বাংলা ছবির নবতরঙ্গ: হাওয়ামে উড়তা যায়ে...

মন্ট্রিয়লে হল থেকে বের হয়েই নারীরা সমবেত হয়ে গাইতে শুরু করলেন ‘সাদা সাদা কালা কালা’ গানটি। বাংলাদেশে হলের ভিতরে দর্শক নাকি কোরাস গাইছিলেন।

শিশির ভট্টাচার্য্যশিশির ভট্টাচার্য্য
Published : 11 Sept 2022, 02:28 PM
Updated : 11 Sept 2022, 02:28 PM

বাংলাদেশের দক্ষিণাঞ্চলের ব্যস্ত একটি নদীবন্দরে অনেকগুলো মাছধরা ইঞ্জিন-নৌকা সাগরে যাবার জন্যে অপেক্ষমান। ক্লোজশটে বড়সড় একটি প্ল্যাস্টিকের টুকরা গোটানো হচ্ছে। পাশে সারে সারে লইট্টা শুটকি শুকাচ্ছে। ঠেলাগাড়িতে ভরে মাছ আসছে। ক্যামেরার দিকে পেছন দিয়ে লুঙ্গির নিচের কিনারা হাঁটুর উপরে তুলে মোবাইলে কথা বলতে বলতে হেঁটে যাচ্ছে জেলে নাগু।

মিডিয়াম শটে চায়ের দোকানে মাঝি ও জেলেরা সাগরে যাবার আগে শেষ আলাপ সেরে নিচ্ছে মহাজনের সাথে। বাইরে কাঠফাটা রোদ, কিন্তু দোকানগুলোর ভিতরে অপেক্ষাকৃত অন্ধকার। নাপিতের দোকানে বগলের কেশ খেউড়ি করাতে করাতে, ঠোঁট একদিকে খিঁচে দুই মাড়ির দাঁতের ফাঁকে ঢুকে যাওয়া সুপারির কুচি বের করে পানের পিক গলায় নামাতে নামাতে, হিক্কা তুলে, সহকর্মীদের খোঁজখবর নিচ্ছে চান মাঝি। কারও জ্বর হয়েছে শুনে চান নিদান দিল: ‘সাগরে গেলি পরে জ্বর-টর সব ঠিক হয়ে যাবানে’।

মহা হৈচৈ চারপাশে। চিৎকারের প্রধান উৎস এক ক্যানভাসারের হাতে ধরা মাইক: ‘সব কিছুতে ভ্যাজাল। সম্পর্কে ভ্যাজাল, খাওনে ভ্যাজাল। কিন্তুক, হাজার বছর আগের নিম এখনও ওই রকমই তিতা। গাছের শিকড়ে এখনও গুণ আছে। চুপ কইরা আমার কথা শোনেন মিঞারা, ওই ওই, চাইপা দাঁড়ান। শুনেন, বিশ্বাস অইল গিয়া সব কিছু। বিশ্বাস কইরা খাইবেন, বিষও মধু অইয়া যাইবো। বিশ্বাস যদি না থাকে, মধুও বিষ অইতে দেরি অইবো না। কী ঠিক কিনা?’ উপস্থিত দর্শক সমস্বরে বলে উঠলো: ‘হ হ’। ‘রোডেশিয়ান’ নেড়ি জাতের, কিন্তু বেশ নাদুস-নুদুস লেজবাঁকানো একটি অন্যমনস্ক কুকুর সম্মতির সুরে একবারই শুধু বললো: ভৌ!

হাতে একটি শালিকের খাঁচা নিয়ে মিডিয়াম শটে চানমাঝি এগিয়ে গিয়ে ছোট একটি নৌকায় উঠছে। ছোট নৌকা তাকে নিয়ে গেলো অদূরে গভীরতর জলে অপেক্ষমান একটি বড় নৌকায়। নৌকার নাম ‘নয়নতারা। সেখানে আগে থেকেই আছে সাত জন মাল্লা: ইজা, নাগু, ফণি, রাঁধুনি মরা, ইঞ্জিনম্যান ইবা এবং মানিকজোড়: উর্কেস-পার্কেস। লো অ্যাঙ্গেল শটে দেখা গেল ডেকের উপর নাগুকে। মোবাইলে কথা বলতে বলতে এক সময় আর কিছু শুনতে পায় না নাগু। বোঝা গেলো, নেটওয়ার্ক থেকে দূরে সরে গিয়ে ইতিমধ্যে সমুদ্রের দিকে রওয়ানা হয়েছে নয়নতারা।

দীর্ঘ অভিজ্ঞতায় পোড় খাওয়া চানমাঝি জানে, সাগরের কোথায় মাছ আছে। তার নির্দেশ মেনে জেলেরা জাল ফেলে, জাল তোলে, জালে মাছও ওঠে। জালের ওঠা-নামার নিস্তরঙ্গ জীবনে প্রথম ছন্দপতন হয় এক রাতে যখন চুরি করে মাছ বিক্রি করতে যায় চানমাঝিরই ইঙ্গিতে তার চামচা ইজা। ইঞ্জিনম্যান ইবা বাধা দেয়। চানমাঝি নাগুকে পরামর্শ দেয় ‘নটির ছেলে’ ইবাকে বোঝাতে যে এই দুর্নীতিতে সবারই লাভ। ইবাও যে দুর্নীতির বিরুদ্ধে তা কিন্তু নয়, তবে সে মাছচুরির টাকার সমান ভাগ চায়। চানমাঝির উপদল ইবাকে খুন করার উপযুক্ত সুযোগের অপেক্ষায় থাকে, কারণ ইবা থাকলে দুর্নীতি করা যাবে না, কিংবা তাকে ভাগ দিতে হবে, নয়তো সে মহাজনের কাছে দুর্নীতির কথা ফাঁস করে দেবে। এ ধরনের পরিস্থিতির অপর নাম: বাংলাদেশ।

নয়নতারায় দ্বিতীয় ছন্দপতন হয়, যখন মাছের বদলে এক ঝড়ের রাতে জালে উঠে আসে এক যুবতী, প্রথমে মনে হয় লাশ। প্রচণ্ড বৃষ্টি হচ্ছে তখন। একবার তাকিয়েই উর্কেস-পার্কেস বলে ওঠে: বাইদানি। আশ্চর্যের বিষয়, এতক্ষণ সাগরের নোনা জলে ডুবে থেকেও বাইদানির মুখের মেকাপ অটুট, চেঁছে চিকন করা ভুরুর কথা বাদই দিলাম। বাকি সবাই যখন দেখে মরা একটা মেয়েমানুষ, গাঁজায় দম দেওয়া নাগু দেখে বিশাল এক সুরমা (কড) মাছ। হয়তো সেই ঠিক দেখে। সবাই তার কথায় হেসে উঠলে, চোখ কচলে নাগুই প্রথমে দেখতে পায়, জল থেকে ওঠা মেয়েটা জ্যান্ত, ‘জলজ্যান্ত’ বোধহয় একেই বলে। বাইদানির স্থান হয় ডেকের এক পাশে লাকড়ি রাখার জায়গায়। ‘লাকড়ি’ আর ‘লাড়কি’ এক জায়গায় রাখলে ক্ষতি নেই তেমন, কারণ দুটোই ‘দাহ্য’ (সর্বার্থে) পদার্থ।

বাইদানি কথা বলে না, সুতরাং জানা যায় না, কী তার নাম, কোথা থেকে সে এসেছে, মধ্য সমুদ্রেই বা কীভাবে সে ভেসে এলো। মানুষ, নাকি রূপকথার পরী, নাকি হিন্দু-গ্রিকপুরাণের জলদেবী? খানিক পরেই দর্শকের বুঝতে বেগ পেতে হলো না, বাইদানি মানুষ, কারণ তারও বেগ পায়। বাইদানিকে টাট্টিখানার দরজা দেখিয়ে দেয় পার্কেস।

ঠাস করে টাট্টির দরজা বন্ধ করে বাইদানি। ক্যামেরার ভিতরে প্রবেশ নিষেধ, কারণ সেক্ষেত্রে কোষ্ঠ না আটকালেও সেন্সরবোর্ডে ছবি আটকে যাবে। একুশ দশকের বাঙালি দর্শক-বিচারক পঞ্চাশের দশকের জার্মান দর্শকের মতো অতটা উদার হয়নি যে বিখ্যাত পরিচালক উইম ভেন্ডারের মতো ক্লোজশটে ত্যাগধর্ম দেখানো যাবে। এই দেশে যত খুশি দুই নম্বরি করতে পারেন, কিন্তু সাবধান! কোনমতেই ‘অশালীন’ হওয়া যাবে না, অর্থাৎ (বিয়ে করার সময়) ‘শালি’ থাকতেই হবে, কিংবা অন্য কাউকে গালি দিয়ে ‘শালি’ বানাতে হবে, যেমনটা বানাবে চানমাঝি কয়েকদিন পর, রসের বাইদানিকে, নিজের যৌনলালসা মেটাতে ব্যর্থ হয়ে।

গভীর সমুদ্রে এক দল আদমের নিস্তরঙ্গ জীবনে হাওয়ার উপস্থিতির হাওয়া বদলে দেয় সব হিসাব। জ্ঞানবৃক্ষের ফল খেয়ে বেহেস্তে আদম যেমন নিজের নগ্নতার ব্যাপারে সচেতন হয়েছিল, তেমনি হাওয়ার উপস্থিতিতে নয়নতারার আদমদের মনেও লজ্জার অনুভূতি পুনর্জাগরিত হয়। যে ফণি আগে সব সময় খালি গায়ে থাকতো, সে পার্কেসের কাছে একটা জামা চেয়ে নিয়ে গায়ে দেয়। মাথা যার জীবনে চিরুনির মুখ দেখেনি, সেই ফণি প্ল্যাস্টিক ফ্রেমের আরশি দেখে টেরি করে। সুন্দর চোখের পার্কেস নিজের ভুরু আঁচড়ে চিকনতর করে তোলে। ইবা বাদে নৌকার বাকি সব জেলে মনে মনে বাইদানির আসঙ্গসুখ কামনা করতে থাকে, বিশেষ করে চানমাঝি।

মিডিয়াম শটে রাঁধুনি মরার দিকে পানের বাটা হাতে এগিয়ে যায় বাইদানি। কেবিনের ছাদে উঠে ‘বিগবস’ চানকে আগে পান খাইয়ে আসতে বলে মরা। চানমাঝির জন্য পান সাজায় বাইদানি, বাইদানির তর্জনী থেকে নিজের তর্জনীতে সাদা চুন ঘসে নেয় চানমাঝি। ‘ঘাটে লাগাইয়া ডিঙা পান খাইয়া যাও!’ কিংবা ‘পান খাইয়া ঠোঁট লাল করিলাম, বন্ধুর দেখা পাইলাম না!’ আকৃতির সাদৃশ্যের কারণে প্রাচীন যুগ থেকে বাংলা অঞ্চলে পান ও পানের খিলি যোনি ও যৌনতার প্রতীক। পানের রক্তিম রস প্রেম কিংবা রিরংসার প্রতীক। হতেই হবে, কারণ বাজারে লিপস্টিক তখনও বাজারে আসেনি।

