Published : 17 Jan 2015, 11:16 AM
''৯ ডিসেম্বর, ১৯৭১। সারা দেশেই সম্মুখযুদ্ধ চলছে। ইন্ডিয়ান আর্মি যুক্ত হয়েছে মুক্তিযোদ্ধাদের সঙ্গে। সম্মিলিতভাবে এক একটি এলাকা মুক্ত করছেন তারা। ফেনীর ছাগলনাইয়া আক্রমণ করে মুক্ত করতে হবে। কয়েক দিন ধরেই ক্যাম্পে চলে আমাদের পরিকল্পনা। আমরা পাঁচশ'র ওপরে মুক্তিযোদ্ধা। পেছনে ভারতীয় আর্মি। কমান্ডে ২নং সেক্টরের সাব সেক্টর কমান্ডর জাফর ইমাম সাহেব। আমরা যুদ্ধ করেছি সরাসরি তাঁর কমান্ডেই।
ভারতীয় সীমান্ত পার হয়ে রাতেই আমরা পজিশন নিই ছাগলনাইয়ার চারপাশে। ফজরের পর কমান্ডার বললেন, 'অ্যাডভান্স'। আমরা সামনে এগোই। একটি এসএলআর ছিল আমার কাছে। পাকিস্তানি সেনারা তখন আমাদের ওপর আর্টিলারি ছোঁড়ে। আমরা যার যার পজিশনে। কিন্তু আর্টিলারি আমাদের কোনো ক্ষতি করতে পারল না। আমরা ক্রলিং করে সামনে এগোই।
থেমে থেমেই গুলি চলছিল। পাকিস্তানি সেনাদের অবস্থান ছিল একটু উঁচু জায়গায়। আমরা ধানক্ষেতের আইল ধরে ওদের একশ' গজ সামনে চলে আসি। আমাদের অবস্থান ওরা তখনও টের পায়নি। তাই গুলিও বন্ধ। আরও কাছাকাছি গিয়ে সামনাসামানি তাদের মোকাবেলা করব, এমন পরিকল্পনা করেই আইল ধরে এগোতে থাকি। সকাল তখন সাতটার মতো। হঠাৎ ধুম করে একটা শব্দ হল। চোখের সামনে কুণ্ডলি পাকানো ধোঁয়া চারপাশে ছড়িয়ে পড়ল। সঙ্গে সঙ্গে পাকিস্তানি সেনারাও বৃষ্টির মতো আমাদের ওপর গুলি ছুঁড়তে থাকে।
প্রথমে ভেবেছি আর্টিলারি পড়েছে। কিন্তু আসলে পায়ের নিচে বিস্ফোরিত হয়েছে পুঁতে রাখা মাইন। আমি সামনে না পড়ে ছিটকে পড়ি পেছনে। দাঁড়াতে গিয়ে ধপ করে পড়ে গেলাম। ডান পায়ে কোনো বোধ নেই। পায়ের দিকে চোখ পড়তেই আঁতকে উঠি। পায়ের কিছু অংশ উড়ে গেছে। রক্তের সঙ্গে ঝরঝর করে পড়ছে হাড়ের ভেতরের মজ্জাগুলো। পায়ের রগগুলো ঝুলে আছে শেকড়ের মতো!
