Published : 20 Nov 2014, 10:16 PM
বঙ্গবন্ধু হত্যাকাণ্ডের পর জেনারেল জিয়াউর রহমানের আমল পর্যন্ত (১৯৭৫-১৯৮১) সামরিক বাহিনীতে কয়টি অভ্যুত্থান হয়েছিল এবং কতজন নিহত হয়েছিলেন তা জানতে জাতীয় সংসদে প্রশ্ন উত্থাপন করেছিলেন আওয়ামী লীগের সংসদ সদস্য আ খ ম জাহাঙ্গীর হোসেইন। সংসদ কাজে প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয়ের দায়িত্বপ্রাপ্ত স্থানীয় সরকার মন্ত্রী সৈয়দ আশরাফুল ইসলাম লিখিত জবাবে জানিয়েছেন যে, অনেক দিন আগের এসব ঘটনাবলীর তথ্য একত্রীভূত করা সময়সাপেক্ষ ব্যাপার। এ কথা বলে ইতিহাসের ওই অন্ধকার দিকটি এড়িয়েই গেল সরকার। সামরিক বাহিনীতে ঘটে যাওয়া সেই দিনগুলোর সব তথ্য জানার অধিকার রয়েছে জনগণের।
আমরাও দীর্ঘদিন ধরে নানাভাবে সশস্ত্র বাহিনী বিভাগসহ সরকারি নানা প্রতিষ্ঠানের কাছে সামরিক বাহিনীর অভ্যন্তরে ঘটে যাওয়া বিদ্রোহ বা অভ্যুত্থানের বিষয়ে জানতে চেয়ে আনুষ্ঠানিকভাবে কোনো তথ্য পাইনি। সংসদে যখন সরকারি দলের সাংসদও লিখিত প্রশ্ন করে কোনো তথ্য বের করতে পারেনি, আমরা ধরে নিতে পারি যে, সরকার ওইসব বিষয়ে তথ্য প্রকাশে আগ্রহী নয়। হতে পারে সশস্ত্র বাহিনীকে নতুন করে ওইসব ঘটনা মনে করিয়ে দিয়ে সরকার তাদের বিব্রত করতে চায় না।
সংসদে সরকারের তরফ থেকে যদিও বলা হয়েছে, "… ওই সময় কোনো গণতান্ত্রিক সরকার, সংসদ ও জবাবদিহিতা ছিল না; এ কারণে যারা ঘটনার শিকার হয়েছে বা অভিযুক্ত, তার সঠিক পরিসংখ্যান নেই বলে তা দেওয়া সম্ভব নয়। তবে এই সংখ্যা অনেক।''
সরকারের এই বক্তব্য গ্রহণযোগ্য নয়। এর কারণ সশস্ত্র বাহিনীতে ঘটে যাওয়া অভ্যুত্থান, পাল্টা-অভ্যুত্থানে নিহত সামরিক ও বেসামরিক সদস্যদের তালিকা অবশ্যই থাকার কথা। আর সামরিক আদালতের আদেশে যাদের মৃত্যুদণ্ড কার্যকর করা হয়েছিল তাদেরও তালিকা না থাকার কারণ নেই, যদিও বিভিন্ন সময় পরিকল্পিতভাবে কিছু নথিপত্র গায়েব করে দেওয়া হয়েছে। কিছু কিছু তদন্ত প্রতিবেদন পুড়িয়েও ফেলা হয়েছে বলে আমরা জানতে পেরেছি।
বাংলাদেশের সশস্ত্র বাহিনীতে বেশকটি বিদ্রোহ হলেও প্রাণহানির দিক দিয়ে সবচে বড় অভ্যুত্থান চেষ্টা হয়েছিল ১৯৭৭ সালের ২ অক্টোবর। অন্যান্য ছোট বড় অভ্যুত্থানে নিহত বা অভ্যুত্থান-পরবর্তী সামরিক আদালতের বিচারে মৃত্যুদণ্ডের বিষয়টি কমবেশি জানা গেলেও, ১৯৭৭ সালের ২ অক্টোবরের ঘটনা রাখা হয় একেবারে অন্ধকারে। সেদিন বিদ্রোহী সৈনিকরা বিমান বাহিনীর ১১ কর্মকর্তাকে হত্যা করেছিলে। এরপর ৭ অক্টোবর থেকে সামরিক ট্রাইব্যুনালের মাধ্যমে কয়েকশ' সেনা ও বিমান বাহানীর সদস্যকে মৃত্যুদণ্ড দেওয়া হয়েছিল, যা কিনা দণ্ডপ্রাপ্তদের পরিবার-পরিজনকে জানানোই হয়নি।