‘এতক্ষণ লাগে পান দিয়া আসতে!’ সাপলুডু খেলতে খেলতে বাইদানির অদর্শনে অস্থির হয়ে ওঠে উর্কেস-পার্কেস আর ফণি। একেক জনের রিরংসার পারদ থার্মোমিটারের চূড়ান্তে। ‘এই বাইদানি, খেলবি?’ বলে কেবিনের উপর থেকে বাইদানিকে ডেকে নিয়ে যায় উর্কেস। বাইদানিও খেলতে গররাজি নয়। চানের মুখে চুন, মুখও চুন, যদিও ছেলেছোকরাদের উপস্থিতিতে আপাতত কিছুই তার করার নেই। ‘মারো, মারো!’ বলে বাইদানিকে নেড়েচেড়ে ছক্কা মারতে বলে উর্কেস-পার্কেস।

সকলে সমস্বরে ‘পুট’, ‘পুট’ বলতে বলতে বাইদানির ছক্কায় এক উঠে। গুটি গিয়ে বসে মইয়ের গোড়ায় এবং উপরে উঠে যায় ‘তরতর’ করে। অন্যদিকে তিন জেলের গুটি বার বার সাপের মুখে পড়ে ‘সরসর’ করে অতলে নেমে যেতে বাধ্য হয়। কী আশ্চর্য! বাইদানির গুটি কখনই সাপের মাথায় পড়ে না। বোঝা যাচ্ছিল তখনই যে খেলায় আগে-পরে জেলেরা হেরেতো যাবেই, মরেও যাবে। পাশে বসে হাত জাল বুনতে বুনতে সেই আভাষই কি পাচ্ছিল মরা আপন মনে?

কাহিনীতে তৃতীয় ছন্দপতন সমুদ্রে ধীবর কিংবা তরণী-সম্মেলন। গঞ্জিকা ও সুরা পান করে নৃত্যগীতে মেতে ওঠে জেলেরা। ‘সাদা সাদা কালা। তুমি বন্ধু কালাপাখি, আমি যেন কীঈ! বসন্তকালে তোমায় বলতে পারিনি।’ বাদ্যযন্ত্র বলতে ছিল একটা খমক। থালা-বাসন, কলস, গেলাস, তেলের গ্যালন দিয়ে সঙ্গতের সিংহভাগ কাজ চলে যাচ্ছিল। গাইছিল, নাচছিল প্রধানত নয়নতারার জেলেরাই, কারণ একমাত্র তাদেরই নাচবার-গাইবার বিশেষ কারণ ছিল: অনুষ্ঠানের গোপন দর্শক বাইদানিকে খুশি করার শরীরী তাগিদ ছিল একমাত্র তাদেরই।

নাচাগানায় মন নেই চানের, সে প্ল্যাস্টিকের বোতল থেকে গলায় তরল ঢালছিল এবং দোচোয়ানির কড়া ঝাঁজে বার বার মুখ বিকৃত করছিল। নৃত্যগীতে যখন মশগুল সবাই, নেশাতুর চান সেই অবসরে নয়নতারায় ফিরে বাইদানির আসঙ্গসুখ দাবি করে। হাত ধরে তাকে টেনে নিয়ে যেতে চায় ইঞ্জিনরুমে। বাইদানি হাতে বটি নিয়ে বাধা দেয় এবং চানমাঝি ছিঁটকে পড়ে সাগরের জলে। মুহূর্তে থেমে যায় নৃত্যগীত, চমৎকার ছন্দপতন।

পরদিন থেকে চানমাঝি দুর্ব্যবহার করতে থাকে বাইদানির সঙ্গে। বাইদানিকে নৌকার বুয়ার কাজে লাগানো হয়। সে ডেক ঝাঁট দেয়, বাসন মাজে, বাটনা বাটে এবং খাবার পরিবেশন করে। কিন্তু তাতেও কি শান্তি আছে? বরফঘরে মাছ আনতে গেলে বাইদানিকে জড়িয়ে ধরে ফণি। এমন এক লাথি কষায় বাইদানি, যে ব্যথা কমাতে ফণিকে গোপনাঙ্গে বরফ চাপা দিতে হয়।

রাতে ঘুম ভেঙে যায় ইঞ্জিনম্যান ইবার কিংবা সে হয়তো ঘুমায়ই না। ডেকের উপর গিয়ে দেখে লাকড়ি রাখার জায়গায় লাড়কি নাই। খুঁজতে খুঁজতে সে দেখে নিচে সাগরে জলকেলি করছে বাইদানি। ইবাকে হঠাৎ পাশে দেখে চমকে যাওয়া বাইদানির মুখে ‘ও আল্লাহ!’ শুনে বিস্ময়ে হতবাক হয়ে যায় ইবা। তখন থেকে প্রতি রাতে ইবা বাইদানির সঙ্গে জলকেলিতে যোগ দেয়। বাইদানি জানায় তার নাম গুলতি এবং এক দেবীর ইশারায় চানমাঝিকে সে খুন করতে এসেছে, নিজের পিতার খুনের প্রতিশোধ নিতে। পুরো নৌকাও চাইলে সে ডুবিয়ে দিতে পারে, কিন্তু একের অপরাধে সবাই কষ্ট পাক, এমন ইচ্ছা নয় তার।

বেলা দ্বিপ্রহর। গায়ে, চোখে-মুখে সাবান মেখে স্নান করতে করতে গানের সুরে নাচছে পার্কেস। মোবাইল ফোনে নাচের গান চালিয়ে পার্কেসের নাচের ছবি তুলছে উর্কেস। গানের কথাগুলো চমৎকার, সুরটি সম্ভবত পশ্চিমবঙ্গের ভাদুগানের: ‘ত্রিশ টাকা কেজি মাছ বাবু ভেয়ে খাবে গো, আটটা বাজে দেরি করিস না…’। গুলতি কাছে এসে প্রথমে মোবাইল হাতে নিয়ে পার্কেসের ছবি তোলে, তারপর নাচে যোগ দিয়। উর্কেস এবং পার্কেস গুলতির নাকে-মুখে সাবানের ফেনা লাগিয়ে দেয়। ইবা দূর থেকে হাস্যমুখে তকিয়ে দেখে।

উর্কেস আর পার্কেস- এই মাণিকজোড় যেন রায় বাবুদের গোপী-বাঘা, লরেল অ্যান্ড হার্ডি, টিনটিনের জনসন অ্যান্ড জনসন, কিংবা মহাভারতের পঞ্চপাণ্ডবের নকুল ও সহদেব। দ্রৌপদী গুলতিকে তারা শারীরিকভাবে কামনা করে- এটা সত্য, কিন্তু প্রিয় সখীর মতোও যে তাকে দেখে, সে কথাও মিথ্যা নয়। এই নির্মল আনন্দের দৃশ্য যখন নষ্ট, বিকৃতমনা, কামপ্রত্যাখ্যাত বিচারক-সমাজপতি চানমাঝির চোখে পড়ে, ব্যাপারটা তার কাছে নোংরামি মনে হয় এবং এক ধমকে সে নৃত্যগীত থামিয়ে দেয়।

দেবীর অভিশাপে বা অন্য কোনো কারণে প্রথমে ইঞ্জিন নষ্ট হয়। ইঞ্জিন সারানো গেলেও তেলের ড্রাম কীভাবে যেন ফুটা হয়ে যায়। নোঙর ছিঁড়ে দশ লাখ টাকা দামের জাল হারিয়ে যায় সাগরে। তেলের অভাবে ইঞ্জিন চলছে না বলে পাল তোলা হয়। কিন্তু পালও ভেঙে পড়ে। কেন ঘটছে একের পর এক অঘটন? নিশ্চয়ই বাইদানির কারণে, কারণ ‘নৌকায় মাইয়া মানুষ থাকা পাপ!’ এমন সময় ইবাকে বাইদানির সঙ্গে সাগরে জলকেলিরত অবস্থায় দেখে ফেলে ইজা। দুজনে উপরে উঠে এলে লাগে ভীষণ হট্টগোল।

বাইদানিকে চুলের মুঠি ধরে টেনে আনতে গেলে ইবা দা হাতে বাধা দেয়। ইবার ঘাড়ে দায়ের কোপ বসায় ইজা। বাইদানি চিৎকার করে উঠলে সবাই বুঝতে পারে, বোবা নয় সে। ইবার হাতে আহত হয় ইজা। বাইদানি পিতৃহন্তা চানকে হুমকি দেয়। ইবাকে খুন করে চানমাঝি। ইবার লাশ পড়ে থাকে ডেকের এক মাথায়। পরদিন অজ্ঞাত কারণে মারা যায় ফণি। কেউ জানে না, কীভাবে মাথায় বটির কোপে মরে যায় মরা। পার্কেস মাথা খারাপ হয়ে ‘আমি বাঁচতে চাই!’ বলে ঝাপ দেয় জলে। তাকে ফিরিয়ে আনতে গিয়ে ব্যর্থ হয় উর্কেস। রাতে পারস্পরিক দোষারোপের এক পর্যায়ে চান খুন করে ইচ্ছাক্রমে ইজাকে এবং ভুলক্রমে উর্কেসকে। আপাতত বেঁচে থাকে হারাধনের দুইটি ছেলে: নাগু এবং অবশ্যই চান মাঝি দ্য গ্রেট।

চান এক পর্যায়ে শালিকটিকে খাঁচা খুলে উড়িয়ে দেয় এই আশায় যে শালিক যদি ফিরে না আসে, তবে বোঝা যাবে তীর থেকে নয়নতারা খুব বেশি দূরে নেই। শালিক ফিরে আসে এবং হতাশ চান শালিকটিকে রোস্ট করে খায়, কারণ তার খুবই মাংস খেতে ইচ্ছা করছিল। লাশের তীব্র গন্ধে নৌকায় টেকা দায়। লাশ ফেলা দূরে থাক, ভয়ে নাগু লাশ স্পর্শ করতেও রাজি নয়। অগত্যা চানকেই লাশ ফেলতে হয় সাগরে একে একে। মাথায় বটি আটকানো মরা, ইজা, ফনি, মার্কেস। ইবার লাশ ফেলতে গিয়ে চানকে সাপে ছোবল দেয়। সাপের ছোবলে ইতিমধ্যে মুখে ফেনা তুলে মারা গেছে নাগু। দশাশই একটি সাপ ইবার লাশ জড়িয়ে ধরে এগোনোর এক পর্যায়ে ইবার মাথার পাশে দেখা যায় বাইদানির হাতের আঙ্গুল এবং পাশে বাইদানির মুখ। আঙ্গুলে নেলপলিশ নেই, কিন্তু মুখে মেকাপ তখনও বজায় আছে আঠারো আনা।

