Published : 21 Sep 2014, 08:17 AM
উত্তরায় সম্প্রতি আঠার বছরের সদ্যতরুণী চিরশ্রী জামান মনমন আর তার পনের বছর বয়সের কিশোর ভাই মোহাম্মদ বিন আলিমের একসঙ্গে আত্মহত্যার ঘটনাটি দেশজুড়ে আলোড়ন তুলেছে। নিদারুণ বেদনাদায়ক এক ঘটনা। আমরা জানি না নির্দিষ্ট কী কারণে এই টিনএজ দুজন আত্মহত্যার সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন। বিষয়টি নিয়ে নানা জন নানা রকম ব্যাখ্যা দিচ্ছেন। উঠে আসছে একাকী মা বা বাবার সংসারে শিশু-কিশোরদের নানা সমস্যার বৈতরণী পার হওয়ার সংগ্রামে বিপর্যস্ত জীবন ও মননের কথাও।
পারিবারিক, সামাজিক এবং অর্থনৈতিক সমস্যা অনেক সময় মানুষকে আত্মহত্যাপ্রবণ করতে পারে। বিশেষ করে, অসহনীয় কোনো সমস্যায় গভীর অসহায়ত্ব ও হতাশা অনেক কিশোর-তরুণের আত্মহননের অন্যতম কারণ হিসেবে কাজ করে। প্রাপ্ত তত্থ্য বলছে, মনমন ও আলীম, ভাই-বোন দুজন আর্থিক অস্বচ্ছল পরিবেশে অনেকটা জনবিচ্ছিন্ন ছিলেন। বিচ্ছিন্নতা (Isolation) কিন্তু মানুষকে বিষাদগ্রস্ত করে যা তাকে আত্মহত্যায় প্ররোচিত করতে পারে। এই কিশোর-কিশোরীর অসহায়ত্ব কতটা ব্যাপক ও গভীর ছিল তা আমরা কখনও জানতে পারব না কিন্তু তাদের পরিস্থিতি থেকে আমাদের অনেক কিছুই শেখার আছে, যা হয়তো এই ধরনের মর্মান্তিক ঘটনার পুনরাবৃত্তি রোধে সহায়ক হতে পারে।
এই টিনএজ দুজনের মা-বাবা প্রায় ছ' বছর যাবত পৃথক জীবনযাপন করছেন। বিচ্ছেদের শুরুতে সন্তানরা প্রথমে কিছুদিন বাবার সঙ্গে ছিলেন। বাবার দ্বিতীয় বিয়ের পর থেকে মায়ের সঙ্গে বসবাস শুরু করেন ওরা। মা-বাবার বিচ্ছেদের সময় মনমনের বয়স ছিল বার; আলিমের নয়। হয়তো বিচ্ছেদের আগে থেকেই মা-বাবার মনোমালিন্য, কলহ শুরু হয়েছিল এবং শুরু থেকেই এর প্রত্যক্ষদর্শী ছিলেন সন্তানরা।
নিঃসন্দেহে, পারিবারিক কলহ-বিবাদ-বিচ্ছেদ দেখে বেড়ে ওঠা বাচ্চারা তীব্র মানসিক কষ্টের মধ্যে থাকে। মনমন-আলীমের জীবনে হয়তো এর ব্যতিক্রম হয়নি। দীর্ঘদিনের যন্ত্রণাদায়ক অভিজ্ঞতা শিশু-কিশোরদের বিষণ্ন করে, যা পরবর্তীতে তাদের মধ্যে আত্মহত্যার প্রবণতা সৃষ্টি করে।
স্বামী-স্ত্রীর বিচ্ছেদ-প্রক্রিয়া সাধারণত তিক্ত হয়। যে তিক্ততার চরম নেতিবাচক প্রভাব পড়ে সন্তানের উপর। অপ্রিয় সত্যি হচ্ছে, অধিকাংশ ক্ষেত্রেই বাবা-মার পরস্পরের বিরুদ্ধে রাগ-ক্ষোভ-ঘৃণার বহিঃপ্রকাশ ঘটে সন্তানের উপর। এক পক্ষ অন্য পক্ষকে নিকৃষ্ট প্রমাণ করতে সন্তানকে নিজের দিকে টানার চেষ্টা করেন। এই টানাপড়েনে সন্তান মানসিকভাবে আহত হয়, মা বা বাবার সমালোচনা তাকে ব্যথিত করে।
