Published : 05 Apr 2011, 10:10 PM
আমাদের কোন নারী নীতি নাই, কিন্তু হৈ চৈ হচ্ছে প্রচুর। আমরা অনেকেই কিছু জানা বা শোনার আগেই শুনি নারী নীতি নিয়ে ইসলামী একটি গোষ্ঠী প্রতিবাদ করছেন এমনকি তাঁরা হরতালও করে ফেলেছেন। কারণ, তাঁদের দাবি, ধর্মের বিরুদ্ধে, ধর্মীয় বিধিবিধান লংঘন করে নারীদের সম্পত্তিতে নাকি অধিকার দেয়া হয়েছে। তাই যদি হয় তাহলে নিশ্চয়ই শুধু ইসলাম ধর্মের বিধিবিধানের বিরুদ্ধে বিপদটি ঘটেনি, ঘটেছে হিন্দু, বৌদ্ধ, খ্রিস্টানসহ অন্য সকল ধর্মের ক্ষেত্রেও। কোন ধর্মেরই ধর্মীয় বিধি বিধানে নারী-পুরুষের সম্পত্তি সংক্রান্ত বিষয়ে সম-অধিকার নেই। কিন্তু অন্য ধর্মের দিক থেকে কোন সমস্যা বা আপত্তি দেখা যাচ্ছে না এমনকি সকল ইসলামী দল যে বিরোধিতা করছেন তাও নয়। অনেক আলেম মাশায়েখরা হরতাল ডাকা সমর্থন করেন নি। ইসলামিক ফাউন্ডেশানও ব্যাখ্যা দিয়েছে। ধর্ম মন্ত্রণালয় পত্রিকায় বিজ্ঞাপন দিয়েছে। তাহলে এই একটি গোষ্ঠীর এই তোল্পাড় ও হরতাল ডাকা কেন?
শুরুতে বলেছি আমাদের নারী নীতি নেই, যেটা ঘোষণা করা হয়েছে সেটা হচ্ছে 'জাতীয় নারী উন্নয়ন নীতি ২০১১'। সেই ১৯৯৭ সালে যে নীতি প্রণয়নে সকল নারী সংগঠন একত্রে কাজ করেছে, সেই নীতি এতো বছর ধরে বারে বারে কাঁটাছেড়া হওয়ার পর এবং কেন জানি গোপনে, কিংবা বলা যেতে পারে সকলের মতামত না নিয়ে, ঘোষণা করা হয়েছে। সত্যি বলতে কি ২০০৪ সালে যখন কাঁটাছেড়া হয় তখনও সরকার কারো সাথে কোন আলোচনা করে নি। তখন যখন জানতে পারলাম, নারী সংগঠন হিসেবে আমরা প্রতিবাদ জানিয়েছি। অভিযোগ ছিল নারীদের উত্তরাধিকার সূত্রে পাওয়া সম্পত্তিতে সমানাধিকার দেয়া হয় নি। কিছুদিন প্রতিবাদ হোল, তারপর আবার চুপ। সেনা-সমর্থিত অসাংবিধানিক তত্ত্বাবাধায়ক সরকার (২০০৭-২০০৮) জাতীয় স্বাস্থ্য নীতি ও জাতীয় নারী উন্নয়ন নীতি নিয়ে আবার একটু মেতে উঠলো, যেনবা তারা জনগণের স্বাস্থ্য এবং নারীর অধিকার নিয়ে খুবই উদগ্রীব। যখন দেশে গণতন্ত্র বলে কিছু নেই, দ্রব্যমূল্যের উর্ধ্ব গতির কারণে মানুষের জীবন অতীষ্ঠ, শ্রমিকের অধিকার আদায় হচ্ছে না, তখন ফখরুদ্দিন আহমদের সরকার ২০০৮ সালে আন্তর্জাতিক নারী দিবসে নারী নীতির ঘোষণা দিয়েছিলেন, তখনও সরকারের বিরুদ্ধে কিছু করতে না পারলেও উপদেষ্টা মন্ডলীর মধ্যে একমাত্র নারী উপদেষ্টার ওপর যথেষ্ট আক্রমণাত্মক সমালোচনা