জেব্রা ক্রসিংরা কোথায় গেল

হাঁটাকে নির্বিঘ্ন করতে হলে উঁচু উঁচু পুল নয়, বানাতে হবে জেব্রা ক্রসিং এবং সেখানে পথচারী ব্যবস্থাপনার জন্য কমিউনিটি পুলিশ নিয়োগ দিতে হবে। আশা রাখি, অচিরেই এর পক্ষে জোরালো সামাজিক আন্দোলন গড়ে উঠবে ঢাকাসহ দেশের সব নগর, মহানগরে।

প্রিসিলা রাজপ্রিসিলা রাজ
Published : 21 May 2023, 12:32 PM
Updated : 21 May 2023, 12:32 PM

অফিস আসার পথে তেজতরি বাজার সংলগ্ন পদচারী সেতুটি প্রায়দিনই পার হতে হয়। প্রাইভেট কার কণ্টকিত ঢাকা শহরে নিম্ন ও নিম্নমধ্যআয়ের মানুষের জন্য গুটিকয়েক বাসে মহিলাদের অফিসটাইমে জায়গা হয় না। নিত্য সেখানে নারী ও পুরুষ যাত্রীদের মধ্যে কটুকথা আর ঝগড়াঝাঁটির চাপান-উতোর চলে। সকালে একটু ঠাণ্ডা মাথায় অফিস যেতে তাই হাঁটা, রিকশা টেম্পোর পাঁচভাঙা দিয়ে গুলশান যাই।

সেতু পার হওয়ার সময় প্রায় প্রতিদিনই দেখি কারওয়ানবাজারের কুলিরা কী অসম্ভব কষ্টে তরকারির ঝাঁকা নিয়ে সিঁড়ি ভেঙে ফার্মগেটের পশ্চিমদিকটায় আসছেন। তাঁদের মধ্যে অনেকে আছেন পঞ্চাশোর্ধ্ব। একবার এমন একজন বয়স্ক কুলি মনে হলো পড়েই যাবেন। বিশাল ঝাঁকাসহ উল্টে পড়লে কী করব সেটাই ভাবতে গিয়ে থেমে গিয়েছিলাম। উনি বুঝতে পেরে চোখ ইশারা করলেন চলে যেতে। তারপর দুঃসহ কষ্টে নিঃশ্বাস ফেলতে ফেলতে কোনোরকমে টাল সামলে ওপরের সিঁড়িতে একটা পা রাখলেন।

ঢাকা শহরের রাস্তাগুলো উঁচু দেওয়ালের সড়ক বিভাজকে ভরে যাচ্ছে। ছোট-বড় জেব্রাক্রসিং বন্ধ করে দেওয়ার হিড়িক পড়েছে আরো আগেই। তার বদলে উঠছে পদচারী সেতু। মহাখালি, মিরপুর রোড, সাতমসজিদ রোড যেখানে যাই একই অবস্থা। সাধারণ সক্ষম মানুষের বাইরে বাকিরা চলবে কী করে কর্তাদের তা মাথাতেই নেই। তাঁদের তো আর পায়ে হেঁটে রাস্তা পেরোতে হয় না।

পৃথিবীর সব দেশে জেব্রাক্রসিংই পথচারীদের রাস্তা পারাপারের মূল উপায়। ভারতের মতো ঘনবসতির দেশেও তার ব্যত্যয় নেই। কেবল রেল জংশনগুলোতে পদচারী সেতুর ব্যবস্থা। সাধারণ সক্ষম মানুষ ছাড়াও দুনিয়াতে শারীরিক প্রতিবন্ধী, অসুস্থ মানুষ, গর্ভবতী মা, বয়স্ক মানুষ, কোলের শিশুসহ অভিভাবক এবং নানা কারণে যাঁদের সিঁড়ি ভাঙতে সমস্যা হয়– তাঁরাও রয়েছেন। সকলেই যাতে রাস্তায় অবাধে চলাফেরা করতে পারে এসব ভেবেই সব দেশে জেব্রাক্রসিংয়ের ব্যবস্থা।

