Published : 12 Dec 2010, 07:18 PM
প্রতি সপ্তাহে পাঁচদিন আমার সন্তানদের স্কুলে পৌঁছে দিতে আমি মিরপুর থেকে ভাষানটেক এলাকা দিয়ে উত্তরায় যাই। এতে শর্টকাট হয়, সময় বাঁচে। খুব একটা যানবাহন চলাচল নেই ঐ এখনো 'পুরোপুরি-চালু-না-হওয়া' সড়কটিতে। প্রভাতের পথে যেতে যেতে যে দৃশ্যটি চোখে পড়ে তা হল – পথটির দু'পাশ ধরে অনেকটা মিছিলের মত গার্মেন্টস শ্রমিকদের কাফরুল ও মিরপুর এলাকায় তাদের কর্মস্থলে যাওয়া। প্রধাণতঃ নারী শ্রমিকদের ঐ মানবজোয়ারে তাদের পোশাক-আশাক দেখে বোঝা যায় মানবেতর জীবন যাপন করছে তারা। তবে দারিদ্রের মাঝেও অভাবনীয় ব্যাপার হল, তাদের প্রায় প্রত্যেকের হাতে মোবাইল ফোন থাকা। মোবাইল ফোন যে কী বিপুলভাবে প্রসারিত হয়েছে তা এদের, যাদের মাসিক আয় তিন হাজার টাকার নিচে, দেখে বোঝা যায়। আর কিছু না থাকুক একটি মোবাইল ফোন তাদের আছে। মোবাইল ফোন, যা ছিল একদা ধনীর স্ট্যাটাস সিম্বল, তা এখন গরীবের পর্ণকুটিরে শোভা পাচ্ছে; কিছুটা হলেও তাকে সমমর্যাদার সুখ দিচ্ছে।
প্রতি ঈদে শক্তিমান চলচ্চিত্রকার আমজাদ হোসেন টিভির জন্য একটি ব্যাঙ্গাত্বক নাটক তৈরি করেন, এটা হচ্ছে 'জব্বার আলীর ঈদ সিরিজ'। নামচরিত্রে অভিনয় করা নাট্যকার এবার দেখালেন 'জব্বার আলীর ময়ূরপঙ্খী' নামে আমিনবাজারের কাছে তুরাগ নদীতে ডুবে যাওয়া সাম্প্রতিক বাস দুর্ঘটনার উপরে একটি নাটক। জব্বার আলীর মেয়ে জবা আমেরিকা থেকে দেশে এসেছে। সে যখন দেখল তাদের বাসার কাজের মেয়েটিরও মোবাইল ফোন আছে, কথা বলছে মোবাইলে, সে ভীষণ অবাক হল। বাংলাদেশ যে এতখানি এগিয়ে গেছে তা তার জানা ছিল না। হানিফ সংকেত তার বিপুল জনপ্রিয় টিভি বিনোদন প্রোগ্রাম 'ইত্যাদি'-তে একবার দেখিয়েছিলেন মাছ কিনতে বাজারে গেছে বাড়ির কাজের লোক, আর মৎস্যবাজার থেকেই সে গৃহকর্ত্রীকে বিভিন্ন মাছের দাম জানিয়ে কর্ত্রীর সিদ্ধান্ত জানার চেষ্টা করছিল। হাস্যকর হলেও এই যোগাযোগের উপযোগিতা অস্বীকার করার উপায় নেই। কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ে সন্তানকে পাঠিয়ে নিরন্তর উদ্বিগ্ন থাকা মা-বাবার জন্য এই ফোন স্বস্তিদায়ক হয়ে এসেছে। প্রিয়জনকে ট্রাকিং করার চমৎকার সুবিধা এনে দিয়েছে মোবাইল ফোন; কবি নির্মলেন্দু গুণ যাকে বলেছেন 'মুঠোফোন'। তিনি