Published : 06 Sep 2015, 11:34 PM
তুরস্কের উপকূলে ভেজা বালিতে উপুড় হয়ে পড়ে থাকা, নিলুফার দেমির ক্যামেরায় তোলা আয়লান কুর্দির ছবিটি বিশ্বজুড়ে হৈচৈ ফেলেছে। ছবিটি যারাই দেখেছে, তাদের মন মুহূর্তের জন্য হলেও যন্ত্রণায় কেঁদে ওঠার কথা। অদূরেই পড়ে ছিল আয়লানের বড় ভাই গালিপের মৃতদেহ। ওদের বাবা আবদুল্লা যুদ্ধবিধ্বস্ত সিরিয়া ছেড়ে নিরাপদ আশ্রয়ের খোঁজে দুই সন্তান ও স্ত্রীকে নিয়ে রাত তিনটায় দেশ ছেড়ে পালিয়ে ছিলেন।
এবারই প্রথম নয়, আগেও বহুবার দালালের মাধ্যমে সিরিয়া ছাড়তে চেয়েছিলেন আবদুল্লা। নৌকার সংকটের কারণে প্রতিবারই পরিকল্পনা বাদ দিতে হয়েছে। তার বোন কানাডা-প্রবাসী টিমা কুর্দি তাদেরকে কানাডায় পাড়ি দেওয়ার জন্য চার হাজার ইউরো পাঠিয়েছিলেন। এই টাকাই আবদুল্লার জীবনে ঝড় বয়ে আনে। দালালের সঙ্গে স্টিলের বড় নৌকায় সমুদ্রযাত্রার চুক্তি থাকলেও দালাল প্রতারণা করায় ছোট রাবারের নৌকায় রওনা দিতে বাধ্য হয়েছিলেন তারা। এমনকি মৃত গালিপের গায়ে লাইফ জ্যাকেটও পাওয়া যায়নি।
পনের ফুটের দৈত্য ঢেউ আবদুল্লার চোখের সামনেই দুই সন্তান ও স্ত্রীকে ভাসিয়ে নিয়ে যায়। আবদুল্লা কেন এভাবে দুই সন্তান ও স্ত্রীকে নিয়ে মৃত্যুর পথ পাড়ি দিতে গেলেন সে অভিযোগ উঠছে তার প্রতি। আবদুল্লার আকুতি, 'আর কোনো কিছুর মূল্য আমার কাছে নেই। আমার যা কিছু মূল্যবান ছিল, তা হারিয়েছি।' তার দাবি, যে করেই হোক, শরণার্থী সমস্যার স্থায়ী সমাধান করা হোক। আবদুল্লার বোন টিমাও বললেন, 'যে কোনো উপায়েই হোক, যুদ্ধ বন্ধ করতে হবে।'
প্রশ্ন হল, আবদুল্লার আকুতি ও টিমার আবেদন কি পুঁজিবাদী রাজনীতির কর্ণধার ও আরবের স্বৈরশাসকদের কর্ণকুহরে প্রবেশ করবে? যে বৈশ্বিক বাস্তবতায় আমরা রয়েছি, তার ভিত্তিতে বলতেই হয়, 'না, এই সমস্যার আশু সমাধান নেই।' বরং এটি বলা যায়, আজকের এই শরণার্থী সমস্যা আরব এলাকার ভবিষ্যৎ রাজনীতিতে অরাজকতা ও নৈরাজ্যের প্রাথমিক উপসর্গ মাত্র। খেলার আরও অনেক বাকি।
আরবের বাসিন্দা হলেও একজন শরণার্থীরও যখন সম্পদশালী আরবের কোনো দেশে স্থান হয়নি, তখন সমস্যাটির বহুমাত্রিক চরিত্র অনুসন্ধানের প্রয়োজনীয়তা অপরিহার্য হয়ে পড়ে। সংস্কৃতি ও বিশ্বাসগত সাদৃশ্য থাকার পরও আরবের কোনো দেশে এদের ঠাঁই হচ্ছে না কেন? উদার ও মানবিক ইউরোপ কেনই-বা শরণার্থীদের ব্যাপারে কঠোর অবস্থান নিয়েছে?