দু’টো-তিনটে পরিস্থিতির কথা বলি। ধানমন্ডির গণস্বাস্থ্য নগর হাসপাতাল থেকে ল্যাব এইড পর্যন্ত রাস্তায় একটা বড় ও দুটা ছোট্ট (প্রায় দুই-ফুটি) মোট তিনটা পথচারী পারাপারের জায়গা ছিল। রাস্তায় বিরাট উঁচু লোহার রেলিং (খরচটা ভাবুন!) দিয়ে সড়কদ্বীপ আলাদা করার সময় ছোট দু’টো পারাপারের ফাঁকও বন্ধ করে দেওয়া হয়। তোলা হয় ল্যাব এইডের সামনে পদচারী সেতু। এখন ছয় নম্বর মোড়ের জেব্রাক্রসিং আর ওই পদচারী সেতু ছাড়া আর কোনো জায়গা নেই রাস্তা পারাপারের। গণস্বাস্থ্য থেকে বেশ খানিকটা তফাতে একই লাইনে বেশ কয়েকটি হাসপাতাল আছে। এখান থেকে কোনো অশক্ত রোগী বের হয়ে যদি ওপারে যেতে চান তাঁকে হয় সেতুতে চড়তে হবে, নয়তো উত্তরদিকের ব্যস্ত রাস্তা পেরিয়ে ছয় নম্বরের মোড়ে জেব্রাক্রসিংয়ে আসতে হবে। এই ক্রসিংয়ে একটা রাস্তা নির্বিঘ্নে পার হওয়া গেলেও টাঙ্গাইল সুইটসের সামনের রাস্তা পার হওয়া সহজ নয়, কারণ পার হওয়ার সময় বিপরীত দুই দিক থেকে গাড়ি ঢুকতে থাকে। তাহলে অশক্ত রোগীরা কী করবেন? এর একটাই উত্তর, গাড়িওয়ালা না হলে সিএনজি ভাড়া করতে হবে হাসপাতালের সামনে থেকে।

পরিচিত এক বয়স্ক ভদ্রমহিলা সাতমসজিদ রোডের শংকরের দিক থেকে শুক্রাবাদ-রাজাবাজারে মেয়ের বাসায় আসেন প্রায় প্রতিদিন। হাঁটাও হয়, সাংসারিক প্রয়োজনও মেটে। ইদানীং জিগাতলা থেকে ২৭ নম্বর পর্যন্ত সড়কদ্বীপে উঁচু রেলিং বসছে, পথচারী পারাপারের জায়গা বন্ধ হয়ে যাচ্ছে। উঠেছে একাধিক রাস্তা পারাপার সেতু। ভদ্রমহিলা এখন আবাহনী মাঠের ওদিকে একটা ফাঁক গলে রাস্তা পার হন। অচিরেই এটাও বন্ধ হলে কী করবেন তা-ই ভাবছেন। তাঁর হৃদরোগ থাকায় সিঁড়ি ভাঙায় নিষেধাজ্ঞা আছে। প্রতিদিন দু’শ টাকা রিকশাভাড়া গোনার সঙ্গতিও নেই।

বিপরীত চিত্রও আছে। সম্প্রতি আগারগাঁওয়ের রাস্তা অনেকটা চওড়া করা হয়েছে। পাসপোর্ট অফিস থেকে বেরিয়ে আগারগাঁও মোড়ের দিকে গেলে সড়ক বিভাজকে রাস্তা পারাপারের বিরাট ফাঁক রাখা হয়েছে। পাসপোর্ট প্রত্যাশীরা ফটোকপিসহ নানা কাজে রাস্তার ওপারের দোকানগুলোতে যেতে পারেন অনায়াসে। সারা ঢাকার জেব্রাক্রসিং বন্ধ করে ওখানে রাখা হলো কেন? ব্যবসা কথা বলে তাই?