এ বিষয়ে টানা দু'বছর অনুসন্ধান চালিয়ে ১৯৯৭ সালে দৈনিক 'ভোরের কাগজ'এ আমার কয়েকটি ধারাবাহিক প্রতিবেদন প্রকাশিত হয়। তখনও সশস্ত্র বাহিনী থেকে অনুরোধ করা হয়েছিল যে, প্রতিবেদনগুলো যেন প্রকাশ করা না হয়। সেসব প্রতিবেদনের উপর ভিত্তি করে ২০০৮ সালে 'রহস্যময় অভ্যুত্থান ও গণফাঁসি' নামে আমার লেখা একটি বইও প্রকাশিত হয়েছে, যেখানে প্রহসনের বিচারে শত শত সৈনিকের ফাঁসির তথ্য-প্রমাণ রয়েছে। ১৯৯৭ সাল থেকে এখন পর্যন্ত সামরিক বাহিনীর ভেতরের হত্যাকাণ্ড নিয়ে অনুসন্ধান চালিয়ে যাচ্ছি। আরও বেশকিছু তথ্য-প্রমাণ যোগাড় করতে পারলেও দুঃখজনক হল, সরকারের কাছ থেকে কখনওই কোনোরূপ সহায়তা পাওয়া যায়নি।
সবগুলো অভ্যুত্থান-চেষ্টাই হয়েছে জেনারেল জিয়ার শাসনামলে এবং মূলত জেনারেল জিয়ারই বিরুদ্ধে। তিনি অভ্যুত্থানগুলো দমন করেছেন খুবই নিষ্ঠুরভাবে। তাই বিএনপির শাসনামলে সরকারের কাছ থেকে কোনো তথ্য পাওয়া যাবে এমন আশা করা বৃথা। ১৯৯৬ সালে যখন আওয়ামী লীগ একুশ বছর পর ক্ষমতায় এল, তখন আশান্বিত হয়েছিলাম যে, এবার বুঝি সামরিক বাহিনীর ইতিহাসের অন্ধকার অধ্যায়টি জানা যাবে। নানাভাবে চেষ্টা করেও যখন সরকারের কাছ থেকে তথ্য পাওয়া যাচ্ছিল না, তখন দ্বারস্থ হয়েছিলাম কয়েকজন সাংসদের। এরা প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয় সংক্রান্ত সংসদীয় স্থায়ী কমিটির সদস্য ছিলেন। ওই কমিটির বৈঠকে সামরিক অভ্যুত্থান নিয়ে বেশ কয়েকবার আলোচনা করেছিলেন তারা। এক পর্যায়ে স্থায়ী কমিটি বিভিন্ন সেনা অভ্যুত্থান নিয়ে বিস্তারিত প্রতিবেদন তৈরির জন্য সাংসদ কর্নেল (অবসরপ্রাপ্ত) শওকত আলীকে প্রধান করে একটি সাব-কমিটি গঠন করে দিয়েছিল।
সংসদীয় স্থায়ী কমিটি বেশ কয়েকটি বৈঠকে সামরিক অভ্যুত্থান নিয়ে আলোচনা করেছে। তবে সেই আলোচনা বেশিদূর এগুতে পারেনি। কমিটির কার্যবিবরণী ঘেঁটে দেখা যায় যে, স্থায়ী কমিটির ২৬তম বৈঠকে প্রাসঙ্গিকক্রমে তৎকালীন সেনাপ্রধান লেফটেন্যান্ট জেনারেল মুস্তাফিজুর রহমান জানিয়েছিলেন, ১৯৭৫ থেকে ১৯৭৭ পর্যন্ত সময়ে সশস্ত্র বাহিনীর ৪ শ' থেকে ৫শ' সদস্যকে ফাঁসি দেওয়া হয়েছে।
২০০০ সালের ডিসেম্বরের ৪ তারিখের ২৭তম বৈঠকের কার্যবিবরণীতে দেখা যায় যে, কমিটির সভাপতি আওয়ামী লীগের সাংসদ মেজর জেনারেল কেএম সফিউল্লাহ ১৯৭৭ সালের ২ অক্টোবরের ঘটনার সঙ্গে সেনা ও বিমান বাহিনীর সদস্যদের বিচারকার্যের ওপর আলোচনার আহ্বান জানালে, সেনাপ্রধান লেফটেন্যান্ট জেনারেল মুস্তাফিজুর রহমান জানান, আলোচ্য সময়ে ঢাকা, বগুড়া ও অন্যান্য ক্যান্টনমেন্টে বিদ্রোহের প্রেক্ষিতে, তৎকালীন সেনাপ্রধান কর্তৃক 'কোর্ট অব ইনকোয়ারি' করা হয়। ইনকোয়ারির পর একাধিক মার্শাল ল' ট্রাইব্যুনালের মাধ্যম জড়িত ব্যক্তিদের বিভিন্ন ধরনের শাস্তি প্রদান করা হয়েছে।
