Published : 20 Dec 2014, 09:02 AM
আমরা আক্রান্ত! আমরা মানে শুধু সাংবাদিকরাই নয়, গোটা রাজ্যের মানুষ ভীষণ সন্ত্রাসে আক্রান্ত। পশ্চিমবঙ্গের মূখ্যমন্ত্রী অহরহ সাংবাদিকদের গ্রেপ্তার করার হুমকি দিচ্ছেন। এ ধরনের অভূতপূর্ব ও নিন্দনীয় ঘটনা এর আগে সারা দেশে কখনও দেখা যায়নি। অন্য কোনো দেশে স্বয়ং রাষ্ট্রনায়ক জনসভায় আঙুল তুলে 'অমুক কাগজ পড়বেন না' বা 'তমুক চ্যানেল দেখবেন না' বলে ফতোয়া দেননি। এই ফতোয়ার ভাষা লেখার অযোগ্য। তিনি এক সময়ে বলেছেন, 'পিছন দিক দিয়ে বাম্বু দেব।' জনসভায় তিনি তাঁর নিজস্ব লুম্পেনদের বলেছেন, 'আপনারা শপথ নিন অমুক অমুক কাগজ পড়বেন।' সারদার দয়ায় তাঁর পাঁচটা কাগজ ও চারটে টিভি চ্যানেল আছে। সাড়ে তিন বছরে চিট ফান্ডের টাকায় এগুলি তিনি করেছেন।
তাঁকে নিন্দা জানানোর ভাষা বাঙালিরা হারিয়ে ফেলছেন। মমতা মুখে মাঝে মাঝে আগে বলতেন, হৃদয়ে রবীন্দ্রনাথ, চেতনায় নজরুল। তাঁর ভাষা ও কীর্তিকলাপ দেখে রবীন্দ্রনাথ-নজরুল-জীবনানন্দ নিশ্চয়ই আঁতকে উঠতেন। কেন তিনি এমন করছেন? তাহলে কি তাঁর মানসিক কোনো গোলমাল দেখা দিয়েছে?
প্রশ্নটি গোটা রাজ্যের বাঙালি সমাজ করছেন। তাঁদের মনে বারবার প্রশ্ন দেখা দিয়েছে, তিনি কি ভোটের জন্য এই সন্ত্রাস সৃষ্টি করছেন? যুগ যুগ ধরে পশ্চিমবঙ্গের বাঙালিরা যে ভাষা ও সংস্কৃতির ওপর দাঁড়িয়ে নিজদের পরিচয় তৈরি করেছেন, তাঁরা আজ বিভ্রান্ত। দীর্ঘ সাংবাদিক জীবনে পশ্চিমবঙ্গ তো বটেই, ভারতবর্ষের কোনো রাজ্যে এই ধরনের মূখ্যমন্ত্রীর সঙ্গে আমরা পরিচিত নই। বাঙালির দুর্ভাগ্য যে, মমতার মতো একজন আঞ্চলিক দলের নেত্রী গোটা বাংলার মাথা নিচু করে দিয়েছেন।
এর থেকে মুক্তির উপায় কী? এ প্রশ্নই বারবার উঠে আসছে। কেন আমরা আক্রান্ত হব? যে জনগণের দ্বারা তিনি নির্বাচিত হয়েছিলেন জনস্বার্থে কাজ করার জন্য, তা না করে সেই জনগণকেই তিনি ঠেলে দিয়েছেন চরম অনিশ্চয়তা ও সন্ত্রাসের মুখে। ভারতবর্ষে এখন জরুরি অবস্থা নেই। সাতের দশকের মাঝামাঝি জরুরি অবস্থার সময় সংবাদের ওপর নিয়ন্ত্রণ চালু হলেও কোনো জনসভায় নেতারা বলতেন না, এর লেখা পড়বেন না। একে গ্রেপ্তার করুন। এ ঘটনা কল্পনাতীত। আসলে তিনি কী চান?