হয়েছিল। তারপর গণতান্ত্রিক সরকার ক্ষমতায় এলো, এবং সেই দলই এলো যারা ১৯৯৭ সালের জাতীয় নারী উন্নয়ন নীতি প্রণয়ন করেছিলেন। তারা নির্বাচনী ইস্তেহারে প্রতিশ্রুতি দিয়েই জনগণের ভোট নিলেন, নিরংকুশ সংখ্যা-গরিষ্ঠতা নিয়ে সরকার গঠন করলেন। নারী ভোটাররাই তাদের ভোট দিয়ে জয়ী করলো। এবার তাঁদের পক্ষে এই নীতি ঘোষণায় কোন বাধা থাকার কথা ছিল না। ভেবেছিলাম সরকার গঠনের পর পরই আন্তর্জাতিক নারী দিবসে এই সুখবর পাবো কিংবা কোন তৎপরতা দেখবো। কিন্তু সেটা হয় নি। দুটো বছর পার হবার পর যখন নারী নীতি হচ্ছে বলে হৈ চৈ শুনছি, তখন বুঝলাম নারী নীতি ঘোষিত হয়েছে। আবারও এই ধরণের জাতীয় দলিল চূড়ান্ত করার ক্ষেত্রে গোপন পন্থা। যাঁরা নারীদের অধিকার নিয়ে কাজ করেন তাদের অংশগ্রহণের কোন সুযোগ ছিল না। একটি দৈনিক পত্রিকায় জানতে পারলাম নারী ও শিশু বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের ওয়েব সাইটে নতুন নীতি পাওয়া যাবে। ডিজিটাল যুগের সুবিধা নিয়ে দ্রুত ডাউনলোড করে ফেললাম। দেখলাম ওটা আসলে 'নারী নীতি' নয়, এটা 'জাতীয় নারী উন্নয়ন নীতি ২০১১'। এবং সেই নীতি পড়ে জানতে পারছি নারী উন্নয়ন নীতিতে আসলে কী আছে!
যারা নারী নীতি বাতিলের দাবীতে হরতাল করেছেন তাঁদের কথার উত্তর দেয়ার জন্য আমি এই লেখা লিখছি না। এই নিয়ে আমি ভাবছি না। বিভিন্ন পর্যায়ের মন্ত্রীরা ব্যস্ত হয়ে তাঁদের আশ্বাস দিয়েছেন, কোরান সুন্নাহ'র বিরুদ্ধে যায় এমন কোন কিছুই এই নীতিতে নাই। এতে হরতাল ঘোষণাকারীরা দমে যান নি, তাঁদের প্রতিবাদ অব্যাহত রইলো। কিন্তু পত্রিকার সব খবর যদি কেউ পড়েন তাহলে দেখা যাবে শুধু একটি ইসলামী গোষ্টী নয়, বাম মোর্চাও এর বিরোধিতা করেছে। তাঁদের আপত্তি হলো নারী নীতিতে দেশের বঞ্চিত, অবহেলিত ও নির্যাতিত নারী সমাজের গণতান্ত্রিক আকাঙ্ক্ষার প্রতিফলন ঘটে নি। আশ্চর্য্য যে তাদের এই আপত্তির প্রশ্নে সরকারের কোন মাথা ব্যথা নেই।
আমি মনে করি, 'জাতীয় নারী উন্নয়ন নীতি ২০১১'-র বিরুদ্ধে নারী সংগঠনগুলোরই প্রতিবাদ করা উচিৎ ছিল। তাছাড়া এই নীতি ঘোষণার আগে সরকার, বা নির্দিষ্টভাবে বললে মহিলা ও শিশু বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের পক্ষ থেকে কোন উদ্যোগ দেখা যায় নি, সকল নারী সংগঠন (দল মত নির্বিশেষে), সামাজিক সংগঠন, বিভিন্ন ধর্মীয় গোষ্ঠীসহ সংশ্লিষ্টদের একটি সভা ডেকে মত বিনিময় করার দরকার ছিল। তাহলে আজ বিষয়টি শুধু হরতাল আহবানকারী কোন গোষ্ঠী বনাম সরকারের বিষয় হয়ে উঠত না। দুঃখের বিষয় হচ্ছে যে একটি নির্বাচিত সরকারের কাছে আমরা গণতান্ত্রিক আচরণ পাই নি। এটা দেখতে খুব অদ্ভুত লাগে যে এই দেশে সম্পত্তিতে নারীকে সমধিকার দেয়া হবে না, এই বিষয়টি প্রকাশ্যভাবে এমনভাবে বলা হচ্ছে যেন নারীর অধিকারের ব্যাপারে এখন সকল কাজ-কারবার বন্ধ করে দিতে হবে। মনে হয় পুরুষতান্ত্রিক সরকার নিজেই নারীকে সেই সমধিকার দিতে চায় না বলে ধর্মীয় গোষ্ঠীর ডাকা হরতালে খুব কাহিল ভাব দেখাচ্ছেন। আরও দুঃখজনক হচ্ছে যে এই নারী উন্নয়ন নীতিকে অতিমাত্রায় দলীয়করণ করে ফেলা হয়েছে, যার ফলে সরকারী দল এবং মহাজোটের শরীক দল ছাড়া, বিরোধী দল সমর্থন জোগাতে চাইলেও পারবে না। নারী উন্নয়ন নীতির আওতায় দেশের সকল নারীই থাকবেন, শুধু একটি দলের নয়। জাতীয় নীতির ভাষার বদলে পুরো ব্যাপারটাই একটা দলীয় প্রচারপত্রে পর্যবসিত হয়েছে।
আসলে সম্পত্তিতে উত্তরাধিকারের ক্ষেত্রে নারীর অধিকারের কথা বা প্রতিশ্রুতির কিছুই এই নীতিতে নাই। দাড়ি, কমার মধ্যে ২৫.২ ধারায় 'উপার্জন, উত্তরাধিকার, ঋণ, ভূমি এবং বাজার ব্যবস্থাপনার মাধ্যমে অর্জিত সম্পদের ক্ষেত্রে নারীর পূর্ণ নিয়ন্ত্রণের অধিকার প্রদান' করার কথা বলা হয়েছে। এতে আইনীভাবে নারী কতটুকু সম্পদ অর্জন করতে পারবে জানি না, কিন্তু একই বাক্যে সব কথা ঢূকিয়ে দিয়ে নারীর নিজের অর্জিত সম্পদও হাতছাড়া করার ব্যবস্থা করা হয়েছে। একইভাবে ২৩.৫ নিয়েও হরতাল আহবানকারীরা আপত্তি তুলেছে। এখানে আছে 'সম্পদ, কর্মসংস্থান, বাজার ও ব্যবসায় নারীকে সমান সুযোগ ও অংশীদারিত্ব দেয়া'। এই ২৩ অনুচ্ছেদটির শিরোনাম হচ্ছে জাতীয় অর্থনীতির সকল কর্মকাণ্ডে নারীর সক্রিয় ও সম অধিকার নিশ্চতকরণ। এখানে সম্পত্তিতে উত্তরাধিকার বিষয়ে কিছুই বলা নাই। তাছাড়া কিভাবে নারীর 'সমান সুযোগ ও অংশীদারীত্ব কায়েম হবে তার কোন ইঙ্গিত কোথাও দেয়া হয় নি। এগুলো কথার কথাই হয়ে থাকবে।
নিউ এজ পত্রিকায় (৩ এপ্রিল, ২০১১) তারিখে্ প্রথম পাতায় নারী নেত্রীদের কঠোর সমালোচনার কথা উল্লেখ করা হয়েছে। তাঁরা উত্তরাধিকারে নারীর সমঅধিকারের কথা না থাকার বিষয়ে প্রধানতঃ আপত্তি জানিয়েছেন। তবে তাঁরা অন্যান্য বিষয়ে সন্তুষ্ট মনে হয়েছে।