হয়তো কোনো শিশু কোনো কারণে মা বা বাবাকে কিছুটা অপছন্দ করে, কিন্তু অন্য কারও কাছ থেকে এ ব্যাপারে সমালোচনা সে গ্রহণ করতে পারে না। এর বাইরে আছেন আত্মীয়-প্রতিবেশি যারা মা বা বাবার পক্ষ বা বিপক্ষ নিয়ে পরিস্থিতি বিচার করেন এবং তা শোনাতে শোনাতে মা-বাবা-সন্তান সকলের জীবন অতীষ্ঠ করে তুলেন।
ঘরে-বাইরের এমন পরিস্থিতি শিশুদের তীব্রভাবে অসহায় করে তুলে। ফলে কলহপূর্ণ বা একাকী মা বা বাবার পরিবারে সন্তানরা এক ধরনের অপরাধবোধে (Guilt) ভুগে। মা-বাবার অশান্তির জন্য নিজেদের দায়ী মনে করে। তাদের মধ্যে উদ্বেগ, দুশ্চিন্তা, পরিত্যক্ত হবার ভয়, শিক্ষায় অমনোযোগ এবং বিচ্ছিন্নতায় ভোগার আশঙ্কা থাকে। দুঃখজনকভাবে আমাদের দেশে মা-বাবার সম্পর্কের জটিলতায় সন্তানের মানসিক স্বাস্থ্যের ব্যাপারটি প্রায়ই উপেক্ষিত হয় এবং এর দীর্ঘমেয়াদী প্রভাব থেকে যায় সন্তানের জীবনে। অসুখী শৈশব সুস্থ সুন্দর ভবিষ্যত ব্যাহত করে।
বলা হয়, সন্তান প্রতিপালন একটা কঠিন কাজ। একাকী মা বা বাবার জন্য তা কঠিনতর দায়িত্ব। একাকী অবস্থায় মা বা বাবা নিজেই মানসিকভাবে বিপর্যন্ত থাকেন। এতে অনেক সময় সন্তানের প্রতি মনোযোগে ব্যাঘাত ঘটতে পারে। অন্যদিকে সন্তানরা চায় মা-বাবার মনোযোগ।
বাস্তবতা হচ্ছে, মা-বাবার কলহ বা বিচ্ছেদ যাই হোক না কেন. অধিকাংশ ক্ষেত্রে সন্তানরা তাদের মা-বাবা দুজনকেই ভালোবাসে, দুজনেরই মনোযোগ আশা করে, দুজনের সঙ্গেই সময় কাটাতে চায়। সন্তান মার সঙ্গে বসবাস করলে বাবাকে এবং বাবার সঙ্গে থাকলে মাকে মিস করে, যা তারা প্রায়ই মুখে প্রকাশ করে না। মা বা বাবার প্রতি কোনো সন্তানের অভিমান থাকলেও, বিচ্ছেদে সে তাকে মিস করে, অন্তত 'একজন' মা বা বাবাকে সে মিস করে। এই ব্যাপারটা মা বা বাবা প্রায়ই অনুধাবন করেন না, অথবা গুরুত্ব দেন না।
একাকী মা বা বাবার পরিবারে, অধিকাংশ ক্ষেত্রে মাকেই সন্তান প্রতিপালনের গুরুদায়িত্ব পালন করতে দেখা যায়। মা-বাবা দুজনেই সন্তানদের ভালোবাসেন কিন্তু দায়িত্ব পালনের ব্যাপারে মা সাধারণত বেশি যত্নশীল। আইনের চোখেও সাধারণত মার কাছে বাচ্চারা বেশি সুরক্ষিত। এসব কারণে একাকী মায়ের সংখ্যা একাকী বাবার তুলনায় অনেক বেশি, সারা বিশ্বেই।
আমাদের দেশে একাকী মা এবং তার সন্তানকে প্রায়ই সহ্য করতে হয় অর্থনৈতিক টানাটানি। এ ক্ষেত্রে বাবার আর্থিক অংশীদারিত্ব এবং রাষ্ট্রীয় সহায়তার অভাব একাকী মাকে অধিক দুর্দশাগ্রস্ত করে। স্বাভাবিকভাবেই এই পরিস্থিতির প্রভাব পড়ে সন্তান প্রতিপালনে। আবার অনেক বাবা শুধু অর্থনৈতিক দায়িত্ব পালন করেই বাবার দায়িত্ব পালন যথেষ্ট মনে করেন।