‘হাওয়া’ ছবিটি ইংরেজিতে বললে একটি হরর-ডক্যু-ফিকশান। ‘ডক্যু’ কারণ এতে সাগরের জেলেদের জীবন চমৎকারভাবে ফুটিয়ে তোলা হয়েছে। মহাভারতের মতোই এক প্রতিশোধের কাহিনী হাওয়া। দ্রৌপদীর প্রতিজ্ঞা দুঃশাসনের বুকের রক্তে তিনি চুল ভেজাবেন। গুলতিরও চুলির মুঠি ধরে তাকে নয়নতারার ডেকে আছড়ে ফেলেছে চান আর ইজা। গুলতি কিংবা তার পরিচালিকা দেবী কাউকে রেয়াৎ করেনি, যা দেখে গীতায় অর্জুনে যেমন বলেছেন: ‘রোমহর্ষশ্চ জায়তে!’ অর্থাৎ ‘(ভয়ে আমাদের গায়ের) লোম দাঁড়িয়ে গেছে’। ভয়-রোমা -হরর চরমে পৌঁছে যখন সর্বশেষ দৃশ্যে ভয়ঙ্কর সাপটি পুনরায় ক্রন্দনরতা এবং ‘মেকাপিতা’ রসের বাইদানিতে রূপান্তরিত হয়।

এ ঘটনা নতুন কিছু নয়। পাশ্চাত্য ভাষায় এর নাম ‘মেটামরফোজ’। সংস্কৃত এবং গ্রিক সাহিত্যে রূপবদলের ঘটনা প্রচুর আছে। মহাভারতে এক ঋষি-দম্পতির হরিণের রূপ ধারণ করে রমণ করা এবং রমণরত হরিণকে দেখে রাজা পাণ্ডুর রমণেচ্ছা হওয়া, অভিশাপে স্বর্গের অপ্সরা উর্বসীর লতায় রূপান্তরিত হওয়া, জিউসের রাজহংস হয়ে রানি লেডার সঙ্গে রমণ করে হেলেনের জন্ম দেওয়া ইত্যাদি আরও কত শত কাহিনী ছড়িয়ে-ছিটিয়ে আছে এশিয়া-ইউরোপের আনাচে-কানাচে এবং অন্যত্র।

ইন্দো-আর্যরা আকাশে বিরাজমান একেশ্বরের ধারণা চাপিয়ে দেবার আগে সারা পৃথিবীতেই মাতৃকাদেবীর পূজা হতো, দক্ষিণ আমেরিকায়, আরবদেশে, তুর্কিস্থানে, ভারতে, কোথায় নয়। সেই মাতৃকাদেবীর হাতে থাকতো সাপ। সাপ জ্ঞানের প্রতীক, এখনও চিকিৎশাস্ত্রের লোগোতে যুগল সাপের চিত্র ব্যবহৃত হয়। তান্ত্রিক-বাউলদের মতে, মানব-শরীরের স্নায়ু-ব্যবস্থার যে কুলকুণ্ডলীনি সেটাও সাপের আকৃতিই বটে। মা দুর্গার হাতেও একটি সাপ থাকে না কি? তেনার স্বামী মহাদেব শিবতো সাপকে গলার মাফলার হিসেবে ব্যবহার করেন।

শিবের কন্যা বাংলা অঞ্চলের লোকদেবী মনসাও সাপের দেবী বটেন। মনসামঙ্গল কাব্যে মনসা দেবীর প্রতিদ্বন্দ্বী ছিলেন চাঁদ সওদাগর, যার সপ্তডিঙা মধুকর সাগরে ডুবিয়ে দিয়েছিল মনসা এবং সাত ছেলের অপমৃত্যু ঘটিয়েছিল। নয়নতারা ডিঙাতেও সাতজন মাল্লা ছিল, চান বাদে। সবারই অপমৃত্যু হয়েছে, ডিঙা ডোবেনি বটে, কিন্তু দিশাহীন, মনুষ্যবিহীন হয়ে অকূল সাগরে ভেসে যাওয়া মৃত্যুর চেয়ে কম কী? মনসামঙ্গল ও হাওয়ামঙ্গলের এই সাদৃশ্য কি একান্তই কাকতালীয়?

‘উড়ে গেলো দেশলাই কাঠি প্রজাপতি হয়ে’- স্বরচিত অতিপ্রিয় একটি পঙতি আমার। ঘষা দিলে দেশলাই কাঠি জ্বলে ওঠা বাস্তবতা- আমাদের পঞ্চেন্দ্রিয় নির্ভর ত্রিমাত্রিক বাস্তবতা। এর বাইরেও চতুর্মাত্রিক, বহুমাত্রিক বাস্তবতা থাকা অসম্ভব নয় মোটেই। দুই চর্মচক্ষে মানুষ যা দেখে, পুঞ্জাক্ষির অধিকারী একটি মক্ষিকাও কি সেই একই জিনিস দেখবে? জ্বলন্ত কাঠির প্রজাপতি হয়ে উড়ে যাওয়া মনুষ্যসুলভ বাস্তবতায় অসম্ভব, সত্য, কিন্তু বাস্তবতা, অনুভবের অন্য এক উচ্চতর, ভিন্নতর স্তরে অসম্ভব নাও হতে পারে।

যাকে ‘যাদু-বাস্তবতা’ বলা হয়, সেই স্তরে কিংবা মানুষের কল্পনার, নেশাগ্রস্ততার বিশেষ একটি স্তরে এসে, ধরা যাক, যে স্তরে সালভাদর দালির ঘড়ি দুই ভাঁজ হয়ে গলে পড়তে থাকে নিচে, দেশলাইয়ের ভিতরে এতকাল সারবন্দি হয়ে শুয়ে থাকা শুককীট-মুককীট কাঠিগুলো ঘর্ষণ-উত্তর জীবনে জ্বলতে জ্বলতে বোকার মতো নিভে না গিয়ে একেকটি প্রজাপতি হয়ে (ঠাকুরের ভাষায়) ‘তোমার অসীমে প্রাণমন লয়ে যত দূরে আমি ধাই...’ গাইতেই পারে।

ষোড়শ শতক থেকে সাহিত্যের, শিল্পের বিবর্তনের ক্রমধারায় প্রথমে এসেছে ধ্রুপদীবাদ বা ক্ল্যাসিসিজম, তার পর বাস্তববাদ বা রিয়ালিজম, তারপর পরাবাস্তববাদ বা সুররিয়ালিজম। এর বাইরে ন্যাচারালিজম, রোমান্টিসিজম ইত্যাদি ধারাও আছে। ক্ল্যাসিসিজম বলবে, দেশলাই কাঠি জ্বলতে জ্বলতে নিভে যাবে- এর বেশি কিছু দেখালে সেটা শিল্পই হবে না, দেখালে শিল্পীকে শাস্তি দিতে হবে, শাস্তি দেয়া হয়েছে এক সময় ইউরোপে। ন্যাচারালিজম বা রিয়ালিজম বলবে, কাঠি জ্বলে উঠে নিভে যাওয়া পর্যন্ত দেখালে ভালো হয়, কারণ সেটাই প্রকৃতিতে ঘটে থাকে, সেটাই প্রকৃতিসম্মত, বাস্তবতা। দেশলাই কাঠির প্রজাপতি হয়ে উড়ে যাওয়া পরাবাস্তবতা বা সুররিয়ালিজম।

ক্ল্যাসিসিজম, ন্যাচারিলিজম কিংবা রিয়ালিজমের ক্ষেত্রে শিল্পীর মধ্যে প্রদর্শনের, দর্শনের মুন্সিয়ানা বা কাবলিয়ত থাকাটাই যথেষ্ট। পক্ষান্তরে পরাবাস্তববাদী শিল্পের সৃষ্টি ও সমজদারি উচ্চমানের কল্পনাশক্তি ও সৃজনক্ষমতা দাবি করে। পরিচালক মেসবাউর রহমান সুমনের ‘হাওয়া’ ছবিতে অনুরূপ কল্পনাশক্তি আর সৃজনক্ষমতা লক্ষ্য করা যেতে পারে। যেমন ধরুন, গুলতি নিজের পরিচয়ে বলেছে সে বাইদানি। বেদেরা ভারত থেকে বের হয়ে ইরান-মধ্যএশিয়া হয়ে সারা পাশ্চাত্যে ছড়িয়ে গেছে বটে, কিন্তু সাধারণত তারা স্থলে ও নদীতে থাকে। গভীর সমুদ্রে কখনই যায় না বেদেরা। কীভাবে গুলতি বাইদানি মধ্য সমুদ্রে এসে পড়লো?

চানকে ইঙ্গিতে বলেছে বটে গুলতি, সে সাঁতার কেটে এসেছে। কিন্তু সেটা কি সম্ভব? একটা মেয়ে কখনও মাছ হয়, কখনও সাপ। সেই মেয়ে আবার বলে, সে নিজে কিছু জানে না, দেবীর আদেশ পালন করে মাত্র। ‘সবটাই কি কিস্যা! তুই তো মানুষ, তুই কীভাবে দেবী অইবি?’ গলাজলে দাঁড়িয়ে বাইদানির কাছে জানতে চায় ইবা। মানুষতো সে বটেই, নইলে কি টাট্টিখানায় যেতো। হিন্দু কিংবা গ্রিক কোনো দেবী বা দেবতাকে কখনও ভোগ ছাড়া ত্যাগ করতে দেখা যায়নি, মলত্যাগতো দূর কী বাত। (নজরুলের ভাষায়) ‘দেখিয়া শুনিয়া ক্ষেপিয়া গিয়া’ চানের মতো আমাদেরও বলতে ইচ্ছা করে: ‘বুঝি না, তোমার কতা কিছু বুঝি না!’ না বুঝলেও বিশ্বাস করতে দোষ কী? ছবির শুরুতেও বিশ্বাসের শক্তির কথা বলা হয়েছে। বিশ্বাস করলে বিষও নাকি মধু হয়ে যায়। ‘মধু কই কই বিষ খাওয়াইলা।’ মধু বলে বিশ্বাস করে বিষই হয়তো খাচ্ছি আমরা সবাই।

দর্শক পুরোটা যদি বুঝেই যায়, তবেতো সেটা বাস্তবতা হতো, পরাবাস্তবতা নয়। ‘বোঝা আর না বোঝার মাঝামাঝি কোনো রং চোখে আর ভাসবে কি কখনো?’ মান্না দের গাওয়া গান। বিংশ শতকের বিশের দশকে সূচিত হওয়া পরাবাস্তব শিল্পধারার এই আলো-আঁধারি কিংবা ‘বোঝা-আর না-বোঝার মাঝামাঝি’ এই রঙ দিয়ে মুন্সিয়ানার সঙ্গে পুরো ছবিটিকে রাঙিয়েছেন পরিচালক মেসবাউর রহমান সুমন এবং তার দুই আলোকচিত্রী। বাংলাদেশের বেশির ভাগ ঝানু পরিচালক কিংবা স্বঘোষিত আব্বাস কিরোস্তামিরা যখন বাস্তবতাটাকেও ঠিকঠাকমতো ফুটিয়ে তুলতে পারছেন না, তখন কম কথা বলা, বেশি কাজ করা বছর ত্রিশের বয়সের এক ভেতো বাঙালি যুবক আন্তর্জাতিক দর্শককে পরাবাস্তবতার স্বাদ দিচ্ছে- এই ঘটনা বাংলাদেশের সিনেমার, শিল্পের ইতিহাসে অভিনব বটে।