আস্ত একটি কাব্য লিখে ফেলেছেন মুঠোফোনে, নাম রেখেছেন 'মুঠোফোনের কাব্য'। সৃজনশীলতা ও সুবিধার পাশাপাশি যন্ত্রটি যন্ত্রনা হয়েও এসেছে মানুষের জীবনে। আগে নিভৃতির যে মাধুর্য ছিল, মানুষের জীবন থেকে তা অপসৃত হতে চলেছে। ইভ টিজিংয়ের উৎপাতে বিরক্ত নারীরা বেছে নিতে বাধ্য হন 'কল ব্লক' অপশন। চাঁদাবাজী আর হুমকী প্রদানের শতকরা পঁচাত্তর ভাগ ঘটনাই ঘটে মোবাইল টেলিফোনে। অপরাধীরা মোবাইল ফোনকে ব্যবহার করছে সংগঠিত হওয়া, অপরাধ সংঘটন এবং পুলিশ এলে নিরাপদে পালিয়ে যাবার মত জঘন্য কাজে ।
বাংলাদেশে প্রথম মোবাইল ফোন নিয়ে আসে সিটিসেল, তখন একটি মোবাইল ফোনসেটের দাম ছিল এক লক্ষ টাকার উপরে। কেবল ধনীরাই তা ব্যবহার করতো বা করতে পারত। বিএনপির ক্ষমতার সাথে ঘনিষ্ঠ এক মন্ত্রী-ব্যবসায়ী তখন একচেটিয়া ব্যবসা করে গেছেন। গ্রামীন ফোনের একটি ভিশন ছিল গ্রামের মানুষদের সংযুক্ত রাখা, তথ্যের সঞ্চালন বাড়ানো ও তাদের অর্থনৈতিক উন্নয়নে একে ব্যবহার করা। প্রথমদিকে উচ্চ কলরেটের কারণে তা সম্ভব হয়নি। পরে বাজারে তীব্র প্রতিদ্বন্ধিতার কারণে মোবাইল ফোনসেট, সংযোগ ও কলরেট সবই কমে আসে, বাজার সম্প্রসারিত হয় অবিশ্বাস্য গতিতে। পনের কোটি জনসংখ্যার একটি দরিদ্র দেশে প্রায় ছয় কোটি মোবাইল ফোন গ্রাহক, ভাবা যায় না। সর্বাধিক মোবাইল ফোন ব্যবহারের (access) দিক থেকে বাংলাদেশ পৃথিবীর শীর্ষ দেশগুলোর মধ্যে এগারতম–এটাও বিস্ময়কর তথ্য!
টেলিফোনের অত যে বিশাল চাহিদা তা জেনেশুনেও বছরের পর বছর চোখ বন্ধ করে ছিল বাংলাদেশ টেলিফোন এন্ড টেলিগ্রাফ (টিএন্ডটি) কর্তৃপক্ষ। জমিদাররা যেভাবে প্রজাকে ক্ষমা-ঘেন্না করতেন, তারাও ঠিক সেভাবে যেন গ্রাহককে দয়া করে এক একটি টেলিফোন সংযোগ দিতেন। যক্ষের ধনের মত তারা টেলিফোন নামক দুর্লভ বস্তুটিকে আগলে রেখেছেন, সাধারণ জনগণের চোখের বাইরে নিয়ে গেছেন। তাদের ভাবখানা ছিল টেলিফোন তাদের নিজস্ব জমিদারী, সেখান থেকে একছটাক জমিও তারা কাউকে দিবেন না। এর প্রধান কারণ ছিল দুর্নীতি। টিএন্ডটির সাদামাটা কর্মচারী-কর্মকর্তাদের এই শহরে অনেক রঙীন বাড়িঘর আছে, প্রায় প্রত্যেকেরই, কারো কারো রয়েছে একাধিক। সেখানে তদবির, টাকার লেনদেন সবই ছিল, আর ছিল অন্তহীন অপেক্ষা। আমার স্মরণ আছে, একটি টেলিফোনের জন্য