আমাকে সরিয়ে নিতে ক্রলিং করে এগিয়ে আসে সহযোদ্ধারা। গামছা দিয়ে তারা পা-টা বেঁধে দেয়। অতঃপর আমাকে তুলে নেওয়া হয় নিরাপদ জায়গায়। শরীর তখন হিম হয়ে আসছিল। মনে মৃত্যুভয়। কিন্তু জ্ঞান ছিল তখনও। বাড়িতে রেখে এসেছিলাম স্ত্রী আর আড়াই বছরের মেয়ে শাহনাজকে। চোখের সামনে তাদের মুখ বারবার ভেসে উঠছিল।
বাঁশ কেটে ছালা বেঁধে বেড তৈরি করে নেয় সহযোদ্ধারা। আমাকে তাতে শুইয়ে চার জনে কাঁধে তুলে নিয়ে যায় ক্যাম্পে। আমি চিৎকার করছিলাম। ইনজেকশন দেওয়ার পর আর কিছুই মনে নেই। দুদিন পর চোখ মেলে দেখি আমি পুনা হাসপাতালে। ডান পায়ের হাঁটুর নিচ পর্যন্ত তখন কেটে ফেলা হয়েছে। পায়ে অপারেশন হয় সাত বার। শ্রীমতি ইন্দিরা গান্ধী আমাদের দেখতে হাসপাতালে এসেছিলেন। আমাদের তিনি সম্বোধন করলেন 'বীর' বলে। দেশে ফিরে স্বাভাবিক কাজ করতে পারব এমন কথা বলেও মনোবল বাড়ালেন। পরে পুনা হাসপাতাল থেকে লাগিয়ে দেওয়া হয় কৃত্রিম পা। ওই পা নিয়েই চলছি আজও।''
দেশের স্বাধীনতার জন্য পা হারানোর কথা এভাবেই বলছিলেন যুদ্ধাহত মুক্তিযোদ্ধা আবদুর রহিম।
তাঁর গ্রামের বাড়ি কক্সবাজার জেলার চকরিয়া উপজেলার বহতলী গ্রামে। একবার ঘুর্ণিঝড়ে তাঁদের বাড়িঘর সম্পূর্ণ নিশ্চিহ্ন হয়ে যায়। ফলে তাঁরা বসতি গাড়ের ওই উপজেলারই কোটাখালি গ্রামে। আবদুর রহিমের পিতা আবদুস সোবহান ছিলেন লবন-চাষি, আর মা বিলকিস বেগম সাধারণ গৃহিনী। তিন ভাই ও এক বোনের সংসারে রহিম ছিলেন ভাইদের মধ্যে বড়। এলাকায় কোনো মাদ্রাসা বা স্কুল না থাকায় লেখাপড়া শেখা হয় না তাঁর। বাবার সঙ্গে লবণ চাষে সাহায্য করা আর অবসরে বন্ধুদের সঙ্গে ডুডু (হা-ডু-ডু) খেলেই কাটত সময়টা। তখন বৈশাখ মাসে গ্রামে গ্রামে আয়োজন হত ঐতিহ্যবাহী 'বলি' খেলার। বন্ধুদের সঙ্গে দলবেঁধে বলি খেলা দেখতেন যেতেন রহিম। এই সত্তরের ওপর বয়সেও ছেলেবেলার সে সময়গুলোর কথা ভুলে যাননি।
যুদ্ধাহত মুক্তিযোদ্ধা আবদুর রহিমের খোঁজ আমরা পাই তাঁরই এক সহযোদ্ধার কাছে। ঢাকার টিকাটুলিতে থাকেন তিনি। কে এম দাস লেনে হরদেও গ্লাস ওয়ার্কসের একটি শ্রমিক কলোনিতে। মুক্তিযোদ্ধা কল্যাণ ট্রাস্টের নিজস্ব সম্পত্তি এটি। বস্তি-সদৃশ এই কলোনীর বেহাল দশা আমাদের আবেগতাড়িত করে। দেশের জন্য রক্ত দেওয়া এক মুক্তিযোদ্ধাকে আমরা খুঁজে পাই এখানকারই ছোট্ট এক ঝুপড়ি ঘরে।
অনেকেই তো তখন মুক্তিযুদ্ধে যায়নি, আপনি কেন গেলেন, এভাবে জানতে চাইলে আবদুর রহিম বলেন:
''আমাদের ওখানে ঠাণ্ডা চেয়ারম্যান ছিল মুসলিম লীগে। মুক্তিযুদ্ধ শুরু হলে সে ও তার লোকেরা যোগ দেয় শান্তি কমিটি ও রাজাকার বাহিনীতে। পাকিস্তানি সেনাদের পথঘাট চিনিয়ে দিত তারা। কোন বাড়িতে আক্রমণ করতে হবে তাও নির্ধারণ করে দিত রাজাকাররা। হিন্দুদের বাড়িগুলো তারা জ্বালিয়ে দিচ্ছিল। যুবক ছেলেদের দেখলেই ধরে নিয়ে যেত। তখন গ্রামের অনেক যুবকই ভয়ে যোগ দেয় রাজাকার বাহিনীতে। এসব দেখে আমি ও চাচা নুরুল হুদা গোপনে পরিকল্পনা করি মুক্তিযুদ্ধে যাওয়ার।''
তারপর…
''পরিবারকে না জানিয়ে এক রাতে আমরা বাড়ি ছাড়ি। কাপ্তাইয়ের পাহাড় পেরিয়ে চলে যাই ভারতে। পায়ে হেঁটে পৌঁছুতে সময় লেগেছিল চারদিন। ভারতের হরিনাথে নিই এক মাসের ট্রেনিং। লিলিং, লাইন, স্টেনডিং, আর্মস ক্রেরিং, ফায়ার করা, ক্রলিং, গ্রেনেড চার্জ প্রভৃতি শেখানো হয় টেনিংয়ে। ইন্ডিয়ান আর্মিরসদস্যরা আমাদের খুব আন্তরিকতার সঙ্গে ট্রেনিং করিয়েছিলেন।'
কোথায় কোথায় যুদ্ধ করলেন?
মুক্তিযোদ্ধা রহিমের উত্তর:
''আমরা ছিলাম গেরিলা। সীমান্তের ওপার থেকে এসে চট্টগ্রামের বিভিন্ন এলাকায় প্রথম প্রথম আক্রমণ করতাম। আতঙক তৈরি করেই সরে পড়তাম। আক্রমণের পদ্ধতি ছিল হিট অ্যান্ড রান। শেষে আমরা সম্মুখযুদ্ধে অংশ নিই ছাগলনাইয়াতে।''
মুক্তিযুদ্ধে সাধারণ মানুষের সহযোগিতার কথা উঠতেই তিনি বলেন, ''সাধারণ মানুষ মুক্তিযোদ্ধাদের ভালোবাসত। তারা আশ্রয় দিয়ে, খাবার দিয়ে, তথ্য দিয়ে সাহায্য করত। মুক্তিকামী জনতা না থাকলে এদেশ এত সহজে স্বাধীন হত না।''
আবদুর রহিমের কাছে বঙ্গবন্ধুর ৭ মার্চের ভাষণটিই ছিল স্বাধীনতার স্পষ্ট ঘোষণা। তাঁর ভাষায়, ''বঙ্গবন্ধু বললেন,এবারের সংগ্রাম আমাদের মুক্তির সংগ্রাম, এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম…। আজও ওই ভাষণ শুনলে শরীরের লোমগুলো দাঁড়িয়ে যায়। রক্ত এখনও টলমল করে।''
দেশ স্বাধীন হওয়ার খবরে আপনার অনুভূতি…
প্রশ্ন শুনে এ বীর মুক্তিযোদ্ধা খানিক নিরব থাকেন। নিজেকে ধরে রাখতে পারছিলেন না। কান্নাজড়ানো কণ্ঠে বলেন, ''আমরা তখন পুনা হাসপাতালে। দেশ স্বাধীনের খবর পেয়ে খুব কেঁদেছিলাম। বাঁচমু কিনা জানতাম না। মা, বউ আর ছোট বাচ্চার কথা বারবার মনে হচ্ছিল। পা একটা অচল। তাদের কাছে ফিরতে পারব কিনা তাও জানি না। তবুও আনন্দে বুকটা ভরে যাচ্ছিল। মনে মনে অস্থির ছিলাম, কবে ফিরব নিজের স্বাধীন দেশে!''