কল্পনা করুন, আপনি খেতে বসেছেন। পরিবেশনকারী একের পর এক বেগুন ভাজা দিয়ে যাচ্ছে আপনার পাতে, কিংবা ডাল ঢেলে ভাসিয়ে দিচ্ছে আপনার থালা, কিংবা অনেকখানি ভর্তা দিচ্ছে, কিন্তু ভাত দিচ্ছে চা চামচ পরিমাণ। এমনও হতে পারে, পাতে ভাত নিয়ে ঠায় বসেই আছেন আপনি, তরকারি আর আসছে না, তার বদলে হঠাৎ আসলো সরিষার তেল। সরিষার তেল দিয়ে ভাত মেখে খাওয়া যেতেই পারে, কিন্তু চর্ব্য-চোষ্যের আশ্বাস দিয়ে স্রেফ তেল দিয়ে ভাত মেখে খাওয়ানো হলে মেজবানের মাথার স্ক্রু একটু ঢিলা বলেই আপনার সন্দেহ হবে। আবার এমনও হতে পারে, পরিবেশনের চামচটা তিন ব্যাকা কিংবা থালাটা নিচে ফুটা, যেখান দিয়ে ঝোলটা গড়িয়ে পড়ে নিচে।

‘তিক্তেন ভোজনারম্ভ, মধুরেণ সমাপয়েৎ।’ তিতা দিয়ে খাওয়া শুরু এবং মিষ্টি দিয়ে সমাপ্ত হবে। ধরা যাক, প্রত্যেকটি তরকারি স্বাদ হয়েছে ঠিকই, কিন্তু পরিবেশকারী তরকারি পরিবেশনের প্রচলিত ক্রম মানছে না- ভর্তার পরে দিচ্ছে পায়েস এবং পায়েসের পরে মাংস, মাংসের পর তিতা করলা। কিংবা যে সব তরকারি দিচ্ছে, তার একটাতেও বিন্দুমাত্র স্বাদ নেই, কারণ, রান্নার সময় কোনো প্রকার নিয়ম মানা হয়নি। নিয়ম না মেনেও স্বাদু রান্না করা অসম্ভব নয়, কিন্তু রান্না যখন স্বাদ হবে না, তখন নিয়ম না মানাটা রান্না খারাপ হবার অন্যতম কারণ হিসেবে অবশ্যই দেখানো হবে।

যত ক্ষুধাই থাকুক আপনার পেটে, মেহমান হিসেবে যত সহনশীলই হন আপনি, একের পর এক এমন সব মেজবানের দাওয়াতে গিয়ে নিশ্চয়ই আপনি মহাবিরক্ত হবেন। আপনাদের কথা জানি না, আমি নিজে এমন বিরক্ত হয়েছি, স্বাধীনতার পর থেকে আজ পর্যন্ত বাংলাদেশের বেশির ভাগ তথাকথিত ‘আর্ট ফিল্ম’ দেখে। এদের সবগুলোতেই গল্প আছে সত্য, কিন্তু বেশির ভাগ পরিচালক গল্প বলতেই যেন জানেন না। উপন্যাসে, মঞ্চ নাটকে আর সিনেমায় গল্প বলার ধরণ এক রকম নয়। সিনেমার একটা আলাদা ভাষা আছে, সেই ভাষা বাংলাদেশের বেশিরভাগ পরিচালক শেখেননি। কেন শেখেননি তা নিয়ে গবেষণা হতে পারে, কিন্তু শেখেননি সেটাই হচ্ছে কথা। হয়তো প্রয়োজনীয় প্রতিভাই নেই, অথবা চর্চার অভাব। সিনেমার অভিনয়, নাটকের অভিনয় আর যাত্রার অভিনয় এক নয়। বাংলাদেশের বেশির ভাগ কুশীলবের অভিনয় ড্রামাটিক, যাত্রাসুলভ, সিনেমাটিক নয়।

তেনারা ‘আর্ট ফিলিম’ বানানোর দাবি করেন বটে, কিন্তু বেশির ভাগ চলচ্চিত্র ‘ফিল্ম’ই হয় না, আর্টতো দূর কী বাত। তাদের ছবি যখন চলে না, তারা এই বলে না চলার সাফাই দেয় যে লোকে তাদের আর্ট বোঝে না। সরকারি লোকজনকেও বলতে শুনেছি সম্প্রতি, আর্টফিল্ম চলে না, কিন্তু এ ধরনের ফিল্মের দরকার আছে। সরকার যেহেতু ভাবে দরকার আছে এবং সরকারের ধামাধরা চলচ্চিত্রকারদের হাতে কলাটা-মূলোটা তুলে দেবার প্রয়োজনও যেহেতু অনস্বীকার্য, সেহেতু এসব আর্টফিল্মে অনুদান দেওয়া হয়। কিন্তু অনুদান যতটা দেওয়া হয়, পরিচালকদের দাবি অনুসারে সে টাকার পরিমাণটা যথেষ্ট নয় এবং যেভাবে টাকাটা দেওয়া হয়, সেই প্রক্রিয়াটাও নাকি সুবিধার নয়। সমস্যা হচ্ছে, অনুদানের ছায়াছবিটি যদি ‘আর্ট’ এবং ‘ফিল্ম’ কোনটাই না হয়, সেক্ষেত্রে সরকার তথা জনগণের পুরো টাকাটাই অপচয়।

অস্কার ওয়াইল্ড বলেছেন: ‘নৈতিক বিচারে বই ভালো বা খারাপ হয় না। বই হয় ভালোভাবে লেখা হয়, নয়তো খারাপভাবে।’ একইভাবে, অনেক চলচ্চিত্র সমালোচক আর্ট ফিল্ম এবং বাণিজ্যিক ছবির পার্থক্য মানতে চান না। তাদের মতে ছবি দুই রকম, ভালোভাবে নির্মিত ছবি এবং আনাড়িভাবে নির্মিত ছবি। এমন একটি মানদণ্ড কল্পনা করার অবকাশ আছে, যার সর্বোচ্চ দাগের নিচে লেখা আছে ‘দারুণ’ এবং সর্বনিম্ন দাগের নিচে লেখা আছে ‘ফালতু’। যে কোনো শিল্প, সে চলচ্চিত্রই হোক, কিংবা উপন্যাস, এই দুইয়ের মাঝখানে কোথাও অবস্থান করে। কোনো ছবি হতে পারে অনেকটাই দারুণের দিকে, আবার কোনো ছবি ফালতুর কাছাকাছি।

মানদণ্ডটা ব্যক্তি ও সমাজের রুচির প্রকৃতির উপরও নির্ভর করে। ‘পাখি গায় আপন মনে, যার যেমন লাগে কানে’। ‘কারও বুঝ, কারও তরমুজ’! সংস্কৃতে যেমন বলে: ‘ভিন্ন রুচির্হি লোকাঃ’ অর্থাৎ ‘রুচি জনে জনে আলাদা’। ব্যক্তি শুধু নয়, সমাজের রুচিও স্থান ও কালভেদে ভিন্ন হতে পারে। একটি শিল্পনির্ভর সমাজ ও একটি কৃষিজীবী সমাজের রুচি এক রকম হবার কোনো কারণ নেই। আজ থেকে এক শ বছর আগে বাংলাদেশের দর্শকের রুচি আর হালের বাংলাদেশের দর্শকের রূচি এক নয়।

সিনেমার উপর বছর খানেক হাতেকলমে পাঠ নেবার সুযোগ হয়েছিল আমার ফ্রান্সের বার্গান্ডিতে, আশির দশকের শেষ দিকে। গুরুরা আমাকে যত্ন নিয়ে চিত্রগ্রহণ, শব্দগ্রহণ ও সম্পাদনার কাজ শিখিয়েছিলেন। সপ্তাহে খান পাঁচেক ছবি দেখে সেই সব ছবি নিয়ে আলোচনা করতে অনেকটা বাধ্য করা হতো ফাঁকিবাজ আমাকে। গুরুরা আশা করেছিলেন, ভালো ফিচার ফিল্ম বানাবো, কিন্তু বাংলাদেশের প্রথম ফরাসি/ইউরোপীয় প্রযোজনায় নির্মিত ‘গন্তব্য চট্টগ্রাম’ ছবির এক্সিকিউটিভ প্রডিউসার হিসেবে কাজ করা ছাড়া চলচ্চিত্রের এই শিক্ষাকে কাজে লাগানোর অবসর বা ইচ্ছা কোনোটাই হয়ে ওঠেনি আমার। ছবি দেখাটা হয়তো কিছুটা শেখা হয়েছিল এবং ছবি দেখতে দেখতে একটা বিশেষ বাতিকও যোগ হয়ে গিয়েছিল চরিত্রে: নতুন কোনো বই হাতে পেলে যেমন পড়া শুরু করার আগে, ছাপার ত্রুটি কিংবা মুদ্রণ-সৌকর্য যেমন আমার চোখে পড়ে, সিনেমার ক্ষেত্রেও কারিগরী দিকগুলো খেয়াল করতে করতে অনেক সময় ছবিটাই দেখা হয়ে উঠে না। এ কারণে যে ছবিটা দেখা দরকার বলে মনে করি, সেটা একাধিক বার দেখি, দেখতে হয় এবং হাওয়ার ক্ষেত্রে তাই হয়েছে।

আমার দিদিমা বলতেন, বুদ্ধিমান পুরুষ রান্নাটা বাজার থেকেই করে আনে। কোন মাছের সঙ্গে কোন তরকারি যাবে, কোন শবজি দিয়ে কোন তরকারি রাঁধতে হবে, সেটা বাজার করার সময়েই ঠিক করতে হয়। একইভাবে সম্পাদকের দৃষ্টি দিয়ে একটি ছবির চিত্রগ্রহণ করলে সময় এবং অর্থ দুইয়েরই সাশ্রয় হবার কথা। কোন বিশেষ সিকোয়েন্সের পর কোন বিশেষ সিকোয়েন্স আসবে, কোন কোন দৃশ্য নিয়ে একেকটি সিকোয়েন্স হবে- এটা একটা পরিকল্পনার ব্যাপার। আমরা জানি, ছবি করার আগেই সত্যজিৎ রায় প্রতিটি সিকোয়েন্সের ছবি এঁকে রাখতেন, অনেকটা নিজের রেফারেন্সের জন্যই, যা সুমনও করেছেন বলে জানা গেছে।

কোনো রচনা বা টেক্সট সুখপাঠ্য হবার জন্যে একেকটি পরিচ্ছেদে সরল, জটিল, যৌগিক বিভিন্ন ধরনের বাক্য থাকতে হয়। এর ক্রমটা কী হবে, সেটা একান্তভাবে লেখককের সিদ্ধান্ত, প্রতিভা কিংবা অভ্যাসের ব্যাপার। একই গল্প বিভিন্ন ধরনের সিকোয়েন্সে বিভক্ত করে যেমন দেখানো যায়, তেমনি একই সিকোয়েন্সেও দৃশ্যবৈচিত্র্য ভিন্ন ভিন্ন হতে পারে। সিনেমার ক্ষেত্রে একেকটি সিকোয়েন্সে ক্লোজ, মিডিয়াম, লঙ, টপ-অ্যাঙ্গেল, লো-অ্যাঙ্গেল বিভিন্ন ধরনের দৃশ্য থাকা বাঞ্ছনীয়, কারণ তা যদি করা না হয়, তবে দর্শকের দিক থেকে দেখাটা অনায়াস না হয়ে ক্লান্তিকর হবে। এই বোধ বা আক্কেলটা বাংলাদেশের বিখ্যাত অনেক পরিচালকেরই নেই।

