক ওঠেছে। বিশ্ববিদ্যালয়ের সাধারণ শিক্ষার্থীদের মাঝে এ নিয়ে চরম ক্ষোভ দেখা দিয়েছে, শুরু হয়েছে নানা আলোচনা-সমালোচনা। ইতোমধ্যে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে অনেকেই এ ঘটনা নিয়ে এখনও উষ্মা প্রকাশ করে চলেছেন।
এভাবে প্রতিদিন কোথাও না কোথাও শিক্ষকরা নিজেদের সম্মান বিলিয়ে দিচ্ছেন। তাদের অপদস্থও করা হচ্ছে। হয়রানির শিকার হচ্ছেন। যে শিক্ষার্থীদের হাত ধরে বৈষম্যহীন বাংলাদেশের স্বপ্ন জাগরিত হল, ওই শিক্ষার্থীরাই এখন দ্বিধাবিভক্ত।
বলা যায়, এক সহিংসতাসংকুল আর উদ্বেগাক্রান্ত সময়ে বাংলাদেশে এসেছে এবারের শিক্ষক দিবস। শিক্ষা এবং শিক্ষকতা নিয়ে এক বেদনাভরা মৌসুমে দিবসটি কতটুকু আশা জাগাবে সেটি ভাববার বিষয়। ভয়ঙ্কর সহিংসতা, অভ্যুত্থান এবং ব্যাপক রাজনৈতিক পট-পরিবর্তনের পর তুমুল অস্থির একটি সময় অতিক্রম করছে বাংলাদেশ। আর শিক্ষক এবং শিক্ষার্থীরা আছেন ওই পটভূমির কেন্দ্রে। এ অবস্থায় দাঁড়িয়ে কী ভাবা যায়!
জুলাই-অগাস্টের অভ্যুত্থানের পর শিক্ষা সংস্কারের কথা জোরেশোরে উঠলেও দৃশ্যত কোনো অগ্রগতি নেই। উল্টো হোচট খেল পাঠ্যক্রম পরিমার্জন উদ্যোগ। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলো বিশেষ করে বিশ্ববিদ্যালয়গুলো সচল হচ্ছে যত, ততই ধেয়ে আসছে পুরনো আতঙ্ক। প্রতিশোধ, প্রতিহিংসা ফিরে আসছে ক্যাম্পাসে।
এই শিক্ষক দিবসে বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে সবচেয়ে জরুরি কাজটা হচ্ছে শিক্ষাক্ষেত্রে সংস্কারের উদ্যোগ নেওয়া। শিক্ষাক্ষেত্রে সংস্কার নিয়ে ইতোমধ্যে কথা শুরু হয়েছে বিভিন্ন ফোরামে। আসছে খুবই গুরুত্বপূর্ণ পরামর্শ এবং সুপারিশ। এর মধ্যে শিক্ষাক্রম সংস্কার করা, শিক্ষকের জীবনমান উন্নয়নের জন্য স্বতন্ত্র বেতন কাঠামো, শিক্ষক নিয়োগ পদ্ধতিতে পরিবর্তন, গবেষণার সুযোগ সৃষ্টি, বাজেট বরাদ্দ বৃদ্ধি ইত্যাদি উল্লেখযোগ্য। কিন্তু তার আগে একটি পূর্ণাঙ্গ শিক্ষাদর্শন আমাদের প্রয়োজন। আমরা আসলে কী চাই? রাষ্ট্র কোন ধরনের নাগরিক চায়? বাংলা মাধ্যম, ইংরেজি মাধ্যম, মাদ্রাসা, এমপিও, নন এমপিও, সরকারি, বেসরকারি— এমন উদ্ভট, বিচিত্রধারার শিক্ষা পৃথিবীর আর কোথাও আছে কিনা জানা নেই। আমরা জানি না কেমন প্রাথমিক বিদ্যালয় চাই, কেমন মাধ্যমিক, উচ্চমাধ্যমিক শিক্ষালয় চাই, কেমন বিশ্ববিদ্যালয় চাই! আমরা জানি না, আমাদের সন্তানেরা বড় হয়ে কী হবে? তাদের ক্যারিয়ার, চরিত্র, মানবিকতা কেমন হবে কিচ্ছু জানি না। আমরা শুধু কাক ডাকলে স্কুল ব্যাগ নিয়ে বের হই, সন্ধ্যা নামলে কোচিং হয়ে বাসায় ফিরি! ক্লান্ত চোখে এ প্লাস খুঁজে বেড়াই, বিশ্ববিদ্যালয়ে ভালো চাকরির সন্ধান দেয় এমন বিষয়ে পড়তে চাই, পাঠাগারে বসে চাকরির প্রস্তুতি নিতে থাকি। মানুষ হওয়ার, হৃদয়বৃত্তির বিকাশের পথ খুঁজি না। এত অব্যবস্থাপনা, এত অরাজকতা নিয়ে তো শিক্ষা কোনো স্বপ্ন দেখাতে পারে না। সেই পাকিস্তান আমল থেকে আমাদের শিক্ষায় বৈষম্য চলেই আসছে। শিক্ষার স্তরে স্তরে বৈষম্য। শিক্ষকতার পদে পদে বৈষম্য। স্বাধীনতার এতগুলা বছর গেল, এতগুলো কমিশন হলো কিন্তু এতদিনেও শিক্ষার একটি সুনির্দিষ্ট লক্ষ্য স্থির করা সম্ভব হলো না। তার ওপর আছে সীমাহীন দুর্নীতি, অনিয়ম, জবাবদিহিতার অভাব এবং স্বেচ্ছাচারিতা।