একদিকে তিনি বর্ধমান কাণ্ডে জড়িতদের সমর্থন করছেন। সে কথা যাতে প্রকাশ্যে না আসে সে জন্যে সংবাদপত্রকে চাপে রাখতে চাইছেন। সমাজের নিচু তলায় কু-কথার স্রোত যে বিপরীতমুখী দশায় বইয়ে দেওয়ার চেষ্টা হবে, তা পরিবর্তনের আগে এই প্রতিবেদক অন্তত বুঝতে পারেনি। স্বয়ং মূখ্যমন্ত্রী যে ভাষা এবং অঙ্গভঙ্গি জনসভায় তুলে ধরতে শুরু করেছেন তা নিঃসন্দেহে উদ্বেগজনক একটা প্রবণতা। আন্ডারওয়ার্ল্ডের ভাষা তিনি তুলে এনেছেন রাজনৈতিক মহলে।
তার সঙ্গে পাল্লা দিয়ে গালিগালাজ চালিয়ে যাচ্ছেন দলের বাছা বাছা কয়েকজন সাংসদ। তাপস পাল এবং কল্যাণ ব্যানার্জির মুখনিঃসৃত হুমকি জাতীয় স্তরে আলোচনার বিষয়বস্তু হয়ে উঠেছে। তাঁদের শাস্তি হওয়া তো দূরের কথা, দলনেত্রীর কাছে তাঁদের 'নম্বর' বেড়েছে। মূখ্যমন্ত্রী নিরব থেকে বুঝিয়ে দিচ্ছেন, দলীয় নেতাকর্মীরা প্রয়োজনে গালাগালির বন্যা বইয়ে দিলেও তাঁর কোনো আপত্তি নেই।
এসব মেনে নিলেও মূখ্যমন্ত্রীর মুখে অশালীন ভাষা ও কুৎসিত অঙ্গভঙ্গি বঙ্গবাসী কিছুতেই বরদাস্ত করতে পারছেন না। মূখ্যমন্ত্রী শুধু কোনো দল বা গোষ্ঠীর নেত্রী নন। তিনি রাজ্যেরও নেত্রী, রাজ্যবাসীর নেত্রী। যাঁরা মমতা বন্দোপাধ্যায়কে ভোট দেননি, তিনি সেই জনগোষ্ঠীরও প্রশাসনিক নেত্রী। সর্বভারতীয় স্তরে রাজ্যবাসীর প্রতিনিধিত্ব করেন তিনিই। তাঁর কর্মকাণ্ডে পশ্চিমবঙ্গবাসী নিশ্চিত হয়ে গেছেন, রাজ্যের নেত্রী হিসেবে দায়িত্ব পালনে তিনি অক্ষম। রাজ্যের মূখ্যমন্ত্রী নিজেই রাজ্যকে গোটা দেশের সামনে হাস্যস্পদ করে তুলেছেন।
অন্যান্য রাজ্যের বাসিন্দারা মুচকি হেসে প্রশ্ন করতে শুরু করেছেন, যে সংস্কৃতি নিয়ে বাংলার গর্বের শেষ ছিল না, সেই সংস্কৃতির হলটা কী? মমতারও অর্থের দম্ভেই কি এই ভাষা? পরিস্থিতি সামলাতে না পেরেই এই মতিভ্রম? নাকি এটাই হলেন আসল মমতা। যাঁর মুখটা এতদিন প্রতিবাদী অগ্নিকন্যার মুখোশে ঢাকা ছিল?
উত্তর যাই হোক না কেন, জবাব দেওয়ার জন্য প্রস্তুত রাজ্যবাসী। প্রস্তুত সংবাদ মাধ্যমও। তবে মমতা নিশ্চিন্ত থাকতে পারেন, প্রতিবাদের ভাষায় কোনো স্খলন হবে না। সুস্পষ্ট, সুভদ্র এবং সুনির্দিষ্ট ভাষায় তাঁকে বুঝিয়ে দেওয়া হবে 'পরিবর্তন' সততই 'পরিবর্তনশীল'।
নির্ধারিত সময় ২০১৬ এর মে মাস। পশ্চিমবঙ্গ বিধানসভার বর্তমান মেয়াদ ওই মাসেই শেষ হবে। কিন্তু শুধু রাজ্যেই নয়, গোটা ভারতবর্ষে প্রশ্ন উঠেছে মমতার নেতৃত্বে তৃণমূল সরকার ওই সময় পর্যন্ত টিকবে তো? না তার আগেই নির্বাচন হবে? নির্বাচন কীভাবে হবে সে প্রসঙ্গে কয়েকটি প্রশ্ন উঠেছে। আকাশ-ছোঁয়া দুর্নীতির চাপের মুখে মমতা নিজেই কি বিধানসভা ভেঙে দিয়ে আগাম নির্বাচনে যাবেন? নাকি পরিস্থিতি তাঁকে বাধ্য করবে রাষ্ট্রপতি শাসন জারি করতে?