শট এবং সিকোয়েন্স বৈচিত্র্যের একটি অলিখিত ব্যাকরণ নিশ্চয়ই রয়েছে। ভাষার ব্যাকরণের একটা অংশ ভাঙা যায় না, কিন্তু আরেকটা অংশ ভাঙা যায়। ‘আমি খায়’ কোনো মতেই বলা যায় না, কিন্তু ‘খাই আমি ভাত’ বলা যেতেই পারে, যদিও ‘আমি ভাই খাই’ বেশি স্বাভাবিক। ব্যাকরণ থাকার সুবিধাটা হচ্ছে এই্, ব্যাকরণ থাকলেই ব্যাকরণ ভাঙা যায় এবং ব্যাকরণটা সেই সফলভাবে ভাঙতে পারে, ব্যাকরণটা ভালোভাবে যে জানে, বোঝে।

অনেকে মনে করেন, ছবিতে গল্প থাকতেই হবে এবং চলচ্চিত্রকারকে গল্পটা বলতে জানতে হবে। মানুষ গল্প শুনতে ভালোবাসে বটে, কিন্তু সিনেমা কেন, কোনো শিল্পেরই গল্প বলার ‘দায়’ নেই। এ কথার অর্থ এই নয় যে শিল্পে গল্প থাকবে না। শিল্পী যদি গল্প বলতেই চান, তিনি বলতে পারেন। যদি কোনো ‘অ্যান্টি স্টোরি’ বা ‘প্রতিগল্প’ বলতে চান পরিচালক, সে স্বাধীনতাও তার রয়েছে বৈকি। কিন্তু শর্ত হচ্ছে, কাজটা সর্বোচ্চ মুন্সিয়ানার সঙ্গে করতে হবে, এই সত্যটা মনে রেখে, ‘ইন নো সিচুয়েশন অডিটি ক্যান বি কলড স্ট্যাইল’ বা বাংলায় বললে: ‘অসংলগ্নটা কখনই শৈলী হতে পারে না’ (কথাটা আমার)। সুমন অবশ্য বলেছেন এক সাক্ষাৎকারে, নতুন কোনো গল্প তিনি বলতে চান নি, না ‘হাওয়া’ ছবিতে, না তাঁর অন্য কোনো কাজে। সবার জানা গল্পকেই তিনি নতুন আঙ্গিকে বলতে চান। সুমনের বক্তব্যটা যদি আমি বুঝে থাকি, তিনি হয়তো বলতে চান: ‘কাফকার মেটামরফোজের গল্প আমি বলতে চাইনি, বাংলাদেশে সবার জানা, নাগিনের মতো মেটামরফোজের একটা স্থানীয় গল্প বলতে চেয়েছি।’

‘হাওয়া’ ছবিটি দুই বার দেখলাম, প্রথম বার স্রেফ দেখে গেছি, দ্বিতীয়বার খেয়াল করেছি। ছবিটি এত ভালোভাবে নির্মিত হয়েছে যে আরও কয়েক বার দেখলেও আমার খারাপ লাগবে না। প্রতিবার এই ছবিতে নতুন কোনো সৌন্দর্য আবিষ্কার করা সম্ভব। চিত্রগ্রহণ, শিল্পনির্দেশনা, শব্দগ্রহণ, ডাবিং ও সম্পাদনার দিক থেকে আমার দেখা বাংলাদেশের কোনো ছবিই হাওয়ার মতো ত্রুটিহীন নয়। পানির নিচের দৃশ্যগুলোও কী নিখুঁতভাবে চিত্রায়িত! ছবিতে কোনো স্ট্যান্টম্যান ব্যবহার করা হয়নি। গ্রাফিক্সের কোনো কারিকুরিই কি নেই এই ছবিতে? অনেক জায়গায় যেগুলো গ্রাফিক্সের কাজ মনে হচ্ছে, সাপের দৃশ্য বা পানির নিচে সুরমা মাছ, সেগুলোও নাকি প্রাকৃতিকভাবেই চিত্রায়িত করা। তেলের ড্রাম জোড়া দিয়ে ভেলা বানিয়ে তার উপর ক্যামেরা রেখে শুটিং হয়েছে। অভিনেতাদের শারিরীকভাবে ফিট থাকতে হয়েছে, সাঁতারও শিখতে হয়েছে। যেখানে শুটিং হচ্ছিল, সেটা মধ্য সমুদ্র, যেখানে হাঙ্গরের মতো বিপদজনক প্রাণী দুর্লভ ছিল না, বলেছেন চঞ্চল চৌধুরী। কলাকুশলীদের বিভিন্ন সাক্ষাৎকার শুনে যতটুকু মনে হয়েছে, ছবির এক্সিকিউটিভ প্রডিউসার (কিংবা প্রডিউসারগণের) যোগ্যতা প্রশ্নাতীত।

বাংলাদেশে নির্মিত সব ছবি আমি দেখিনি, কেই বা দেখেছে, তবে ‘হাওয়া’ দেখে মনে হয়েছে, এই ছবি যারা বানিয়েছেন, নিজের কাজটা তারা পৃথিবীর যে কোনো দেশের সিনেমা শিল্পের সর্বোচ্চ পেশাদারদের মতোই খুব ভালোভাবে জানেন, হাতে-কলমে শিখেছেন। অন্য যাদের ছবি আমি দেখেছি (কোন ছবি, কাদের ছবি আমি বলছি না, বলা শোভনও নয়), হাওয়ার কলাকুশলীদের সঙ্গে তুলনা করলে তারা এখনও শিক্ষানবীশ পর্যায়ে আছেন। বাংলাদেশ একটি উন্নয়নশীল দেশ। এই দেশে পাশ্চাত্যের মতো যন্ত্রপাতি সহজলভ্য হবে- এমনটা আশা করা যায় না। একটি উন্নয়নশীল দেশে প্রাপ্য সুযোগ-সুবিধা দিয়ে পরিচালক এবং তার টিম একটি আন্তর্জাতিক মানের ছায়াছবি বানাতে সক্ষম হয়েছেন।

ও ভালো কথা, একটি ত্রুটির কথা এ মুহূর্তে মনে পড়ছে: সাবটাইটেলের ফন্ট আরও বড় হলে ভালো হতো বলে মন্তব্য করেছেন একজন তথ্যচিত্র নির্মাতা। এছাড়া ছবির শেষদিকে ঝগড়ার দৃশ্যে আরও কিছু ক্লোজশটের দরকার ছিল। ঝগড়ার সিকোয়েন্সে দৃশ্যবিন্যাস সমৃদ্ধতর করার প্রয়োজন ছিল। চানমাঝির শালিকের জায়গায় একটি হরবোলা ময়না বা তোতা হলে এবং মাঝে মাঝে পাখিটি (শ্যাম বেনেগালের ১৯৮৩ সালে করা ‘মান্ডি’ ছবিতে যেমন খাঁচার পাখি বলে উঠতো ‘লুচ্চা’), দুই একটি প্রাসঙ্গিক বাণী দিলে সম্ভবত খারাপ হতো না।

এক সাক্ষাৎকারে চঞ্চল চৌধুরী যেমনটা বলেছেন: ‘এই সময়ে অর্থাৎ ২০২২ সালে কী ধরনের ছবি হওয়া উচিত, সেটা মাথায় রেখেই হাওয়া ছবিটি নির্মিত হয়েছে।’ তার মুখেই শুনলাম, করোনা মহামারী শুরু হবার আগে সেন্ট মার্টিন এবং গভীর সমুদ্রে ঘটনার ক্রম মেনে একটানা ৪৫ দিনে শুটিং শেষ হয়েছে হাওয়ার। ঘূর্ণিঝড় বুলবুলের কারণে সপ্তাহ খানেক শুটিং বন্ধ ছিল। হাওয়ার প্রস্তুতিপর্ব সুদীর্ঘ। সুমন লোকটা, কথাবার্তা শুনে মনে হয়েছে, ইংরেজিতে যাকে বলে, ‘টাফ গাই’। শুটিং শুরুর আগে ছয় মাস ধরে রিহার্সাল হয়েছে, প্রতিদিন সকাল দশটা থেকে রাত আটটা পর্যন্ত। রিহার্সালে শেষ দৃশ্যের সাপটি এবং আরও কয়েকটি সাপ উপস্থিত ছিল। জানি না, এদের পুষতে কী পরিমাণ ‘দুধ-কলা’ লেগেছে। সুমন অবশ্য জানিয়েছেন, ছবিটির পরিকল্পনা এবং নির্মাণ শেষ হওয়া পর্যন্ত সময় লেগেছে প্রায় পাঁচ বছর (মধ্যে দুই বছর কোভিড মহামারী ছিল)। ‘সাদা সাদা কালা কালা’ গানটি রেকর্ড হয়ে কেমন দাঁড়াবে, সেটা ঠিক করতেই টিমের লেগে গেছে প্রায় সাড়ে তিন বছর। গভীর সমুদ্রে গানটির শুটিং-এ লেগেছে দুই দিন। গানের দৃশ্যায়নে আটজন অভিনেতা ছাড়া সাধারণ জেলেরাও অংশগ্রহণ করেছে।

সাগরের লোকেশন চমৎকার এবং বিশ্বাসযোগ্য। আমার নিজের জন্ম ও বেড়ে ওঠা চট্টগ্রামের সীতাকুণ্ড থানার কুমিরা গ্রামের সাগরপাড়ে। শুধু তাই নয়, যে ফরাসি-বাংলাদেশ যৌথ প্রযোজনা ‘গন্তব্য চট্টগ্রাম’ ছবির সঙ্গে আমি ওতপ্রোতভাবে জড়িত ছিলাম, সেটাও ছিল সাগর ও নদীভিত্তিক ছবি। এ ছবিরও শুটিং হয়েছিল গভীর সমুদ্রে, ভেগা-টি নামক জাহাজে। সুতরাং হাওয়ার দৃশ্যগুলোকে আমি আমার অভিজ্ঞতার সঙ্গে মেলাতে পেরেছি, প্রতিটি দৃশ্য ও সিকোয়েন্সকে আলাদা করে যাচাই করতে পেরেছি। হাওয়া ছবির বেশির ভাগ সিকোয়েন্স-বিন্যাস এবং সিকোয়েন্সের ভিতরে দৃশ্যবিন্যাস যথাযথ। অন্য রকম হতেই পারতো এবং সেই ‘অন্য রকম’ দৃশ্য ও সিকোয়েন্স বিন্যাস বর্তমানেরটাও চেয়েও ভালো হতে পারতো। কিন্তু সেটাতো সম্ভাবনার কথা। যে রকম হয়েছে, তাতে ছবি উৎরেছে এবং খুব ভালোভাবেই উৎরেছে।

