Published : 27 Jan 2010, 01:50 PM
বৈশাখের শুভেচ্ছা দিয়েই লেখাটা শুরু করছি। নতুন বছর ১৪১৮ সবার জন্যে সুখ শান্তি বয়ে আনুক।
ঢাকা শহরে বৈশাখ মাস আসছে এই খবর যেমন শাড়ীর দোকানে গিয়ে টের পাওয়া যাচ্ছে, তেমনি পাওয়া যাচ্ছে কাঁচা বাজারে ইলিশের বাজারে। শোনা যাচ্ছে চৈত্রের শুরু থেকেই নাকি ইলিশ কিনে ফ্রিজে ঢুকিয়ে রাখা হচ্ছে, পয়লা বৈশাখে পান্তা-ইলিশ খাবে বলে। গ্রামের মানুষ এমনিতেই গরমকালে নিয়মিতভাবে পান্তা ভাত খান, সাথে কাঁচা কিংবা পোড়া মরিচ, একটি পেঁয়াজ থাকলেও থাকতে পারে, কখনো বাসী তরকারী, বা ডাল ও খাওয়া যায়। সকালে পান্তা ভাত খেলে পেটেও শান্তি লাগে। গরীব এবং সাধারণ গ্রামবাসী যে খাবার খান তার সাথে এক দিকে তাঁদের আর্থিক অবস্থার যেমন যোগ আছে তেমনি মৌসুমের সাথেও শরীরে কোন খাবার কখন ভাল সেটারও সম্পর্ক রয়েছে। কিন্তু ঢাকা শহরেই পান্তা ভাতের সাথে ইলিশ খাওয়া নিয়ে না বুঝেই যে পাগলামী শুরু হয়েছে, তাতে মনে হচ্ছে নতুন বছরকে বরণ করতে হলে ইলিশ না খেলে বছরটাই মাটি হয়ে যাবে।
বৈশাখের প্রথম দিনে পান্তা-ইলিশ খাওয়ার রেওয়াজ কেমন করে শুরু হয়েছিল তা রমনা বটমূলে বৈশাখের অনুষ্ঠান আয়োজনকারীরাই ভালো বলতে পারবেন, তবে যতদূর জানি এর সঙ্গে বাংলার সংস্কৃতির সম্পর্ক নেই। এটা ব্যক্তিগতভাবে কেউ শুরু করেছিলেন, তারপর থেকে ব্যাপক আকার নিয়েছে। পান্তা ভাত খান, ভাল কথা তবে ইলিশ দিয়ে খেতে হবে কেন? এটা কি মধ্য ও উচ্চবিত্তের অহমিকা নয়?
তাছাড়া ঢাকার মধ্যবিত্তরা কি জানেন এই সময় (৪ এপ্রিল থেকে ১০ এপ্রিল পর্যন্ত) জাটকা সংরক্ষণ সপ্তাহ চলছে? এই সময় ইলিশ মাছ ধরা নিষেধ? এই সপ্তাহের উদ্বোধন করেছেন মৎস ও প্রাণী সম্পদ মন্ত্রী আবদুল লতিফ বিশ্বাস। বিভিন্ন পত্রিকায় জাটকা সংরক্ষণ সপ্তাহ সংক্রান্ত প্রতিবেদন বেরিয়েছে, বিশেষ করে মফস্বল সাংবাদিকরা এই বিষয় নিয়ে তথ্য সম্বলিত লেখা লিখছেন। জাতীয় দৈনিকের একটি প্রতিবেদনে (৯ এপ্রিল, ২০১১) বলা হয়েছে, 'মৎস বিজ্ঞানীদের সুপারিশ অনুযায়ী আগামী ৩০ মে পর্যন্ত দেশের সব নদ নদীতে ইলিশ-পোনা জাটকা আহরণ, পরিবহন ও বিপণন নিষিদ্ধ করা হয়েছে।
এমনকি মৎস বিজ্ঞানীদের গবেষণা অনুযায়ী মেঘনার ভাটিতে সাগর মোহনার চারটি এলাকার প্রায় সাত হাজার বর্গ কিলোমিটার এলাকাকে ইলিশ প্রজননস্থল হিসেবে চিহ্নিত করে প্রতি বছর ১৫ থেকে ২৪ অক্টোবর পর্যন্ত সব ধরণের মৎস আহরণ নিষিদ্ধ করা হয়েছে। উপরন্তু প্রতি বছর নিম্ন মেঘনা নদী, শাহবাজপুর চ্যানেল ও তেঁতুলিয়া নদীতেও মার্চ থেকে এপ্রিল মাসে এবং পটুয়াখালীর আন্ধারমানিক নদীতে নভেম্বর থেকে জানুয়ারী সময়কালকে অভয়াশ্রম হিশেবে ঘোষণা করে সব ধরণের মাছ ধরা নিষিদ্ধ করা হয়েছে।'