পশ্চিমবঙ্গে বর্তমানে পুরোপুরি নৈরাজ্য এবং জঙ্গলের শাসন চলছে। তা থেকে রাজ্যবাসী মুক্তি চাইছেন। রাজনৈতিক বিশেষজ্ঞরা ভাবছেন, এই মুক্তি কে বা কারা দিতে পারে, বিজেপি, বামদল না কংগ্রেস। এ ব্যাপারে যে চর্চা গোটা রাজ্যে দার্জিলিং থেকে দীঘা পর্যন্ত শোনা যাচ্ছে তাতে কেউ বিস্মিত নন। কারণ, কী রাজনৈতিক মহল কী ব্যবসায়ী কী শিক্ষামহল– সর্বত্র একটা অসন্তোষের ঢেউ বয়ে চলেছে। আওয়াজ উঠেছে তৃণমূল থেকে– পরিবর্তন চাই। বিষয়টি যদিও খুবই জটিল। আর তাতে ইন্ধন জুগিয়ে গেছেন বিজেপির সর্বভারতীয় সভাপতি অমিত শাহ। তাঁর ভাষায়– দুর্নীতিগ্রস্ত মমতা ও তাঁর দলকে পশ্চিমঙ্গ থেকে 'ছুড়ে ফেলে দিন।'
অবশ্য মমতার রাজনীতি নিয়ে যাঁরা দীর্ঘদিন ধরে পরিচিতি, তাঁদের মতে, মমতা ক্ষমতার পূর্ণ সময় কোথাও থাকেননি। যেমন, '৯৮ সালে তিনি কংগ্রেস ছেড়ে দেন। '৯৯ সালে তিনি অটলবিহারী বাজপেয়ীকে ধরে কেন্দ্রে রেলমন্ত্রী হন। ৩ বছরের মাথায় সেই পদ ছেড়ে দেন। এক বছর পর আবার অটলজিকে ধরে তিনি কয়লামন্ত্রী হন। তাও দশ মাস পরে ছেড়ে দেন। এর আগে '৯১ সালে পিভি নাসিমহা রাওয়ের কংগ্রেস মন্ত্রিসভায় জুনিয়র মন্ত্রী ছিলেন। ২ বছরের মাথায় সেই মন্ত্রিসভাও তিনি ছেড়ে দেন। সুতরাং পুরো সময় কাজ করার কোনো রেকর্ড মমতার নেই।
ক্ষমতালোভী, অস্থিরমস্তিষ্ক এবং আগাপাশতলা দুর্নীতিতে ভরা মমতা এখন ধরা পড়ে গেছেন। নাটকের প্রতি তাঁর খুব লোভ। প্রথম জীবনে তিনি অভিনয় করার চেষ্টা করেছিলেন। পারেননি। তাই টালিগঞ্জের কিছু শিল্পী ছাড়া তাঁর বিশেষ কোনো শুভানুধ্যায়ী আছে কিনা তা নিয়েও প্রশ্ন উঠেছে।
মমতার সামনে এখন সবচেয়ে বড় সঙ্কট দেখা দিয়েছে যে, তাঁর এখন কোথাও যাওয়ার নেই। তিনি লেনিনের ভাষায়, এক পা এগোচ্ছেন আর দু'পা পেছোচ্ছেন। তাঁর দলের নেতারা এক এক করে ধরা পড়ছেন। কলকাতায় এসে মমতাকে চ্যালেঞ্জ করে অমিত শাহ বলে গেছেন– মমতা প্রমাণ করে দেখান, সারদা কাণ্ডে তাঁর দলের যে সাংসদ-মন্ত্রীরা ধরা পড়ছে তাঁরা সব ধোয়া তুলসীপাতা। মমতা এ নিয়ে যতই দিনরাত মোদি-অমিতকে গালাগাল দিন না কেন, অমিত শাহের এই চ্যালেঞ্জ তিনি নিতে পারছেন না। এখন জলের মতো স্পষ্ট হয়ে গেছে সারদা কাণ্ডে তৃণমূল কতটা গভীরে ঢুকেছিল। বর্তমানে কেন্দ্রীয় যে সংস্থাগুলি তদন্ত করছে তারা দেখছে একটার পর একটা ঘটনার সঙ্গে তৃণমূল তথা তাদের নেত্রী জড়িত। তাঁর সংসদীয় দল দিল্লিতে যে নাটক করেছে তাতে বাংলার মুখে বিস্তর চুনকালি মাখিয়েছে।