শরণার্থী ইস্যুতে ইউরোপিয়ান ইউনিয়নের টিকে থাকার বাস্তবতা নিয়ে জটিলতা দেখা দিয়েছে। কারণ সিরিয়ার গৃহযুদ্ধ শুরু হওয়ার পর থেকেই শরণার্থীরা ইউরোপের দিকে যেতে থাকে। মানব-পাচারকারীরা সুযোগটি লুফে নেয়। গত আগস্ট থেকে অস্থিতিশীল আরবের বিভিন্ন দেশ, আফ্রিকার লিবিয়াসহ আফগানিস্তান থেকে পশ্চিম ইউরোপে নিরাপদ আশ্রয়প্রার্থীদের সংখ্যা জ্যামিতিক হারে বাড়তে থাকে। আন্তর্জাতিক অভিবাসন সংস্থার (আইওএম) হিসাব অনুয়ায়ী সাড়ে তিন লাখ শরণার্থী মেসিডোনিয়া, সার্বিয়া ও হাঙ্গেরি হয়ে পশ্চিম ইউরোপে গিয়েছে। এখনও হাঙ্গেরিতে ৫৪ হাজার, গ্রিসে ৬৭ হাজার ও ইতালিতে ৪০ হাজার শরণার্থী আটকে পড়ে রয়েছে।
গত মাসে জার্মান সরকার যখন ঘোষণা দিল জার্মানি সকল সিরিয়ান শরণার্থীকে আশ্রয় দিতে ইচ্ছুক, ঠিক তখনই ইউরোপিয়ান ইউনিয়নের সদস্য রাষ্ট্রগুলির মধ্যে মতপার্থক্য দেখা গেল। হাঙ্গেরি তার সীমান্তে কড়াকড়ি আরোপসহ বুদাপেস্ট রেল স্টেশন থেকে যে সকল ট্রেন অস্ট্রিয়া হয়ে জার্মানিতে যায়, সেগুলি বন্ধ করে দেওয়ার সিদ্ধান্ত নেয়।
হাঙ্গেরির এই সিদ্ধান্তে ইইউ সদস্য রাষ্ট্রের অভিবাসনবিরোধী রাজনৈতিক দলগুলি সমর্থন জানিয়েছে। শ্লোভাকিয়ার পররাষ্ট্রমন্ত্রী ইইউ সদস্য রাষ্ট্রগুলিকে যে কোনো মূল্যে সীমান্তে বিধিনিষেধ আরোপের উপর গুরুত্ব প্রদান করতে আহ্বান জানান। তিনি সীমান্ত ব্যবস্থাপনা ভেঙে যাওয়ার শঙ্কা প্রকাশ করেন। আবার ইইউএর উদার রাজনৈতিক সমাজ সমস্যাটির সমাধানে মানবিকতা প্রদর্শনের আহ্বান জানান। জার্মানির এক রাজনৈতিক নেতা কট্টর অভিবাসনবিরোধী নীতির সমালোচনা করে বলেন, শরণার্থী সমস্যার সমাধান না হলে ইইউএর সীমান্ত কেবল নয়, ইইউ স্বয়ং ভেঙে যাবে।
যাহোক, ইইউএর জরুরি সভায় সিদ্ধান্ত হয় ইইউএর দেশগুলি ১ লাখ ৬০ হাজার শরণার্থীকে আশ্রয় দিবে। এর মধ্যে জার্মানি ৩৫ হাজার, ফ্রান্স ২৬ হাজার, স্পেন ১৬ হাজার এবং ইউরোপের অন্যান্য দেশগুলিতে বাকি শরণার্থীরা আশ্রয় পাবেন। উল্লেখ্য, যুক্তরাজ্য কোনো শরণার্থী নিতে রাজি হয়নি। হাঙ্গেরি, নেদারল্যান্ডসহ অন্যান্য রাষ্ট্র ইইউর সিদ্ধান্ত কতটা অনুসরণ করে, সেটি এখন বড় প্রশ্ন।