আমি ধরে নিচ্ছি পয়লা বৈশাখ উদযাপনকারী প্রতিষ্ঠান বা ব্যক্তি পর্যায়েও যারা বছরে অন্তত একটি দিন বাঙ্গালী হতে চান, তাদের এই সব তথ্য জানা নাও থাকতে পারে। কিন্তু পত্রিকাগুলো এমন গুরুত্বপুর্ণ তথ্য প্রথম বা শেষ পাতায়, কিংবা ২ বা ৩ নম্বর পাতায় ছাপলেও হয়তো তাদের নজরে পড়তো, কিন্তু ১০ নম্বর পাতায় এমন একটি জনগুরুত্বপূর্ণ বিষয়ের প্রতি সুবিচার করা হয় না বলেই আমার বিশ্বাস। ফলে অনেকেই জানতে পারেন না।
একই সাথে কোন কোন পত্রিকার প্রথম পাতায় ইলিশ নিয়ে যে শিরোনাম তা মোটেও ইলিশকে রক্ষার জন্যে নয়, বরং শহরের যে নির্বোধ মধ্যবিত্তরা ইলিশ কিনতে পারছে না তাদের প্রতি সহানুভূতি দেখিয়ে বলা হচ্ছে, 'বর্ষবরণের বাজার ধরতে পরিকল্পিত ইলিশ সংকট' শিরোনামে সংকট সৃষ্টির অভিযোগ করা হয়েছে। এমনকি ভারতে ইলিশ রপ্তানী হচ্ছে না বলেও অভিযোগ উঠেছে। এই সময় ইলিশের মণ ৩০ হাজার থেকে ৫০ টাকা পর্যন্ত উঠেছে। এক কেজি সাইজ থেকে ১৪শ গ্রাম ইলিশের মণ ৫৫ হাজার টাকা। (কোরবানীর গরুর দামের মতোই শোনাচ্ছে!!)
ব্যবসায়ীদের মতে, 'এখন প্রকৃতিতে চলছে মরা কটালের জো। সাগরে কিংবা নদীতে ইলিশ নেই। তার ওপর সামনে সংক্রান্তি আর নববর্ষ। এসব কারণেই বাড়ছে ইলিশের দাম। এক সঙ্গে এত মানুষের চাহিদা পূরণ করতে গিয়ে হিমশিম খাচ্ছি আমরা' (যুগান্তর ১১ এপ্রিল, ২০১১)।
এ তো গেল ইলিশ উৎপাদন ও ব্যবসায়ীদের দিক থেকে কথা। কিন্তু ঢাকা শহরে যারা (এবং কিছু জেলা শহরেও) চৈত্রের শুরু থেকে ইলিশ কিনে রেফ্রিজারেটরে যারা রেখে দিচ্ছে তারা কিনছে প্রতি এক কেজি ৪০০ গ্রাম ওজনের ইলিশ ২,২০০ টাকায়, কমের মধ্যে ১০০০ থেকে ১৫০০ টাকা। এর কমে ইলিশ কেনা যাচ্ছে না! অন্য একটি দৈনিকে শিরোনাম 'ইলিশের বাজারে বৈশাখী ঝড়'। এখানেও জানা যাচ্ছে বৈশাখ এলে কীভাবে মানুষ হুমড়ি খেয়ে পড়ে ইলিশ কিনতে।
অন্য একটি দৈনিকে প্রথম বাক্যে বলা হচ্ছে, বৈশাখের সকালে পান্তা-ইলিশ খাবেন না তা কি হয়? পান্তা ভাতে ইলিশ ভাজা যেভাবে করবেন যেভাবে বলা হয়েছে তাতে আমার হাসি ধরে রাখা একটু কঠিন হয়ে পড়েছিল। 'ভাতের চাল ধুয়ে রান্না করে একরাত খাওয়ার পানিতে ভিজিয়ে রাখতে হবে। সকালে ভাতগুলো তুলে মাটির সাঙ্কিতে রেখে পাশে কয়েক রকমের ভর্তা, ভাজা ইলিশ এবং টুকরো পেঁয়াজ ও পোড়ানো শুকনো মরিচ দিয়ে পান্তা ভাতে ইলিশ সাজিয়ে পরিবেশন করুন।' এখানে পান্তা ভাত কই? ভেজা ভাত বলা যেতে পারে। ভাতে পানি না থাকলে পান্তা হয় কেমন করে?