সারদা কাণ্ডসহ বহু কাণ্ডে সরাসরি মমতার নাম এসে যাওয়ায় তিনি এখন আবোল তাবোল বকছেন, যা তাঁর দলের মন্ত্রীরাও মেনে নিতে পারছেন না। সবকিছুই তাঁর নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে গেছে। তার উপরে বর্ধমান কাণ্ড, বাংলাদেশের জামাতের সঙ্গে কোটি কোটি টাকার লেনদেন প্রকাশ হতেই মমতা এখন ষড়যন্ত্রের গল্প ফেঁদেছেন। সবই ষড়যন্ত্র।
বর্তমান পরিস্থিতিতে কেউ যদি ষড়যন্ত্র করে থাকেন তাঁর বিরুদ্ধে, তাহলে সেটা তিনি নিজেই। তাঁর লোভ খুব বেশি। মূখ্যমন্ত্রী হওয়ার এক মাসের মধ্যেই তিনি দেশের প্রধানমন্ত্রী হওয়ার স্বপ্ন দেখতে শুরু করেন। তাঁর এই স্বপ্ন বাস্তবে রূপ দেবার দায়িত্ব নিয়েছিলেন সুদীপ্ত সেন (সারদা) এবং গৌতম কুণ্ডু (রোজভ্যালি।)
সম্প্রতি সিপিআই (এম)-এর মুখপত্র 'গণশক্তি'-তে প্রকাশিত হয়েছে, কালিম্পং-এর ডেলো বাংলোতে দুই চিটফান্ড সংস্থার মালিকের সঙ্গে মমতার বৈঠকের ভিডিও সিবিআই-এর হাতে এসে গেছে। ওই বৈঠকের কথা সিপিআই (এম) নেতা গৌতম দেব দু'বছর আগেই বলেছিলেন। সে রাতে মমতাকে প্রধানমন্ত্রী করার জন্য দুই চিটফান্ড মালিক দশ হাজার কোটি টাকা করে মোট কুড়ি হাজার কোটি টাকা দেবার প্রতিশ্রুতি দেন।
তারপর থেকেই তৃণমূলের একটা অংশ প্রচার করতে শুরু করে দেয় ২০১৪ সালে মমতাই প্রধানমন্ত্রী হচ্ছেন। ওঁদের অঙ্ক ছিল ১৯৯৬ সালের মডেল অনুসরণ করে মমতা প্রধানমন্ত্রী হয়ে যাবেন। সেবার আটজন সাংসদ নিয়ে অবিজেপি বিভিন্ন দল এবং কংগ্রেসে সমর্থন নিয়ে দেবগৌড়া প্রধানমন্ত্রী হয়েছিলেন। এই অঙ্কটা তাঁর মাথায় ঢুকিয়েছিল একটি পশ্চিমি দেশ এবং বাংলাদেশের জামাত নেতারা।