কেন তারা শরণার্থীদেরকে আশ্রয় দিতে চাচ্ছে না, রাখঢাক না করেই সেটির একটি স্পষ্ট ব্যাখ্যাও হাঙ্গেরির প্রধানমন্ত্রী ভিক্টর ওরবান দিয়েছেন। তার ব্যাখ্যার মূলে রয়েছে আন্তঃধর্মীয় অবিশ্বাস ও ঐতিহ্যগত মূল্যবোধের সহজাত দ্বন্দ্ব। তিনি বলেন, 'ইউরোপে খ্রিস্টান মূল্যবোধের অস্তিত্ব আজ বিপন্ন হওয়ার পথে।' ইউরোপের ভবিষ্যৎ প্রজন্ম একটি সংযুক্ত খিলাফতের অধীনে বড় হোক, সেটি ইউরোপবাসী চায় কিনা তা নিয়েও তিনি ইউরোপীয়দের প্রতি প্রশ্ন ছুঁড়ে দেন। তিনি আরও বলেন, "আমরা আর মুসলিম চাই না। আমাদের সেই অধিকার রয়েছে যে আমরা আর কোনো মুসলিমকে স্বাগত জানাব কী জানাব না।"
ভিক্টর ওরবান মুসলিমদের ইউরোপে স্বাগত জানানোর ফলাফল কী তা বুঝাতে গিয়ে ষোল ও সতের শতকের ইউরোপে আধিপত্যশীল শদেড়েক বছরের অটোম্যান সাম্রাজ্যের কথা উল্লেখ করেন, যে সাম্রাজ্যে রাষ্ট্রধর্ম ছিল ইসলাম।
নাইন-ইলেভেনে আমেরিকার টুইন টাওয়ারে হামলার পরই এই গ্রহের বাসিন্দাদের মধ্যে আন্তঃধর্মীয় সহাবস্থান ঝুঁকির মধ্যে পড়ে যায়। বিশ্বব্যাপী, বিশেষ করে খ্রিস্টান-অধ্যুষিত দেশগুলিতে মুসলিম-বিদ্বেষ সমাজের বিভিন্ন স্তরে ছড়িয়ে পড়ে। নাইন-ইলেভেনের পরও লন্ডনে বোমা হামলার মতো অনেক ঘটনার ফলে পশ্চিমা বিশ্বে সাধারণ জনগণের মধ্যে মুসলিমবিদ্বেষী মনোভাব বহুগুণে বেড়ে যায়।
এ প্রেক্ষাপটে ইউরোপের দেশগুলিতে উদার রাজনীতির বিপক্ষে ইসলামবিরোধী কট্টর ডানপন্থী রাজনীতি খুব দ্রুত জনপ্রিয় হয়ে উঠছে। নেদারল্যান্ডের 'পার্টি অব ফ্রিডম'এর জনপ্রিয়তা এর জাজ্বল্যমান দৃষ্টান্ত। ২০০৪ সালে জন্ম নেওয়া এই পার্টির প্রধান গ্রেট উইল্ডারস ইউরোপে ইসলামবিরোধী রাজনীতির অগ্রদূত হিসেবে পরিচিত। ২০১০ সালের পার্লামেন্ট নির্বাচনে দলটির অবস্থান তৃতীয় স্থানে চলে আসে; ধারণা করা হয় আগামী নির্বাচনে নেদারল্যান্ডের শাসনভার ফ্রিডম পার্টির হাতে চলে যেতে পারে।