পশ্চিমবঙ্গে দেখেছি, ব্যস্ত রাস্তার জেব্রাক্রসিংয়ে পুলিশ এপাশ-ওপাশ টাঙানো দড়ি ধরে রেখে পথচারীদের আটকে রাখেন। সংকেত পড়লে দড়ি নামিয়ে নেন। পথচারীরা পার হয়ে যান। ঢাকায় এখনও যে গুটিকয়েক জেব্রাক্রসিং আছে তার অধিকাংশই রাস্তার মোড়ে। অর্থাৎ গাড়িও মোড় ঘুরবে, পথচারীও পার হবে। অত্যন্ত বিপজ্জনক এই ব্যবস্থা রাস্তা পারাপারের সর্বজনীন নির্দেশনার ঠিক উল্টো। ছোটবেলা থেকে আমরা শিখে এসেছি রাস্তা পার হতে হবে মোড় থেকে দূরে। অর্থাৎ জেব্রাক্রসিংও হতে হবে মোড় থেকে দূরে।

মোড়ে জেব্রাক্রসিং হওয়ার ফলে কী হয়, আমরা ভুক্তভোগীরা সবাই জানি। ট্রাফিক পুলিশ গাড়ি ছাড়া আর বন্ধ করার ওপর নজর দিতে ব্যস্ত থাকেন। পথচারীদের জন্য নিরাপদে রাস্তা পার করার দিকে তাঁদের নজর থাকে না। ফলে গাড়ি চলাচলের মধ্যেই তাঁরা দৌড় দেন। যাঁরা নিয়ম মেনে রাস্তা পার হতে চান দেখা যায় অপেক্ষা করতে করতেই সময় ফুরিয়ে যায়। তাঁরাও তখন গাড়ির মাঝখান দিয়ে দৌড় দেন। নিয়ম না মেনে রাস্তা পার হওয়া একসময় পথচারীদের অভ্যাসে পরিণত হয়।

জেব্রাক্রসিং ব্যবস্থাপনা করা খুব কঠিন নয়। পথচারী ব্যবস্থাপনা এর প্রধান দিক। কমিউনিটি পুলিশ নিয়োগ করে সে কাজটি করা যেতে পারে। এক্ষেত্রে প্রয়োজনে সরকারি-বেসরকারি অংশীদারির মডেল অনুসরণ করা যেতেই পারে। কমিউনিটি পুলিশের বেতন ছাড়া এতে যেহেতু বাড়তি বড় ধরনের খরচ নেই, তাই বড় বাজেটও লাগে না। স্থানীয় স্বেচ্ছাসেবকদেরও একাজে লাগানো যেতে পারে। তাঁদের প্রশিক্ষণ দিতে পারে সরকারের সংশ্লিষ্ট সংস্থা আর বেতনের দায়িত্ব নিতে পারে এলাকারই প্রতিষ্ঠান, ব্যবসায়ী ও বাসিন্দারা।

পদচারী সেতু তোলা বড়ই লাভজনক। ঠিকাদারদের বাড়বাড়ন্ত, বামহাতের কারবারিদেরও পোয়াবারো। ফলে জেব্রাক্রসিং রাখার পক্ষে যত ভাল ভাল যুক্তিই দেওয়া হোক না কেন, কর্তাব্যক্তিদের কানে তা যাবে না। একমাত্র বড় ধরনের সামাজিক আন্দোলনই এর গুরুত্বকে পুনঃপ্রতিষ্ঠা করতে পারে।

জাতিসংঘ নিরাপদ সড়ক সপ্তাহের আজ শেষ দিন (১৫-২১শে মে)। হাঁটা ও সাইকেল চালানোর মতো স্বাস্থ্যকর অভ্যাসকে গুরুত্ব দেওয়ার কথা অনেকদিন ধরেই বলে আসছে বৈশ্বিক এই সংস্থাটি। কিন্তু হাঁটাকে নির্বিঘ্ন করতে হলে উঁচু উঁচু পুল নয়, বানাতে হবে জেব্রা ক্রসিং এবং সেখানে পথচারী ব্যবস্থাপনার জন্য কমিউনিটি পুলিশ নিয়োগ দিতে হবে। আশা রাখি, অচিরেই এর পক্ষে জোরালো সামাজিক আন্দোলন গড়ে উঠবে ঢাকাসহ দেশের সব নগর, মহানগরে।