আমাকে ডাক ও টেলিযোগাযোগ মন্ত্রী পর্যন্ত দৌঁড়াতে হয়েছিল। আমার এক ছাত্র ছিল তখনকার মন্ত্রীর ভাইপো। সে-ই জোগাড় করে দিয়েছিল মন্ত্রীর মহামূল্যবান স্বাক্ষর আর তার সুপারিশ, 'দেয়া যেতে পারে'। দরখাস্তে ঐ স্বাক্ষর আর সুপারিশ থাকার কারণেই আমি টেলিফোনটি পাই, তারপরেও সময় লেগেছিল আরো বছর দেড়েক। তিনি যদি লিখতেন 'দিন', তবে নির্ঘাৎ ছয় মাসের মধ্যে টেলিফোন সংযোগটি পেতাম।
অথচ আমি যখন প্রথম আমার গ্রামীন ফোন সংযোগটি কিনি, তখন সঙ্গে সঙ্গেই টেলিফোন সেটটি পাই, আর সংযোগটি পাই ঐদিন রাতেই। টাকা দিয়ে টেলিফোন সংযোগ কিনতে চায় কোটি কোটি মানুষ, আর কেনা মানেই প্রতিমাসে কোম্পানীর বিপুল আয় বৃদ্ধি। অথচ 'টেলিফোন দিবনা, গ্রাহককে ভোগাব,' এটা কোন মাত্রার মূর্খতা, তা টিএন্ডটির কর্মকর্তারাই ভাল বলতে পারবেন। স্বাধীনতার পর থেকে এই উনচল্লিশ বছরে টিএন্ডটি গ্রাহক করতে পেরেছে দশ লক্ষ আর মাত্র ১০ বছরে (১৯৯৭- ২০০৭) গ্রামীন ফোনের গ্রাহকসংখ্যা এক কোটি ছাড়িয়ে যায়। বর্তমানে দেশে টেলিফোন ব্যবহারকারী ছয় কোটি গ্রাহকের মাত্র ০.১ কোটি অর্থাৎ দশ লক্ষ ল্যান্ডফোনের গ্রাহক; বাকী ৫.৯ কোটিই মোবাইল ফোনের গ্রাহক। কী বিপুল বাজার আর রাজস্ব উপার্জনের সুযোগ রাষ্ট্রায়াত্ত্ব টেলিফোন সংস্থাটি হারিয়েছে তা বলার অপেক্ষা রাখেনা। এদের দূরদৃষ্টিহীনতা, অদক্ষতা, অসততা ও সর্বোপরি দেশপ্রেমহীনতা দেশকে বিপুল পরিমাণ রাজস্ব অর্জন থেকে বঞ্চিত করেছে।
সাধারণ মানুষের মাঝে মোবাইল ফোনের ছড়িয়ে পড়া এক নীরব বিপ্লবের মতই। গার্মেন্টস শিল্প যেমন ঘটিয়েছে নারী স্বাধীনতার এক নীরব বিপ্লব, তেমনি মোবাইল ফোন ঘটিয়েছে তথ্যপ্রবাহের নীরব বিপ্লব। তরুণ প্রজন্ম, যাদের মাঝে মোবাইল ফোন ভীষণ জনপ্রিয়, তারা হৃদয়ের আবেগ আদান-প্রদানে 'টকটাইম' অপচয় করলেও ব্যবসায়ের জগতে এই ক্ষুদ্র যন্ত্রটি অসাধ্য সাধন করেছে। এটি বাঁচিয়ে দিচ্ছে প্রচুর সময় ও তথ্য সংগ্রহের ঝক্কি-ঝামেলা। মুক্তবাজার অর্থনীতির একটি প্রধান শর্তই হচ্ছে পণ্য সম্পর্কে ক্রেতার পূর্ণ তথ্যপ্রাপ্তি। মোবাইল ফোন কোম্পানীর জন্য বিজ্ঞাপন তৈরী করে এমন একটি বিজ্ঞাপনী সংস্থা এই বিষয়টি চমৎকারভাবে তাদের বিজ্ঞাপনে নিয়ে এসেছিল। পদ্মায় ইলিশ ধরে এমন জেলেদের ঠঁকাত ফড়িয়ারা (মধ্যস্বত্ত্বভোগী), মোবাইল ফোন সে সুযোগ বন্ধ করে দিয়েছে, ফোন করে জেলেরা জেনে নিচ্ছে বিভিন্ন হাঁটে মাছের পাইকারী দাম। দেখা যাচ্ছে মোবাইল ফোন সংরক্ষণ করছে সাধারণ মানুষের স্বার্থ। এমন একটি ভিশন নিয়ে শুরু করলেও গ্রামীন ফোন এদেশ থেকে হাতিয়ে নিয়েছে হাজার হাজার কোটি টাকা। এ কোম্পানী এবং এর প্রতিদ্বন্ধি কোম্পানীগুলো অবৈধ ভিওআইপির মাধ্যমে শত শত কোটি কোটি টাকা রাজস্ব আয় করেছে আর কর ফাঁকি দিয়েছে। এজন্য সরকার তাদের জরিমানা করেছিল। অবশ্য এদেশে তাদের বিনিয়োগও কম নয়, কেবল গ্রামীন ফোনই উপরিকাঠামো ও নেটওয়ার্ক তৈরীতে বিনিয়োগ করেছে পনের হাজার কোটি টাকা; তবে কৈয়ের তেলেই কৈ ভেজেছে কোম্পানীটি। প্রায় ছয় হাজার লোকেশনে ১২,০০০ বেজ স্টেশন তৈরী করে এদেশে সবচেয়ে বড় টেলিযোগাযোগ নেটওয়ার্ক তারাই তৈরী করেছে, যা দেশের ৯৮% মানুষকে এর আওতায় নিয়ে এসেছে। টেলিযোগাযোগের ক্ষেত্রে এটা একটি মাইলফলক।
আমি যে বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াই সেখানে করিডোরে, সিঁড়িতে, পথে-ঘাটে, সর্বদাই দেখি তরুণ-তরুণীরা অবিরত কথা বলে যাচ্ছে তাদের প্রিয়জনের সাথে। হৃদয়ের লেনদেন যে ব্যাপকহারে বেড়েছে তা বোঝা যায়। ভাবি, এত এত কথা জমা ছিল আমাদের অন্তরে? 'কত কথা বলে রে' নামে একটি বিজ্ঞাপনও আছে। বাঙালী কেবল কথাপ্রিয় জাতি নয়, বাঙালী অনুকরণপ্রিয় জাতি, আর হুজুগে তো বটেই। মোবাইল ফোন বিক্রির হার দেখে সেকথা পুনর্বার প্রমাণিত হয়। সবার আছে, আমারও একটা চাই। মোবাইল ফোন আমাদের আচরণেও প্রভাব ফেলেছে। আগে ঈদে বা জন্মদিনে আমরা প্রিয়জনকে চিঠি লিখতাম, শুভেচ্ছা কার্ড পাঠাতাম; এখন পাঠাই টেক্সট ম্যাসেজ (sms); আগে দেখা করতাম, এখন টেলিফোনে কথা বলি। চিঠি লেখার দিন বোধহয় এ ধরাধামে শেষ হয়েই এলো, যেমন শেষ হতে চলেছে ক্যামেরায় ফ্লিমের ব্যবহার। sms লিখতে গিয়ে ইংরেজী বাংলার জগাখিচুরি মিশিয়ে নতুন প্রজন্ম যে সংক্ষিপ্ত ভাষা (coded message) লেখে তা বাংলা ভাষাকে বিকৃত করছে। মোবাইল ফোন সংস্কৃতি তৈরী করছে এক বিকৃত নতুন ভাষা। চুরি ও ছিনতাইয়ের প্রধান একটি লক্ষ্যও হয়ে দাঁড়িয়েছে মোবাইল ফোন, কেননা তা আকারে ক্ষুদ্র, কিন্তু দামে চড়া।