গ্রেট উইল্ডারসের ইউরোপে ইসলামাইজেশন বন্ধের মন্ত্রই তাকে জনপ্রিয় করে তুলছে। মুসলিম বিশ্ব থেকে নতুন অভিবাসী না নেওয়া, মসজিদ নির্মাণ করতে না দেওয়া এবং আরব বিশ্বের টাকায় বিশ্ববিদ্যালয়ের আরব স্টাডিজ না খোলার মতো কট্টর অবস্থানের কারণে ইউরোপব্যাপী তার ধারণা জনপ্রিয় হয়ে ওঠে। বলা যায়, হাঙ্গেরির প্রধানমন্ত্রী ভিক্টর ওরবান গ্রেট উইল্ডারসের দার্শনিক মন্ত্রে দীক্ষিত মাত্র। কেবল নেদারল্যান্ড নয়, ফ্রান্স, বেলজিয়াম, যুক্তরাজ্য, ডেনমার্ক, সুইডেন এমনকি জার্মানির রাজনীতিতেও বর্তমান বাস্তবতায় মুসলিমবিদ্বেষ রাজনীতিতে একটি তাৎপর্যপূর্ণ বিষয়।
ফ্রান্সের কট্টর ডানপন্থী নেতা মেরিন লি পেনের নেতৃত্বে ন্যাশনাল ফ্রন্ট ২০১১ সালের নির্বাচনের মধ্য দিয়ে তৃতীয় দল হিসেবে স্থান করে নেয়। অভিবাসন, ইসলামীকরণ, ধর্মীয় রীতিতে পোশাক পরিধান ও খাবার গ্রহণ, ফ্রান্সে আরবের বিশ্বের বিনিয়োগসহ বহু বিষয়ে দলটির কট্টর অবস্থান রয়েছে। লি পেনও গ্রেট উইল্ডারসের আদর্শিক সহযাত্রী। ফ্রান্সে ডানপন্থী নেত্রী লি পেনের জনপ্রিয়তা ক্রমশ বাড়ছে।
বেলজিয়ামের রাজনীতিতে ধর্মীয় বিশ্বাস বড় বিষয় হয়ে যাচ্ছে। সেখানকার আইনসভায় ইসলামিক পার্টির দুজন সদস্য রয়েছেন। শরিয়া আইন সমর্থন, অল্পবয়সে বিয়ের পক্ষে জনমত গঠন এবং নারী সহকর্মীদের সঙ্গে করমর্দন না করার অভিযোগ তাদের প্রতি রয়েছে। সরকার পরিচালিত এক আদমশুমারিতে দেখা যায়, বেলজিয়ামের মোট জনসংখ্যার ৬ শতাংশ মুসলিম। তবে রাজধানী ব্রাসেলসে বসবাসকারীদের ২৫ শতাংশ মুসলিম। আগামী ২০ বছরে ব্রাসেলসে মুসলিম সম্প্রদায় সংখ্যাগরিষ্ঠ হয়ে যাবে। এন্টোর্পের স্কুলে নিবন্ধনকৃত ছাত্রের পরিসংখ্যান থেকে জানা যায়, সেখানে মোট ছাত্রসংখ্যার ৪০ শতাংশ মুসলিম। ব্রাসেলসে অনেক খ্রিস্টান পরিবারকে শরিয়া আইন মানতে বাধ্য করার মতো ঘটনা ঘটছে যা কট্টর ডানপন্থী রাজনীতি প্রসারের ক্ষেত্রে সহায়ক ভূমিকা পালন করছে। তারা বেলজিয়ামকে ভবিষ্যৎ 'বেলগিস্তান' বলে হতাশা প্রকাশ করে থাকেন।
যুক্তরাজ্যে ইসলামবিরোধী প্ল্যাটফর্ম "ইংলিশ ডিফেন্স লীগ'এর মতো জার্মানিতে 'পেডিগা' ব্যাপক জনপ্রিয় হয়ে উঠেছিল। এই পেডিগার হাওয়া জার্মানির সীমান্তের বাইরেও ছড়িয়ে পড়ে। ডেনমার্ক ও সুইডেনেও অভিবাসন ইস্যু, বিশেষ করে মুসলিম ইস্যু রাজনীতিতে স্থান করে নিচ্ছে।
