Published : 29 May 2011, 09:52 PM
জানালার শার্সির ভেতর দিয়ে আসা সকালের সোনালি রোদে একটি প্রসন্ন দিনের প্রত্যাশায় ঘুম থেকে উঠে বাইরে তাকিয়ে দেখি সামারের রোদহীন ভোরের সূর্য ইতিমধ্যে তেতে উঠেছে। আমরা যারা কর্মহীন হয়ে বসে সময় কাটাই, তারা ছাড়া আর সবাই ইতিমধ্যে কাজে বের হয়ে গেছেন। রাস্তায় প্রতিদিনের মতো ব্যস্ত ট্রাফিক। দিনটি বুধবার, তারিখ ২৫ মে ২০১১।
সকালের সূচনায় বাকি দিনটা কেমন যাবে বোঝা যায়, এই আপ্তবাক্য যে সব সময় অব্যর্থ হয় না, এবং জগৎ সংসারে কোনো সত্যই যে শেষ সত্য নয়, বোধকরি তা প্রমাণ করার জন্যই সকালের কিছু পরেই, ঘন্টা দুয়েকের মধ্যে আবহাওয়ার পূর্বাভাসে দ্রুত পরিবর্তন আসতে শুরু করলো। ভয়ংকর এক টর্নেডো ওকলাহোমা সিটির দিকে ধেয়ে আসছে, ওয়েদার ওয়াচের সতর্কবাণী শুনে মনে মনে হাসি। ছিমছাম দিন, আকাশ পরিষ্কার। তারপরও বারবার পূর্বাভাস ভয়ংকর ঘূর্ণিঝড়ের।
এ বছর বৈরী আবহাওয়ায় মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ভালোই বিপদে পড়েছে। দিনকয়েক আগেই ২২ মে, রোববার টর্নেডোর ছোবলে ছিন্নভিন্ন হয়েছে মিসৌরি রাজ্যের জপ্ নিন শহর।
মৃতের সংখ্যা ১২৬। এই সংখ্যা আরো বেড়ে যেতে পারে, এমন আশংকা কর্তৃপক্ষের।
নিখোঁজ মানুষের সংখ্যা দুই শ' ছাড়িয়ে!
এর মধ্যেই আবার নতুন করে ঝড়ের পূর্বাভাস।
বছর খানেক হলো দেশ থেকে এসেছি। এখানকার জীবন যাত্রায় ধাতস্থ হতে পারিনি দীর্ঘদিনের অভ্যাসের কারণে যতোটা মানসিক অনতিক্রম্য বাঁধার জন্য তার চেয়ে বেশি। বিদেশে বানপ্রস্থে যাওয়ার বয়স তো এটা নয়!
তাই সব কিছু দেশের নিরিখে বিচার করতেই স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করি।
দেশের সঙ্গে মিল খুঁজে পাই না অনেক কিছুতেই। পাওয়ার কথাও নয়। তার পরেও বলে না, অভ্যাস বদলায় না সহজে।
এদেশের মানুষ বৈরী আবহাওয়ার সময় মিডিয়া নির্ভর হয়ে পড়েন। দেশেও আমরা, যাদের আছে মিডিয়ার সঙ্গে সহজ সংযোগ। যাদের দরকার মিডিয়ার সঙ্গে সহজ সংলাপ, সেই উপদ্রুত এলাকায়। সাগর বক্ষে মিডিয়ার আওয়াজ থাকে অনুপস্থিত। বেতারবার্তা হয় পৌঁছে না, না হয় রেডিয়োর অভাবে শোনা হয় না। প্রতিটি দুর্যোগের পর এমনটাই শোনা হয়।
ঘূর্ণিঝড় আসন্ন। মিডিয়া ঘুমিয়ে আছে, অকল্পনীয় এমন চিন্তা আজ বিশ্বে।
