Published : 06 Aug 2015, 02:43 AM
মনে হচ্ছে যেন নরখাদকের দেশে বাস করছি। এখানে বীভৎস কায়দায় শিশুদের হত্যা ও ধর্ষণ করা হচ্ছে, নির্যাতন চালানো হচ্ছে ওদর ওপ। এই সেদিন শিশু রাজনকে হত্যা করা হল পিটিয়ে। আবার সে দৃশ্য ঘাতকরা নিজেরাই মোবাইলের ক্যামেরায় ধারণ করে সেটি ফেইসেবুকে আপলোড করল যেন এটা একটা উৎসবের দৃশ্য। সে বেদনার ক্ষত শুকাতে না শুকাতেই আবার খুলনায় শ্রমজীবী শিশু রাকিবকে হত্যা করা হল বীভৎস কায়দায়।
প্রকাশিত খবর থেকে যা জানা গেছে তা হল, বার বছর বয়সী রাকিব একটি মোটর গ্যারেজে কাজ করত। সে কাজ ছেড়ে অন্য একটি গ্যারেজে কাজ নিলে আগের গ্যারেজের মালিক এবং তার কমর্চারী মিলে শিশুটির উপর নির্যাতন চালায়। সেই নির্যাতনও ভয়াবহ। বিকৃত ও বীভৎস সেই নির্যাতনের কারণে মৃত্যু হয় রাকিবের। রাজনের হত্যাকারীদের মতো রাকিবের হত্যাকারীরাও শিশুর উপর নির্যাতন চালিয়ে পৈশাচিক আনন্দ পেয়েছে।
এই হত্যাকারীরা কিন্তু দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময়কার নাৎসি শিবিরের ঘাতক নয়, একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধের সময়কার পাকিস্তানি জল্লাদ নয়, এরা কোনো উন্মাদ সিরিয়াল কিলার নয়। এই হত্যাকারীরা আমাদের দেশের বেসামরিক নাগরিক। বলা যায় সাধারণ মানুষ। এই মানুষদের বিবেক ও মূল্যবোধ কোন স্তরের হলে এমনটি ঘটা সম্ভব? এরা শ্রমজীবী শিশুর উপর নির্যাতন চালাচ্ছে, তাদের হাসতে হাসতে হত্যা করছে|।
এই শিশুহত্যা যে কোনো বিচ্ছিন্ন ঘটনা তাও নয়। কাল যে আবার দেশের কোথাও এমন ঘটনা ঘটবে না তারও কোনো গ্যারান্টি নেই। বিষয়টি এমন, যেন পোকামাকড়ের মতো একটি শিশুকে চাইলেই মেরে ফেলা যায়। যেহেতু শিশুটি দরিদ্র, শ্রমজীবী, সুতরাং তার জীবন কোনো মানুষের জীবন নয়, পোকামাকড়ের জীবন।
দেশে আইনের শাসন থাকলে কি এ ধরনের ঘটনা এত অকাতরে ঘটাতে পারত খুনিরা? এই সপ্তাহেই রাজধানীতে পৃথক ঘটনায় দুটি শিশুর ধর্ষণের শিকার হওয়ার খবর পাওয়া গেছে। এখানেও শিশু দুটি দরিদ্র পরিবারের। তাদের উপর নির্যাতন চালিয়েছে তাদেরই প্রতিবেশী। নির্যাতনের কারণে শিশু দুটি যদি মারাও যেত তাহলেও এটাকে তাদের ঘাতকরা গুরুত্ববহ বলে মনে করত না। গরিব পরিবারের একটি শিশুর উপর তো চাইলেই যেভাবে ইচ্ছা সেভাবে নির্যাতন চালানো যায়, তাকে মেরেও ফেলা যায়। কী আর হবে তাতে!
একমাত্র নরখাদকদের সমাজেই এ ধরনের মূল্যবোধ চালু থাকে। নরখাদকরা সুবিধা পেলেই একজন মানুষকে ধরে বেঁধে খেয়ে ফেলতে পারে। তাদের মূল্যবোধে সেটি তেমন কোনো অপরাধ নয়।
দরিদ্র শিশুর ক্ষেত্রে একই রকম মনোভাব এই সমাজেও দেখছি। পথেঘাটে ছিন্নমূল শিশুদের উপর যথেচ্ছা নির্যাতন চালানো হয়। এসব শিশু হরহামেশাই যৌন নির্যাতনেরও শিকার হয়। এই নির্যাতনের প্র্রক্রিয়ায় তাদের মৃত্যুও ঘটে। তবু কোনো প্রতিকার হয় না্। বাসাবাড়িতে যে শিশুরা গৃহশ্রমিক হিসেবে কাজ করে তাদের অবস্থা আরও করুণ। তাদের মজুরির বেলায় ঠকানো হয়, প্রয়োজনীয় খাবার দেওয়া হয় না, চড় কিল ঘুষি থেকে শুরু করে গুরুতর আঘাত, নির্যাতন, যৌন নির্যাতন চালানো হয় তাদের উপর, কখনও কখনও হত্যাও করা হয়। গরিব বলে তারা বিচার পায় না্। টাকার জোরে পার পেয়ে যায় অপরাধী।
একটি অপরাধ করে যখন অপরাধীরা পার পায়, তখন আরও দশ অপরাধীর জন্ম হয়, তাদের সাহস বাড়ে। মনে হয়, কই, কিছুই তো হয় না। গরিব মারলে সমস্যা নেই।
জাতিসংঘের শিশু অধিকার সনদে অন্যতম স্বাক্ষরকারী দেশ বাংলাদেশ। কিন্তু এদেশে শিশু অধিকার পদে পদে লংঘিত। মাতৃগর্ভে শিশু গুলিবিদ্ধ হওয়ার ঘটনাও সম্প্রতি আমাদের দেশে ঘটেছে। বাবা মায়ের কোলে থাকা শিশুও গুলিতে প্রাণ হারিয়েছে। কিছুদিন আগে এক নবজাতককে হাসপাতালের ছাদ থেকে ফেলে দিযে হত্যা করেছে তারই বাবা। কন্যাশিশুকে হত্যা করেছে জন্মদাতা এমন ঘটনাও এদেশে বিরল নয়|। আর শিশু ধর্ষণ তো এদেশে ডালভাত। প্রায় প্রতিদিনই দেশের কোনো না কোনো অঞ্চলে ধর্ষণের শিকার হচ্ছে শিশু|
প্রাথমিক বিদ্যালয়ে শিশুকে পেটানো হচ্ছে হরহামেশা। এমনকি গুরুতর জখমও করা হচ্ছে। সেখানেও যে মৃত্যুর ঘটনা ঘটছে না তা নয়। সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে যেহেতু মূলত গরিব মানুষের সন্তানরাই পড়ে তাই তাদের ইচ্ছামতো প্রহার করায় কেউ কোনো মানসিক বাধাও অনুভব করে না। যদিও বিদ্যালযে শিশুকে শারীরিকভাবে আঘাত করা আইনত দণ্ডনীয় অপরাধ। কিন্তু কোথায় বা আইন, আর কে-ই-বা সে কথা মানে!