গ্রামীন ফোন একমসয়ে একচেটিয়া ব্যবসা করে যাচ্ছিল। পরে ওরাসকম নামের আরেকটি বহুজাতিক কোম্পানী এসে বাজারে 'বাংলালিঙ্ক' নামে তাদের অপ্রতিহত ব্যবসায় ভাগ বসায়। আরো কিছু কোম্পানী সিটিসেল, রবি, ওয়ারিদ, টেলিনর নিয়ে এই oligolpoly market-টি অর্থনীতির ছাত্রদের কাছে এ ধরণের বাজারের একটি আদর্শ উদাহরণ হতে পারে। মার্কেটিংয়ের ছাত্রদের কাছেও তারা চমৎকার উদাহরণ। এ ধরণের বাজারে, যাকে বলা হয় price-war', তা চূড়ান্ত বিচারে ভোক্তাদের স্বার্থ সংরক্ষণ করে, করছেও । আমি যখন গ্রামীন ফোনের গ্রাহক হই, তখন প্রতি মিনিট কলের চার্জ ছিল ৭.৫০ টাকা, আর আজ বহুবছর পরে এর রেট ৭৫ পয়সার নিচে এসে দাঁড়িয়েছে, অর্থাৎ এক-দশমাংশ। অথচ এ সময়ের মধ্যে অন্য সকল পন্যের দাম তিনগুন, চারগুন কিংবা আরো বেশী বেড়েছে। ব্যবসায় প্রশাসন বিষয়ের একজন শিক্ষক হিসেবে আমি কৌতুহলের সাথে এদের বিজ্ঞাপন-যুদ্ধ ও মূল্য-যুদ্ধ প্রত্যক্ষ করি। ঐসকল কোম্পানীতে যারা বিপণনের সাথে যুক্ত, তারা যে অত্যন্ত দক্ষ, এ ব্যাপারে কোন সন্দেহ নেই। একদিকে সম্প্রসারণশীল বাজার, অন্যদিকে তাদের চমৎকার বিপণন স্ট্রাটেজি কোম্পানীগুলোর জন্য বিপুল মুনাফা নিয়ে এসেছে।
কেবল তরুণ শিক্ষার্থীরা নয়, উন্নত প্রযুক্তির এসকল কোম্পানীর ব্যবস্থাপনা ও বিপণন কৌশল থেকে অনেক কিছু শিখতে পারে দেশীয় কোম্পানীগুলো। সরকারী সংস্থাগুলো যে কিছু শিখবেনা তা বোঝা যায়, কেননা সেগুলো চালাচ্ছে 'সকল কাজের কাজী' আমলারা, যারা ভাবে তারা সবকিছুই জানেন, অথচ প্রকৃত সত্য হল আধুনিক ব্যবস্থাপনা বা বিপণনের কোন খবরই তারা রাখেননা, সে দক্ষতাও তাদের নেই। এই আমলারাই একসময় সরকারকে বুঝিয়েছিল সাবমেরিন ক্যাবলে যুক্ত হলে বাংলাদেশের সকল তথ্য পাচার হয়ে যাবার মত আহাম্মুকি যুক্তি। ঐ একটি ভুল সিদ্ধান্ত বাংলাদেশকে তথ্য প্রযুক্তির মানচিত্রে অন্ততঃ দশ বছর পিছিয়ে দিয়েছে। এদেরই একাংশ চট্টগ্রামে গভীর সমুদ্রবন্দর নির্মাণের বিরোধিতা করেছিল, বর্হিবিশ্বের কাছে উন্মুক্ত না হবার, এশিয়ান হাইওয়েতে যুক্ত না হতে, ভারতকে ট্রানজিট না দিতে অজস্র খোঁড়াযুক্তি প্রদর্শন করেছিল, সঙ্গে ছিল 'ভারতীয় জুজুর ভয়' দেখানো স্বার্থানেষী রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দ। বাংলাদেশকে একটি বদ্ধ জলাশয়ে পরিণত করতে চেয়েছিল এ চক্রই।
