Published : 04 Apr 2011, 10:02 PM
নারী। নারী শব্দ এবং উচ্চারণে যে অবয়ব তৈরি হয়, তাতে মুফতি ফজলুল হক আমিনী বা আল্লামা শাহ আহমেদ শফীর যত জ্বালা হয়, সরকারের প্রতারণা তার চেয়ে কম নয়।
৭ মার্চ মন্ত্রিপরিষদে নারী উন্নয়ন নীতির খসড়া অনুমোদন হওয়ার পর দিন ইসলামী আইন বাস্তবায়ন কমিটি ৪ এপ্রিল হরতাল ডেকে বসে। কারণ কী? প্রশ্ন করেছিলাম, হরতাল আহবানকারী দলটির চেয়ারম্যান ফজলুল হক আমিনীকে। তিনি আমার সাথে কথা বলতে চান না জানিয়ে,তার দলের জনসংযোগ কর্মকর্তা আহলুল্লাহ ওয়াসেলকে ফোন ধরিয়ে দেন। ওয়াসেলের সাফ জবাব, নারী উন্নয়ন নীতি পুরোপুরি কোরান বিরোধী। কেমন করে? কোরানে পরিস্কারভাবে বলা আছে, উত্তরাধিকার সম্পত্তিতে নারী, পুরুষের অর্ধেক সম্পত্তি পাবে। খসড়া নারী নীতিতে উত্তরাধিকার সম্পত্তিতে নারীর অধিকার বিষয়ে সুস্পষ্ট কিছু কি বলা আছে? পাল্টা প্রশ্নে তিনি জানান, ফজলুল হক আমিনী অনুমোদিত খসড়া নারী নীতি ভালো করেই পাঠ করেছেন এবং তাতে উত্তরাধিকার সম্পত্তিতে নারীর সম অধিকারের কথা বলা আছে।
সরকারের প্রতারণা অথবা ধাপ্পা দেয়ার প্রসঙ্গটি আরেকটু পর বলছি। তার আগে শুক্রবার, অর্থাৎ পয়লা এপ্রিল একই ইস্যুতে হেফাজতে ইসলাম বাংলাদেশ নামের একটি সংগঠনের লম্ফনের কথা একটু বলে নেই। শুক্রবার মানেই যেন আমিনী আর তার অনুসারী ছোট ছোট ইসলামী দলগুলোকে নারী বা ফতোয়া বা শিক্ষানীতি বিষয়ে মারামারি, তান্ডব করতেই হবে। সে দিন চট্টগ্রামে অন্দরকিল্লা মোড়ে শাহী জামে মসজিদের সামনে কওমী মাদ্রাসা শিক্ষা বোর্ডের চেয়ারম্যান আল্লামা শাহ আহমেদ শফীর নেতৃত্বে নারী নীতি বাতিলের দাবিতে সড়ক অবরোধ, বিক্ষোভ, গাড়ি ভাংচুর করে হেফাজতে ইসলাম। পুলিশের ওয়াকিটকি কেড়ে নেয়। ১০ পুলিশ, ৫ সাংবাদিকসহ ১৯ জন আহত হয়। বিভিন্ন জাতীয় দৈনিকে এ খবর প্রকাশিত হয়েছে। তাদেরও যুক্তি একটাই। উত্তরাধিকার সম্পত্তিতে নারীর ভাগ কোরানবিরোধী। তাই মেনে নেয়া যায় না নারী উন্নয়ন নীতি।
৮ মার্চ আর্ন্তজাতিক নারী দিবসকে সামনে রেখে ৭ মার্চ ১৯৯৭ সালের নারী উন্নয়ন নীতির মোড়কে নতুন যে নারী উন্নয়ন নীতির খসড়া অনুমোদন করা হয় মন্ত্রিপরিষদে, অনুমোদন শেষে প্রধানমন্ত্রীর প্রেস সচিব সাংবাদিকদের যে তথ্য জানান; খবরের কাগজে প্রকাশিত সংবাদে তা ছিল এমন: প্রস্তাবিত নারী উন্নয়ন নীতিমালায় উত্তরাধিকার সম্পদে নারী-পুরুষের সমান অধিকারের কথা বলা হয়েছে|
