ফুটবল যে নারী ক্ষমতায়নের একটা শক্তপোক্ত উপায়, বিশ্বের নানা দেশে তা প্রতিষ্ঠিত সত্য। অথচ একবিংশ শতকের বাংলাদেশে এখনও জনমানসে নারীদের ফুটবল খেলা নিয়ে উদাসীনতা, অনেক ক্ষেত্রে আপত্তি স্পষ্ট। তার সঙ্গে আছে মনস্তাত্ত্বিক প্রতিরোধ, সাংস্কৃতিক টানাপড়েন।
Published : 31 Jan 2025, 10:29 AM
‘তৌহিদী জনতা’-এর দাবির মুখে দিনাজপুর ও জয়পুরহাটে নারীদের ফুটবল ম্যাচ বন্ধ করে দেওয়া হয় সম্প্রতি। বিষয়টা শুধু খেলা বন্ধেই সীমাবদ্ধ থাকেনি। মারপিট ও ভাঙচুরের ঘটনাও ঘটেছে। এর আগে বিক্ষুব্ধ জনতার চাপে চিত্রনায়িকা পরীমণি ও অপু বিশ্বাস নির্ধারিত অনুষ্ঠানে যোগ দিতে পারেননি। মাসদুয়েক আগে চট্টগ্রামে শোরুম উদ্বোধন করতে গিয়ে একই ঢঙে তৌহিদী জনতার বাধার মুখে পড়েছিলেন অভিনেত্রী মেহজাবীন চৌধুরীও।
মূলত, গত ৫ অগাস্টের পর দেখা যাচ্ছে যে ‘তৌহিদী জনতা’ বা ‘বিক্ষুব্ধ জনতা’-এর নামে দেশের বিভিন্ন স্থানে বিভিন্ন নারীকেন্দ্রিক অনুষ্ঠান পণ্ড করা হচ্ছে। অন্তর্বর্তী সরকারের পক্ষ থেকে এসব ঘটনা মোকাবিলায় তেমন কোনো পদক্ষেপ গ্রহণ করা হচ্ছে বলে মনে হচ্ছে না। অবশ্য নারীদের ফুটবল কোনোভাবে ব্যাহত হোক, তা সরকার চায় না বলে প্রধান উপদেষ্টার দপ্তর থেকে বলা হয়েছে। প্রধান উপদেষ্টার উপ প্রেস সচিব আবুল কালাম আজাদ মজুমদার মেয়েদের ফুটবল খেলাকে কেন্দ্র দিনাজপুর ও জয়পুরহাটে হাঙ্গামার ঘটনা প্রসঙ্গে বুধবার বিকালে রাজধানীর ফরেন সার্ভিস একাডেমিতে এক ব্রিফিংয়ে বলেন, “বাংলাদেশ সরকার মনে করে নারীদের ফুটবল প্রমোট করা উচিত। তারা আমাদের সমাজের অংশ ও তারা আমাদের গর্ব। নারীদের ফুটবল কোনোভাবে ব্যাহত হোক, এটা সরকার চায় না। এজন্য প্রশাসন ও বাংলাদেশ ফুটবল ফেডারেশন সবার সাথে মিলে আন্তরিকভাবে এ বিষয়ে কাজ করবে।”
নারীদের খেলাধুলায় বাধা দেওয়ার আগে ব্যবসায়িক কার্যক্রম বাধাগ্রস্ত করার ঘটনাও দেখতে হয়েছে আমাদের, যা অত্যন্ত উদ্বেগজনক। এমনিতেই আমাদের দেশে একশ্রেণির মানুষ বিশ্বাস করে যে, নারীর জায়গা ঘরে। যে বাচ্চার জন্ম দেবে, লালনপালন করবে, রেঁধেবেড়ে খাওয়াবে। যে হবে সংসারী। গৃহিণী। এর বাইরে নারীর কোনো জীবন নেই। থাকতে পারে না।