একদিকে প্রযুক্তি এগিয়েছে আর অন্যদিকে মোবাইল ফোন কোম্পানীগুলো তাদের ভ্যালু এ্যাডেড সার্ভিসগুলো যেমন VMS, SMS, WAP, fax data transmission, Internet browsing, international roaming ইত্যাদি গ্রাহকদের দোরগোড়ায় পৌঁছে দিয়েছে। অন্যদিকে মোবাইল ফোনসেট প্রস্তুতকারী বহুজাতিক কোম্পনীগুলো যেমন নকিয়া, সনি এরিকসন, স্যামসাং, মটোরোলা, এলজি প্রভৃতি একে একে যোগ করেছে সাউন্ড রেকর্ডার, ক্যামেরা, রেডিও, ভিডিও, ইন্টারনেট ইত্যাদি। গ্রাহককে নিত্য নতুন উন্মাদনায় ব্যস্ত রেখেছে তারা আর গ্রাহক প্রাণের খুশিতেই আরো আরো অর্থ ঢেলেছে নতুনতর সব বৈশিষ্ট্য (feature), নতুনতর সব সেবা নিতে। পোষাক বদলের মত মোবাইল ফোন বদল করেছে তারা। এসব নতুন প্যাকেজ নিয়ে মোবাইল ফোন কোম্পানীগুলো যে বিজ্ঞাপন যুদ্ধে নেমেছে তা এদেশের বিজ্ঞাপন নির্মাণেও নতুনতর মাত্রা এনেছে। তাদের ডিষ্ট্রিবিউশন নেটওয়ার্ক দেখার মত। গ্রাহক সংখ্যা বাড়ার সাথে সাথে তারা পোস্টপেইড সংযোগের পাশাপাশি প্রিপেইড সংযোগ চালু করে। প্রথমে মাসিক বিল পাঠালেও পরে রিচার্জের জন্য স্ক্রাচ কার্ড এবং আরো পরে ফ্লেক্সিলোড প্রথা চালু করে। এসবই সম্ভব হয়েছে প্রযুক্তিগত উৎকর্ষতা অর্জনের কারণে। একটি বিপুল এবং ক্রমশঃ স্ফীত হয়ে ওঠা গ্রাহকগোষ্টিকে কী করে দ্রুত ও কার্যকর সেবাপ্রদান করা যায়, তার দৃষ্টান্তমূলক উদাহরণ হতে পারে এদের কার্যক্রম।
এখন বাংলাদেশে একস্থান থেকে আরেকস্থানে টাকা পাঠাতে মোবাইল ফোন ব্যবহৃত হচ্ছে। কেবল বাংলাদেশেই নয় পৃথিবীর যেকোন প্রান্ত থেকে অন্য কোন প্রান্তে টেক্সট ম্যাসেজের মাধ্যমে টাকা আদান-প্রদান করা হচ্ছে। এজন্য ব্যবহার করা হচ্ছে ব্যাংক ও পোস্ট অফিস – যেগুলো ছড়িয়ে আছে দেশের প্রত্যন্ত অঞ্চলে। এটি যাচাই করতে আমি নিজে ঢাকার একটি পোস্ট অফিসে যাই এবং শরীয়তপুরের গ্রামে বসবাসকারী আমার এক আত্মীয়কে কিছু টাকা পাঠাই। আমাকে একটি ফর্ম পূরণ করতে হয় যেখানে আমার মোবাইল ফোন নাম্বার ও আমার আত্মীয়ের মোবাইল ফোন নাম্বার লিখে দেই, সঙ্গে টাকার অঙ্ক। টাকা প্রদানের পর আমার মোবাইল ফোনে একটি গোপন কোড আসে, যা পোস্টঅফিসের মানুষেরাও দেখেনি বা জানেনা। আমি কোডটি আমার আত্মীয়কে ফরোয়ার্ড করে দিই এবং জানিয়ে দিই তাকে কী করতে হবে। সে