শিশুর উপর নির্যাতন চালানো যেন একপ্রকার বিনোদন। রাকিবের উপর যখন বীভৎস নির্যাতন চালাচ্ছিল গ্যারেজ মালিক মিন্টু মিয়া ও শরীফ গং, তখনও তারা 'মজা' পাচ্ছিল, 'বিনোদন' পাচ্ছিল। রাজনকে যখন হত্যা করা হয় পিটিয়ে তখনও তার হত্যাকারীরা দারুণ বিনোদন পাচ্ছিল, ফূর্তি করে সেই দৃশ্য তারা মোবাইল ক্যামেরায় ধারণ করছিল|
যে দেশে শিশুর উপর এ ধরনের নির্যাতন ঘটে, যে দেশে শিশুকে এভাবে হত্যা করা হয়, সে দেশের নাগরিক হিসেবে আমরা কি বিনা লজ্জায় নিজেদের দিকে তাকানোর অধিকার রাখি? যে কোনো শিশু হত্যাকারীর দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি যে দেশে নিশ্চিত হয় না, যে দেশে টাকার জোরে শিশু হত্যাকারী রেহাই পায় সে দেশের, সে সমাজের সঙ্গে নরখাদক– সমাজের কি কোনো মৌলিক পার্থক্য আছে? যে দেশে শিশুরা নির্যাতিত হয়ে মৃত্যুবরণ করে সেখানে আমরা নিজেদের 'মানুষ' নামে অভিহিত করার অধিকার রাখি কি?
এরপরও আমরা লজ্জায় অবনত হচ্ছি না। জাতি হিসেবে আমরা আর কত 'ছোট' হলে লজ্জা পেতে শিখব? যে সমাজের মানুষ একটি শিশুকে এভাবে পিটিয়ে হত্যা করে উল্লাসের সঙ্গে আমিও যে সে সমাজের একজন সেটা কীভাবে বিনা লজ্জায় উচ্চারণ করি? যে নরপিশাচরা শিশুর উপর নির্যাতন চালায়, শিশুকে হত্যা করে, তাদের প্রত্যেককে প্রকাশ্যে দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি দিতে পারলে তবেই আমরা নিজেদের সভ্য দেশের নাগরিক বলার অধিকার রাখি।
কয়েক বছর ধরেই বিভিন্ন ওযেবসাইটে একটি বীভৎস ছবি দেখা যায়। অপরিণত মানবভ্রূণ রেস্টুরেন্টে খাদ্য হিসেবে পরিবেশিত হচ্ছে। যদিও এই ধরনের ঘটনার সত্যতা সম্পর্কে কোনো জোরালো প্রমাণ পাওয়া যায়নি এবং মনে করা হচ্ছে এগুলো বানোয়াট ছবি, তারপরও বিদেশের এই ধরনের ছবি দেখলে আমরা একে বর্বর, বীভৎস বলে থাকি। যে জাতির মানুষরা এমন খাদ্য গ্রহণ করে বলে রটনা করা হয় তাদের সম্পর্কে কতই না গালাগাল করি।
এ কথা কি ভেবে দেখি যে, তারা যদি 'অসভ্য বর্বর' হয় তাহলে আমরা কী? এককালে ফিজি দ্বীপের মানুষ নাকি নিজেদের বৃদ্ধ বাবা-মাকে রান্না করে খেয়ে ফেলত। সে কালের সে সমাজ থেকে আমরা কতটুকু উন্নত?
যে সমাজ শিশুর বাসযোগ্য নয়, যে রাষ্ট্র শিশুর নিরাপত্তা প্রদানে অক্ষম, তার টিকে থাকার যৌক্তিকতা কোথায়? আমাদের এক সংসদ সদস্য আবার আফ্রিকানদের 'অসভ্য' বলেছেন, যেন আমরা কত বড় 'সভ্য' হয়েছি। সভ্যতা তো দূরের কথা, যে দেশে শিশুর নিরাপত্তা নাই, সেই দেশের নাগরিক হয়ে আমরা কি নিজেদের 'মানুষ' বলার অধিকার রাখি?
শান্তা মারিয়া: সাংবাদিক।