এক পা না থাকলেও কারও কাছে হাত পাততে রাজি নন এই মুক্তিযোদ্ধা। তাই স্বাধীনতার পর তিনি কল্যাণ ট্রাস্টের অধীনে টিকিট কাটার কাজ নেন মুন সিনেমা হলে। বেতন ছিল পচাঁত্তর টাকা। তা দিয়েই বহু কষ্টে চালিয়ে নিতেন পরিবার।
মুক্তিযোদ্ধা আবদুর রহিম এক পায়ে একশ' মিটার দৌড়ে অর্জন করেছেন একাধিক পদক। এ প্রসঙ্গে তিনি বলেন:
''ভারতে যখন ছিলাম তখন পুনা হাসপাতালেই কৃত্রিম পা নিয়ে খেলাধুলা করতাম। দেশে ফিরে কল্যাণ ট্রাস্টের পক্ষে বিভিন্ন সময়ে একপায়ে একশ' মিটার দৌড় দিয়ে একাধিক মেডেল ও সম্মাননা পেয়েছি। ১৯৮৯ সালে সরকারিভাবে জাপানের সিউলে অনুষ্ঠিত বিশেষ অলিম্পিকে এদেশ থেকে আমরা পাঁচজন অংশ নিই। এক পায়ে একশো' মিটার দৌড়ে আমরা স্বর্ণপদক অর্জন করি। মন খারাপ হলে আজও দেখি সে সময়কার ছবিগুলো। মনটা তখন ভালো হয়ে যায়।"
কথা উঠে মুক্তিযোদ্ধাদের তালিকা নিয়ে। মুচকি হেসে মুক্তিযোদ্ধা রহিম বলেন, ''এ তালিকা স্বাধীনতার পর পরই হওয়া উচিত ছিল। তখন এগারটি সেক্টরেই ছিল মুক্তিযোদ্ধাদের তথ্য।''
দুঃখ করে তিনি বলেন, ''এখন তো তালিকা বির্তর্কিত হয়েছে নানাভাবে। অমুক্তিযোদ্ধাদের হাতেও চলে এসেছে মুক্তিযোদ্ধার কাগুজে সনদ। তবে বর্তমান সরকার যে উদ্যোগগুলো নিয়েছে তা মুক্তিযোদ্ধাদের জন্য মঙ্গলজনক হবে। আমরা চাই এ তালিকায় কোনো মুক্তিযোদ্ধা নয় এমন কেউ এবং কোনো রাজাকারের নাম না থাকুক।''
চুয়াল্লিশ বছর পরেও মুক্তিযোদ্ধাদের তালিকা কেন বাড়ে, এমন প্রশ্নে আবদুর রহিম বলেন:
''রাজনৈতিক কারণটি বড়। তাছাড়া স্বাধীনতার পর পয়সার লোভে মুক্তিযোদ্ধাদের অনেকে সৎ থাকতে পারেননি। ফলে তাঁদের হাত ধরেই মুক্তিযোদ্ধাদের সংখ্যা বেড়েছে। পা হারিয়ে আমি যেমন মুক্তিযোদ্ধা, তেমনি যুদ্ধ না করেও আরেক জন সনদ নিয়ে মুক্তিযোদ্ধা হয়েছে। আমাদের জন্য এটি লজ্জাজনক। '
মুক্তিযোদ্ধারা এক প্লাটফর্মে থাকলে দেশের জন্য মঙ্গল হত বলে তিনি মনে করেন। তাঁর ভাষায়::
''জামায়াতে ইসলামীরও এখন মুক্তিযোদ্ধা দল আছে! লোভ আর স্বার্থচিন্তা মুক্তিযোদ্ধাদের শেষ করে দিয়েছে। মুক্তিযোদ্ধাদের নানা দলে বিভক্ত হওয়াটা ছিল সবচেয়ে বড় ভুল।''