নারী উন্নয়ন নীতির খসড়া যাদের কাছে আছে, তারা একটুখানি উল্টে পাল্টে দেখলেই বুঝবেন, সংবাদ মাধ্যমের মধ্য দিয়ে কীরকম প্রতারণাময় তথ্য পরিবেশন করেছে সরকার, যার প্রধান একজন নারী এবং সেটা খোদ আন্তর্জাতিক নারী দিবস উপলক্ষ্যেই। তিনটি ভাগে বিভক্ত মোট ৪৯ দফার কোথাও উত্তরাধিকার সম্পত্তিতে নারীর অধিকার কী হবে, তা নিয়ে একটি অর্ধ বা সম্পূর্ণ বাক্য, কিছুই নেই। দুটি জায়গায় এর সাথে সম্পর্কিত কিছু কথা বলা আছে। একটি, জাতীয় অর্থনীতির সকল কর্মকাণ্ডে নারীর সক্রিয় ও সমঅধিকার নিশ্চিতকরণ সাব-হেড এ ২৩.৫ ধারায় বলা আছে:
সম্পদ, কর্মসংস্থান, বাজার ও ব্যবসায় নারীকে সমান সুযোগ ও অংশীদারিত্ব দেয়া।
নারীর অর্থনৈতিক ক্ষমতায়ন শিরোনামের আরেক সাব-হেড এর ২৫.২ ধারায় বলা হয়েছে:
উপার্জন, উত্তরাধিকার, ঋণ, ভূমি এবং বাজার ব্যবস্থাপনার মাধ্যমে অর্জিত সম্পদের ক্ষেত্রে নারীর পূর্ণ নিয়ন্ত্রণের অধিকার প্রদান করা।
তাহলে, উত্তরাধিকার সম্পত্তিতে নারীর সমঅধিকার বিষয়ে কোথায় বলা হলো? সরল প্রশ্ন আসতেই পারে, প্রধানমন্ত্রীর প্রেস সচিব, মন্ত্রিপরিষদ বৈঠক শেষে উত্তরাধিকার সম্পদে নারী-পুরুষের সমান অধিকারের বয়ানটি কিসের ভিত্তিতে দিলেন?
নারীদের প্রতি সরকারের এ প্রতারণা আর মিথ্যাচার আর তাতে ইসলামী দলগুলার লাফ-ঝাপ আসলে কোন উদ্দেশ্যে, কার স্বার্থে? এখানে প্রধান বিরোধীদল বিএনপির অবস্থানটা বলে নেয়া দরকার। পয়লা এপ্রিল জাতীয় তাঁতী দলের আলোচনা সভায় দলটির জ্যেষ্ঠ যুগ্ম মহাসচিব মীর্জা ফখরুল ইসলাম বলেন, হরতালে সমর্থন দেয়ার ব্যাপারে এখনও সিদ্ধান্ত হয় নি, তবে দেশের মানুষের ধর্মীয় মূল্যবোধে আঘাত আসতে পারে এমন কিছু মেনে নেয়া হবে না| অর্থাৎ, বিএনপির অবস্থান আমিনীকে কাগজে কলমে সমর্থন দেয়া নয়, তবে সঙ্গে আছি টাইপের আশ্বস্ত করা।
এবার একটু অন্য কথা বলি। দেশের মধ্যবিত্ত, নিম্নবিত্ত আর উচ্চবিত্ত শ্রেণীর একটা বিশাল সংখ্যক পরিবারে নারী সদস্যরা পরিবারকে আর্থিক সহযোগিতা দিয়ে যাচ্ছে, চাকরি কিংবা মাঝারি ও ক্ষুদ্র শিল্পে কাজ করে। অনেক পরিবার আছে যেখানে ভাইদের চেয়ে বোনেরা পরিবারে বেশি আর্থিক সহযোগিতা দিয়ে যাচ্ছে। অথচ, সম্পদের ভাগাভাগির বেলায়, প্রচলিত ধর্মীয় আইনের কল্যাণে ভাইরা পিতা-মাতার বৃক্ষের তলারটা কুড়িয়ে খাচ্ছেন, উপরেরটা তো খাচ্ছেনই| এটা নারীর প্রতি পুরোমাত্রার প্রবঞ্চণা এবং বাবা-মায়ের ভালোবাসার বৈষম্যমূলক প্রাতিষ্ঠানিক প্রকাশ বলে মনে করি; এটি খুবই অযৌক্তিক এবং অন্যায্য। আমি বেশ কয়েকটি পরিবার চিনি, যেখানে বাবা-মা নিজেরাই আইনজীবীর মাধ্যমে পরিবারের মেয়ে ও ছেলে সন্তানকে সমানভাবে সম্পত্তি ভাগ করে দিচ্ছেন, প্রচলিত আইনের বাইরে গিয়ে। কিন্তু এটা ব্যতিক্রম।