যাই হোক, বর্ধমান কাণ্ড, জামাত-তৃণমূল যোগাযোগ ইত্যাদি নানা অভিযোগ নিয়ে মোদি সরকার মমতাকে যে ছেড়ে দেবে না তার স্পষ্ট ইঙ্গিত দিয়ে একটা সময়ে পেয়েছেন বিরাট রকম উপকার। এক কথায়, কেউ টাকা পেয়েছেন অনেক, সেই সঙ্গে চোখধাঁধানো সরকারি সম্মানও। আবার কেউ কেউ বিপুল রকম পেশাগত সহযোগিতা আর সর্বোপরি সরকারি আনুকুল্য। ফলে, কৃতজ্ঞতা একটা থাকতেই পারে।
এত কিছু সত্ত্বেও, এমনকি তৃণমূল নেত্রীর পরোক্ষ আদেশের পরও, আদৌ জমল না সারদা কাণ্ডে সিবিআই তদন্তের জেরে একের পর এক তৃণমূলী হেভিওয়টের জেলবন্দি হবার প্রতিবাদে তৃণমূল-ঘনিষ্ঠ বুদ্ধিজীবীদের মিছিল। সম্প্রতি কলকাতা শহরের সাংস্কৃতিক প্রাণকেন্দ্র নন্দন থেকে কার্যত ঢিল ছোঁড়া দূরত্বে অ্যাকাডেমি অব ফাইন আর্টস পর্যন্ত মেরে-কেটে শ পাঁচেক মিটার পর্যন্ত মিছিলে হাঁটতে হয়। এলেন না, নয়তো এসেও এক রকম কাঁচুমাচুই রয়ে গেলেন এককালীন পরিবর্তনকামী, তৃণমূল ঘনিষ্ঠ বুদ্ধিজীবীরা। ঝালে-ঝোলে-অম্বলে যেখানে পশ্চিমবঙ্গের মূখ্যমন্ত্রী হাজির, সেখানেই তাঁদের হুজুরে হাজির থাকতে দেখা যায় প্রাণের দায়ে।
অনেক কাঠখড় পুড়িয়ে যাঁদের হাজির করা গেল, টালিগঞ্জ পাড়ার সেইসব সবে-বাজার-জমানো 'স্টারলেট' আর গত তিন বছরে 'ভাঁড়ে মা ভবানী', পশ্চিমবঙ্গের সরকারি তহবিল থেকে অকাতরে টাকা বিলোনো হয়েছে যাঁদের, সেইসব ক্লাব সদস্যদের আগলাতে তৈরি রাখতেই হল পুলিশ বাহিনী। বারবার হুমকি দিতে হল, 'সাংবাদিকরা যেন ভেতরে ঢুকতে না পারে। পুলিশ কই?' আর পুলিশ বাহিনীর সেই হুজুরে হাজির ব্যারিকেড পেরিয়ে যদি-বা কাছে পৌঁছানো গেল মিছিলে পা মেলানো কোনো কোনো সারদা তারকার, কিন্তু মিলল না কুল্লে একটি মাত্র প্রশ্নের জবাব যে, কেন এই মিছিল? কীসের প্রতিবাদে?
মিছিলের হয়ে আহ্বায়ক মহলের কেউ কেউ (তাঁরা কেউ নিজে নিরুপায় তারকা বা সদ্য শিবির বদলানো কবি, কেউ আবার আচমকাই 'হণু' বনে যাওয়া প্রযোজক) অবশ্য জানিয়েছেন, এই প্রতিবাদ নাকি বাংলা ও বাঙালির সম্মানহানি আর রাজ্যের সম্পর্কে কুৎসার বিরুদ্ধে। তাহলে, সেখানেও তো প্রশ্ন: কে করল বাংলা ও বাঙালির এই সম্মানহানি? রাজ্যের বিরুদ্ধে কুৎসাটাই বা করতে গেল কে? কী উদ্দেশ্যে?
স্বভাবতই উত্তর নেই কোনো প্রশ্নেরই। অন্তত মিছিলের কর্মকর্তা আর পদযাত্রীদের কাছে তো নেই-ই। ফলে, কার্যত মুখ না লুকিয়ে আর উপায়ই বা কী!