আমাদের দেশে নারীরা খেলবে, এটা অনেকের কাছেই আপত্তির। যে কারণে ক্রীড়াজগতে নারীদের খুব একটা দেখা যায় না। নারীর জন্য কিছু কাল্পনিক অথচ প্রতিষ্ঠিত সামাজিক নিয়মাবলি আছে, নারীদের ক্রীড়া-অবরোধের জন্য ওই শর্তগুলিই যথেষ্ট। সে কারণে ফুটবলের মতো ‘বডি-কন্ট্যাক্ট গেম’-এ আসা অধিকাংশ মেয়ের পরিবারই চায় না। কেউ যদি নিজ উদ্যোগে ক্রীড়ানিপুণ হয়ে ওঠে সে সহযোগিতা ও সমর্থন পায় না। এমনকি পাড়া-প্রতিবেশীও তাদের সাফল্যে নির্বিকার থাকে। সাফল্য উদযাপন করে না। সমাদর মেলে না বন্ধুদের কাছেও। নিভে যায় খেলার মাধ্যমে আত্মপরিচয় তৈরির ইচ্ছা।
ফুটবল যে নারী ক্ষমতায়নের একটা শক্তপোক্ত উপায়, বিশ্বের নানা দেশে তা প্রতিষ্ঠিত সত্য। অথচ একবিংশ শতকের বাংলাদেশে এখনও জনমানসে নারীদের ফুটবল খেলা নিয়ে উদাসীনতা, অনেক ক্ষেত্রে আপত্তি স্পষ্ট। তার সঙ্গে আছে মনস্তাত্ত্বিক প্রতিরোধ, সাংস্কৃতিক টানাপড়েন। এ দেশে ফুটবল ও নারীদের সংযোগের প্রতিকূল পরিবেশ বজায় রাখার আপ্রাণ চেষ্টা হয় নানাভাবে। কিন্তু তারপরও বিক্ষিপ্ত-বিচ্ছিন্নভাবে উঠে আসা নারী ফুটবলারদের ক্ষমতায়নের যুদ্ধে ‘ফুটবল’ নামক অস্ত্রটি ভোঁতা হয়ে যাচ্ছে। ফুটবলের মাধ্যমে প্রান্তিক মেঠো মেয়েদের অন্তত পারিবারিক স্তরে ক্ষমতা প্রতিষ্ঠার যে ন্যূনতম সুযোগ তৈরি হতে পারত, তা ক্রমশ চলে যাচ্ছে নাগালের বাইরে, যাও এক-আধটু উদ্যোগ আছে, সেটাও গলা টিপে হত্যা করা হচ্ছে।
‘নারীদের ফুটবল খেলতে দেওয়া যাবে না’— বরং এই দাবি প্রকাশ্যে উঠছে। যা অগ্রহণযোগ্য ও নিন্দনীয়। এটা রাষ্ট্রীয় রীতিনীতির বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণার শামিল। বাংলাদেশে নারীদের খেলাধুলা নিষিদ্ধ নয়। ফুটবল তথাকথিত কোনো অশ্লীল খেলাও নয়। কিন্তু সম্প্রতি একটি বিশেষ শ্রেণি ধর্মের দোহাই দিয়ে নারীবিরোধী কর্মকাণ্ডে লিপ্ত হয়েছে। সরকারের শিথিল ভূমিকার কারণে এই শ্রেণি বেপরোয়া হয়ে উঠেছে। তাদের ক্রমবর্ধমান হুমকি এবং আক্রমণের কারণে সামাজিক স্থিতি মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। নারী অধিকার, মুক্তচিন্তা এবং আইন-শৃঙ্খলার প্রতি এই চ্যালেঞ্জ শুধু একটি বিচ্ছিন্ন ঘটনা নয়; বরং এটি একটি গভীর সামাজিক সংকটের প্রতিফলন। ব্যক্তিপরিসরে যে কেউ, যে কোনও নিয়ম মানতে পারে। কিন্তু জনপরিসরে মান্যতা পাবে দেশের সংবিধান, যা পুরুষ-নারীকে সমান মর্যাদা দেয়। কোনো ধর্মীয় অনুশাসন সাম্যের নীতিকে ছাপিয়ে যেতে পারে না।
