পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের ভিসিদের একটা গড় চেহারা তুলে ধরেছিলেন আহমদ ছফা তার ‘গাভী বিত্তান্ত’ উপন্যাসে। সেই উপন্যাসের কেন্দ্রীয় চরিত্র যদিও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য, কিন্তু সাম্প্রতিক বছরগুলোয় দেশের আরও অনেক বিশ্ববিদ্যালয়ের ভিসির মধ্যেই বিশ্ববিদ্যালয়গুলোকে ‘গোয়ালঘর’ বানানোর প্রতিফলন দেখা গেছে।
Published : 09 Oct 2024, 04:37 PM
সবাই কি ভিসি হতে চান? এই প্রশ্নের উত্তর হচ্ছে ‘না’। নিশ্চয়ই সব শিক্ষক ভিসি হতে চান না। কেননা ক্লাসে পড়ানো আর ভিসিগিরি করার মধ্যে তফাৎ ঢের। জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের এক অধ্যাপক এই সেদিন ভিসি হওয়া নিয়ে রসিকতা শুরু হওয়ার পর ফেইসবুকে লিখেছেন, ‘ভিসি হতে চাই না, পড়াতে চাই, পড়ানোর পরিবেশ তৈরি করুন।’ একজন শিক্ষকের কথা বললাম, কিন্তু এমন অনেক জনের কথা আমরা জানি, যারা ভিসি হওয়ার প্রস্তাব পেলেও সেটা গ্রহণ করবেন না। ভিসি পুরোপুরি একটি প্রশাসনিক পদ। তবে বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াশোনার পরিবেশ তৈরি করার তার প্রধান দায়িত্ব। ভিসিরা কয়জন তা করতে চেষ্টা করেছেন? এই পদাধিকারীর অনেক ক্ষমতা। দুর্জন শিক্ষক যদি ভিসি হন, তাহলে তার পক্ষে এই পদে বসে প্রচুর মালকড়ি কামানোও সম্ভব। অনেক ভিসির বিরুদ্ধে এমন অভিযোগ আছে। বরং বলা ভালো, সাম্প্রতিক বছরগুলোয় খুব কম ভিসিই বিতর্কমুক্ত থাকতে পেরেছেন বা পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে এরকম ভিসি খুঁজে পাওয়াই খুব কঠিন যার বিরুদ্ধে নিয়োগ-বাণিজ্য, স্বজনপ্রীতিসহ অন্য আরও এক বা একাধিক অভিযাগ ওঠেনি।
৭ অক্টোবর অন্তর্বর্তী সরকারের শিক্ষা উপদেষ্টা ওয়াহিদউদ্দিন মাহমুদের একটি বক্তব্য গণমাধ্যমের শিরোনাম হয়। তিনি বলেন, ‘বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকরা এখন শিক্ষার্থীদের পড়ানোর পরিবর্তে উপাচার্য বা উপ-উপাচার্য হতে বেশি আগ্রহী। কোনো বিশ্ববিদ্যালয়ে হয়তো ৩০০, ৪০০ বা ৫০০ শিক্ষক আছেন; কিন্তু তারা সবাই কেন ভিসি হতে চান, আমি বুঝি না। তিনি আরও বলেন, ‘আমি সবসময় একজন ভালো শিক্ষক হতে চেয়েছি, ভিসি হতে চাইনি।’
যদিও ওইদিনই প্রধান উপদেষ্টার প্রেস উইং থেকে পাঠানো একটি বিবৃতিতে বলা হয়, পরিকল্পনা ও শিক্ষা উপদেষ্টা একনেক সভার গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্তগুলো জানানোর জন্য পরিকল্পনা কমিশনে একটি সংবাদ সম্মেলন করেন। শুরুতে তার ব্যস্ততা ও শারীরিক ক্লান্তির কথা বুঝাতে তিনি বলেছিলেন, তার কাছে চারশ থেকে পাঁচশ ভিসি, প্রো-ভিসি হওয়ার আবেদন আছে, যা তিনি এখনো যাচাই-বাছাই শেষ করতে পারেননি। এ প্রসঙ্গে তিনি মজার ছলে বলেছিলেন, সবাই ক্লাসে পড়ানোর চাইতে এসব পদে যেতেই আগ্রহী।
ওয়াহিদউদ্দিন মাহমুদ হয়তো মজার ছলেই বলেছেন। তিনি একজন সজ্জন মানুষ হিসেবে পরিচিত। অহেতুক বিতর্ক তৈরি করা বা কাউকে ছোট করা তার চরিত্রের সঙ্গে বেমানান। কিন্তু বাস্তবতা হলো, তিনি মজার ছলে হলেও একটি নির্মম সত্য বলেছেন— যা সম্পর্কে দেশের সচেতন নাগরিকদেরও কমবেশি ধারণা আছে। বিশেষ করে সাম্প্রতিক বছরগুলোয় বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য, উপ-উপাচার্য এমনকি প্রক্টর পদে থাকা অনেক শিক্ষকের বিরুদ্ধে যেসব দলীয়করণ (দলবাজি) ও নানাবিধ অনিয়ম-দুর্নীতির অভিযোগ উঠেছে; এইসব পদে নিয়োগ নিয়ে যে ধরনের রাজনীতি হয়েছে বা এই পদগুলোকে যেভাবে দলীয় আনুগত্যের পুরস্কারে পরিণত করা হয়েছে এবং সর্বোপরি এইসব পদকে যেভাবে ক্ষমতার কেন্দ্র ও টাকা কামানোর মেশিনে পরিণত করা হয়েছে— তাতে বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষকদের বিরাট অংশের মনে ভিসি, প্রো-ভিসি, প্রক্টর হওয়ার বাসনা তৈরি হওয়াটা অস্বাভাবিক নয়। ওয়াহিদউদ্দিন মাহমুদের মতো নির্লোভ, সৎ ও আন্তরিক শিক্ষকের সংখ্যা কি আসলে খুব বেশি যারা কোনোদিন এসব প্রশাসনিক পদে যেতেই চাননি?
পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের ভিসিদের একটা গড় চেহারা তুলে ধরেছিলেন আহমদ ছফা তার ‘গাভী বিত্তান্ত’ উপন্যাসে। সেই উপন্যাসের কেন্দ্রীয় চরিত্র যদিও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য, কিন্তু সাম্প্রতিক বছরগুলোয় দেশের আরও অনেক বিশ্ববিদ্যালয়ের ভিসির মধ্যেই বিশ্ববিদ্যালয়গুলোকে ‘গোয়ালঘর’ বানানোর প্রতিফলন দেখা গেছে।
আশা করতে চাই বিশ্ববিদ্যালয়গুলোকে গোয়ালঘর বানানোর যে অবস্থা করা হয়েছিল, তা থেকে উত্তরণ ঘটবে। বিগত অনেকগুলো সরকারের আমলে দেখেছি পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্যদেরকে যে রাজনৈতিক বিবেচনায় নিয়োগ দেওয়া হয়, এটি ছিল ওপেন সিক্রেট। অর্থাৎ ব্যক্তি হিসেবে তিনি যতই উন্নত চরিত্রের হোন না কেন; তার অ্যাকাডেমিক ক্যারিয়ার যতই উজ্জ্বল হোক না কেন; প্রশাসক হিসেবে তিনি যতই দক্ষ হোন না কেন— দলীয় আদর্শের ব্যাপারে তিনি যদি নিজের অবস্থান সুস্পষ্ট করতে না পারেন এবং নিঃশর্ত আনুগত্য প্রদর্শনে ব্যর্থ হন, তাহলে তার পক্ষে উপাচার্য তো দূরের কথা, উপ-উপাচার্য হওয়ারও সুযোগ ছিল না। আর যখনই কেউ এভাবে ক্ষমতা ও রাজনৈতিক বলয়ের ভেতরে থেকে বিশ্ববিদ্যালয়ের শীর্ষ পদে নিয়োগ পান, তখন তিনি ওই ক্ষমতাকে প্রথমত কাজে লাগান নিজের ও পরিবারের আর্থিক উন্নয়নে। তার কাছে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার মান ও পরিবেশ উন্নয়নের মতো বিষয়গুলো অগ্রাধিকারের তালিকায় থাকে না। তার বড় অগ্রাধিকার যেহেতু বৈধ-অবৈধ নানা উপায়ে অর্থ উপার্জন, ফলে তার অধিক আগ্রহ থাকে অবকাঠামো নির্মাণ, বিভিন্ন কেনাকাটা এবং অবশ্যই নিয়োগে। আর এইসব করতে গিয়ে তিনি তার শিক্ষক চরিত্র থেকে বিচ্যুত হয়ে অপরাপর দুর্নীতিগ্রস্ত সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারীদের কাতারে চলে যান।
এই পদগুলো এতটাই দলীয়করণ করা হয়েছে যে, ছাত্র-জনতার গণঅভ্যুত্থানের মুখে গত ৫ অগাস্ট শেখ হাসিনা সরকারের পতনের পর বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর উপাচার্য, উপ-উপাচার্য, প্রক্টর, কোষাধ্যক্ষসহ শীর্ষ পর্যায়ে শিক্ষক-কর্মকর্তারা পদত্যাগ করেন। যেহেতু তারা বিগত সরকারের আমলে নিয়োগ পেয়েছেন এবং খুব ব্যতিক্রম ছাড়া এই পদগুলোয় দলীয় আনুগত্য আছে এমন লোকদেরই নিয়োগ দেওয়া হয়েছে— ফলে রাজনৈতিক পটপরিবর্তনের তারা পদত্যাগ করেছেন। বাস্তবতা হলো, পদত্যাগ না করলেও তাদের সরিয়ে দেওয়া হতো। এদের অনেকের বিরুদ্ধে অভ্যুত্থান চলাকালীন আন্দোলনকারী শিক্ষার্থীদের বিরুদ্ধে অবস্থান নেওয়ারও অভিযোগ আছে। দলীয় বিবেচনায় নিয়োজিত হলে তারা সরকারের বিরুদ্ধে গড়ে ওঠা ওই আন্দোলনে যে সরকারের পক্ষে অবস্থান নিয়েছেন— এটি অস্বাভাবিক নয়। তবে এরকম গুরুত্বপূর্ণ পদে থেকেও কেউ কেউ ছাত্রদের বিরুদ্ধে যাননি।
