ক্যান্সার চিকিৎসা একটি ম্যারাথন। নিরাময়ের এই দীর্ঘ দৌঁড়ে দৌঁড়বিদের (রোগী) প্রতি মনোবল যোগানো, প্রার্থনা, হাসি, ভালোবাসার স্পর্শ ইত্যাদির মাধ্যমে সহযোগিতার হাত অনুগ্রহ করে প্রসারিত করুন।
Published : 05 Feb 2024, 03:45 PM
দোকানের ফোকড় দিয়ে ওষুধগুলো নিচ্ছি এমন সময় আমার ফোন বেজে ওঠে। এখন ফোন বেজে ওঠা মানেই এমন এক ধরনের চাপ যে আর কী না জানি শুনতে হয়? ফোনটি কে করল দেখার জন্য ঘুরলাম।
দেখলাম টিউমার বিশেষজ্ঞ (অনকোলজিস্ট) ফোন করেছেন। মনে হলো আমার ডানের প্যাসেঞ্জার সিটে ভাইব্রেটিং মুডে থাকা ফোনটি ছোট্ট একটি ঝিঁঝিঁ পোকার মতো নাচছে। ফার্মেসির পেছনের দেয়ালের বামে মোড় নেওয়ার সময় ফোনটি তোলার চেষ্টা করতে গিয়ে মনে হলো গাড়িটি থামিয়ে নেওয়া উচিত। অশ্রুতে আমার চোখ ঝাপসা হয়ে এল। আমার হাত ঘেমে স্টিয়ারিং হুইল পিচ্ছিল হয়ে গেল। গাড়িটি চালিয়ে একটি গাছের ছায়ার নিচে নিয়ে গেলাম কারণ অগাস্টের গরমে উত্তাপ তখন প্রায় ১০০ ডিগ্রির কাছাকাছি আর স্বগতোক্তি করলাম, ‘কখন এই গরমকাল শেষ হবে।’
গাড়ির কাঁচের বাইরের সূর্যরশ্মি অসহনীয় লাগছিল আর মনে হচ্ছিল এই পার্কিং লটের সামনের রাস্তাটি নরম আর চকচকে, যেন গলে গিয়ে কালো লাভায় পরিণত হবে; যদিও মরীচিকা ছিল না সেখানে। ডান হাতে ফোনটি তুলতে গেলে মনে হলো সেটি হাত পিছলে বেরিয়ে সিটের নিচে চলে যাবে। তবে শেষ পর্যন্ত সেটি ধরে রাখতে পারলাম।
ফোনটি স্পিকারে দিয়ে যথাসম্ভব স্বাভাবিক গলায় বললাম, ‘হাই’। অপর পাশ থেকে আমার নাম ধরে তিনি এখন কোথায় আছি, কথা বলতে পারব কিনা জানতে চাওয়া হলো।’ বললাম, ‘গাড়ি চালাচ্ছি, তবে এক মিনিটের মধ্যে গাড়ি পার্ক করে কথা বলতে পারব।’ অপর পাশের জিজ্ঞাসা, ‘সাথে কেউ আছে?’ বললাম, ‘কেউ নেই, আমি ঠিক আছি, কথা বলতে পারব, মাত্রই পার্ক করলাম, ঠিক আছে, আমি কথা বলতে পারব।’ একজন চিকিৎসককে বুঝতে হয় যে তার রোগী একান্তে কথা বলতে পারবেন এমন স্থানে আছেন কিনা এবং বলা কথার চাপটি তিনি নিতে পারবেন কিনা, বিশেষ করে সেটি যদি দুঃসংবাদ হয়। এই ধরনের তথ্য সচরাচর ফোনে দেওয়া যায় না। আমার ব্যাপারটি একটু পৃথক একারণে যে আমি নিজে একজন চিকিৎসক এবং অনকোলজিস্ট আমার একজন সহকর্মী আর বিপজ্জনকভাবে সময় গড়িয়ে যাচ্ছে, আমার এখনই চিকিৎসা শুরু করা প্রয়োজন। আগেই ঠিক হয়েছিল যে বায়োপসি রিপোর্ট পাওয়া মাত্রই তিনি আমাকে জানাবেন। অনকোলজিস্ট যেন জানা মাত্রই সকল তথ্য আমাকে স্বচ্ছন্দে জানান এই বিষয়টি আমি আগেই নিশ্চিত করেছিলাম।