তার নিকটবর্তী পোস্ট অফিসে গিয়ে মোবাইলে রক্ষিত কোডটি দেখালে সেখানকার পোস্ট মাস্টার তাকে টাকা বুঝিয়ে দেয়। সেদিন এক অনুষ্ঠানে বাংলাদেশ ব্যাঙ্কের গভর্ণর ড. আতিউর রহমান বলেছিলেন কী করে এবছরের কৃষি ভতুর্কির সাড়ে ছয় হাজার টাকা কোটি ব্যাঙ্কের মাধ্যমে লক্ষ লক্ষ কৃষকের মাঝে বিতরণ করা হয়েছে। এজন্য বাংলাদেশ ব্যাঙ্ক বাণিজ্যিক ব্যাঙ্কগুলোকে নির্দেশ দিয়েছিল প্রতিটি কৃষককে যেন দশ টাকা দিয়ে একটি এ্যাকাউন্ট খুলে দেয়া হয়। আগে এসব টাকা স্থানীয় চেয়ারম্যান, মেম্বারদের মাধ্যমে বিতরিত হত এবং প্রকৃত কৃষক হয় অর্ধেক টাকা পেত, বা একেবারেই কিছু পেতনা। দুর্নীতিগ্রস্থ মধ্যসত্ত্বভোগীদের সরিয়ে দিয়ে প্রযুক্তি এই নীরব বিপ্লব সাধন করছে এবং মানুষের জীবনে ইতিবাচক ফলাফল বয়ে আনছে। বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ডিজিটাল বাংলাদেশ গড়ার যে প্রত্যয় ও প্রতিশ্র"তি নির্বাচনী ইস্তেহারে ব্যক্ত করেছেন, তা যে আকাশকুসুম কল্পনা নয়, এবং কিছু মানুষ তা নিয়ে নিবেদিতভাবে কাজ করছেন, আমার নিজের অভিজ্ঞতা ও ড. আতিউর রহমানের উদাহরণ তার প্রমাণ।
পশ্চিমী দুনিয়ার পুরোনো সাম্রাজ্যগুলো আর নেই, সৈন্য পাঠিয়ে অন্য দেশ দখলের দিন শেষ হয়ে এসেছে। অতবড় যে সামরিক শক্তির দেশ মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র সেও ইরাকে সৈন্য পাঠিয়ে হাঁড়ে হাঁড়ে টের পেয়েছে জবরদখলের দিন শেষ। পরাজিত শেয়ালের মত লেজ গুটিয়ে তাকে সরে পড়তে হচ্ছে। সাম্রাজ্যবাদের নতুনরূপ অর্থনৈতিক আগ্রাসন ও শোষণ। পশ্চিমী দুনিয়ার রয়েছে উন্নত প্রযুক্তি আর বিশ্বমানের পন্য, তা দিয়েই সারা বিশ্বে সে প্রভূত্ব করছে। কেবল অস্ত্র বিক্রি নয়, সে বিক্রি করছে গাড়ি, ইলেকট্রনিক্স, মেশিন, কম্পিউটার এবং আরো কত কী, মোবাইল ফোনও এ তালিকার একটি উন্নত প্রযুক্তির পন্য। প্রযুক্তি যেভাবে এগুচ্ছে তাতে ঐ ক্ষুদ্র যন্ত্রটি হয়ে উঠছে অত্যন্ত শক্তিশালী এক অস্ত্র, তবে ধ্বংসের নয়, উন্নত জীবনের। সন্দেহ নেই মুঠোফোন বাংলাদেশের অর্থনীতিতে ধনাত্মক প্রভাব বয়ে এনেছে, ব্যবসা-বাণিজ্যে এনেছে গতিশীলতা, কাছে রেখেছে আমাদের সকলকে, আর সাধিত করেছে এক নীরব বিপ্লব, অনেক গোপন যুদ্ধ আর প্রচারণা বহুদশকে যা সাধন করতে পারেনি!