যেখানে নারী উন্নয়ন নীতি ২০১১ তে কোথাও উত্তরাধিকার সম্পত্তিতে নারীর অধিকার নিয়ে কিছুই বলা হয় নি, তারপরও কেন আমিনীদের হরতাল করতে হয়? কারণ, নারীকে মানুষের মর্যাদা দিয়ে ভাবতে এদের ব্যাপক আপত্তি। ভয়ও। ধর্মের দোহাই তুলে নারীর বিরুদ্ধে অবস্থান নেয়াই এদের ধর্ম। ২০০৮ সালে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সময় নারী উন্নয়ন নীতি প্রণয়নের বিরুদ্ধে এই আমিনীরাই জরুরী আইন ভেঙ্গে আন্দোলন করেছিল। তবে ২০০৪ সালে বিএনপি ক্ষমতাসীন সময়ে তারা কিছুই করেনি। কারণ তখনকার নারী নীতি তাদের পছন্দ অনুযায়ীই হয়েছিল। আমিনী বা আল্লামা শফীরা না চাইলেও নারীর ঘরের বাইরে এসে কাজ করাকে আটকিয়ে রাখা সম্ভব হয় নি। ঠেকিয়ে রাখতে পারেনি পোশাক শিল্পে লাখ লাখ নারী শ্রমিকের যুক্ত হওয়াকে, যারা দেশের অর্থনীতির চাকাকে সবচে বেশি সচল রাখছে।
তারপরও পুরুষদের অভিজ্ঞতা থেকে বলি, বেশিরভাগ পুরুষেরই এ অভিজ্ঞতা আছে, শুক্রবার মসজিদে খুতবার সময় ধর্মের মনগড়া ব্যাখ্যা দিয়ে কীরকম অশ্লীলভাবে নারীকে উপস্থাপন করা হয়। উপস্থাপন করা হয় ইসলামী জীবন-যাপনের নিয়ম ভঙ্গকারী এবং উস্কানিদাতা হিসাবে।
মুফতি আমিনীদের কাছে নারী নীতির মূল আতঙ্ক সম্পদ এবং সমানাধিকার। প্রচলিত ব্যবস্থায় ক্ষমতার চরকি ঘোরানোর মূল যে সম্পদ, এটা তারা খুব পাকাপাকিভাবে জানে, জানে বলেই আতঙ্কিত হয়ে পড়েছেন। তাই কোন ইস্যু না থাকলেও নারী নীতির অজুহাতে তারা মাঠ গরম করবার চেষ্টা করছে। নারী এবং প্রগতিশীলতার বিরুদ্ধে ধর্মকে ব্যবহার করে মাঠে থাকতে সব সময় অভিলাষী মুফতি আমিনীর ময়দান থেকে হারিয়ে যাবার আতঙ্কও আছে। ফলে ইস্যু তৈরি করে আওয়াজ দেয়ারও একটা চেষ্টা এই হরতাল।
খুব আশ্চর্য হতে হয়, ১৯৯৭ সালে জাতীয় নারী উন্নয়ন নীতিতে উত্তরাধিকার সম্পত্তিতে যা বলা হয়েছে, ২০১১তে তা থেকে লাফ দিয়ে সরে এসেছে এখনকার সরকার। তখনো কিন্তু সরকারে এই আওয়ামী লীগই ছিলো। তাতে বলা আছে:
নারীর অর্থনৈতিক ক্ষমতায়নের লক্ষ্যে জরুরী বিষয়াদি যেমন স্বাস্থ্য, শিক্ষা, প্রশিক্ষণ, জীবনব্যাপী শিক্ষা, কারিগরী শিক্ষা, উপার্জনের সুযোগ, উত্তরাধিকার সম্পদ, ঋণ প্রযুক্তি এবং বাজার ব্যবস্থাপনার মাধ্যমে অর্জিত সম্পদসহ ভূমির ওপর অধিকার ইত্যাদির ক্ষেত্রে নারীর পূর্ণ ও সমান সুযোগ এবং নিয়ন্ত্রণের অধিকার দেয়া এবং সেই লক্ষ্যে প্রয়োজনে নতুন আইন প্রণয়ন করতে হবে।