তাই বলা যায়, মূল সংকট আন্তঃধর্মীয় বিশ্বাসের, ঐতিহ্যগত মূল্যবোধের সহজাত দ্বন্দ্বের, স্বতন্ত্র দুটি সভ্যতার। আজকে ইউরোপে যে সকল কট্টর ডানপন্থী রাজনৈতিক দল কিংবা গোষ্ঠী ইসলাম সামনে রেখে নিজেদের রাজনৈতিক ক্যাশ করছে ও জনপ্রিয়তা পাচ্ছে, তাদের রাজনৈতিক ন্যারেটিভ খণ্ডন করার জন্য ইউরোপে কোন প্ল্যাটফর্ম নির্মাণ হয়নি। ইসলামের নামে জঙ্গি রাজনীতি এবং গণতন্ত্রের সঙ্গে ইসলামের সাংঘর্ষিক ন্যারেটিভ মোকাবেলা করে আন্তঃধর্মীয় বিশ্বাসের সহাবস্থান নিশ্চিত করার তাগিদ থেকে ইউরোপের উদার রাজনীতি ক্রমশ দূরে সরে যাচ্ছে; বলা যায় যেতে বাধ্য হচ্ছে।
ফলে এটি ধারণযোগ্য যে, সংকটটি কেবল ইউরোপ নয়, সারা বিশ্বকে জড়িয়ে ফেলবে। ইউরোপ পশ্চিম এশিয়ার মতো সামরিক সমর ক্ষেত্রে রূপান্তরিত হতে পারে। একইভাবে, ইউরোপে মুসলিম সম্প্রদায়ের উদারমনা ও গণতন্ত্রে বিশ্বাসীদের কণ্ঠগুলিকে ক্ষীণ বলে মনে হয়। বলা যায়, এদের সংখ্যা এতই নগণ্য যে কেউ এদের কথা শুনতে চায় না। বরং আঞ্জেম চৌধুরীর মতো উগ্র ধর্মীয় নেতাদের কণ্ঠ অনেক বেশি শক্তিশালী।
উল্লেখ্য, আঞ্জেম চৌধুরীর সংসার ব্রিটিশ সরকারের ওয়েলফেয়ারের টাকায় চলে এবং তার একটি অংশ জঙ্গিবাদী কর্মকাণ্ডে তিনি ব্যয় করেন বলে বিস্তর অভিযোগ রয়েছে। যুক্তরাজ্যে বসেই আঞ্জেম চৌধুরী আইএসএর রিক্রুটার হিসেবে দীর্ঘদিন ধরে কাজ করে যাচ্ছেন।
ইইউএর উদার রাজনৈতিক দলগুলি তাদের দেশে কী হচ্ছে, তা জানে না বিষয়টি কিন্তু তেমন নয়। তারা মানবিকতার দিকটি চিন্তা করেই শরণার্থী নিতে বাধ্য হচ্ছে। কারণ ইইউএর রাজনৈতিক এজেন্ডা থেকে মানবিকতা উঠে গেলে ইউনিয়নটির মৌলিক উদ্দেশ্য প্রশ্নবিদ্ধ হয়ে পড়ে। তবে এত শরণার্থীকে একসঙ্গে আশ্রয় দেওয়ার ফলে ইইউএর সামাজিক ও রাজনৈতিক কাঠামোতে কী প্রভাব পড়বে এবং উগ্র ডানপন্থী দলগুলির প্রতিক্রিয়াই-বা কী হবে, তা ক্রমশ স্পষ্ট হতে থাকবে। এটি হলফ করেই বলা যায়, এতে ইউরোপের রাজনীতিতে বড় পরিবর্তন সূচিত হতে পারে।