সমুদ্রে সকাল, দুপুর, বিকাল, সন্ধ্যা ও রাতের দৃশ্যায়নে আলোর ব্যবহার যথাযথ এবং চমৎকার। ডেক, ডেকের উপরে নির্মিত কেবিন, ধৃত মাছ হিমায়িত করে রাখার বরফঘর এবং ইঞ্জিনঘর- এই চারটি জায়গায় কুশীলবেরা দৃশ্যমান হয়েছেন। দিনের বেলায় ডেকের উপরে স্বাভাবিকভাবেই অনেক আলো, ডেকের উপর নির্মিত কেবিনের ভিতরে অপেক্ষাকৃত কম আলো, হিমঘরে, ইঞ্জিনঘরে আরও কম আলো। এই চার ধরনের আলো যথাযথভাবে চিত্রায়িত হয়েছে।

হলিউডে ডিরেক্টর অব ফটোগ্রাফি ছিলেন এমন সব লোককে কাছ থেকে কাজ করতে দেখেছি। ১৯৯৮ সালে ‘গন্তব্য চট্টগ্রাম’ ছবির শুটিং- এর সময় আমাদের অবাক লাগতো এবং একটু বিরক্তও হতাম বৈকি যখন দেখতাম, আলোক-ব্যবস্থাপনায় তারা ঘণ্টার পর ঘণ্টা কাটিয়ে দিচ্ছেন। ফরাসি ভাষায় আলোক-ব্যবস্থাপনা যিনি করেন, তাকে বলা হয় ডিরেক্টর অব ফটোগ্রাফি বা ডিপি আর ক্যামেরা যিনি চালান, তাকে বলা হয় ক্যামেরাম্যান। ক্যামেরাম্যানের র‌্যাংক ডিপির নিচে, ছবিতে আলোর এতটাই গুরুত্ব। ‘গন্তব্য চট্টগ্রাম’ ছবির ডি.পি. জর্জি ফ্রোমন্ত্যাকে একদিন এ ব্যাপারে প্রশ্ন করাতে তিনি বলেছিলেন, ফটোগ্রাফিতে, সেটা স্থিরচিত্র হোক কিংবা চলচ্চিত্র, আলোক-ব্যবস্থাপনাই মূল কাজ। আলো একবার ঠিকমতো করা গেলে ক্যামেরা চালানোতো কোনো ব্যাপারই নয়।

বাস্তবের অন্ধকারে সাধারণত কিছু দেখা যায় না। সিনেমার কৃত্রিম, চিত্রায়িত অন্ধকারে অন্ধকার যেমন থাকতে হয়, বিষয়ও দৃশ্যমান হতে হয়। অনেক আলোকচিত্রী রাতের দৃশ্যায়নকে বাস্তব-সম্মত করার অজুহাতে এত বেশি অন্ধকার রেখে দেন যে দৃশ্যে কী ঘটছে, বোঝা মুশকিল হয়ে পড়ে। অনেক চিত্রগ্রাহক লেন্সের উপর উল্টাপাল্টা ফিল্টার লাগিয়ে রাতের ফটোগ্রাফিকে অতিমাত্রায় কৃত্রিম এবং বিরক্তকর করে তুলেন। চিত্রগ্রহণের এমন কোনো আনাড়িপনা হাওয়ায় দেখা যায় না। রাতের কোনো দৃশ্যেই অন্ধকার দৃশ্যকে ছাপিয়ে উঠেনি। আমার দেখা উপরোক্ত সব অভিজ্ঞ পাশ্চাত্য আলোক-নির্দেশক হাওয়ার চিত্রগ্রাহক ও আলোক-নির্দেশকের চেয়ে উন্নততর কাজ করতেন- এমন দাবি আমি করতে পারছি না।

সত্যি বলতে কী, হাওয়ার মতো সফল আলোক-ব্যাবস্থাপনা সহজ কাজ নয় মোটেই। এমন একটি কাজ বাংলাদেশের আলোকচিত্রীরা করেছে- এটা ভেবে দেশপ্রেমে চোখ আমার অশ্রুসজল হয়ে উঠছে। ‘হাওয়া’ ছবিটা যেন বলিউড আর হলিউডের ছবির সামনে গুলতি বাইদানির মতো, মাজা বাঁকিয়ে, বুক চিতিয়ে বলে: ‘দেখ, আমার রূপের বাহার দেখ! নোনা জলে ভিজেও দেখ মেকাপ কেমন আমার জ্বলজ্বল করছে, ‘আই নো হাউ টু মেক ইট আপ!’ তুই দেখবি আর জ্বলবি, লুচির মতো ফুলবি!’ মন্ট্রিয়লে হাওয়া দেখে হল থেকে বের হয়ে দেখলাম, না সব লুচি ফোলেনি। লুচি না ফোলার একাধিক কারণ থাকতে পারে, কখনও ময়দা ভালো থাকে না, কখনও তেলে ভেজাল থাকে। পরিচালক মেসবাউর রহমান সুমন যেমনটা বলেছেন, এক সাক্ষাৎকারে: ‘এ ছবি সবার ভালো নাও লাগতে পারে। কোনো শিল্পই সবার ভালো লাগে না, যদিও সবার জন্যই আমি এ ছবি বানিয়েছি।’

বুদ্ধ হবার লক্ষ্যে সিদ্ধার্থ গৌতম যখন ধ্যানমগ্ন, দেবতারা তার ধ্যান ভঙ্গ করার উদ্দেশ্যে এক গর্ভবতী নারীকে হাজির করেছিলেন তার দৃষ্টিপথে। সে যুগের লোক ভাবতো, গর্ভবতী নারী সুন্দর, কারণ তিনি পরিপূর্ণা। সংস্কৃত মন্ত্র: ‘ওঁ র্প্ণূমিদং’ অর্থাৎ ‘এটা (ব্রহ্মা-) পূর্ণ এবং পবিত্র’। হাওয়া ছবির প্রতিটি ফ্রেম ভরা, পূর্ণ, কোনো অপ্রয়োজনীয় খালি জায়গা রাখা হয়নি কোনো ফ্রেমে। বেশ কিছু ফ্রেম প্রাকৃতিক। একটি দৃশ্যে চান মাঝির মাথা, ঘাড় এবং হাত দিয়ে ফ্রেম করা হয়েছে- আংটিপরা ডানহাতে নৌকাকে সামনে এগোতে ইশারা করছে চান।

এছাড়া আরও কতো বিচিত্র ফ্রেমিং যে এই ছবিতে আছে বলে শেষ করা যাবে না। পরিচালক ও আলোক-ব্যাবস্থাপক-ক্যামেরাম্যান তাদের মনের মাধুরি মিশিয়ে ফ্রেমিং নিয়ে বেশ একটা গবেষণা করেছেন বটে। প্রতিটি দৃশ্যই ‘চঞ্চল চৌধুরী’- একটি দৃশ্যকে ‘চতুর্দিক থেকে ধারণ করে’ বলে প্রতিটি ফ্রেমই একেকটি ‘চৌধুরী’, এবং হাওয়ার প্রতিটি চৌধুরীই ‘ঘটনা-চঞ্চল’, প্রতি মূহূর্তেই কিছু না কিছু ঘটে চলেছে প্রতিটি ফ্রেমে। প্রতিটি ফ্রেমে স্থান-গভীরতা বা ডেপথ অব ফিল্ডের দিকে খেয়াল রাখা হয়েছে, যার ফলে সৃষ্টি হয়েছে অভিনব সব ত্রিমাত্রিকতা।

আমাদের পাড়ার এক মহিলা, বাউচ্চার মা-কে একবার চট্টগ্রাম শহরে সিনেমা দেখাতে নিয়ে গিয়েছিলেন আমার দিদিমা। মাত্র তিন ঘণ্টায় ছবি শেষ হয়ে যাওয়ায় বাউচ্চার মা খেপে গিয়ে বলেছিলেন: ‘এর চেয়ে যাত্রাগান ঢের ভালো, সারা রাত চলে।’ নাচে-গানে ভরপুর তিন ঘণ্টার ছবি দেখে অভ্যস্ত এই বাংলাদেশে মাত্র দুই ঘণ্টায় ছবি শেষ করতে গিয়ে সম্পাদনার সময় বেশ কিছু মজার দৃশ্য নিশ্চয়ই বাদ গেছে এবং দৃশ্য বাছাই করতে গিয়ে ‘শ্যাম রাখি না কূল রাখি’ অবস্থা হয়েছিল নিশ্চয়ই পরিচালকেরও। ‘ত্রিশ টাকা কেজি মাছ’ গানটা সম্ভবত পুরোটা রাখা হয়নি। কিন্তু যে সিকোয়েন্স এবং দৃশ্যগুলো রাখা হয়েছে, যুক্তিসম্মতভাবেই সেগুলো আছে। পরিমিতির স্বার্থে দুই ঘণ্টার ছবি থেকে এদিক-ওদিক-সবদিক মিলিয়ে হয়তো মিনিট দুয়েক বাদ দিলেও দেওয়া যেতে পারে, তার বেশি নয়।

মন্ট্রিয়লে হল থেকে বের হয়েই নারীরা সমবেত হয়ে গাইতে শুরু করলেন ‘সাদা সাদা কালা কালা’ গানটি। বাংলাদেশে হলের ভিতরে দর্শক নাকি কোরাস গাইছিল। আমি জানি না, স্মরণকালে আর কোনো গান এমন জনপ্রিয়তা পেয়েছে কিনা। অতি সরল বাণীর সঙ্গে বাংলাদেশের মেঠোসুর মিশে এতটাই মন ছুঁয়ে গেছে এই গীত যে আজ এটি বাংলাদেশের আপামর জনতার মুখে মুখে। বাংলাদেশের সিনেমায় এত যুক্তিযুক্তভাবে গানের ব্যবহার বিরল। ‘সাদা সাদা কালা কালা’ গানের জটিল দৃশ্যায়ন এত মুন্সিয়ানার সঙ্গে করা হয়েছে যে এই সিকোয়েন্সটির জন্যেই হাওয়া ছবিটি স্মরণীয় হয়ে থাকবে।

আহা, কত দৃশ্যই না মনে পড়ে। রাতের বেলা লিলুয়া বাতাসে একমাত্র শাড়িটি শুকাচ্ছিল বাইদানি। উড়তে থাকা পালের মতো খয়েরি রঙের শাড়ির পিছনে সায়া আর শাড়ি পড়া বাইদানির ছায়ারেখা, ফরাসিতে যাকে বলে ‘সিলুয়েত’, কী যে সুন্দর সেই দৃশ্য! সাথে যে মিউজিক ব্যবহৃত হয়েছে, তাকে ব্যক্তিগতভাবে আমার মনে হয়েছে কল্পিত মৎস্যকন্যার মোহময় চিৎকার। ঝড়ের রাতে মাছের বদলে যখন জালে উঠে আসে মেয়েমানুষ, তীব্র বৃষ্টির ছাঁটের মধ্যে জেলেদের বিচিত্র রঙের রেইনকোটের বর্ণালী। রাতের আধো অন্ধকারে ডেকের উপর দিয়ে বাইদানির একা হেঁটে যাওয়া (মেয়ের হাঁটার মধ্যে একটু ক্যাটওয়াকের ভাব আছে। যাক মাফ করে দিলাম। ধরে নিলাম গুলশানের বাইদানি, দেবতারা সব ওদিকেই থাকেন কিনা!)।