বৈঠকে বিমান বাহিনীর প্রধান এয়ার মার্শাল জামাল উদ্দিন আহমেদ জানান, যে সকল বিমান বাহিনীর সদস্য বিদ্রোহে জড়িত ছিলেন তাদের বেশিরভাগেরই মিলিটারি ট্রাইব্যুনালে এবং বাকিদের বিমান বাহিনীর ট্রাইব্যুনালে বিচার হয়েছিল। বিদ্রোহের সঙ্গে জড়িত ৩১৬ জন বিমান সদস্যের মধ্যে মৃত্যুদণ্ডসহ ২৪৭ জনকে বিভিন্ন প্রকারের শাস্তি প্রদান করা হয় এবং ৬৯ জনকে ট্রাইব্যুনাল খালাস প্রদান করে।
২৭তম বৈঠকেই সিদ্ধান্ত হয়েছিল যে, প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয় সেনা অভ্যুত্থানগুলো নিয়ে বিস্তারিত প্রতিবেদন তৈরি করে ২০০০ সালের ১৭ ডিসেম্বরের পরবরর্তী বৈঠকে জমা দিবে। প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয় সংক্রান্ত সংসদীয় স্থায়ী কমিটির পরবর্তী বৈঠকটি হয়েছিল ২০০১ সালের ৭ জানুয়ারি। ওই বৈঠকে এই ইস্যু নিয়ে আলোচনা হয়নি। এরপরে কোনো বৈঠকে এসব ইস্যুতে আলোচনায় প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয় কী প্রতিবেদন দিয়েছে তা কোনো কার্যবিবরীতে পাওয়া যায়নি।
বর্তমান বাস্তবতায় অতীতের সেই উদাহরণ টেনে আনছি এই কারণে যে, এখনও সম্ভব সংসদে একটি কমিটি গঠন করে দিয়ে সব সামরিক অভ্যুত্থানে জড়িত ব্যক্তি, কারা দোষী, কারা ক্ষতিগ্রস্ত এবং সামরিক আদালতের মাধ্যমে যথাযথ প্রক্রিয়ায় দণ্ড দেওয়া হয়েছিল কিনা তা খতিয়ে দেখা। সরকারি দলের সাংসদ আ খ ম জাহাঙ্গীর হোসেইনের প্রশ্নের জবাবে সরকারের পক্ষ থেকে যদিও বলা হয়েছে, "ওই সময়কালে নৌ ও বিমান বাহিনীতে কোনো অভ্যুত্থান হয়নি। তবে ১৯৭৫ সালের ৩ নভেম্বর নৌবাহিনী ও ১৯৭৭ সালের ২ অক্টোবর বিমান বাহিনীতে স্থানীয় বিদ্রোহ হয়। সেনাবাহিনীর অভ্যুত্থানে বেশ কিছু ব্যক্তিবর্গের প্রাণ বিসর্জন দিতে হয়েছিল। … সঠিক পরিসংখ্যান নেই বলে তা দেওয়া সম্ভব নয়।''
সরকারের এই্ বক্তব্যও যে ঠিক নয় তা প্রমাণ করে সপ্তম সংসদের প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয় সংক্রান্ত স্থায়ী কমিটি। কারণ তৎকালীন বিমান বাহিনী প্রধান তো স্থায়ী কমিটিকে জানিয়েছিলেন যে, ১৯৭৭ সালে বিদ্রোহের সঙ্গে জড়িতদের মধ্যে মৃত্যুদণ্ডসহ ২৪৭ জনকে বিভিন্ন ধরনের শাস্তি দেওয়ার তথ্য তাদের কাছে রয়েছে (যদিও এই সংখ্য নিয়ে বিতর্ক রয়েছে)। ঠিক তেমনিভাবে, স্থায়ী