১৩ বছর পর সেই আওয়ামীলীগ ক্ষমতাসীন হবার পর আবার নারী উন্নয়ন নীতি প্রণয়ন করতে গিয়ে, কেন আগের সাহসটুকুও ধরে রাখতে পারলো না? বরং প্রতারণার আশ্রয় নিলো।
সাদাচোখে বলতে গেলে, আওয়ামী লীগ নারীকে মর্যাদাবান মানুষ হিসেবে ভাবার নৈতিক জায়গা রাখে কি? নারীর স্বাধীনতার সাথে ইসলাম ধর্মের অবস্থান সাংঘর্ষিক বলেই মত অনেকের। এমনকি সংবিধানে যে নারী-পুরুষের সমান অধিকারের কথা বলা আছে, সেটাও কোরান অনুযায়ী সাংঘর্ষিক বলা হয়ে থাকে। এই 'সাংঘর্ষিক' অবস্থানের একটা সমাধান সংবিধান সংশোধনের উদ্যোগে বার বার উচ্চারিত হয়েছে- বাহাত্তরের সংবিধানে ফিরে গিয়ে সেক্যুলার রাষ্ট্র গঠনের কথা। কিন্তু যে আওয়ামীলীগ ১.তাদের দলীয় ব্যানারে আল্লাহ সর্বশক্তিমান লিখে, ২. সংবিধান সংশোধনে বিশেষ সংসদীয় কমিটি মতামত দেয়, বিসমিল্লাহ হির রাহমানির রাহিম থাকবে এবং ধর্ম নিরপেক্ষ সমাজ ব্যবস্থা হবে- সেই আওয়ামী লীগ নারীর জন্য মর্যাদাবান জীবন কাঠামোর রূপরেখা নামক নারী উন্নয়ন নীতি কী করে তৈরি করবে?
এই প্রকাশ্য স্ববিরোধিতাকারী সরকার ব্যবস্থাপনার পক্ষেই সম্ভব উত্তরাধিকার সম্পত্তিতে নারীর জন্য কোন ঘোষণা না রেখেই গণমাধ্যমে তা ছড়িয়ে দেয়া। আর এ কথা ছড়িয়ে দিয়ে আমিনীকে মাঠ গরম করার সুযোগ আওয়ামীলীগ প্রধান এবং প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা নিজেই করে দিয়েছেন।
খুবই আশ্চর্যের বিষয়, গত ১০ বছর ধরে শুধু নারী উন্নয়ন নীতি নামক এক তকমা শুনেই যাচ্ছি, গণমাধ্যমের কর্মী হিসেবে। আর বরাবরই সেটা খসড়া। এটা চুড়ান্ত কখনোই হবে না মনে হচ্ছে। কারণ, তাতে আমিনীদের রাজনীতি বন্ধ হয়ে যায়। আমিনীদের রাজনীতি বন্ধ হওয়াটা যেমন শেখ হাসিনা চান না, খালেদা জিয়া তো ননই।
ক্ষমতাসীনদের কাছে নারী বরাবরই কবি জসিমউদ্দিনের সোজন বাদিয়ার ঘাট কবিতার দুলী চরিত্রের মতোই। এদের দেখন এবং বলন ভঙ্গীতে নারীর প্রতি এরকম এক অনুভূতিই কাজ করে:
না না দুলী কাঁদিবে না আর/ নারী সে যে অসহায়
মন যে তাহার খেলার পুতুল সমাজের চোখে হায়
ক্ষমতাসীনরা এরকম সেনসেশন তৈরি করে তাতে ঝিম পাড়তে পছন্দ করেন। খসড়া করে সোমবারের বৈঠকে নারী প্রধানমন্ত্রী তার অনুমোদন দেন। বাইরে এসে গণমাধ্যমকে তার প্রেস সচিব যা নাই, তা বলে আমিনীকে মাঠ গরম করার 'ইঙ্গিতময়' প্রস্তাবনা দেন। ধর্মীয় বিধিমালা থেকে বেরিয়ে এসে যতদিন পর্যন্ত না স্বতন্ত্র নীতিমালা এবং আইন প্রণয়ন হবে নারীর জন্য, ততদিন এসব হাসিনা-আমিনী-খালেদা খেলা চলতেই থাকবে।
শামীমা বিনতে রহমান: লেখক ও সাংবাদিক।