ওকালাহোমার স্থানীয় টিভি চ্যানেলগুলি মুহূর্তের মধ্যে নির্ধারিত অনুষ্ঠান বাদ দিয়ে আপৎকালীন অনুষ্ঠান প্রচার শুরু করে দিলো। এই ব্যাপারে এগিয়ে আছে চ্যানেল ফোর-কেএফওআর। অন্য দুই চ্যানেল ফাইন এবং নাইনও কম যায় না। তবে ফোরের ওয়েদারম্যানদেন কুশলি উপস্থাপনার কারণে এদের অনুষ্ঠানই আমাকে টানে বেশি। ওয়েদারম্যানরা অনেক বেশি মানবিক তাদের উপস্থাপনায়। একজন ডেভিড পেইন, এক পর্যায়ে আবেগী স্বরে বললেন, ন্যাশনাল ওয়েদার সার্ভিস খুব বেশি মহাদুর্যোগের কথা বলে না। আজ তারা বলছে। দয়া করে এই বার্তার গুরুত্ব উপলব্ধি করে দুর্যোগ মোকাবেলায় তৈরি হোন, ব্যাটারি চালিত রেডিয়ো, টেলিভিশন, সার্চ লাইট হাতের কাছে তৈরি রাখুন। বাড়ির সবচেয়ে নিরাপদ, সব চেয়ে নিচের কোনো ঘরে অবস্থান গ্রহণ করুন। আশ্রয়স্থল যেন বাড়ির মাঝের কোনো কামরা হয়, সেদিকে নজর রাখবেন। ঘূর্ণিঝড়ের সময় মাথার ওপর বালিশ, তোষক, কম্বল দিয়ে রাখবেন। যেন শিশুকে বোঝানো হচ্ছে তার করণীয়। রিক নামের আরেক উপস্থাপকও এসে যোগ দেন ডেভিডের সঙ্গে। মাঝে মধ্যে স্টুডিয়ো থেকে সংযোগ স্থাপন করা হয় ঘূর্ণিঝড়ের আঘাত হানছে এমন জনপদে অবস্থানরত রিপোর্টারদের সঙ্গে। তারা স্পট থেকে সরাসরি ঘূর্ণিঝড়ের ভিসুয়ালসহ ঝড়ের খবর পরিবেশন করেন পেশাদারীত্বের চরম উৎকর্ষ দেখিয়ে।
ইতিমধ্যে বেশ কিছু সময় কাটলো উৎকণ্ঠার মধ্য দিয়ে, দুপুরের রোদে চারদিক উদ্ভাসিত। টেলিভিশনে তারপরও ক্রমাগত বলা হচ্ছে আসন্ন ঘূর্ণিঝড়ের কথা। আমরা এখন আছি দোলাচলে। আবহাওয়া দেখে মনে হয় ঘূর্ণিঝড়ের পূর্বাভাস ভুল হতে যাচ্ছে। আবার এই ক' মাসের অভিজ্ঞতায় বলে এখানকার পূর্বাভাস প্রায় নির্ভুল। ইতিমধ্যে দেখেছি বরফপাতের পূর্বাভাস অবিশ্বাস্যভাবে নির্ভুল হতে!
শরৎচন্দ্রের বিখ্যাত উপন্যাস 'শ্রীকান্তে' সমুদ্র বক্ষে ঝড়ের বর্ণনা আছে! জাহাজের এক খালাসির উক্তি: 'কাপ্তান কইছে সাইক্লোন হতি পারে ….', নতুন করে মনে পড়লো।
এখানে অবস্থা এরকম। আবহাওয়া বিভাগ বলছে ঘূর্ণিঝড় হতে পারে।
ধীরে ধীরে উপস্থাপক, এ্যাকরম্যানের গলার স্বরে উৎকণ্ঠার বাড়তি দেখা যেতে লাগলো।
ঘূর্ণিঝড়ের সময়সীমা নির্ধারিত হয়েছে বিকেলে।
দুপুর তিনটা নাগাদ আকাশে কালো মেঘের আনাগোনা শুরু হলো। কিছুক্ষণের মধ্যে রোদের তেজ কমে গিয়ে বাইরে এক ধরনের ছায়াঘন পরিবেশ সৃষ্টি হলো। গাছের ডালে ডালে পাখিদের অস্থির ডানা ঝাপটানো বলে দেয় ঝড় আসন্ন। টেলিভিশনে বলা হলো আমাদের শহর এডমন্ডে ঘূর্ণিঝড় আঘাত হানবে বিকেল পৌনে চারটা থেকে সাড়ে চারটার মধ্যে। বলা হলো, সব স্কুলে আশ্রয় কেন্দ্র খোলা হয়েছে। যাদের নিরাপদ আশ্রয়স্থল নেই, তারা এই সব কেন্দ্রে এখনই যেন আশ্রয় নেন।
ঠিক পৌনে চারটায় সুতীব্র আওয়াজে সাইরেন বেজে উঠে চারদিকে ভীতিকর পরিবেশ সৃষ্টি করলো। ঘরে ঘরে লোকজনের উৎকণ্ঠিত অপেক্ষার চোখ জানালা দিয়ে বাইরে পাতা।