আমার গা গুলাচ্ছিল, ভয় পাচ্ছিলাম, তবে ভবিষ্যৎ আমার জন্য যাই নির্ধারণ করে থাকুক না কেন সাহসে ভর করে এগিয়ে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নিলাম। আর কিছুক্ষণের মধ্যেই আমার বাচ্চাদেরকে সামার ক্যাম্প থেকে আনতে যেতে হবে। বাচ্চাদের জন্যই আমাকে সুস্থ হয়ে উঠতে হবে আর এর জন্য যা কিছুর মধ্যে দিয়ে যেতে হয় তা আমাকে পারতেই হবে। আমি বিশ্বাস করি সর্বশক্তিমান আমার এই জীবন পরিক্রমায় আমাকে সাহায্য করবেন এবং আমার জীবনের লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য পূরণে আমাকে সহায়তা করবেন। এই সংবাদটির জন্য নিজেকে আমি প্রস্তুত রেখেছিলাম।
‘আমি প্রস্তুত, আমার জানাটা প্রয়োজন যেন কাল বিলম্ব না করে আমি আমার চিকিৎসা শুরু করতে পারি। দয়া করে আমাকে বল, আমি ঠিক হয়ে যাব।’
‘তুমি বাড়ি পৌঁছানোর পর আমি আবার কথা বলব।’
‘না, কিছুক্ষণের মধ্যেই আমাকে বাচ্চদেরকে আনতে যেতে হবে, আমাকে এখনই জানতে হবে, আমরা আগেই এ নিয়ে কথা বলেছিলাম, আমি বুঝতে পেরেছি হয়তো কোন খারাপ কিছু; আমাদের এখন সুনিশ্চিত হওয়া প্রয়োজন, ভেবো না, আমি যে কোনো কিছুর জন্য প্রস্তুত, আমি গাড়ি পার্ক করেছি, গাড়ি চালাচ্ছি না, তুমি আমাকে বলতে পারো।’
ভালো মন্দ যাই হোক, শুনি। মেমোগ্রাম থেকে আগেই নিশ্চিত হয়েছিলাম যে আমার ক্যান্সার। এই ফলাফলে ধরনটা জানা যাবে এবং চিকিৎসার দিক নির্দেশনা পাওয়া যাবে।
আমি চোখের পানি মুছে সোজা হয়ে বসলাম এবং ভবিষ্যৎ ভাবার চেষ্টা করলাম। হাতে আমার অনেক কাজ এবং যত দ্রুত সম্ভব সেরে ওঠার চেষ্টা করার জন্যে আমার এটা জানাটা জরুরি। আমার রিপোর্ট বলছে, যে ধরনের ক্যান্সার হয়েছে সেটি নিরাময়যোগ্য! এখন স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেললাম। গাড়ির চালকের আসনে শরীরটা সামান্য এলিয়ে দিলাম, শীতাতপ নিয়ন্ত্রণ যন্ত্র পুরোদমে চলছে; অবশেষে বাতাস আগের চেয়ে ঠান্ডা বোধ হলো, আবার জিজ্ঞেস করলেন চিকিৎসক, ‘ঠিক আছো তো?’
‘আমি ঠিক আছি, হাজার শুকরিয়া যে এটি চিকিৎসাযোগ্য।’ আমার গলার স্বর কাঁপছে, কপোল বেয়ে অশ্রুধারা গড়াচ্ছে। ফোনের দুপাশে আমরা দুজনই দীর্ঘক্ষণ নিঃশব্দ। চিকিৎসক বলতে শুরু করলেন, ‘‘তোমার সঙ্গে সাক্ষাতের সময় ঠিক করেছি আগামীকালের সকাল, ১০টায় আসতে পারবে?’
আমি তৎক্ষণাৎ বললাম, ‘হ্যাঁ, আমি যাব।’
ওই শুরু। ওইদিন থেকে আমার জীবন বদলে গেল। এখন আমি ক্যান্সারের রোগী। আমার জীবনের বাকি সময়ে রোগের ভার কেবল একজন গবেষক হিসাব করতে পারেন। ক্যান্সারের ভারে অন্য সকল রোগ তলিয়ে যায় এবং রোগী নানা ধরনের স্বাস্থ্যগত জটিলতাসহ মৃত্যু ঝুঁকির সম্মুখীন হয়। আগে যেখানে কোন ওষুধই খেতাম না সেখানে রাতারাতি দৈনিক পাঁচটি ওষুধ খাওয়া শুরু করতে হলো; এখন আমার উচ্চ রক্তচাপ, উচ্চ মাত্রার ডায়বেটিস, ব্যথা, দুঃশ্চিন্তা ইত্যাদি যুক্ত হয়েছে যা কিছু রোগের তালিকায় পড়ে। যে কথাটি আমার রোগের তালিকায় নেই অথচ আমি ভুগছি সেটি হলো আমি খুব বিমর্ষ এবং তা সত্ত্বেও সুস্থ হয়ে ওঠার জন্য চিকিৎসা চালিয়ে যেতে আমি দৃঢ় প্রতিজ্ঞ।