সন্তান প্রতিপালন শুধুমাত্র অর্থনৈতিক চাহিদা পূরণ নয় বরং আরও অনেক কিছু, বিশেষ করে সন্তানের সঙ্গে সময় কাটানো এবং তাদের কথা শোনা, কথা-আচরণ-দায়িত্ব দিয়ে সন্তানের সঙ্গে আস্থা-ভালোবাসা-স্নেহ-মমতার সম্পর্ক তৈরি করা। মা-বাবার সম্পর্ক অটুট থাকুক আর নাই থাকুক, সন্তান প্রতিপালন এক যৌথ দায়িত্ব (যদি দুজনেই জীবিত থাকেন)। কিন্তু বিচ্ছেদের পর অনেক বাবার মধ্যে এই যৌথ দায়িত্বশীলতা দেখা যায় না।
এছাড়া আছে একাকী মা এবং তার সন্তানের প্রতি সমাজের অমানবিক দৃষ্টিভঙ্গি; যেমন 'ভাঙা পরিবার' নামে চিহ্নিত করাসহ আরও কত নেতিবাচক কথা। এইসব কটূক্তি, অবমাননাকর পরিস্থিতির সঙ্গে মানিয়ে চলা বাচ্চাদের জন্য কঠিন হয়। ফলে তাদের বন্ধুবান্ধবহীন হবার আশঙ্কা থাকে।
'ভাঙা পরিবার' শব্দটিতে আমার বিশেষ আপত্তি। উন্নত বিশ্বে এই শব্দটি শোনা যায় না বরং 'একাকী মা বা বাবার পরিবার' (Single parent family) শব্দটি ব্যবহার করা হয়।
যাহোক, ঘরে-বাইরের এইসব চাপ সামাল দিতে মাকে এক ভয়াবহ কষ্টকর জীবনযাপন করতে হয়। এই মায়ের নিজস্ব জীবন বলে আর কিছু থাকে না। পুরুষতান্ত্রিক সমাজব্যবস্থা একাকী মায়ের এই জীবন সংগ্রামকে সহানুভূতির দৃষ্টিতে দেখে না, যা অন্যায্য। নিজের এবং সন্তানের ভবিষ্যত সুন্দর সফল করার এই সংগ্রামে আমাদের সমাজ কাঠামো তাকে সহায়তা করে না। বরং তথাকথিত আত্মত্যাগ, সঙ্গীহীন জীবনযাপনকে মহিমান্বিত করে পুরুষতান্ত্রিক মূল্যবোধ টিকিয়ে রাখার কূটকৌশল বজায় রাখে।
এই চক্রে পড়ে মা নিজেই ক্লান্ত, বিষণ্ন, অবসাদগ্রস্ত থাকেন। অথচ সন্তান প্রতিপালনের জন্য দরকার দায়িত্বশীল মা বা বাবা, যার শারীরিক ও মানসিক সুস্থতা গুরুত্বপূর্ণ। পুরুষতান্ত্রিক সমাজব্যবস্থা এবং পশ্চাৎপদ শিক্ষাব্যবস্থার কারণে সন্তানরাও মা-বাবার একান্ত পৃথক জীবন মেনে নিতে পারে না, বিশেষ করে মায়ের ক্ষেত্রে। মা-বাবাও সন্তানের সঙ্গে সাধারণত এ বিষয়ে খোলাখুলি আলোচনা করেন না।
অন্যদিকে নারী-পুরুষ বৈষম্যহীন দেশে একজন শিশু প্রথম শ্রেণিতেই শেখে মা-বাবা যুগল পরিবার, একাকী মায়ের বা বাবার পরিবার, মা এবং সৎ বাবার পরিবার, বাবা এবং সৎ মার পরিবার, গে বা লেসবিয়ান পরিবার ইত্যাদি বিষয়ে। উন্নত বিশ্বে এই শিক্ষাটি আছে বলে তা পরিবার বা সম্পর্কের ব্যাপারে শিশুদের মধ্যে গ্রহণযোগ্যতা তৈরি করে এবং অন্যের চাহিদার প্রতি সম্মান, সহনশীলতা ও সহমর্মিতা শেখায়।
শুধুমাত্র মা-বাবার বিচ্ছেদের কারণে সন্তানের আত্মহত্যার ঘটনা ঘটে না। বরং বলা হয় সংঘাতময় যুগল পরিবারের চেয়ে কলহ-দ্বন্দ্বমুক্ত একাকী মা বা বাবার পরিবার সন্তানদের জন্য নিরাপদ। সাধারণত কিশোর-কিশোরীদের মধ্যে আত্মহত্যার প্রবণতা বেশি দেখা যায়; যেমন যুক্তরাজ্যে অধিকাংশ কিশোর-কিশোরীর মৃত্যুর অন্যতম প্রধান কারণ আত্মহত্যা। কারণ এই বয়সী ছেলেমেয়েরা ভালো-মন্দ সব বিষয়ে অধিক মাত্রায় আবেগতাড়িত থাকে এবং আবেগপূর্ণ সিদ্ধান্ত নেয়। এজন্য প্রায় সব মা-বাবার কাছেই কিশোর সন্তান প্রতিপালন চ্যালেঞ্জিং।