উৎকণ্ঠার প্রহর যতো দীর্ঘই মনে হোক না, এক সময়ে তা শেষ হয়। আমাদেরও উৎকণ্ঠার অবসান ঘটলো বিকেল পাঁচটার দিকে। টেলিভিশনের অনুষ্ঠানে ঘোষিত হলো বিপদ কেটে যাওয়ার স্বস্তিকর সংবাদটি। অবশ্য এডমন্ডবাসীর জন্য তা স্বস্তিকর হলেও ওকলাহোমা সিটি ও আশেপাশের বাসিন্দাদের জন্য তা ছিলো না স্বস্তির। ঘূর্ণিঝড় আঘাত হেনেছে এসব জায়গায়। আটজনের মৃত্যুর খবর এসেছে এসব স্থান থেকে। ঘূর্ণিঝড় আরো ছোবল মেরেছে পার্শ্ববর্তী রাজ্য কানসাস ও আরকানস-তে।
মানুষ প্রকৃতির কাছে কতোটা অসহায় তা প্রমাণিত হলো আরও একবার। এবার প্রমাণ পেলাম ক্ষমতাদর্পী খোদ মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে। এতো উন্নতি, কারিগরি উৎকর্ষ, চাঁদ আর মঙ্গল বিজয় সত্বেও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের এই অসহায়ত্ব কিন্তু অপ্রস্তুত অসহায়ত্ব নয়। প্রকৃতির বৈরি আচরণের মুখে তাদের প্রস্তুতি প্রশংসনীয়। রাষ্ট্র ও সাধারণ মানুষ পুরো প্রস্তুতি নিয়ে দুর্যোগের মোকাবেলা করে। প্রস্তুতির শুরু আবহাওয়ার পূর্বাভাস জেনে। শেষ হয় উদ্ধার কাজ পরিচালনা আর পুনর্বাসন প্রক্রিয়া সম্পাদনের মধ্য দিয়ে। কোথাও কোনো অপ্রস্তুতির অভিযোগ এখন নেই। ২০০৫ সালে লুইজিয়ানার নিউ অর্লিন্সে হারিকেন ক্যাটারিনা আঘাত হানার পর উদ্ধার তৎপরতায় শিথিলতা থেকে শিক্ষা নিয়েছে যুক্তরাষ্ট্র। আগে যেখানে পুনর্বাসন কাজ শেষ করতে সময় লাগতো মাস এখন লাগে সপ্তাহ!
তুলনা অমূলক। জানি আমাদের দেশের সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্রের কোনো দিক দিয়েই তুলনা হয় না। তারপরও বলি, দুর্যোগপ্রবণ দেশটিতে প্রতিটি দুর্যোগের পরে একই ধরনের অভিযোগের পুনরাবৃত্তি কেন শুনি বারবার? আবহাওয়ার পূর্বাভাস কেনো হয় না সঠিক? কেন আবহাওয়া পণ্ডিতদেরকে চোখ বন্ধ করে গণক ঠাকুরের মতো এখনো আবহাওয়ার সতর্কবাণী দিতে হয়?
কেন উদ্ধারকাজ পরিচালনাকারীদেরকে অভিযোগ করতে হয় সাজ সরঞ্জামের অভাবের? কেন দুর্যোগকবলিত এলাকাবাসীরা বলেন, আবহাওয়া বার্তা তারা ঠিক মতো শুনতে পাননি?
আমাদের মনমানসিকতা দুর্যোগ মোকাবেলা করার মতো প্রস্তুত হয়নি এখনো। আমরা নিয়তি-নির্ভর। প্রকৃতির কাছে পড়ে পড়ে মার খেয়ে আমরা আধমরা।
আইলার ছোবলে দক্ষিণাঞ্চলের বিস্তীর্ণ জনপদ তছনছ হয়ে গেছে দু'বছর আগে। এখনো শোনা যায় দুর্গত অঞ্চলের মানুষের হাহাকার। মিঠা পানির অভাব, বাসস্থানের অভাব। বাঁধের সমস্যার প্রকটতার একই রকম অবস্থার কথা।
অনেক অজুহাত আছে সব কিছুর জবাবে।
কিন্তু আমাদের মানসিক স্থবিরতা আর দায়িত্ব পালনে অপেক্ষাদারীত্বের ব্যাধিকে সাড়াবে কোন দাওয়াই?
কতোদিন আমাদেরকে অপেক্ষা করতে হবে প্রকৃতির রুদ্ররোষের বিরুদ্ধে বুক চওড়া করে দাঁড়াতে?
জর্জ বার্নার্ড শ'র সেইন্ট জোনসের মতো আর্তনাদ করে বলতে ইচ্ছা হয়: হাউ লং, ও লর্ড, হাউ লং? আর কতো কাল, আর কতোকাল, হে প্রভু!
এডমন্ড, ওকলাহোম, যুক্তরাষ্ট্র থেকে।