আরেকটি দৈনিকে পান্তা ভাতের বর্ণনা নাই তবে বলা হয়েছে পহেলা বৈশাখের সকালে পান্তা চাই-ই চাই। একটু আবদারের সুর, বাঙ্গালী হওয়ার আবদার বলে কথা! কিন্তু পান্তা ভাতের সাথে যে ইলিশ রান্নার প্রণালী দেয়া হয়েছে তাতে আর যাই হোক পান্তা-ইলিশ হবে না। এর মধ্যে আছে শর্ষে ইলিশ, নোনা ইলিশ, ইলিশ আনারস, ইলিশ পোলাও, ইলিশ ফুলুরি। বাহ। রীতিমতো ডিনার!
প্রথম সারির এক দৈনিকের নকশায় পাতে পান্তা শিরোনামে একই কথা। পান্তা ইলিশ না হলে চলে না। এখানে ইলিশের পাশাপাশি মসুর ডালের চচ্চড়ি, চ্যাপা সুটকীর ভর্তা, শুকনা মরিচের ভর্তার কথাও আছে। বাঁচা গেলো। তবে একটি বিষয়ে মন্তব্য না করে পারছি না যে আমাদের পান্তা ভাতের রেসিপি লাগে এবং শুকনো মরিচের ভর্তাও আমাদের শিখতে হয়। কলিকাল বই কী!
আমার জানার আগ্রহ হলো পয়লা বৈশাখে ব্যবসায়ীদের হালখাতা ছাড়াও গ্রামের মানুষের খাবারের বিশেষ কোন দিক আছে কিনা। তাই সহকর্মী চুন্নুর মাধ্যমে জানতে চেয়েছিলাম টাঙ্গাইলের হিংগানগর গ্রামের প্রতিভা রানী দে এবং রাবেয়া বেগম এবং মামুদপুর গ্রামের রাবেয়া ও রিনা বেগমের কাছে। হ্যাঁ, পান্তা ভাত তাঁরাও খান, আগের রাতের যত ভাত লাগবে তার চেয়ে বেশী রান্না করে পানি দিয়ে ভিজিয়ে রেখে দেন। সকালে এই পান্তা ভাতের সাথে (ভাতের পানিসহ) পেঁয়াজ, বাসী ডাল, আলু ভর্তা, কাঁচা মরিচ দিয়ে খান। যেটা বেশী গুরুত্বপূর্ণ তা হচ্ছে দিঘা ধানের চিড়া এবং বরন ধানের মুড়ি খাওয়া। আবার কেউ হাম ও বসন্ত রোগ না হওয়ার জন্য বিচা কলার সাথে ছাতু খান। এই দিনে ছাতু অনেক বাড়ীতেই খায়।
আগের দিন চৈত্র সংক্রান্তিতে কম পক্ষে ১৪ রকমের কুড়িয়ে পাওয়া শাক, তার মধ্যে গিমা শাক (বা যে কোন তিতা শাক) অবশ্যই থাকতে হবে। সেদিন কোন মাছ মাংস হবে না। পয়লা বৈশাখে পাট শাক, কচু শাক, গিমা শাক এবং আমের কড়া কুড়িয়ে এনে ডালের সাথে রান্না করে খাওয়া হয়। কেউ আবার চিতই পিঠার সাথে মরিচ বাটা খান। এঁরা কেউই ইলিশ মাছ কেন অন্য কোন মাছের নামও ধরেন নি, এই মৌসুমে মাছ না খাওয়াই ভাল।
আমাদের সংস্কৃতিতে সত্যিকারভাবে কী আছে না আছে, না জেনেই আমরা শুধু বাণিজ্যিক হুজুগে মেতে উঠছি। কাপড়-চোপড় কিনে মেলায় গিয়ে এটা সেটা কেনা, বিশেষ করে মাটির তৈরি নানা সামগ্রী, বাঁশের বাশী কিনে অনেকের জীবন জীবিকা রক্ষায় সহায়তা করতে পারেন, কিন্তু পান্তা-ইলিশের নামে যা চলছে তা ইলিশের ভবিষ্যত নষ্ট করে দেবে। প্রকৃতিকে বাঁচিয়ে রাখাই সংস্কৃতির অংশ, ধ্বংস করা নয়।