আরেকটি মৌলিক প্রশ্ন এখানে থেকে যায়। যে রাজনৈতিক আদর্শের জন্য সমস্যাটি সৃষ্টি হয়েছে, তার সমাধান না করে শরণার্থী সমস্যার স্থায়ী সমাধান কীভাবে সম্ভব? আরব বিশ্বের দেশগুলির মধ্যে রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা, ধর্মীয় উন্মাদনায় পুঁজিবাদী বিশ্বের উস্কানি এবং জঙ্গি রাজনীতির পিছনে সৌদি আরব, কাতার, কুয়েতের মতো ধনী দেশগুলির অর্থায়ন বন্ধ করা ছাড়া এটির মূল উৎপাটন কোনোভাবেই সম্ভব নয়। প্রথমেই আরব বিশ্বের ধনী দেশগুলির ধর্মীয় প্রতিষ্ঠানগুলির সারা বিশ্বকে 'ধর্মরাজ্য' বানানোর স্বপ্ন বাদ দিতে হবে।
এ ক্ষেত্রে তারা মিশরের প্রেসিডেন্ট আবদেল ফাত্তাহ আল সিসির অবস্থানটি অনুসরণ করতে পারেন। সিসি মিশরের সকল ধর্মীয় নেতাদের নিয়ে একটি সভা করলেন; উদ্দেশ্য ছিল কীভাবে ধর্মীয় নেতাদের সম্পৃক্ত করে ধর্মের নামে জঙ্গিবাদ মোকাবেলা করা যায়। তিনি ধর্মীয় নেতাদের উদ্দেশ্য বললেন যা বললেন তা এ রকম, আমাদের এই গ্রহে ৭০০ কোটি মানুষ বাস করে। তার ৬০ থেকে ৭০ কোটি মুসলমান। বাকিরা অন্যান্য ধর্মাবলম্বী; যারা জ্ঞান বিজ্ঞান, প্রযুক্তি, অর্থনৈতিক ও সামরিক শক্তি দিক দিয়ে আমাদের চেয়ে বহুগুণে উন্নত। আমরা যদি এই স্বপ্ন দেখি যে আমরা তাদেরকে শাসন করব, আমাদের বিশ্বাস তাদের উপর চাপিয়ে দেব, তা কোনোভাবেই সম্ভব নয়। বরং আমাদের আরও গভীরভাবে চিন্তা করতে হবে।
আইএস মাত্র বিশ থেকে পঁচিশ হাজার সৈন্য নিয়ে সারা মধ্যপ্রাচ্য অস্থির করে তুলছে। বিশ্বের প্রায় সকল দেশেই ছড়িয়ে পড়ছে তারা। আজ পর্যন্ত তাদের বিপক্ষে আরব লীগ ও ওআইসি কোনো পদক্ষেপ নিয়েছে বলে জানা যায়নি। একইভাবে, আরব বিশ্বের কোনো দেশকেও আইএসের বিরুদ্ধে সর্বাত্মক প্রতিরোধ গড়ে তুলতে দেখা যায়নি। বরং আইএসের যোদ্ধাদের প্রায় এক পঞ্চমাংশ সৌদি নাগরিক এবং আইএস তুরস্কে তেল বিক্রি করে প্রতিদিন এক মিলিয়ন ডলার আয় করে।
এমতাবস্থায় বলা যায়, কেবল সিরিয়ান শরণার্থীদের ইউরোপে আশ্রয় দিলেই সমস্যাটির সমাধান হয়ে যাবে, এমন দিবাস্বপ্ন থেকে আমাদের বের হয়ে আসতে হবে। পাশাপাশি সব কিছুতেই আমেরিকা ও ইহুদিবাদের দোষ খুঁজে মাঠের মূল খেলোয়াড়দের আড়াল করার মানসিকতা বাদ দেওয়া দরকার। আরব বিশ্বের অভ্যন্তরীণ সামাজিক চিন্তা-চেতনার পরিবর্তন ছাড়া সমস্যাটির আসলে সমাধান নেই।
বিজন সরকার: ভাষা গবেষক; কলাম লেখক।