যেখানে পুরো পৃথিবী আছে শিক্ষা এবং শিক্ষকতার নিরন্তর উৎকর্ষ সাধনে, সেখানে বাংলাদেশে শিক্ষকরা আছেন কোনোমতে খেয়েপরে জীবন বাঁচানোর লড়াইয়ে। মেধাবীরা যুক্ত হওয়ার মতো কোনো আকর্ষণ নেই এ পেশায়। যারা নির্মাণ করবে জাতির মেরুদণ্ড তারা নিজেরাই দাঁড়াতে পারছে না সোজা হয়ে। বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই জীবনযাপনের নূন্যতম চাহিদা মেটানো দায় হয়ে পড়েছে এই পেশায়। ফলে ক্রমশ ম্রিয়মাণ হচ্ছে আদর্শ সমাজ বিনির্মাণের স্বপ্ন। এখনো শিক্ষকের প্রতি আমাদের সমাজের মনোভঙ্গির প্রকাশ ‘আহারে মাস্টার’ বলে করুণার চেহারায়।
তাই শিক্ষক দিবসে দাঁড়িয়ে বলি, কোচিং, গাইডবই আর প্রাইভেট টিউশনের চোরাগলিতে হারিয়ে যাওয়া আমাদের শিক্ষাকে ফিরিয়ে নিয়ে আনতে হবে শিক্ষার মৌলিক দর্শনের পথে। জ্ঞান অন্বেষার এক অসীম, অনন্ত সাগরে ভেসে বেড়ানোর আমন্ত্রণে যুক্ত করতে হবে শিক্ষার্থীদের। একইসঙ্গে শিক্ষকতাকে জীবিকা অর্জন এবং রাজনৈতিক লেজুড়বৃত্তির কেন্দ্রবিন্দু থেকে বের করে শিক্ষার্থীর হৃদয়ে নীতি ও নন্দনবোধ জাগানোর চিরায়ত ধারায় ফিরিয়ে আনতে হবে। শিক্ষাকে বাজারবান্ধব করার ফাঁদ থেকে বের করে নিয়ে এসে মানুষের মনোজগতের উন্মেষ ঘটানোর প্রয়াস হিসেবে বিবেচনা করতে হবে। বাংলাদেশের অন্তর্বর্তী সরকারের কাছে প্রত্যাশা, শিক্ষা সংস্কারের একটি বিশেষ উদ্যোগ গ্রহণ করার। শুধু পাঠ্যবই, সিলেবাস, আর মূল্যায়ন পদ্ধতি নয়, একটি টেকসই উদ্যোগ নিতে হবে যাতে শিক্ষক, শিক্ষার্থী এবং অভিভাবক কাউকেই কোনো কারণে আর হা-হুতাশ করতে না হয় পড়ালেখা নিয়ে। বর্তমান সরকারকে মনে রাখতে হবে, ইতোমধ্যে যে সংস্কার উদ্যোগগুলো নেওয়া হয়েছে সেগুলোর স্থায়িত্ব নির্ভর করবে একটি আদর্শ শিক্ষাব্যবস্থার ওপর।
আমাদের মনে রাখতে হবে, একজন শিক্ষক যখন শ্রেণিকক্ষে প্রবেশ করেন, শিক্ষার্থীর দিকে তাকান তখন শুধুই খাতা, কলম, বই-ই দেখেন না, দেখেন শিক্ষার্থীর চোখে খেলারত অযুত স্বপ্ন, তার বাবা-মায়ের আকুলি-বিকুলি, তার সংগ্রাম-শপথ। দ্রষ্টার মতো শিক্ষার্থীর চোখে খুঁজে ফেরেন আগামীকে। একটা দেশের শিক্ষাব্যবস্থা ভ্রান্ত পথে পরিচালিত হলে ওই দেশ, দেশের অগ্রযাত্রা স্থবির হয়ে পড়ে। একটি দেশ এগিয়ে যাওয়া মানে শুধু ব্রিজ, কালভার্ট আর দালান-ইমারত নয়। দেশের মানুষের মনোজাগতিক উৎকর্ষের ওপর নির্ভর করে তার অগ্রগতির মানদণ্ড। এটা আমাদের সবার মনে রাখা উচিত যে, শিক্ষাব্যবস্থা মানে শুধু একটি পরিকল্পনা কাঠামো নয় বরং এটি একটি গুরুত্বপূর্ণ উন্নয়ন প্রক্রিয়াও। ওই প্রক্রিয়াকে গতিশীল রাখতে না পারলে এগিয়ে যাওয়া সম্ভব হয়। তাই বিশ্ব শিক্ষক দিবসে বাংলাদেশের প্রেক্ষিতে প্রত্যাশা থাকল, একটি সুদূরপ্রসারী শিক্ষা কমিশন গঠনের যেখানে সকল বৈষম্য দূরীকরণের উপায় বাতলে দেওয়া থাকবে, থাকবে একটি টেকসই, উদার, মানবিক সমাজ বিনির্মাণের নির্দেশনা।