বাংলা ও বাঙালির অপমানের কথাটা উঠেছে যেহেতু মিছিলের তরফ থেকেই, ফলে প্রশ্নটা রয়েই যাচ্ছে যে, গত তিন-সাড়ে তিন বছর রাজ্যের খুন-জখম-ধর্ষণ-তোলাবাজি-সন্ত্রাসের যে জমানা চলেছে তাতেই কি অপমানিত হচ্ছে না রবীন্দ্রনাথ-বঙ্কিমচন্দ্র-শরৎচন্দ্র-বিভূতিভূষণ- তারাশংকরের বাংলা ও বাঙালি? মমতার সরকারের বিরুদ্ধে একেকটা অভিযোগ উঠছে আর সত্যিই কি মাথা হেঁট হয়ে যাচ্ছে না পশ্চিমবঙ্গ তথা গোটা ভারতের, যার বাসিন্দা হিসেবে এই সেদিনও মাথা উঁচু করে দাঁড়াতে পারত বাঙালি?
একসময় যে বাংলার সাংস্কৃতিক-রাজনৈতিক ভাবনার চালচিত্র নির্মাণ করে গেছেন রামমোহন বিদ্যাসাগর-বিবেকানন্দ থেকে শুরু করে স্যার আশুতোষ-দেশবন্ধু চিত্তরঞ্জন-বিনয়-দীনেশ-সূর্য সেন-ঋষি অরবিন্দ-নেতাজি সুভাষচন্দ্রের মতো ব্যক্তিত্বরা, সেই বাংলার বুকে বিরাজিত এক নির্বাচিত সরকারকে ঘিরেই আজ এই যে দেশদ্রোহী, আন্তর্জাতিক স্তরের সন্ত্রাসবাদীদের নির্বিচারে সহেযাগিতা করার অভিযোগ উঠছে– এটাই কি বাংলা ও বাঙালির সব থেকে বড় অপমান নয়?
ভুলে গেলে চলবে না যে, যে সময়ে আমরা বাস করছি সেই সময়টা বিশ্বায়নের তথা প্রযুক্তিক সময়কাল। এখন যে কোনো তথ্য বা সংবাদের মুহূর্তে সারা বিশ্বে ছড়িয়ে যেতে কোনো বাধা নেই এবং তা যাচ্ছেও। এমতাবস্থায় পশ্চিমবঙ্গের শহরে-গ্রামে-গঞ্জে ছড়িয়ে থাকা ভোট ব্যাংককেই কেবল যেনতেন প্রকারে কবজা করে এই গ্লোবাল লজ্জার হাত থেকে মুক্তি পাওয়া কি সম্ভব?
না, নয়। সম্ভব যে নয় সেটা তাঁর দল তথা মমতা ব্যানার্জিও জানেন। তাঁরা খুব ভালোই জানেন সারদা কাণ্ড থেকে শুরু করে বর্ধমানের সন্ত্রাসবাদী কর্মকাণ্ড নিয়ে আজ দেশে-বিদেশে সর্বত্র জনমানসে তোলপাড় চলছে। আর সেই জন্যেই তাঁরা যেভাবে হোক দম ফেলবার উপায় খুঁজছেন। সিবিআই-এনআইএ-র সাঁড়াশি তদন্ত তাঁদের চারদিক থেকে যত জাপটে ধরছে তত তাঁরা প্রমাণ করে দিচ্ছেন যে, তাঁরা আসলে দিশাহারা, তাঁদের পাশে কেউ নেই– একমাত্র কিছু এখনও-না ধরা-পড়া অপরাধী ছাড়া।
কেন্দ্রে রেলমন্ত্রী থাকাকালীন যাঁদের তিনি কোনো না কোনো উপায়ে অর্থনৈতিক সুরাহা করে দিয়েছেন, এমনকি সেইসব শিল্পী-বিদ্বজ্জনদের একাংশও কিন্তু এই বিপৎকালে পাশ থেকে সরে দাঁড়িয়ে প্রমাণ করে দিলেন বিরূপ বিশ্বে মমতা এবং তাঁর দল এখন একা, একদম নিঃসঙ্গ।
সুখরঞ্জন দাশগুপ্ত: আনন্দবাজার পত্রিকার সাবেক বিশেষ প্রতিনিধি; কলামিস্ট।