আমাদের নারী ফুটবল দল জাতির গৌরব। গত অক্টোবর মাসে বাংলাদেশের নারীরা সাফ ফুটবলে চ্যাম্পিয়ন হয়েছে। নারী ফুটবল দলের অর্জন আমাদের জন্য গর্বের, যা আন্তর্জাতিক পরিমণ্ডলে বাংলাদেশের মর্যাদা বৃদ্ধি করেছে। কিন্তু এই সাফল্যের বিপরীতে একটি বিশেষ গোষ্ঠী নারীদের খেলাধুলার বিরুদ্ধে অবস্থান নিয়ে মাঠে হামলা চালাচ্ছে, আয়োজকদের হুমকি দিচ্ছে, এবং সমাজে নারী স্বাধীনতাকে বাধাগ্রস্ত করার চেষ্টা করছে। এসব ঘটনায় প্রশাসনের নীরবতা আরও গভীর সংকট সৃষ্টি করছে। যেখানে আইনের শাসন প্রতিষ্ঠার কথা, সেখানে উগ্রবাদী চক্রের ভয়ংকর দৌরাত্ম্য নারীদের মৌলিক অধিকার হরণ করছে।
একটি সভ্য রাষ্ট্রের ভিত্তি দাঁড়িয়ে থাকে ন্যায়বিচার ও আইনের শাসনের ওপর। কিন্তু বাংলাদেশে কিছু চরমপন্থী গোষ্ঠী নারীর ওপর ধর্মের নামে বিধিনিষেধ চাপিয়ে দিতে চাইছে। এটি শুধু নারীদের জন্য নয় বরং দেশের সামগ্রিক সামাজিক নিরাপত্তার জন্যও হুমকিস্বরূপ।
যখন কোনো বিশেষ গোষ্ঠী ‘তৌহিদী জনতা’ বা ধর্মীয় অনুভূতির দোহাই দিয়ে সহিংসতায় লিপ্ত হয়, তখন রাষ্ট্রের দায়িত্ব হলো এসব আইনবিরোধী কর্মকাণ্ডের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা নেওয়া। কিন্তু বাস্তবতা হলো, সরকার বারবার এদের চাপে আপস করে, যা তাদের আরও সহিংস হতে উৎসাহ যোগাচ্ছে। বেপরোয়া করে তুলছে। এই আপসকামী আচরণের ফলে নারীর অধিকার ও স্বাধীনতা সংকুচিত হচ্ছে, সামাজিক উন্নয়ন ও আধুনিকায়নের পথে গুরুতর প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি হচ্ছে। সরকার যদি শক্ত অবস্থান গ্রহণ না করে, তবে ভবিষ্যতে আরও ভয়াবহ পরিস্থিতি সৃষ্টি হতে পারে।
একটি সভ্য সমাজ তখনই প্রতিষ্ঠিত হয়, যখন সংখ্যালঘুদের নিরাপত্তা নিশ্চিত হয়, নারীর স্বাধীনতা ও অধিকার সংরক্ষিত হয় এবং আইন সবার জন্য সমানভাবে প্রয়োগ হয়। কিন্তু বাংলাদেশ ক্রমশ এক ‘মবের মুল্লুক’ হয়ে উঠছে, যেখানে একদল মানুষ আইনের ঊর্ধ্বে থেকে নিজেদের মতবাদ চাপিয়ে দিচ্ছে। এর সমাধানের পথ খুঁজতে হবে। রাষ্ট্রকে আপসকামিতা পরিহার করে কঠোর আইন প্রয়োগ করতে হবে। নারীদের বিরুদ্ধে সহিংস আচরণ যারা করছে, তাদের বিচার নিশ্চিত করতে হবে। পাশাপাশি শিক্ষার মাধ্যমে ধর্মের অপব্যাখ্যার বিরুদ্ধে গণসচেতনতা গড়ে তুলতে হবে।
নারীর খেলাধুলায় বাধা সৃষ্টি করা শুধু তাদের অধিকার লঙ্ঘন করা নয় বরং একটি আধুনিক ও সমৃদ্ধ বাংলাদেশের স্বপ্ন ধ্বংসের সামিল। তাই, সময় এসেছে শক্তিশালী রাষ্ট্রীয় অবস্থান গ্রহণ করার এবং নারী অধিকার রক্ষায় নিরলস কাজ করার।
‘নিজের ভালো লাগা ভালোবাসা নিয়ে নিজের আনন্দে বাঁচার স্বাধীনতা’— আমরা কবে পাব? কোনোদিনই কি পাব না?