কমিটি সব বাহিনী প্রধানকে ডেকে বা প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয়কে নির্দেশ দিতে পারে সবগুলো সামরিক অভ্যুত্থানের বিস্তারিত প্রতিবেদন জমা দেবার জন্য। যে ধরনের নির্দেশ সপ্তম সংসদের প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয় সংক্রান্ত স্থায়ী কমিটি ২০০০ সালের ৪ ডিসেম্বর দিয়েছিল।
বর্তমান সংসদে প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয় সংক্রান্ত স্থায়ী কমিটি ছাড়াও স্পিকার একটি বিশেষ কমিটি গঠন করে দিতে পারেন যার কাজ হবে ১৯৭৫ থেকে ১৯৮২ সাল পর্যন্ত সব সামরিক অভ্যুত্থানের তথ্য যোগাড় করে বিস্তারিত প্রতিবেদন তৈরি করে সংসদে পেশ করা। ওই কমিটি ক্ষতিগ্রস্তদের ক্ষতিপূরণেরও সুপারিশ করতে পারে। আসলে সামরিক ট্রাইব্যুনালে যে প্রহসনের বিচারে কয়েকশ' সৈনিককে হত্যা করা হয়েছে, বিচারের কার্যক্রম পর্যবেক্ষণ করলে যে কোনো বিবেকবান মানুষই সেটি বুঝতে পারবেন।
দেশের ইতিহাসে গুরুত্বপূর্ণ এ বিষয় সম্পর্কে জনগণের জানার অধিকার রয়েছে। এই বিষয়ে ব্যাপক অনুসন্ধান ও গবেষণা প্রয়োজন। এজন্য এ ধরনের ঘটনার সকল তথ্যই প্রকাশ করা উচিত। কালো অধ্যায় থেকে বের হয়ে আসার জন্য সশস্ত্র বাহিনীর অভ্যন্তরের নৃশংসতা তুলে ধরতে কোনো না কোনো উদ্যোগ দরকার। ইতিহাসের সত্য উদঘাটনের জন্য সবচেয়ে বেশি গুরুত্বপূর্ণ যে দুটি বিষয়, তা হল দলিল-দস্তাবেজ আর ঘটনার সময় বা ঘটনার সঙ্গে সংশ্লিষ্টদের বক্তব্য। দলিল-দস্তাবেজ কিছু নষ্ট করা হয়ে থাকতে পারে। ঘটনার সাক্ষী ও জড়িতদের অনেকে মারাও গেছেন। তারপরেও যারা বেঁচে আছেন তাদের বক্তব্য নিয়ে এবং আর যতটুকু দালিলিক প্রমাণ অবশিষ্ট আছে তার সংমিশ্রণে বের হয়ে আসতে পারে ইতিহাসের অন্ধকার দিকটি।
গত প্রায় চার দশক, অর্থাৎ পঁয়ত্রিশ থেকে চল্লিশ বছর ধরে একটি প্রশ্ন জ্বলন্ত হয়ে রয়েছে– ১৯৭৫ থেকে ১৯৮১ সাল পর্যন্ত দেশের সামরিক ছাউনিগুলোতে কী পরিমাণ রক্তপাত ঘটেছে, কতগুলো অভ্যুত্থান বা অভ্যুত্থান-চেষ্টা হয়েছে বা শত্রু চিহ্নিত করে তাকে 'শেষ' করে দেওয়ার জন্য কতবার ফাঁদ পাতা হয়েছে। সে সময় সামরিক আইনবলে গঠিত কোনো ট্রাইব্যুনালই যে স্বাধীনভাবে বিচার করতে পারেনি সেটা বলার অপেক্ষা রাখে না।
তর্কের খাতিরেও যদি ধরে নিই যে, বিচারের মাধ্যমে শত শত সৈনিককে ফাঁসি দেওয়া হয়েছে (যার তালিকা সারাদেশের কারাগারগুলো থেকে খুঁজে খুঁজে বের করেছি আমরা), কিন্তু তারপরও প্রশ্ন থেকে যায়, কত সেনাসদস্যকে ফায়ারিং স্কোয়াডে হত্যা করা হয়েছিল, কোনো প্রমাণ না রেখে?
কেউ জানে না সেটা।
২০ নভেম্বর, ২০১৪