দিন ও রাতের বিভিন্ন সময়ে বাংলার সমুদ্রের অপরূপ রূপ। নদীবাহিত বিশেষ প্লাংকটনের উপস্থিতির কারণে বঙ্গোপাসাগরের জলের সবুজাভ রঙ। সূর্যের দিকে মুখ করে পার্কেসের মৃত্যু-গহ্বরে সাঁতরে যাওয়া এবং পিছনে কোমড়ে দড়িবাঁধা হতাশ, ক্রন্দনরত উর্কেস। পানির নিচে নাগুর মুখের ভিতরে জিহ্বার ভাঁজে জ্বলন্ত সিগারেট রেখে দেওয়া (এ কাজটা নিশ্চয়ই নাসির উদ্দিন খানকে যতœ করে শিখতে হয়েছে!)। শার্টের ভিতরে চঞ্চল চৌধুরীর সিগারেট ধরানো। শালিকের ঝলসানো মাংস খেতে খেতে পাকা ঝিঙাবিচির মতো দাঁত বের করে ভীত-সন্ত্রস্থ নগুকে চানমাঝির সহাস্য জিজ্ঞাসা: ‘ভয় পাস?’...দৃশ্যগুলো অবিস্মরণীয়। আমাদের সবার প্রিয় বাংলাদেশকে কী সুন্দরভাবেই না দেখানো হয়েছে এই ছবিতে, কিন্তু অন্য অনেক বাংলাদেশি ছবির মতো হাওয়াকে চমৎকার ভিউকার্ডের বিরক্তকর প্রদর্শনী করে তোলা হয়নি। প্রতিটি দৃশ্য ঠিক ততক্ষণই স্থায়ী হয়েছে যতক্ষণ না হলেই নয়।

গুলতির মেকাপ নিয়ে অনেক দর্শকই আপত্তি করছেন। এতটা মেকাপের প্রয়োজন আদৌ ছিল কি? আমি জানি না, এই ত্রুটির জন্য কে দায়ী, পরিচালক নাকি নায়িকা। ভুল নাকি সচেতন সিদ্ধান্ত? এই মানের একটি প্রডাকশন টিমের কাছ থেকে এমন ভুল আশা করা যায় না। পঁচিশ বছর আগের একটি ঘটনা মনে পড়ছে। ১৯৯৮ সালে ‘গন্তব্য চট্টগ্রাম’ ছবিতে প্রথম দিনের শ্যুটিং হবে চট্টগ্রাম স্টেশনে। সকাল বেলা নায়িকার কক্ষে ঢুকে দেখি ওনার মেকাপম্যানকে দিয়ে সোনার অঙ্গ তিনি কালো করে ফেলেছেন। ‘কী ব্যাপার?’ জিগ্যেস করলাম আমি। ‘গ্রামের মেয়েতো, গায়ের রংতো কালো করতেই হবে!’- নায়িকা সাফাই দিলেন। আমি দৌঁড়ে গিয়ে পরিচালক ও ডি.পি. কে খবর দিতেই তারা এসে নায়িকাকে বললেন: ‘কোনো কৃত্রিম মেকাপের প্রয়োজন নেই এ ছবিতে। আপনি স্বাভাবিক থাকুন, যা করার আমরা আলো দিয়ে করবো!’

খুলনা-বাগেরহাট অঞ্চলের সংলাপ শিখতে অভিনেতারা কর্মশালায় অংশ নিয়েছেন, স্ক্রিপ্টরাইটারদের একজন ওই এলাকারই বাসিন্দা, তিনিও প্রতিনিয়ত সংশোধন করেছেন, কিন্তু তবুও সংলাপে কিছুটা কৃত্রিমতা-আড়ষ্টতা, নাটকীয়তা কমবেশি রয়ে গেছে। প্রচুর গালাগালি এবং অশ্লীল সংলাপ আছে হাওয়ায়, কিন্তু সব গালাগালি ও অশ্লীলতা যুক্তিযুক্ত। গভীর সমুদ্রে অশিক্ষিত জেলেরা নিশ্চয়ই নিরামিশ ভদ্রভাষায় কথা বলবে না- এমনটাই বলেছেন বাংলাদেশের দর্শকেরা। গুলতির সংলাপে আড়ষ্টতা আছে, তার সংলাপ রচনাও দুর্বল। ‘বাইদার মেয়ে আমি, ভয়েরেও ডরাই না!’- এই সংলাপ দুই বার আছে ছবিতে। এর বাক্যের অর্থ আমার বোধগম্য হয়নি। বাকি সব কুশীলবের সংলাপ, কস্টিউম, মেকাপ, প্রপস যথাযথ। কন্টিনিউটির তেমন কোনো ভুল দুই বার দেখেও চোখে পড়েনি।

গলাজলে গুলতির সংলাপ ও অভিনয়ে অল্প ত্রুটি আছে বটে, কিন্তু নৌকার উপরে সে চমৎকার। জলের ধাক্কায় ইবা ও গুলতির শরীরের ওঠানামা যত বিশ্বস্ততার সঙ্গে চিত্রায়িত হয়েছে, সে তুলনায় নয়নতারাকে মনে হয়েছে অনেকটাই স্থির। ইবার লুঙ্গি এবং শার্ট পরে বাইদানির লাজুক, মুচকি হেসে তাকানো কে ভুলতে পারবে? ওই বিশেষ দৃশ্যটিতে কিন্তু গুলতির মেকাপ যথাযথ ছিল। বাইদানি তার দৃষ্টি দিয়েই বেশির ভাগ ভাব প্রকাশ করেছে এবং ভালোভাবেই করেছে।

নিজের অভিনয়-প্রতিভার সবটুকু অকাতরে ঢেলে দিয়ে চানমাঝির চরিত্রে চঞ্চল চৌধুরী বিশ্বমানের অভিনয় করেছেন। ইজা, ইবা, নাগু, মরা, ফণি, উর্কেস-পার্কেস, প্রত্যেকের অভিনয় সিনেমাটিক এবং এক কথায় চমৎকার। তবুও পরিচালক সুমন বলেছেন, তিনি এবং তার টিম ভালো করেই জানেন, হাওয়া ছবিতে কী কী করতে তারা সফল হয়েছেন আর কী কী করতে ব্যর্থ হয়েছেন। এই ব্যর্থতাগুলো তারা পরের ছবিতে কাটিয়ে উঠতে চান। নিজেকে অন্তর্লীন বা ইন্ট্রোভার্ট বলে দাবি করা সুমনের অতি পরিণত মনের কথাবার্তা শুনে আমি অবাক হয়ে ভাবি: ‘আমাদের দেশে এই ছেলে কবে হলো? কাজেতো হলোই বড়, কথায়ও মজালো।’

সত্যি বলতে কী, সুমনের এই টিমটি এমন ভালো একটি কাজ করেছে যে হাওয়ার পর থেকে বাংলাদেশে ছবি করাটা কঠিন হয়ে যাবে, বাকিদের জন্য তো বটেই, নিজেদের জন্যেও। দর্শক এরপর খারাপ ছবি দেখামাত্র হাওয়ার জেলেদের মতো বলে উঠবে: ‘ফাজলামি জোদাও, হেরা পারলে তোমরা পারো না ক্যান? কিংবা আগে পারলে অহন পারো না ক্যান?’ আমিতো মনে করি, হাওয়া দেখার পর শ্যাম বেনেগালও তার বঙ্গবন্ধুর বায়োপিক মুক্তি দেবার ব্যাপারে দ্বিধায় থাকবেন। সুমনের মতো পরিচালক থাকতে ভবিষ্যতে বাইরের কাউকে ডেকে আনারই বা কী দরকার? পশ্চিমবঙ্গের এবং বাংলাদেশের বিখ্যাত সব পরিচালক, এমনকি টেরান্টিনোর মতো সফল পরিচালকের প্রথম ছবির সঙ্গে হাওয়ার তুলনা যদি করি, তবে বাকিরা আমার বিচারে সুমনের চেয়ে বেশি নম্বর পাবেন না। হাওয়া ছবিটি আমার দৃষ্টিতে বাংলাদেশের মানুষের সক্ষমতার প্রমাণ। এমন ছবি যে জাতি বানাতে পারে, তারা কী না পারে?

নাম ‘হাওয়া’ কেন? প্রশ্ন করেছেন অনেকে। আরবি ভাষায় ‘হাওয়া’ শব্দটির কমপক্ষে তিনটি অর্থ আছে: ‘বাতাস’, ‘যোনি’ এবং ‘শ্রীমতি আদম’- বলেছিল মরক্কোর এক আরব বন্ধু। সে আরও বলেছিল, ‘বাতাস’ ও ‘যোনি’ অর্থে ‘হাওয়া’ শব্দের উচ্চারণ আরবিতে কাছাকাছি, কিন্তু এক নয়। চট্টগ্রামী বাংলাতেও ‘শব্দটি’ সামান্য ভিন্ন উচ্চারণে ‘যোনি’ অর্থে ব্যবহৃত হয় বটে। প্রাচীন হিব্রুতে শব্দটির একটি অর্থ ‘জীবন’। বাইবেলের স্বর্গের কাহিনী মূলত হাওয়া এবং সাপকে ঘিরে গড়ে উঠেছে, সুমনের সিনেমা হাওয়ার গল্পও অনেকটা তাই। বাইদানি এসে উপস্থিত হওয়াতেই নয়নতারার নিস্তরঙ্গ জীবনের হাওয়া পাল্টে যায়, হাওয়ার উপস্থিতিতে আদমেরা পাগল হয়ে উঠে এবং এক সময় একে একে সবাই পৃথিবীচ্যুত হয়। সুতরাং এর চেয়ে সার্থক নাম এ ছবির আর কীই বা হতে পারতো? এটা অবশ্য আমার ব্যাখ্যা। পরিচালক সুমনের কাছে অবশ্য ‘হাওয়া’ দুই বা ততোধিক মানুষের মধ্যে বয়ে যাওয়া একটা ঠাণ্ডা, শীতল অনুভুতির প্রতীক।

বাংলাদেশের দর্শক আজ দুই ভাগে বিভক্ত: ১. হাওয়া যারা দেখেছে এবং ২. যারা দেখেনি। হাওয়া ছবির আরেকটা সাফল্য হচ্ছে, এ ছবি হলে বসে দেখা অনেকটাই বাধ্যতামূলক। টিভি বা কম্পিউটারের ছোটো পর্দায় এর দৃশ্য ও শ্রাব্য সৌন্দর্যের অনেকখানিই নষ্ট হবে। হাওয়া ছবিকে উপলক্ষ করে বাংলাদেশের দর্শক আবার হলমুখী হয়েছেন- এটাও একটা ভালো খবর। যত বেশি সুস্থ বিনোদন থাকবে সমাজে, মানুষের মধ্যে তত কম মৌলবাদ ও জঙ্গী মনোভাব সৃষ্টি হবে, এমনটা আশা করাই যায়।

