Published : 14 Apr 2015, 11:43 AM
পহেলা বৈশাখ উদযাপন কিংবা বাঙালিদের বর্ষবরণ অনুষ্ঠান সকল বাঙালিদের সর্বজনীন অনুষ্ঠানের অন্যতম। গ্রামীণ কৃষক সমাজের ঘরে ফসল তোলা আর খাজনা আদায়ের মধ্যে সামঞ্জস্যতা আনয়নের জন্য এই বঙ্গাব্দের শুরু। পহেলা বৈশাখে কৃষকরা সরকারকে খাজনা দিয়ে মিষ্টিমুখ করে বাড়িতে ফিরতেন। এখনও বাঙালি গ্রামীণ সমাজে পহেলা বৈশাখে হালখাতা ও মিষ্টিমুখের প্রচলন আছে। পরে মোগল সম্রাট আকবরের বাংলা ক্যালেন্ডার 'বঙ্গাব্দের' শুরু থেকে এই বর্ষবরণ আনুষ্ঠানিকতা পায়।
পৃথিবীর অন্যান্য ক্যালেন্ডারের বর্ষবরণের মতোই পুরাতনের বিদায় জানিয়ে নতুনের আবাহনের উদ্দীপনা ও উচ্ছ্বাসই হচ্ছে পহেলা বৈশাখ উদযাপনের মূল প্রেরণা। বাংলা বর্ষবরণ যেন বাঙালির আত্নপরিচয় ফুটিয়ে তোলে। বর্ষবরণে কবি গান, গাজীর গান, পুতুল নাচ, ভাটিয়ালী, মুর্শীদি, বাউল গান, যাত্রাপালাসহ লাঠি খেলা, বলি খেলা, ষাঁড়দৌড়, ঘৌড়দৌড় ইত্যাদি অনুষ্ঠান যেন বাঙালির ভিতরের মনের প্রকাশ ঘটায়।
আমরা নিজেদের সংস্কৃতির মূল থেকে ছিটকে যেয়ে মনে মনে যে বিচ্ছিন্নতা অনুভব করি, পহেলা বৈশাখ উদযাপন আমাদের সে কষ্ট ভুলিয়ে দেয়। এই দিন সেই মহামিলনের সুযোগ করে দেয় যেখানে ধর্ম-বর্ণ-শ্রেণির বালাই থাকে না। বাঙালির এই মহামিলন বাঙালি সংস্কৃতিতে অসাম্প্রদায়িকতার বীজ বপন করেছে।
ধর্মীয় দ্বিজাতিতত্ত্বের ভিত্তিতে ভারত-পাকিস্তান বিভক্ত হয়ে পড়লেও পূর্ব পাকিস্তানে বাঙালির আশা-আকাঙ্ক্ষার কোনো গুরুত্ব ছিল না। প্রথম আঘাতই এল বাঙালির ভাষায়। এই আঘাত প্রতিরোধ করতে যেয়ে আমরা নিজেদের অন্যভাবে আবিষ্কার করলাম। যে চেতনায় বলিয়ান হয়ে বাঙালি বাংলা ভাষার জন্য রাজপথে রক্ত দিতে পারে, সামরিক শাসকদের রক্তচক্ষু উপেক্ষা করে সরকারি বর্বরতার বিরুদ্ধে কথা বলতে পারে, যে শক্তিতে বাঙালি রবীন্দ্র সাহিত্য ও রবীন্দ্র সঙ্গীতচর্চা নিষিদ্ধের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়াতে পারে, সে চেতনাই বাঙালি জাতীয়তাবোধ। আর এই বোধ বাঙালি জাতীয়তাবাদ প্রতিষ্ঠায় প্রচণ্ড আন্দোলনে রূপ নেয়। যা পরবর্তীর পথপরিক্রমায় স্বাধিকার ও স্বাধীনতা অর্জনের আন্দোলনে পর্যবসিত হয়।
বাঙালি জাতীয়তাবোধের মধ্যে অসাম্প্রদায়িকতা ও ধর্মনিরপেক্ষতা ছিল এর ভিতরকার শক্তি। শক্তি বাঙালিদের একই প্ল্যাটফরমে দাঁড়ানোর প্রেরণা যোগাত। বাঙালির সংস্কৃতি ও সাংস্কৃতিক চর্চায় এমন কিছু ইভেন্ট দরকার ছিল যেখানে সে স্পেস বাঙালি পায়। বাংলা নববর্ষ এবং এর বরণ প্রক্রিয়ায় ছিল সে রকম একটি স্পেস যেখানে বাঙালি তাদের মনের রস আস্বাদন করতে পারত। পাকিস্তানি শাসকদের সাম্প্রদায়িক আঘাত ও ষড়যন্ত্রের বিরুদ্ধে এ রকম একটি অসাম্প্রদায়িক উৎসবই ছিল এক রকম প্রতিবাদ; বাঙলির মন ও মানস গড়ে তোলার প্রচেষ্টা।
তাই সাতচল্লিশের পর প্রতিটি বাংলা বর্ষবরণ পহেলা বৈশাখে জমকালো হয়ে উঠে। বাংলার সর্বত্র সকল মানুষের মহামিলনের আনন্দ ও উচ্ছ্বাস নতুন বছরের জন্য নতুন করে জেগে ওঠার প্রণোদনা দান করে। গেল বছরের সব গ্লানি মুছে দিয়ে, সকল জীর্ণতা, শীর্ণতা দূরে ঠেলে দিয়ে সামনে এগোনোর জন্য বাঙালির এর চেয়ে বেশি আর কী আছে?