যুদ্ধাপরাধীদের বিচার প্রসঙ্গে কথা বলেন যুদ্ধাহত আবদুর রহিম। তাঁর মতে, রাজাকারদের বিচার আরও আগেই হওয়া দরকার ছিল। এদের বাঁচিয়ে রাখায় দেশের বারটা বেজেছে। ইতিহাস হয়েছে কলঙ্কিত। দেরিতে হলেও বড় বড় রাজাকারের ফাঁসির রায় শুনছেন এখন। তাতে বুকের ভেতরের কষ্ট কমছে এই মুক্তিযোদ্ধার। রায়গুলো দ্রুত কার্যকর না হওয়া পর্যন্ত দেশে অরাজকতা চলতেই থাকবে বলে মনে করেন তিনি। কারণ, রাজকারদের বিচার হলেও তাদের দোসররা টিকেই আছে।
বঙ্গবন্ধুর সাধারণ ক্ষমার বিষয়টি যুক্তিযুক্ত সিদ্ধান্ত বলেই মনে করেন এই বীর। মুক্তিযুদ্ধের সময় অনেকেই বাধ্য হয়ে শান্তি কমিটিতে যোগ দিয়েছিল। মুসলিম লীগ করতেন, কিন্তু কোনো খারাপ কাজ করেননি, এমন লোকও কম ছিল না। এ ধরনের অপরাধীদের ক্ষমা করাটা সঠিক সিদ্ধান্ত ছিল। কিন্তু যারা হত্যা, ধর্ষণ ও অগ্নিসংযোগের মতো বড় বড় অপরাধ করেছে সেসব রাজাকারকে তো ক্ষমা করা হয়নি ওই সাধারণ ক্ষমার মাধ্যমে।
মুক্তিযোদ্ধা রহিম মনে করেন, বঙ্গবন্ধুর হত্যার পর জিয়াউর রহমানের হাতে দালাল আইন বাতিল ও রাজাকারদের রাজনীতিতে প্রতিষ্ঠা করা ছিল ইতিহাসের লজ্জাজনক অধ্যায়। তাঁর ভাষায়, 'মুক্তিযোদ্ধা জিয়াউর রহমান' রাজাকারদের সঙ্গে বন্ধুত্ব গড়েছেন। তার দলের হাত ধরেই এদেশের মন্ত্রী ও রাষ্ট্রপতি হয় রাজাকার। ফলে মুক্তিযোদ্ধাদের সামনে দিয়েই রাজাকাররা গাড়িতে স্বাধীন দেশের পতাকা উড়িয়েছে। এর চেয়ে দুঃখের, কষ্টের আর কী আছে! এদেশের মানুষকে যখন এরা হত্যা করেছিল তখন কোনো আইন মানেনি। তাই প্রত্যেক রাজাকারেরই ফাঁসি হওয়া উচিত। ''তাহলে স্বাধীন দেশে মরেও শান্তি পেতাম'', বললেন আবদুর রহিম।
যে দেশের জন্য রক্ত দিয়েছিলেন তেমন দেশ কি পেয়েছেন? প্রশ্ন শুনে আবদুর রহিম নিরব থাকেন। অতঃপর দীর্ঘনিঃশ্বাস ছেড়ে উত্তরে বলেন:
'''আমরা চাইছিলাম সোনার বাংলা। দরজা খোলা রেখে ঘুমাব। আমার ঘরে এক কোটি টাকা পড়ে থাকলেও কেউ ধরবে না। এমন দেশের স্বপ্ন দেখেছিলাম। কিন্তু ওই দেশ তো আমরা পাইনি, বাবা। এখন তো ঘরে ঢুকেও মানুষকে মেরে ফেলা হচ্ছে।''