উন্নত বিশ্বে মা-বাবার বিচ্ছেদ একটা স্বাভাবিক ঘটনা কিন্তু এজন্য একাকী মা বা বাবার পরিবারকে জটিল সমস্যায় পড়তে হয় না। সেখানে রাষ্ট্র এর দায়িত্বশীলতা নিশ্চিত করে সংশ্লিষ্ট বিষয়ে শিক্ষা ও নানা ধরনের সেবা প্রদানের মাধ্যমে। ফলে একাকী মা বা বাবা ও তার সন্তান মানসিক, সামাজিক ও অর্থনৈতিকভাবে আত্মমর্যাদার সঙ্গে টিকতে পারে।
উদাহরণ হিসেবে বলছি, একাকী মা-বাবাদের জন্য সেসব দেশে আছে বিশেষ ব্যবস্থা; যেমন, বিনামূল্যে বিভিন্ন প্যারেন্টিং কোর্স, দক্ষতা উন্নয়নমূলক কোর্স, টেক্স রেয়াত, আর্থিক সুবিধা, অগ্রাধিকার ভিত্তিতে বাড়ি ইত্যাদি। বিদ্যালয়ে শিশুদের মানসিক অবস্থা প্রশিক্ষিত শিক্ষকদের দৃষ্টি এড়াতে পারে না। মানসিকভাবে বিপন্ন শিশুকে শিক্ষক এবং অন্যান্য পেশাজীবীরা বিশেষ সহায়তা নিশ্চিত করেন এবং নজরদারিতে রাখেন। প্রতিটা স্কুলের সঙ্গে শিক্ষা মনোবিজ্ঞানীরা কাজ করেন যারা হতাশাগ্রস্ত, অমোনযোগী, উদ্বিগ্ন শিক্ষার্থীদের মানসিক সহায়তা দেন। গুরুতর কিছু হলে শিশুদের জন্য বিশেষ মনোচিকিৎসা বিভাগে চিকিৎসার ব্যবস্থা করেন।
এর সবকিছু হয়তো আমাদের গরিব রাষ্ট্রের পক্ষে নিশ্চিত করা সম্ভব নয় কিন্তু সদিচ্ছায় অনেক কিছুই হতে পারে। যেমন, শিক্ষা কারিকুলাম যুগোপযোগী করা, স্কুলে বুলি (bullying) বিরোধী তৎপরতা, একাকী মায়ের ভাতা, চাকুরিতে অগ্রাধিকার, টেক্স রেয়াত, বিনামূল্যে সন্তানের শিক্ষা ইত্যাদি। মনমন এবং আলিমের এই করুণ পরিণতি হয়তো হত না যদি আমাদের শিক্ষা ব্যবস্থা যুগোপযোগী হত এবং রাষ্ট্রের সহায়তা থাকত।
এই অতি দুঃখজনক ঘটনায় নির্দিষ্ট কাউকে দোষারোপ করা অমানবিক; কারণ কোনো মা বা বাবা সন্তানের এ ধরনের করুণ পরিণতি কখনও কল্পনা করেন না। সন্তান হারানোর বেদনা অপূরণীয়। যেভাবেই হোক, অজ্ঞতা বা অসচেতনতায় এমন বিষাদময় ঘটনা হয়তো ঘটেছে। বলা যায়, মনমন ও আলিম একটা জটিল পারিবারিক পরিস্থিতি এবং আমাদের সমাজ কাঠামোর নির্মম বলি। এ ধরনের পরিস্থিতিতে মা-সন্তান সবাই অসহায় বোধ করেন।
রাষ্ট্রের নিষ্ক্রিয়তা এবং প্রয়োজনীয় সহায়তার অভাবে এ ধরনের পরিস্থিতি জটিল থেকে জটিলতর হয় এবং করুণ পরিণতি ডেকে আনে। এই মর্মান্তিক ঘটনায় রাষ্ট্র এর দায় এড়াতে পারে না। বাস্তবতা হচ্ছে, আমাদের সমাজ, সংস্কৃতি ও মূল্যবোধে ব্যাপক পরিবর্তন এসেছে এবং এর প্রভাব পড়েছে আমাদের জীবনযাপনে। এই পরিবর্তনশীলতা গ্রহণযোগ্য করতে আমাদের শিক্ষা ব্যবস্থার হালনাগাদ জরুরি; চাহিদা অনুযায়ী রাষ্ট্রীয় সুযোগ-সুবিধার ব্যবস্থাও সময়ের দাবি।
এসব পদক্ষেপ এখন রাষ্ট্রকেই নিতে হবে।
ড. সীনা আক্তার: প্যারেন্টিং পেশাজীবী।