তবু পহেলা বৈশাখ উদযাপন কখনও একেবারে নির্বিঘ্ন ছিল না। এই মিলনমেলা নস্যাতের জন্য বারবার সাম্প্রদায়িক আঘাত এসেছে। একে 'অধর্মীয়' কিংবা 'বিধর্মীয়' বলে বার বার বাঙালি চেতনায় আঘাত করার চেষ্টা করা হয়েছে। লাল-সবুজ পতাকার স্বাধীন এই বাংলাদেশ আজ যতটা এগোচ্ছে তার চেয়ে বেশি নানা চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি হচ্ছে। সাতচল্লিশ খেকে একাত্তর পর্যন্ত যারা বাঙালির সংস্কৃতির অধিকার, অর্থনৈতিক অধিকার অস্বীকার করেছে, তাদের প্রেতাত্মারা এখনও বাঙালি স্বপ্নস্বাদ তাড়িয়ে বেড়াচ্ছে। ষড়যন্ত্রে মেতে আছে ছোবল দেবার দুষ্ট কামনায়।
তাই একাত্তরেরর পর কখনও কখনও এমন সময়ও গেছে যখন অত্যন্ত সুকৌশলে বাংলা বর্ষবরণের বিভিন্ন অনুষ্ঠান ধর্মের নামে অনুৎসাহিত করা হয়েছে। পহেলা বৈশাখ উদযাপন অপ্রয়োজনীয় একটি কৃষ্টি-কালচার হিসেবে তুলে ধরার চেষ্টা ছিল। কিন্তু সময়মতো সবাই আবার মহামিলনের টানে উচ্ছ্বসিত হয়েছে।
বৈশ্বিক ও বাংলাদেশের কিছু কিছু ঘটনায় এটা হলফ করেই বলা যায়, পহেলা বৈশাখ উদযাপন বাংলাদেশে এখন অনেক বেশি প্রাসঙ্গিক ও গুরুত্বপূর্ণ। মুক্তিযুদ্ধের চেতনা যারা লালন করেন, বাংলাদেশের স্বাধীনতায় যারা গৌরববোধ করেন, তাদের পক্ষে বৈশাখের আবাহনে অবহেলা থাকার কথা নয়। যদি সে রকম হয়, তাহলে বুঝতে হবে বাঙালি চেতনা নিয়েই তাদের প্রশ্ন রয়েছে; বাঙালি জাতীয়তাবোধ তাদের কাছে ধোঁয়াশা। পাশাপাশি, এটাও বুঝতে হবে, মুক্তিযুদ্ধের চেতনা তাদের কাছে একটি ফ্যাশন কিংবা ব্যক্তিগত স্বার্থ হাসিলের একটি মাধ্যম মাত্র।
বর্তমান সরকার বঙ্গবন্ধুর আদর্শের, মুক্তিযুদ্ধের চেতনা লালন করার সরকার; বাঙালি জাতীয়তাবোধ জাগ্রত রাখার কারিগর। আমার আহবান সরকারের কাছে, বাংলা বর্ষবরণকে দেশের সর্বত্র সকল বাঙালির মহামিলনের কেন্দ্র হিসেবে পৃষ্ঠপোষকতা করা হোক। জয়ধ্বনি উঠুক সর্বত্র, 'জয় বাংলা'।
ড. দানেশ মিয়া: অধ্যাপক, বনবিদ্যা ও পরিবেশবিজ্ঞান ইনস্টিটিউট, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়।