সুমন এবং তার টিম ছবির প্রযোজক নিজেরাই জোগাড় করেছেন, সরকারের কাছে গলায় গামছা দিয়ে ধরনা দিতে হয়নি টাকার জন্যে। এ কারণে হয়তো স্বাধীনভাবে কাজও করতে পেরেছেন তারা। এটাও একটা সাফল্য বটে। হাওয়া ছবি নির্মাণে অনুদান না দিলেও সরকার এর প্রচারে ভূমিকা রেখেছে নিজের অনিচ্ছায় এবং অজান্তে। পরিবেশ বিভাগ এ ছবির বিরুদ্ধে মামলা করে ছবিটির প্রতি দর্শকের আগ্রহ নিঃসন্দেহে কয়েক গুণ বাড়িয়ে দিয়েছেন।

হাজার বছর আগের কোনো এক নাম না বলা দেবীর কথা আছে বটে হাওয়ায়, কিন্তু প্রচলিত কোনো ধর্মের নামগন্ধও নেই। গুলতি ‘হায় আল্লাহ’ও বলে, আবার দেবী দ্বারাও চালিত হয়। উপমহাদেশের ধর্মান্ধ পরিবেশে ধর্মসমন্বয়ের এমন উদাহরণ ভাবা যায়? মনসা পুরানের চাঁদ সওদারের সঙ্গে এক নামের মিল ছাড়া আমরা জানি না, চানমাঝি হিন্দু নাকি মুসলমান। ‘ফণি’ নামটা হিন্দু বলে মনে হয়, মৃতবৎসা নারীর সদ্যোজাত সন্তানের ‘মরা’ নামও রাখা হয়। কিন্তু বাকি সব নাম: নাগু, ইবা, ইজা, উর্কেস-পার্কেস (গার্সিয়া মার্কেস?) ইত্যাদি নাম বাংলা ভাষার বলেওতো মনে হয় না। নিমার্তা কি ছবিটিকে স্থান ও কালের উর্দ্ধে রাখতে চেয়েছেন?

দেখে যে কেউ বলবে, ‘হাওয়া’ বলিউড বা টালিউডের ছবি নয়, আমাদের পরিচিত ঢালিউডের ছবিও নয়। তবে ‘হাওয়া’ যে শত ভাগ বাংলাদেশের ছবি, তা নিয়ে কারও সন্দেহ থাকে না। এমনও হতে পারে, হাওয়ার মাধ্যমে নতুন একটি ঢালিউডি ঘরানার সূচনা হতে যাচ্ছে, যা এমন সব ছবি নির্মাণ করতে বাধ্য করবে পরিচালকদের, যা একই সঙ্গে বাংলাদেশিও হবে, আবার ছবিও হবে। শিল্পের অনুরোধও রাখবে এসব ছবি, আবার বাণিজ্যের অনুরোধও এড়িয়ে যাবে না।

সত্তরের দশকের শেষে নির্মিত সারেং বৌ ছবির শেষ দৃশ্যে পর্দায় লেখা ছিল: ‘সামনে নতুন সময়।’ অবশেষে এলো বুঝি সেই নতুন সময়, পরিচালক সুমনের ভাষায়, বইতে শুরু করেছে নতুন সিনেমার সুবাস। হয়তো ‘হাওয়া’ দিয়েই দিয়েই শুরু হলো বাংলাদেশি সিনেমার ‘নবতরঙ্গ’ বা ‘নিউ ওয়েব’। নতুন ‘তরঙ্গ’ (সর্বার্থে) সৃষ্টি করা হাওয়ার অন্যতম কাজ বটে। হাওয়া যদি অস্কার, কান বা ভেনিস কোনো একটি গুরুত্বপূর্ণ পুরস্কার না পায়, আমি সত্যি হতাশ হবো।

‘হাজারো বরস যে নার্গিস আপনি বে-নূরী পর রোতি হ্যায়। বহুত মুশকিল সে হোতা হ্যায় চ্যমন মে দিদাবর পয়দা।’ এই হিন্দি-উর্দু শায়েরির অর্থ: ‘হাজার বছর ধরে নার্গিস ফুল নিজের অন্ধত্বের জন্যে অশ্রুপাত করতে থাকে। কিন্তু বাগানে সমজদারের জন্ম হওয়া খুব কঠিন।’ বাগান বানানো সোজা, কিন্তু বাগানের ফুলের সমজদার থাকা চাইই চাই, নয়তো ফুলের জীবনই বৃথা, বিশেষত যখন বাগানের নার্গিস ফুল নিজের সৌন্দর্য নিজে দেখতে পায় না বলে দুঃখ করছে। সমস্যা হচ্ছে, সমজদারের জন্ম হওয়া এত কঠিন যে এতে হাজার বছর লেগে যেতে পারে।

ছবি দেখা আর উপভোগ করার অনুভূতি এক নয়। শিক্ষিত-অর্ধশিক্ষিত-অশিক্ষিত নির্বিশেষে আমরা বাংলাদেশের সিংহভাগ মানুষ শিল্প উপভোগ করতে জানি না, আমাদের কখনও সেভাবে শেখানোই হয়নি। চাণক্যের অর্থশাস্ত্রের আমল থেকে রাষ্ট্র ও সমাজের একটা অংশ নিজেদের হীন স্বার্থে চেয়েছে, জনগণ ‘শিল্প-শ্রমিক’ হোক, কিন্তু ‘শিল্পপ্রেমিক’ যেন না হয়। আমি আশা করবো, সত্যিকারের চলচ্চিত্র সমজদারেরা ‘হাওয়া’ ছবিটিকে বিশ্লেষণ করে এর শক্তি, সৌন্দর্য ও দুর্বলতার দিকগুলো তুলে ধরবেন। পেশাদারী, নির্মোহ দৃষ্টিভঙ্গি থেকে কোনো শিল্পকর্মের সমালোচনা-পর্যালোচনা পুরষ্কার প্রাপ্তির চেয়ে কম গুরুত্বপূর্ণ নয়, কারণ এগুলো ভালো দর্শক-সমজদারের বীজতলা প্রস্তুত করে। ভালো ছবি তৈরির প্রয়োজন যেমন রয়েছে, ভালো দর্শক তৈরিও অপরিহার্য বটে।

বঙ্কিমচন্দ্র হলে জিগ্যেস করতেন: ‘দর্শক! ‘হাওয়া’ বায়োস্কোপ হইতে তুমি কি কিছু শিখিয়াছ?’ প্রতিটি জীবন গভীর সমুদ্রে ভাসতে থাকা একেকটি নয়নতারা জাহাজ। যে কোনো মুহূর্তে এর তেল ফুরিয়ে যেতে পারে ড্রাম ফুটো হয়ে। যে বাতাস পালে লেগে নৌকা চলে, সেই বাতাসেই হুড়মুড় করে ভেঙে পড়ে যেতে পারে পাল। মহামূল্যবান জাল হারিয়ে গিয়ে মাছ ধরার জীবিকাও বন্ধ হয়ে যেতে পারে। দিশেহারার মতো সময়ের অসীম সমুদ্রে ভাসতে থাকবে তুমি, কোনো কুলকিনারা পাবে না।

মূর্খ মানব! নিজেকে চানমাঝির মতো মহাশক্তিধর মনে করে ‘চান্স’ নিও না! তুমি চাইলেই বাইদানি তোমার হবে না। বাইদানির যাবতীয় ক্ষমতাও কি তার প্রেমিককে বাঁচাতে পারে? আপাতত মৃত্যুর চেয়ে বড় সত্য নেই এই জীবনে। সুতরাং একদম বাড়াবাড়ি করো না, ভাগ্য খারাপ হলে গভীর সমুদ্রেও নৌকায় উঠে আসতে পারে বিষধর সাপ, তোমার মৃত্যুর কারণ হয়ে। স্বর্গ কিংবা জন্ম থেকেই আলাদা আলাদা সাপ আমাদের প্রত্যেকের পিছু নিয়েছে, মৃত্যুর পর বাইদানির মতো গলা জড়িয়ে ধরে চুমু খাবে বলে!

নৌকায় তোমার চারপাশে যেসব মাঝিমাল্লাদের বন্ধু-মানুষ ভেবে নিশ্চিন্তে বসে আছো তুমি, হতে পারে প্রত্যেকে তারা একেকটি ছদ্মবেশী সাপ। তোমার অবস্থা বদল হওয়া মাত্র এদেরও রূপবদল হবে। যার বাপকে সাপে কেটেছে, সে দড়ি দেখলেও ডরায়। বাইদানি দুই দুইবার কইছিল: ‘ভয়রেও ডরাই না!’ ভয়কে ডরানো খারাপ অভ্যাস না। আপাতত, হাসি না, একদম হাসি না, গুরুত্বপূর্ণ কথা বলছি, মন দিয়ে শোনো, শেখো হাসি না, আবারও বলছি! নৌকায় মাইয়া মানুষ কোনো সমস্যা নয়! সব ফালুতু কথা। ওদের মন্দ, কামভ্রষ্ট, মৌলবাদী মানসিকতা আর আচরণই মূল সমস্যা। ভুলেও আশকারা দিও না ওদের, মাথায় চড়ে বসবে, ইতিমধ্যে বসেছে।

জীবন খুবই অকিঞ্চিৎকর একটা ঘটনা, এর কোনোই অর্থ নেই, একে বড় করে দেখারও কিছু নেই! শিশিরভেজা ভোরে (রবীঠাকুরের ভাষায়) ‘প্রাচীরের কোলে এক নামগোত্রহীন’ কুঁড়ি (নজরুলের ভাষায়) ‘ফুল হয়ে ফুটে’ গোধুলীবেলায় ঝরে যাবার মতোই তুচ্ছ ঘটনা প্রতিটি জীবন। পরিচালক সুমনের ভাষায়: ‘এক ঝলকা হাওয়া!’ চোখে-মুখে ঝিকমিক খুশি নিয়ে গর্বভরে সূর্যের পানে এক দুই বার তাকায় একেকটি ফুল, ব্যস জীবন ওটুকুই। জীবনকে অনন্ত-অসীম যারা মনে করে, তারা মূর্খের স্বর্গে বাস করছে, জ্ঞাত কিংবা অজ্ঞাতসারে!

নিজে বাঁচো, অপরকে বাঁচতে দাও! নেচে-গেয়ে, সাপলুডু খেলে, গায়ে সাবান মেখে স্নান করে, বান্ধবীর মুখে ফেনা লাগিয়ে যদি কেউ আনন্দ পেতে চায়, এক ধমকে তাকে থামিয়ে দিও না, প্রত্যেককে তার নিজের মতো করে বাঁচতে দাও। কার গুটি মইয়ের গোড়ায় গিয়ে বসবে, কার গুটি গিয়ে পড়বে সাপের জিহ্বায়, সেটা ভাগ্যের কিংবা দেবীমায়ের ইচ্ছা। ইচ্ছে হলে আমার সঙ্গে এসে আনন্দে যোগ দাও, ইচ্ছে না হলে অবিলম্বে দূর হও, তোমার কল্পিত স্বর্গে অপ্সরা-গেলেমানেরা তোমার অপেক্ষায়। তুমি দ্রুত চলে ‘গেলে’ আমাদের ‘মান’-টা অন্তত বাঁচে!