এখন প্রশ্ন হলো, সম্প্রতি বেশ কয়েকটি পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে যে নতুন ভিসি নিয়োগ দেওয়া হলো, সেখানে কি রাজনৈতিক বিবেচনা নেই? এবারের নিয়োগগুলো কি সবই নির্মোহ ও নিরপেক্ষ হয়েছে। যারা ভিসি হয়েছেন তাদের সবাই কি দলনিরপেক্ষ? চট করে এই প্রশ্নের উত্তর দেওয়া কঠিন। তাছাড়া দায়িত্ব গ্রহণের পরপরই তাদের মূল্যায়ন করা যাবে না। কেননা দেশের একটি কঠিন পরিস্থিতিতে তারা দায়িত্ব নিয়েছেন।
যারা দায়িত্ব পেয়েছেন তাদের প্রত্যেকেরই একটা রাজনৈতিক বিশ্বাস আছে তাতে সন্দেহ নেই। কিন্তু ওই বিশ্বাস যদি তাকে দলীয় কর্মী বা ক্যাডারে পরিণত না করে এবং তিনি যদি দায়িত্ব পালনকালে তার সেই রাজনৈতিক বিশ্বাস অনুযায়ী সিদ্ধান্ত না নেন; তিনি যদি আর্থিকভাবে দুর্নীতিমুক্ত থাকেন এবং নিয়োগবাণিজ্য না করেন; তিনি যদি দল-মত নির্বিশেষে সকল শিক্ষক-কর্মকর্তা-কর্মচারী ও শিক্ষার্থীদের মধ্যে একটা সেতুবন্ধ রচনা করতে পারেন; তিনি যদি ক্যাম্পাসে শান্তিশৃঙ্খলা বজায় রাখতে পারেন; যদি তিনি ক্যাম্পাসকে সকলের জন্য এমনকি ক্যাম্পাসে ঘুরে বেড়ানো কুকুর, শিয়াল, বেজি ও পাখিদের জন্যও একটি নিরাপদ আশ্রয়স্থল হিসেবে গড়ে তুলতে পারেন— তাহলে তিনি ব্যক্তিগতভাবে কোন দলের আদর্শ লালন করেন সেটি হয়তো বিবেচনায় আসবে না। কিন্তু সম্প্রতি নিয়োগ পাওয়া উপাচার্যগণও যদি আগের মতো ক্ষমতার তোষণ করতে থাকেন এবং এই পদটিকে টাকা কামানোর মেশিনে পরিণত করেন— তাহলে বুঝতে হবে কোথাও আলো নেই।
শিক্ষা উপদেষ্টার কাছে যদি ভিসি, প্রো-ভিসি হওয়ার জন্য চার থেকে পাঁচশ আবেদন জমা পড়ে, তাহলে বুঝতে হবে শিক্ষকদের বড় অংশই আসলে ক্ষমতা চান। বরং ভিসি বানানো উচিত এমন শিক্ষকদের, যারা এই পদে যেতে চান না বা যারা আবেদন করেননি। এমন লোকদের মধ্য থেকে বাছাই করে প্রশাসনিকভাবে দক্ষ, আর্থিকভাবে সৎ তথা দুর্নীতিমুক্ত এবং মানবিক গুণাবলি আছে এমন কাউকে নিয়োগ দেওয়া উচিত।
পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য নিয়োগের প্রক্রিয়ায় বড় ধরনের পরিবর্তন আনা প্রয়োজন। ১৯৭৩ সালের আদেশে চলা ৪টি বিশ্ববিদ্যালয়ে সব সময়ই আইন মেনে সবাইকে সিনেট নির্বাচনের মাধ্যমে উপাচার্য নিয়োগ নিশ্চিত করতে হবে। অর্থাৎ দলীয় বিবেচনা এখানে মুখ্য হতে পারবে না। এইকসঙ্গে সকল বিশ্ববিদ্যালয়ের নিজস্ব শিক্ষকদের মধ্য থেকেই উপাচার্য নিয়োগের বিধান করা উচিত। কারণ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে একজন শিক্ষককে বরিশাল-রংপুর-সিলেট-গোপালগঞ্জের ভিসি নিয়োগ করার যে ‘রেওয়াজ’ চলে আসছে, প্রাতিষ্ঠানিক সংস্কারের পথে এই পদ্ধতিটিই বিরাট অন্তরায়। নানাবিধ সংকটের সূত্রপাতও হয় অন্য বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ভিসি নিয়োগের কারণে। ফলে এটি নিয়ে এখন নতুন করে চিন্তা-ভাবনার সময় এসেছে।