আমার বাচ্চারা যে সামার ক্যাম্পে অপেক্ষা করছিল আমি গাড়ি চালিয়ে সেখানে গেলাম। বাচ্চারা ক্যাম্প কাউন্সিলরদের সঙ্গে গেটেই ছিল। ওরা দুজনই শুধু বাকি ছিল। আমার দেরিতে পৌঁছানোটা ছিল অস্বাভাবিক। বাচ্চাদের মুখের হাসি আমাকে প্রফুল্ল করল। আমার বিশ্বাস আছে, আমি আরও শক্তি পাই, আবার সোজা হয়ে বসি। ওদের সামনে গিয়ে গাড়ি থামিয়ে দরজা খুললাম। বাচ্চারা লাফিয়ে গাড়িতে ঢুকতেই ভেতরের আবহ বদলে গেল। সারাদিন ওরা যা যা করেছে, বাড়ি ফিরে কি করবে আর ক্যাম্পে আগামী দিনের থিম কি হবে, এর সবকিছুই আমাকে উত্তেজিত করে; এখনও আমার সামনে ভবিষ্যৎ আছে এবং সেই ভবিষ্যতে আমি আছি।
৪২ দিনের কেমোথেরাপি, ১০ দিনের রেডিয়েশন, আমার পরিবার, বিশ্বের নানা প্রান্তে থাকা বন্ধু, সহকর্মী, প্রতিবেশী, আর এমনকি অপরিচিতজন যাদের কাছে এই সময়কালে আমি ছুটেছি, তাদের প্রার্থনা, ভালবাসা ও যত্ন এসব কিছুই আমার সেরে ওঠাকে সম্ভব করেছে। এখন আমি আরোগ্যের পথে। এখন আমি খাবারের স্বাদ পাই ও পানি খেতে পারি, বারবার দীর্ঘ বিশ্রাম আর ঘুম ছাড়াই দিন পার করতে পারছি। নিজেকে আবার ফিরে পাচ্ছি।
শিখলাম ক্যান্সার এমন এক ব্যাধি যা কেবল রোগী নয় এর সঙ্গে কমিউনিটিকেও যুক্ত করে। ক্যান্সার যেমন রোগীর সঙ্গে যুক্ত সকলকে ক্ষতিগ্রস্ত করে ঠিক তেমনি রোগীকে সারিয়ে তুলতে সকলের সম্মিলিত প্রচেষ্টা প্রয়োজন। এটি একটি ম্যারাথন বা সহ্যশক্তির পরীক্ষা এবং এটি দ্রুত নিরসনযোগ্য নয় এবং জীবনের মোড় ঘোরানো ঘটনা । এখনো বেঁচে আছি , এটা আশীর্বাদ। যদিও আমি সেই আমি আছি । তথাপি এখন থেকে আমি রোগীর প্রতি বিশেষ যত্নবান হব। আমার রোগীর পারিপার্শ্বিক সকল কিছুকে চিকিৎসা প্রক্রিয়ার অংশ হিসেবে বিবেচনা করব । বিশেষ করে ক্যান্সার আক্রান্ত রোগীর ক্ষেত্রে। রোগীদের ব্যবস্থাপত্রে/চার্টে আমি রোগীর মানসিক অবস্থা/বিমর্ষতা এবং রেজিলেন্সের দিকটি যুক্ত করব। অন্যান্য ঝুঁকির মতো এগুলোও সমান গুরুত্বপূর্ণ ঝুঁকি। বিশেষ করে নিরাময়ের ক্ষেত্রে। ওষুধ রোগ দূর করতে পারে ; কিন্তু সার্বিক নিরাময়ের জন্য এসব অধিক গুরুত্বপূর্ণ। আমার রোগীদের ক্ষেত্রেও আমি একই কথা বলব যেটা আমার নিজের ক্ষেত্রে প্রযোজ্য ছিল।
ক্যান্সার চিকিৎসা একটি ম্যারাথন। নিরাময়ের এই দীর্ঘ দৌঁড়ে দৌঁড়বিদের (রোগী) প্রতি মনোবল যোগানো, প্রার্থনা, হাসি, ভালোবাসার স্পর্শ ইত্যাদির মাধ্যমে সহযোগিতার হাত অনুগ্রহ করে প্রসারিত করুন। নিরাময়ের দীর্ঘ যাত্রাপথে আমাদের টিকিয়ে রাখতে হবে রোগীকে। ক্যান্সার নিরাময় ও জয় করতে একটি কমিউনিটির প্রয়োজন। আসুন হাতে হাত রেখে সেই কমিউনিটি গড়ে তুলি এবং সেটাকে শক্তিশালী করি।
লেখক: অধ্যাপক, ম্যাক গভর্ন মেডিকেল স্কুল, টেক্সাস বিশ্ববিদ্যালয়, যুক্তরাষ্ট্র
(সেন্টার ফর ক্যান্সার কেয়ার ফাউন্ডেশনের ‘এখানে থেমো না’ বইয়ে লেখাটি প্রকাশিত হয়েছে)