যুদ্ধাপরাধীদের সর্বোচ্চ বিচারের দাবিতে গড়ে ওঠা শাহবাগের গণজাগরণ মঞ্চ প্রসঙ্গে মুক্তিযোদ্ধা আবদুর রহিম তুলে ধরেন নিজের মতামত। তাঁর মতে, পুরনো দোসরদের বিরুদ্ধে এ প্রজন্ম আরেকটি মুক্তিযুদ্ধ করছে। আমরা যা পারিনি তারা তা করে ইতিহাসে জায়গা করে নিয়েছে। তাই তাদের মাথার ওপর ছায়ার মতো থাকবে মুক্তিযোদ্ধাদের দোয়া।
যুদ্ধাহত মুক্তিযোদের ভাতা বৃদ্ধিতে সরকারকে ধন্যবাদ জানিয়ে এই মুক্তিযোদ্ধা বলেন:
''দেশের জন্য অঙ্গ দিয়েছি। কিন্তু স্বাধীন দেশে চলতে পারতাম না। আজ ভাতা দিয়েই চলছে পরিবার। এটি না থাকলে পরিবার নিয়ে রাস্তায় থাকতে হত।''
আবদুর রহিম মনে করেন, দুর্নীতি না থাকলে দেশটা আরও এগিয়ে যেত। ছোট ছোট ছেলেমেয়ের যখন মাঠে দাঁড়িয়ে জাতীয় সঙ্গীত গায় তখন মন ভরে যায় তাঁর।
স্বাধীন দেশে খারাপ লাগা জানতে চাইলে তিনি নিশ্চুপ থাকেন। অতঃপর বলেন, ''দুর্নীতি খেয়ে ফেলেছে গোটা দেশটা। রাজনৈতিক দলগুলো হানাহানিতে ব্যস্ত। মুক্তিযুদ্ধের সময়ও আমরা ট্রেন ও বাসে কখনও আগুন দিইনি। এখন সাধারণ মানুষকেই আগুনে পোড়ানো হচ্ছে। এসব দেখলে কষ্ট লাগে। মানুষ তো এখন অমানুষ হয়ে গেছে।"
তাই তিনি মনে করেন, জনগণ সচেতন ও ভালো হলেই দেশ ভালো হবে। দেশের রাজনীতিবিদ গুটিকয়েক। জনগণের সংখ্যাই বেশি। তাই তাদের সচেতনতা দরকার।
নানা সমস্যা অতিক্রম করে এ দেশ একদিন অনেক উন্নত হবে, এমনটাই স্বপ্ন দেখেন যুদ্ধাহত মুক্তিযোদ্ধা আবদুর রহিম। পরবর্তী প্রজম্মের কথা উঠতেই আশায় বুক বাঁধেন তিনি। চোখেমুখে আলো ছড়িয়ে তাদের উদ্দেশে তিনি বলেন:
''তোমরা লেখাপড়া করে সত্যিকারের মানুষ হও। নিজেদের মধ্যে হানাহানি কর না। সবাই মিলে দেশটাকে এগিয়ে নিও। মনে রেখ অনেক কষ্ট, ত্যাগ আর রক্তের বিনিময়ে আমরা পেয়েছি এই স্বাধীন দেশ।''
সংক্ষিপ্ত তথ্য
নাম: যুদ্ধাহত মুক্তিযোদ্ধা আবদুর রহিম।
ট্রেনিং নেন: ভারতের হরিনাথে।
যুদ্ধ করেছেন: ২ নং সেক্টরের সাব-সেক্টরের অধীন প্রথমে চট্টগ্রামের বিভিন্ন এলাকায় এবং পরে ফেনীর ছাগলনাইয়াতে।
যুদ্ধাহত: ৯ ডিসেম্বর, ১৯৭১। ফেনীর ছাগলনাইয়ায় এক সম্মুখযুদ্ধে মাইনের আঘাতে তাঁর ডান পায়ের কিছু অংশ উড়ে যায়। পরে ওই পায়ের হাঁটুর নিচ পর্যন্ত কেটে ফেলা হয়। বর্তমানে তিনি কৃত্রিম পায়ে চলাফেরা করেন।
ছবি: লেখক।
সালেক খোকন: লেখক, গবেষক ও প্রাবন্ধিক।