আমি মনে করি সম্পত্তিতে উত্তরাধিকারের প্রশ্নটি শুধু বাংলাদেশেই নয়, পৃথিবীর সব দেশেই গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হয়ে আছে। সাংবিধানিকভাবে তার মীমাংসা ছাড়া এর অন্য কোন পথ নাই। আমাদের দেশে এর মীমাংসা করার জন্য যে জাতীয় প্রক্রিয়ার প্রয়োজন তা না করে আমরা কেবল সংঘাত ও বিরোধ সৃষ্টি করে যাচ্ছি। আশ্চর্য যে নারীর উত্তরাধিকারের বিষয়টি নারী ও আইন অনুচ্ছেদ (৭ নং)-এর অংশ হয় নি। এখানে স্থান পেয়েছে নির্যাতন ও পারিবারিক সহিংসতার কথা। তাছাড়া সরকারের আরও অন্যান্য নীতির সাথেও উত্তরাধিকারের প্রশ্ন জড়িত। যেমন পরিবার পরিকল্পনা কর্মসুচীতে শ্লোগান দেয়া হয় ছেলে হোক, মেয়ে হোক, দুটি সন্তানই যথেষ্ট; একটি হলে নাকি আরো ভাল। কিন্তু সেই একটি সন্তান যদি মেয়ে হয় তাহলে পারিবারিক সম্পত্তিতে উত্তরাধিকারের বিষয়টির মীমাংসা কীভাবে হবে? ইসলাম ধর্ম নারীদের অধিকার থেকে বঞ্চিত করার কথা বলে না, বরং অধিকার দেয়ার জন্যই নানা বিধান রেখেছে। সেক্ষেত্রে সময় এবং অবস্থা অনুযায়ী আইন পরিবর্তন করা যেতে পারে কিনা সেই বিষয়ে সকল ধর্মীয় গোষ্ঠীর সাথে আলাপ আলোচনা করা যায়। কিন্তু এমন কোন চেষ্টা আমরা দেখি না। সেই কারণে নারী অধিকারের বিষয়ে একটা বৈরী সম্পর্ক সৃষ্টি হয়, ধর্মের সাথে এবং পুরুষদের সাথে। অথচ পুরুষদের মধ্যে অনেকেই নারীর অধিকারের পক্ষে কথা বলছেন এবং আন্তরিকভাবে নিজের কন্যা ও বোনকে সম্পদের অধিকার দিতে চাইছেন। তাহলে এই বিরোধ কার সাথে? এবং কেন?
সব মিলিয়ে এই নারী উন্নয়ন নীতি আসলে কী কাজে লাগবে, কার স্বার্থ রক্ষা করবে সেই সব প্রশ্নের উত্তর আমরা পাই নি। এই নারী নীতিতে তিনটি ভাগ এবং ৪৯টি অনুচ্ছেদ রয়েছে। ভাগগুলোতে কোন শিরোনাম নেই, বোঝার উপায় নেই কোন ভাগ কেন করা হয়েছে, তবে প্রতিটি অনুচ্ছেদের উপ-শিরোনাম আছে। তবে এই ভাগ ও অনুচ্ছেদগুলো যেভাবে সাজানো হয়েছে তার মধ্যেও কোন বিশেষ যুক্তি পাওয়া যায় না। আমি নিজে যে সব বিষয়ে বিশেষভাবে আগ্রহী, যেমন নারীর খাদ্য নিরাপত্তা, নারী ও কৃষি, স্বাস্থ্য ও পুষ্টি ইত্যাদিতে দু'একটি ভাল দিক থাকলেও সার্বিক বিবেচনায় নারীর প্রয়োজন বা নারীর দৃষ্টিভঙ্গি রক্ষা হয় নি। আগোছালোভাবে করা এই নীতি কার স্বার্থ রক্ষা করবে সেই প্রশ্ন থেকে যায়।
ফরিদা আখতার : নারীনেত্রী ও কলামলেখক।